Logo
Logo
×

বাতায়ন

দেশপ্রেমের চশমা

ডিসি, ইসি, ভিসি ও দুর্নীতিবান্ধব ভাষা

Icon

মুহাম্মদ ইয়াহ্ইয়া আখতার

প্রকাশ: ১৭ নভেম্বর ২০১৯, ০১:০০ পিএম

প্রিন্ট সংস্করণ

ডিসি, ইসি, ভিসি ও দুর্নীতিবান্ধব ভাষা

ছবি: সংগৃহীত

গণতন্ত্রকে অর্থবহ করতে আমলাতন্ত্রও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। গণতান্ত্রিক সরকার সংসদে নীতিনির্ধারণ করে। উল্লেখযোগ্যসংখ্যক নীতি মাঠ পর্যায়ে বাস্তবায়ন করেন আমলাতন্ত্রের দক্ষ, সুশিক্ষিত ও পেশাদার সদস্যরা। এ কারণে গণতান্ত্রিক বিশ্বে প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার মাধ্যমে আমলাতন্ত্রের সদস্য নিয়োগ করা হয়।

নিয়োগের পর প্রশিক্ষণ দিয়ে তাদের দক্ষতা শানিত করা হয়। আমলারা যাতে দুর্নীতিপরায়ণ না হয়ে জনগণের সেবক হিসেবে ভূমিকা পালন করেন সেজন্য সম্প্রতি তাদের নৈতিকতার ওপরও প্রশিক্ষণ দেয়া হচ্ছে। তবে এমন প্রশিক্ষণ পেয়েও এশীয় দেশগুলোতে খুব কমসংখ্যক আমলাই প্রায়োগিক ক্ষেত্রে তা পরিপূর্ণ চর্চা করেন।

অনেক ক্ষেত্রে তারা জনগণের সেবার পরিবর্তে সরকারি সেবায় মনোযোগী হয়ে ক্যারিয়ারে উন্নতি করতে চান। সরকার যদি আমলাদের রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহার করে তাহলে সে আমলাদের মধ্যে নৈতিক স্খলন ঘটতে পারে।

আর একবার যদি আমলাদের মধ্যে নৈতিক স্খলন ঘটে, তাহলে ওই অনৈতিকতা কেবল আর্থিক দুর্নীতিতে সীমিত থাকে না; ওই অধঃপতন অন্যান্য ক্ষেত্রেও ছড়িয়ে যায়। বাংলাদেশে অতি সম্প্রতি দুই ডিসির এমন অধঃপতনের অভিযোগ উঠেছে।

এ বছর মে মাসে জানা গেল, মাগুরার জেলা প্রশাসনের রেকর্ড রুম থেকে রাজা সীতারাম রায়ের একটি মহামূল্যবান পালঙ্ক হারিয়ে গেছে। সরকারের পক্ষ থেকে ২০১৮ সালে এমন প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন জাদুঘরে জমা দেয়ার নির্দেশনা থাকার পরও মাগুরার ডিসি আলী আকবর সে নির্দেশ পালন করেননি।

এর পরিবর্তে স্টোর রুম থেকে পালঙ্কটি অন্য একজনের সহায়তায় নিজ বাসভবন নিয়ে মেরামত ও রং পালিশ করে এর এন্টিক মূল্য নষ্ট করেন।

সাংবাদিকের কাছে ডিসি এ পালঙ্কে ঘুমানোর অভিযোগ অস্বীকার করলেও পত্রিকায় ‘রাজার পালঙ্কে ঘুমাচ্ছেন মাগুরার ডিসি’ শিরোনামে সংবাদ প্রকাশিত হয় এবং তিনি পালঙ্কটির মেরামত ও রং পালিশ করার কথা স্বীকার করেন।

পরে বিষয়টি জানাজানি হলে ডিসি পালঙ্ক দুর্নীতি কেলেঙ্কারিতে জড়িয়ে পড়েন। গঠিত হয় চার সদস্যবিশিষ্ট তদন্ত কমিটি। প্রত্নতত্ত্ব রক্ষার দায়িত্বপ্রাপ্ত একজন আমলা যদি তার দায়িত্বে অবহেলা করেন, তবে এর চেয়ে দুঃখজনক আর কী হতে পারে।

জামালপুরের ডিসি আহমেদ কবীরের চাঞ্চল্যকর ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হওয়ার পর চারদিকে ছি ছি রব ওঠে। গঠিত হয় তদন্ত কমিটি। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় ২৫ আগস্ট তাকে ওএসডি এবং এক মাস পর সরকারি কর্মচারী (শৃঙ্খলা ও আপিল) বিধিমালা-২০১৮ অনুযায়ী বরখাস্ত করে।

এর মাসাধিককাল পর জনৈক স্কুল শিক্ষয়িত্রী দিনাজপুরের ডিসি মাহমুদুল আলমের বিরুদ্ধে তার সঙ্গে অনৈতিক সম্পর্ক গড়ে তোলার এক ভিডিও বার্তা ছাড়েন যা ভাইরাল হয়। এ ভিডিও বার্তায় দাবি করা হয়, ডিসির ফাঁদে পা দেয়ায় তার সংসার ভেঙে যায়।

তবে জামালপুরের ডিসির কেলেঙ্কারি প্রকাশিত হলে দিনাজপুরের ডিসি এ শিক্ষিকার সঙ্গে যোগাযোগ বন্ধ করে দেন। ভিডিও কলসহ মোবাইল যোগাযোগের রেকর্ড মুছে ফেলতে বলে তাকে রাজাকারের সন্তান বানানোর এবং জীবনে মেরে ফেলার হুমকি দেয়া হয় (যুগান্তর ৩১-১০-২০১৯)। বিষয়টি ঊর্ধ্বতন পর্যায়ে তদন্তাধীন রয়েছে।

একজন ডিসি হচ্ছেন একটি জেলার নাগরিক সমাজের অভিভাবক। জনগণের মানসম্মান ও নিরাপত্তা বিধান তার দায়িত্ব। আর সে দায়িত্বে যদি কেউ অবহেলা করেন, তাহলে মানুষ কার কাছে নিরাপত্তা চাইবে?

গণতন্ত্রকে কার্যকর করতে যে প্রতিষ্ঠানগুলো কাজ করে তার মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। কারণ গণতান্ত্রিক সরকার যে নির্বাচনী ব্যবস্থার মধ্য দিয়ে গঠিত হয় ইসি সে নির্বাচনের আয়োজন করে। এজন্য ইসিকে হতে হয় ফুটবল মাঠের রেফারি বা ক্রিকেট মাঠের আম্পায়ারের মতো নিরপেক্ষ ও পেশাদার।

কিন্তু স্বাধীনতার পর থেকে শুরু করে বর্তমানের কেএম নুরুল হুদা পর্যন্ত এক ডজন কমিশনের কর্মকাণ্ড জরিপ করলে দেখা যায়, দিন দিন ইসির পেশাদারিত্ব ও মানের অবনমন হচ্ছে। অনেক ক্ষেত্রেই কমিশন, রাজনৈতিক দল ও জনগণের কথা না শুনে সরকারের অঘোষিত হুকুমবরদারে পরিণত হন।

কাজেই দু-একটি ব্যতিক্রম ছাড়া এসব কমিশন কর্তৃক অনুষ্ঠিত নির্বাচনগুলো নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। নির্বাচন অনুষ্ঠানের আগেই কোন দল সরকার গঠন করবে তা নির্ধারিত হয়ে যাওয়ার মতো নির্বাচনও করেছে ইসি। আবার এমন নির্বাচনও করেছে, যে নির্বাচনের পূর্বরাতে কোনো কোনো ভোটকেন্দ্রে ব্যালট বাক্স ভরে ফেলা হয়েছে।

অধিকাংশ রাজনৈতিক দল, সুশীলসমাজ এবং নাগরিক সমাজ না চাইলেও ইসি একমাত্র সরকারি দলের ইচ্ছায় কাগজের ব্যবহারবিহীন বিতর্কিত ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিনে (ইভিএম) ভোটগ্রহণের ব্যবস্থা করেছে।

নির্বাচন অনুষ্ঠানে ইসির এহেন ভূমিকা পালনে মানুষ আজ ভোটকেন্দ্রবিমুখ। নির্বাচনের ওপর বা নির্বাচন কমিশনের ওপর তাদের আস্থা নেই। এ আস্থা তৈরি করবে নির্বাচন কমিশন। কিন্তু কমিশন সে কাজে ব্যর্থ হয়েছে। কাজেই আইন তৈরি করে কমিশনের গঠন প্রক্রিয়া ঠিক করা এখন সময়ের দাবি।

সিইসি ও ইসি সদস্য খুঁজতে গঠিত সার্চ কমিটির টর্চলাইট যে যোগ্য লোকের ওপর আলো ফেলতে পারেনি তা একাধিকবার প্রমাণিত হয়েছে।

শিক্ষা গণতন্ত্রকে অর্থবহ করে। প্রচলিত আছে যে, কেবল শিক্ষিত ভোটাররাই যোগ্য এমপি নির্বাচিত করে কার্যকর সংসদ প্রতিষ্ঠায় অবদান রাখতে পারেন। দেশের অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সুশাসনের অভাব রয়েছে। দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় শিক্ষার মানেরও অবনমন ঘটেছে।

ক্যাম্পাসে ছাত্র-শিক্ষকদের দলীয় রাজনীতির লেজুড়বৃত্তির চর্চা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর একাডেমিক চরিত্র ম্লান করে এর রাজনৈতিক চরিত্র প্রকট করে তুলেছে। কোনো কোনো ভিসির বিরুদ্ধে অনিয়ম, নিয়োগ বাণিজ্যসহ বিভিন্ন দুর্নীতির অভিযোগের তদন্ত চলছে।

একাডেমিক ও প্রশাসনিক যোগ্যতাকে প্রাধান্য না দিয়ে কোনো কোনো সরকারি-বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্ষমতাসীনদের ঘনিষ্ঠ ব্যক্তিকে ভিসি নিয়োগ দেয়া হচ্ছে। ফলে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর একাডেমিক পরিবেশ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। সরকার এমন শিক্ষককেও সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি নিয়োগ দিয়েছে যিনি সরকারদলীয় যুব সংগঠনের সভাপতি হওয়ার আগ্রহ প্রকাশ করেছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি একটি সম্মানিত পদ।

কিন্তু বাংলাদেশে তদবিরের ওপর ভিত্তি করে দলীয় বিবেচনায় ভিসি নিয়োগ দেয়ায় এ পদের সম্মান হ্রাস পেয়েছে। কোনো কোনো সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভিসি নিয়োগ লাভের পর ফুলেল সংবর্ধনা পেলেও তারা বিদায় সংবর্ধনা পান না। কারণ তারা এমনভাবে কাজ করেন, হয় তাদের আন্দোলনের মুখে পদত্যাগ করতে হয়, না হয় দায়িত্ব শেষে নীরবে চলে যেতে হয়।

দেশে অনেক প্রতিষ্ঠানে দুর্নীতি এক বড় সমস্যা হিসেবে দেখা দিয়েছে। অস্বচ্ছ নির্বাচনী প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে সরকার গঠিত হওয়ায় দুর্নীতির গতি বেগবান হয়েছে। বর্তমান সরকার দুর্নীতির বিরুদ্ধে ‘জিরো টলারেন্স’ নীতি গ্রহণ করেছে। এর ফলে দুর্নীতি কতটা কমবে ভবিষ্যতে বলা যাবে।

তবে ইতিমধ্যে টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজিসহ সরকারদলীয় ছাত্র ও যুব সংগঠনের কতিপয় নেতার দুর্নীতি প্রকাশিত হয়েছে। বছরের পর বছর ধরে ক্যাসিনো দুর্নীতি চলমান থাকলেও প্রশাসন ও পোশাকধারী বাহিনীর সদস্যরা এ সম্পর্কে নীরব ছিলেন। এখন তারা হয়তো সরকার নির্দেশিত কয়েকজনকে গ্রেফতার করলেও রাঘববোয়াল-দুর্নীতিবাজরা এখনও ধরাছোঁয়ার বাইরে রযেছেন।

ধরা পড়া একজন ক্যাসিনো সম্রাট প্রদত্ত তথ্য অনুযায়ী একটি তালিকার ১ থেকে ৪ নম্বরে যাদের নাম রয়েছে তাদের নাম প্রকাশ না করে ওই তালিকার ৫ নম্বরে থাকা এক জনকে একটি ক্লাবের ক্যাসিনো থেকে মাসে ১০ লাখ টাকা দেয়ার সংবাদ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে।

কেউ কেউ বলছেন, তিনি সরকারদলীয় না হওয়ায় তার নাম প্রকাশ করা হয়েছে। তবে ওই তালিকায় ৫ নম্বরের আগে যে চারজনের নাম ছিল তারা সরকারঘনিষ্ঠ হওয়ায় তাদের নাম প্রকাশ করা হয়নি বলে জনমনে সন্দেহ আছে।

আওয়ামী লীগের বড় কোনো নেতার নাম দুর্নীতির তালিকায় থাকলে সরকার তাদের বাঁচিয়ে দুর্নীতির বিরুদ্ধে ‘জিরো টলারেন্স’ নীতি বাস্তবায়ন করতে চায় কিনা সে বিষয়েও নাগরিক সমাজে প্রশ্ন রয়েছে।

দুর্নীতির আইসবার্গে সামান্য খোঁচা দিয়ে সরকার বুঝতে পেরেছে, পেশাদারিত্বের সঙ্গে দুর্নীতির বিরুদ্ধে ‘জিরো টলারেন্স’ নীতি বাস্তবায়ন করতে হলে পশম বাছতে কম্বল উজাড় হওয়ার অবস্থা হতে পারে। সেজন্য হয়তো বড় বড় রাঘববোয়ালের নাম প্রকাশ করা হচ্ছে না। কোনো কোনো সাংবাদিক ভাষার মারপ্যাঁচে মাদক ও ক্যাসিনো দুর্নীতির সংবাদ বড় করে দেখার পরিবর্তে লঘু করে দেখাচ্ছেন।

কোনো কোনো সাংবাদিক ও সরকারপন্থী বুদ্ধিজীবী ‘জিরো টলারেন্স নীতি’ ঘোষণার পর গ্রেফতারকৃত দুর্নীতিবাজদের নামের আগে ‘ক্যাসিনো মহাদুর্নীতিবাজ’, ‘ক্যাসিনো দুর্নীতিবাজ’ ইত্যাদি বিশেষণ ব্যবহার করেন না। এর পরিবর্তে ‘ক্যাসিনো ব্যবসায়ী’, ‘ক্যাসিনোকাণ্ড’ ইত্যাদি বিশেষণের ব্যবহার লক্ষ করা যাচ্ছে। ‘বালিশ’ ও ‘পর্দা’ দুর্নীতিবাজদের ক্ষেত্রেও তা লক্ষণীয়।

‘বালিশ দুর্নীতি’ বা ‘পর্দা মেগা দুর্নীতি’ ব্যবহার না করে পরিবর্তে ‘বালিশকাণ্ড’, ‘পর্দাকাণ্ড’ ইত্যাদি প্রয়োগ করেন। এভাবে ওই দুর্নীতির ওজন কমানোর চেষ্টা লক্ষ করা যায়।

একই উদ্দেশে একজন নেতা বালিশ ও পর্দা দুর্নীতিকে লঘু দুর্নীতি বলার মধ্যে এ দুর্নীতিবাজরা কঠোর শাস্তির পরিবর্তে অন্য মেসেজ পান।

জানি না দ্রব্যমূল্য সিন্ডিকেটবাজদের পেঁয়াজের দাম ডবল সেঞ্চুরিতে নিয়ে যাওয়ার পেছনে কী কাজ করেছে। কাজেই এসব লক্ষণ দেখে মনে হয়, যারা বর্তমান সরকারের দুর্নীতিবিরোধী অভিযানকে ‘আইওয়াশ’ বলছেন, তাদের বক্তব্যকে সরাসরি নাকচ করা যায় না।

স্মরণ করা যেতে পারে, ওয়ান-ইলেভেনের সময় ফখরুদ্দীন-মইনুদ্দিন সরকার দুর্নীতির বিরুদ্ধে এর চেয়ে বড় দুর্নীতিবিরোধী অভিযান পরিচালনা করেও দুর্নীতি দমনে ব্যর্থ হয়েছিল। নাম প্রকাশ করা হয়নি এমন রাঘববোয়াল দুর্নীতিবাজদের প্রতি বর্তমান সরকারের মনোভাব কেমন তা দেখার পর অনুধাবন করা যাবে, সরকার দুর্নীতির বিরুদ্ধে ‘জিরো টলারেন্স’ নীতি বাস্তবায়নে কতটা আন্তরিক। ইসি, ডিসি, ভিসি ও দুর্নীতিবান্ধব ভাষার ওপর আলোকপাতের ফলে এ প্রবন্ধে সামগ্রিক দুর্নীতির যৎসামান্য উপস্থাপিত হয়েছে।

সমাজবিজ্ঞানীদের জন্য দুর্নীতির অন্যান্য অনুদ্ঘাটিত এলাকায় গবেষণা করার জন্য পর্যাপ্ত তথ্য রয়েছে।

ড. মুহাম্মদ ইয়াহ্ইয়া আখতার : অধ্যাপক, রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

akhtermy@gmail.com

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম