বিদ্যুৎ নিয়ে আমরা আশাবাদী হতেই পারি

মুঈদ রহমান
প্রকাশ: ১৭ নভেম্বর ২০১৯, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

১৩ নভেম্বর সকালে গণভবন থেকে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে সাতটি নতুন বিদ্যুৎ কেন্দ্র এবং ২৩ উপজেলায় শতভাগ বিদ্যুতায়নের উদ্বোধনকালে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, ‘২০২০ সালের ১৭ মার্চ থেকে ২০২১ সালের ২৬ মার্চ পর্যন্ত সময়কে আমরা মুজিববর্ষ হিসেবে ঘোষণা দিয়েছি। এ সময়ে আমরা সারা দেশের ঘরে ঘরে বিদ্যুতের আলো জ্বালাতে সক্ষম হব। কেউ অন্ধকারে থাকবে না।’
এ নতুন কেন্দ্রগুলো চালু হওয়ার কারণে বর্তমানে মোট বিদ্যুৎ উৎপাদনের পরিমাণ দাঁড়ানোর কথা ২২ হাজার ৫৬২ মেগাওয়াটে। যদি উৎপাদনের পরিমাণ যথাযথভাবে হয় তাহলে দেশের ৯৫ শতাংশ মানুষ বিদ্যুৎ সুবিধার আওতায় আসবে। উল্লেখিত ২৩ উপজেলা আমলে নিলে আমাদের মোট ৪৯২টি উপজেলার মধ্যে ২৩৪টিই শতভাগ বিদ্যুৎ সুবিধার আওতায় এসে গেছে। বিদ্যুৎ বিভাগ বলছে, আরও ১২৭ উপজেলায় শতভাগ বিদ্যুতায়ন পাইপলাইনে আছে। কেবল উদ্বোধনের অপেক্ষায়। বাদবাকি উপজেলাগুলোতে শতভাগ বিদ্যুতায়নের জন্য সময়কাল হিসেবে মুজিববর্ষকে বেছে নেয়া হয়েছে। যদি তা সময়মতো করা যায় তাহলে ২০২১ সাল নাগাদ দেশের মোট বিদ্যুৎ উৎপাদন দাঁড়াবে ২৪ হাজার মেগাওয়াট। পরিকল্পনা অনুযায়ী সরকার এগিয়ে যেতে পারলে মোট বিদ্যুৎ উৎপাদন বেড়ে দাঁড়াবে ২০৩০ সাল নাগাদ ৪০ হাজার এবং ২০৪১ সালে ৬০ হাজার মেগাওয়াটে। আশার কথা হল, যেসব দুর্গম ও পাহাড়ি এলাকায় বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন করা কঠিন, সেখানে বিকল্প সৌরবিদ্যুৎ সরবরাহের কথাও প্রধানমন্ত্রী বলেছেন। আমরা মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর আশ্বাসের ওপর ভরসা রাখতে চাই।
বর্তমানে দেশের রাজনীতিতে গণতন্ত্র কতখানি স্বমহিমায় উপস্থিত, তা নিয়ে আর দশজনের মতো আমিও সন্দিহান। যে দুর্নীতিবিরোধী অভিযানের কথা বলা হচ্ছে, তা কতখনি বাস্তব রূপ লাভ করবে, তা নিয়ে সবার মতো আমার মনেও প্রশ্ন জাগে। কিন্তু আওয়ামী লীগের গত ১০ বছরের শাসনব্যবস্থায় বিদ্যুৎ উৎপাদন ও সরবরাহের সক্ষমতা নিয়ে আমার মনে কোনো সন্দেহ নেই। এ খাতে সরকার সম্পূর্ণ সফল না হলেও সন্তোষজনক অগ্রগতি দেখাতে সক্ষম হয়েছে।
যার যা পাওনা তাকে তা দিয়ে দেয়া সুবিবেচকের কাজ। তবে আমরা তা কোনো রাজনৈতিক দলকে প্রতিপক্ষ ভেবে মূল্যায়ন করতে চাই না। কেননা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আরও বলেছেন, ‘২১ বছর পর সরকার গঠন করে ১৯৯৬ সালে বিদ্যুৎ পেয়েছিল মাত্র ১৬০০ মেগাওয়াট। পরবর্তী ৫ বছরে ৪ হাজার ৩০০ মেগাওয়াট করে রেখে গেলেও ২০০১-পরবর্তী বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার পরবর্তী ৫ বছরে দেশের বিদ্যুৎ উৎপাদন এক মেগাওয়াটও বাড়াতে পারেনি। উপরন্তু কমিয়ে ৩ হাজার ২০০ মেগাওয়াটে নিয়ে আসে। ২০০৯ সালে ফের সরকার গঠনের পর থেকে বিদ্যুৎকে বেসরকারি খাতে ছেড়ে দেয়াসহ একের পর এক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের মাধ্যমে বিদ্যুৎ উৎপাদন আজকের পর্যায়ে নিয়ে আসতে সক্ষম হয়েছি’ (যুগান্তর, ১৪.১১.২০১৯)।
বস্তুত এটি আমাদের দেশের বর্তমান রাজনৈতিক সংস্কৃতি। আওয়ামী লীগ বিএনপির কোনো ভালো দিক দেখতে পায় না, বিএনপিও আওয়ামী লীগের কোনো ভালো দিকের সন্ধান পায় না। তবে আমরা দ্বিদলীয় সম্পর্কের বাইরে থেকেও বলতে পারি, বিএনপির সময়ে প্রকৃত অর্থেই আমরা বিদ্যুতের অসহনীয় কষ্ট পেয়েছি যা বর্তমানে নেই। তারপরও সে কথায় যেতে চাই না; কারণ, দিনকে দিন তো আমাদের অর্থনীতির আকার বেড়ে চলেছে। এর সঙ্গে তাল মিলিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন বাড়াতেই হবে। ১৯৯৬ সালে আমাদের জিডিপির আকার ছিল ৪৮ হাজার ১৬৮ মিলিয়ন ডলার এবং মাথাপিছু আয় ছিল ৩৯৪ ডলার। ২০১৯ সালে জিডিপির আকার দাঁড়িয়েছে ৩১৭ হাজার ৪৬৫ মিলিয়ন ডলার আর মাথাপিছু আয় ১৯০৬ ডলার। সুতরাং চলতি হিসাবে ১৯৯৬ সালের তুলনায় বাংলাদেশের অর্থনীতির আকার ৬ গুণেরও বেশি বড় হয়েছে। সেই ধারাবাহিকতায় আওয়ামী লীগ সরকার বিদ্যুৎ উৎপাদন বাড়াতে সক্ষম হয়েছে এটাই কৃতিত্বের ব্যাপার। বিএনপির সঙ্গে তুলনা নাই বা করলাম।
বিদ্যুৎ বিভাগের দেয়া তথ্য অনুযায়ী, দেশে ২০০৯ সালে ১ কোটি ৮০ লাখ বিদ্যুৎ গ্রাহক ছিল। ২০১৯ সালের জুন-পরবর্তী সময়ে সে সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ৩ কোটি ৫১ লাখে। অর্থাৎ গত ১০ বছরে গ্রাহক সংখ্যা বেড়েছে ১ কোটি ৭১ লাখ; যা প্রায় দ্বিগুণ। শহরাঞ্চল ও গ্রামাঞ্চলে মাথাপিছু বিদ্যুৎ ব্যবহারও বেড়েছে তুলনা করার মতো। আগে বছরওয়ারি মাথাপিছু গড় বিদ্যুৎ ব্যবহার ছিল ২২০ ইউনিট, যা বর্তমানে ৫১০ ইউনিট। সন্দ্বীপে বিদ্যুৎ সরবরাহ উল্লেখ করার মতো। দীর্ঘ ১৫ কিলোমিটার সাগর তলদেশে সাবমেরিন কেবল স্থাপন করে ২০১৮ সালের নভেম্বরে এ সাগরদ্বীপের ঘরে ঘরে বিদ্যুৎ সংযোগ দেয়া হয়। আবার যেখানে ন্যাশনাল গ্রিড নেই সেখানে সৌরবিদ্যুতের ব্যবস্থাও আশাব্যঞ্জক। ২০০৯ সালে যেখানে সৌরবিদ্যুৎ ব্যবহারকারীর সংখ্যা ছিল ৯৬ হাজার, সেখানে ২০১৯ সালে তা এসে দাঁড়িয়েছে ৫৫ লাখে। ৬ অক্টোবর পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড (আরইবি) এরকম আরও ১ হাজার ১৪৬টি দুর্গম গ্রাম চিহ্নিত করেছে, যা তারা আলোকিত করার কথা ভাবছে। বিদ্যুৎ মানুষের ঘরে শুধু আলো দেয় এমনটি নয়। বিআইডিএসের গবেষণা বলছে, আমাদের দেশে ১০ লাখ ইউনিট বিদ্যুৎ বৃদ্ধি পেলে অর্থনীতিতে যোগ হয় ৪ কোটি ৬০ লাখ থেকে ১০ কোটি ৭০ লাখ টাকা। ২০১০ সালের আগেও শুধু চাল আমদানিতে আমরা বছরপ্রতি ব্যয় করতাম ১০০ কোটি মার্কিন ডলার। সেচ সুবিধার কারণে এখন আর আমদানি করতে হয় না। এ সেচকাজে ২০০৯ সালে ব্যবহার হতো ২ লাখ ৩৪ হাজার নলকূপ। ২০১৯ সালে এসে এ নলকূপের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৩ লাখ ৬৪ হাজারে। সুতরাং সার্বিক অগ্রগতি পর্যালোচনা করলে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কথার ওপর আমাদের আস্থা না রাখার কোনো কারণ নেই। আমরা কোনোভাবেই বিস্মিত হই না এই ভেবে যে, আগামী এক বছরে প্রতি ঘরে বিদ্যুৎ সংযোগ দেয়া সম্ভব হবে।
তবে বিদ্যুৎ উৎপাদনের ‘পজিটিভ’ দিকটির বিপরীতে ‘নেগেটিভ’ দিকটিও ভুলে গেলে চলবে না। আর তা হল দুর্নীতি। ইতিমধ্যে ‘রূপপুর পারমাণবিক কেন্দ্রের বলিশ কেলেঙ্কারি’ আমাদের হাড়গোড় জ্বালিয়ে দিয়েছে। বিদ্যুৎ খাতের একটি খুব পরিচিত প্রক্রিয়া হল ‘সিস্টেম লস’। সাধারণত বিদ্যুৎ কেন্দ্রে যে পরিমাণ বিদ্যুৎ উৎপাদিত হয় গ্রাহকের কাছে পৌঁছানোর পথে তার কিছু পরিমাণ ‘বার্ন’ হয়ে যায়- এটাকে বলে সিস্টেম লস। সিস্টেম লস কতটা হবে তা নির্ভর করে কেন্দ্র থেকে ভোক্তা বা গ্রাহকের দূরত্ব কতখানি তার ওপর। এক সময়ে, ১৯৮০ সালে এমনও ভোক্তা ছিল, বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে যার দূরত্ব ছিল ৭০০০ কিলোমিটার। বিভিন্ন জায়গায় কেন্দ্র প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর এখনও ৪০০০ কিলোমিটার দূরে বিদ্যুৎ সঞ্চালন ও সরবরাহ করতে হয়। সব দেশেই সিস্টেম লস আছে। মোট উৎপাদনের ৭২.৫ শতাংশই সিস্টেম লস এমন দেশের নাম টোগো। আমেরিকায় তা ৫.৯ শতাংশ, ইউরোপের জার্মানিতে ৪.১৬ শতাংশ। পৃথিবীর সবচেয়ে কম সিস্টেম লসের দেশ সিঙ্গাপুর, সেখানে এ হার মাত্র ২.০৩ শতাংশ। ভারত উৎপাদনে লস দেয় ১৯.৪২ শতাংশ, পাকিস্তান দেয় ১৭.৪১ শতাংশ। সে তুলনায় আমাদের সিস্টেম লস কম, ১১.৪০ শতাংশ।
২০ বছর আগে আমাদের দেশে সিস্টেম লস ছিল প্রায় ২৪ শতাংশ। সেদিক থেকে আমরা অনেকখানিই এগিয়েছি বলতে হবে। কিন্তু সমস্যা হল অন্য দেশের সিস্টেম লসের হিসাব আর বাংলাদেশের সিস্টেম লসের হিসাব এক নয়। অন্যান্য দেশের ক্ষেত্রে সঞ্চালন পথে যে পরিমাণ বিদ্যুৎ নষ্ট হয় তা-ই সিস্টেম লস। কিন্তু আমাদের সেই সঞ্চালনের সঙ্গে যে পরিমাণ বিদ্যুৎ চুরি হয় তা-ও যুক্ত করা হয়। আমাদের অনেক অবৈধ সংযোগ আছে, যার কোনো মিটারই নেই। আবার অনেক বড় বড় শিল্পপ্রতিষ্ঠান আছে, যারা অনাকাক্সিক্ষত সম্পর্কের মাধ্যমে প্রকৃত বিলের অনেক কম পরিশোধ করে। এর সব দায় গিয়ে পড়ে ‘সিস্টেম লসের’ ওপর। তা না হলে আমাদের সিস্টেম লস ৬-৭ শতাংশে নামিয়ে আনা যেত। এ খাতে বিদ্যুৎ সংযোগ দেয়ার নাম করে অনেক দালালের উপস্থিতির খবরও পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। সরকার এদিকে দৃষ্টি দিলে ভালো হয়।
প্রকল্প ব্যয়ে দুর্নীতির অভিযোগ অনেক পুরনো। ‘ভিত্তিহীন অতিরিক্ত প্রকল্প ব্যয় দেখিয়ে বিপুল অঙ্কের অর্থ ভাগবাটোয়ারা করে নেয়ার অভিযোগ উঠেছে। যেসব প্রকল্পে বিদ্যুতের দাম যত বেশি, সেসব প্রকল্পের বিদ্যুৎ কিনতে তত বেশি আগ্রহী পিডিবি। অভিযোগটি গুরুতর। আর এ দুর্নীতির কারণে সংশ্লিষ্ট প্রকল্পের ট্যারিফ বা ইউনিটপ্রতি দাম পড়ে বেশি। বাড়তি এ টাকা গুণতে হয় সাধারণ মানুষ ও শিল্পোদ্যোক্তাদের। উদাহরণস্বরূপ, ১০ হাজার কোটি টাকার যে প্রকল্পকে ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে ৩০ হাজার কোটি টাকার দেখানো হয়, সেখানে সহজ হিসাবে অতিরিক্ত ব্যয় ২০ হাজার কোটি টাকা। এ পুরো টাকাটাই হয় ভাগবাটোয়ারা তথা দুর্নীতি। জানা যায়, খোদ পিডিবির একটি সিন্ডিকেট বেশি দামে বিদ্যুৎ কিনতে আগ্রহী। এ কারণে গত ৬ বছরে লোকসান হয়েছে ৪৫ হাজার কোটি টাকার বেশি অর্থ।
তবে এ ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট আইনেই রয়েছে দুর্নীতির বড় সুযোগ। আইনের ১৫ ধারায় কৌশলে বলা আছে- ট্যারিফ নির্ধারণ নির্ভর করবে প্রকল্প ব্যয়ের ওপর। এ ধরনের বিতর্কিত আইনের কারণে যারা সৎভাবে বিদ্যুৎ প্রকল্প করতে চান, তারা কোনোভাবেই এগোতে পারছেন না’ (যুগান্তর, ২৯.০৯.২০১৭)। এ ধরনের অভিযোগের সুরাহা হওয়া জরুরি। কারণ প্রকল্পগুলোতে যে কোনো ধরনের অনিয়ম বা দুর্নীতি হলে তা উৎপাদন খরচকে প্রভাবিত করে এবং এর অনিবার্য ফল হিসেবে বিদ্যুতের দাম বাড়াতে হয়। আর এ অতিরিক্ত দামের জন্য সাধারণ মানুষকে অতিরিক্ত ঘামের পয়সার জোগান দিতে হয়। তাই আমরা চাই দুর্নীতি দূর করে একটি সহনীয় মাত্রার দামের বিনিময়ে সবার বিদ্যুৎ চাহিদা পূরণ হোক।
মুঈদ রহমান : অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়