Logo
Logo
×

বাতায়ন

মিঠে কড়া সংলাপ

স্বপ্নই মানুষকে সাফল্য এনে দেয়

Icon

মুহাম্মদ ইসমাইল হোসেন

প্রকাশ: ১৬ নভেম্বর ২০১৯, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

স্বপ্নই মানুষকে সাফল্য এনে দেয়

ইংল্যান্ডের কমনওয়েলথ বিশ্ববিদ্যালয় এবং লন্ডন গ্র্যাজুয়েট স্কুলের দুবাই লিডারশিপ সামিটে আমি নিজেও একজন আমন্ত্রিত অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকতে পেরে অনেক জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা অর্জন করতে পারলাম। সংযুক্ত আরব আমিরাতের দুবাই শহরে ২৯-৩১ অক্টোবর অনুষ্ঠানটির আয়োজন করা হয় এবং সেখানে ভারত, পাকিস্তান, বাংলাদেশসহ পৃথিবীর ২৫টি দেশের স্কলাররা উপস্থিত ছিলেন। যাদের মধ্যে অনেক নামিদামি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক, অনেক দেশের রাষ্ট্রদূত এবং স্পিকারও ছিলেন।

উল্লেখ্য, পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের প্রতিনিধিদের কাছে একটি গ্রহণযোগ্য বা উপযুক্ত স্থান বিবেচনা করে আরব আমিরাতের বৃহত্তম শহর দুবাইয়ে অনুষ্ঠানটির আয়োজন করা হয়। এ অবস্থায় ওই সামিটে অংশগ্রহণকালে আমার এবারের দুবাই ভ্রমণ সম্পর্কে কিছু বলা প্রাসঙ্গিক মনে করছি। ইতঃপূর্বে আমি মাত্র একবার দুবাই ভ্রমণ করেছিলাম এবং ট্রানজিট প্যাসেঞ্জার হিসেবে দু’রাত দুবাই কাটিয়ে একজন পর্যটক হিসেবে দুবাই দেখেছিলাম।

কিন্তু এবারে চার দিন দুবাইয়ে অবস্থান করলেও সে সুযোগ হয়নি। কারণ সামিটে অংশগ্রহণ করে রীতিমতো পড়ালেখা করতে হয়েছে। প্রতিদিন চার শিফটে ক্লাসে বসে থাকার মতো অবস্থায় বক্তৃতা-বিবৃতি-লেকচার শুনতে হয়েছে এবং সেসব শুনে তারপর প্রশ্ন করে উত্তর পেতে হয়েছে।

এসব কারণে এবারে পর্যটক হিসেবে দুবাই দেখা সম্ভব না হলেও এক স্থান থেকে অন্য স্থানে, এক হোটেল থেকে অন্য হোটেলে যাতায়াত করতে দুবাই শহরটা নতুন করে ঘুরে দেখার সুযোগ হয়েছে। আর এভাবে যা দেখেছি তাতে আগের দুবাই আর বর্তমান দুবাইয়ের পার্থক্যটা বুঝতে পেরেছি। গতবার দুবাইয়ে অবস্থিত পৃথিবীর সর্বোচ্চ যে ভবনটির নাম ‘বুর্জ দুবাই’ হিসেবে দেখেছিলাম, এবারে সেই একই ভবনের নাম দেখলাম ‘বুর্জ খলিফা’।

উল্লেখ্য, ‘বুর্জ দুবাই’ বা ‘বুর্জ খলিফা’ হল ৮৩০ মিটার বা ২৭২২ ফুট উঁচু একটি ভবন, যেখানে হোটেল, অফিস ও অ্যাপার্টমেন্ট আছে। আর বর্তমানে এ ভবনটিকে কেন্দ্র করে দুবাইয়ের উল্লেখযোগ্য সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড আবর্তিত হয়। যেমন এবারে এক রাতে ভবনটির গায়ে বলিউড সুপারস্টার শাহরুখ খানের জন্মদিনের শুভেচ্ছাসংবলিত আলোকসজ্জা ফুটে উঠল! তাছাড়া

এবারের চলাফেরায় দুবাইয়ে যেসব নতুন নতুন ইমারত, অট্টালিকা, হোটেল, মার্কেট ইত্যাদি দেখতে পেলাম, গতবার তার অনেক কিছুই ছিল না। যেমন দুবাই মল নামের অনিন্দ্যসুন্দর সুরম্য মার্কেটটি ইতঃপূর্বে দেখিনি। আবার নতুন করে নির্মিত অনেক সুন্দর সুন্দর রাস্তা, মেট্রোরেল ইত্যাদি অনেক কিছুই দেখে এলাম। আর হোটেল-রেস্টুরেন্টের তো কথাই নেই।

মোট কথা, দিনের পর দিন পৃথিবীর সব সুবিধাই দুবাই শহরে একত্রিত করা হচ্ছে। যার ফলে আরব আমিরাতের সর্ববৃহৎ এ শহরটিতে লন্ডনের কমনওয়েলথ বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক দুবাই লিডারশিপ সামিট অনুষ্ঠিত হওয়ায় পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে আগত অংশগ্রহণকারীসহ আমরা সবাই আনন্দিত ছিলাম।

অথচ এ দুবাই শহরটি কিন্তু সরাসরি আরব মরুভূমিতে অবস্থিত। এক সময়ের ধূসর বালুময় আরব মরুভূমির একটি অংশই এখন দুবাই শহর। আর এসব কিছুই সম্ভব হয়েছে কিছু মানুষের স্বপ্ন এবং কর্মকাণ্ডের বিশ্বস্ত বাস্তবায়নের মাধ্যমে। কারণ তারা শুধু স্বপ্ন দেখেননি, তাদের স্বপ্নকে বিশ্বস্ততার সঙ্গে বাস্তবায়ন করেছেন বলেই আরব মরুভূমির বুকে দুবাই নামক ফুল ফুটেছে!

সেখানে আজ পৃথিবীর সুন্দরতম ফুলের বাগানসহ গাছগাছালির সমারোহ দেখা যাচ্ছে। কিছু মানুষের স্বপ্ন, সম্মিলিত প্রচেষ্টা, দৃঢ় প্রত্যয় এবং অঙ্গীকারের মাধ্যমে মরুভূমির বুকে যে নগর গড়ে তোলা হয়েছে তাকে বিস্ময়কর বললেও কম বলা হবে। মানুষের স্বপ্ন আর বিশ্বস্ত কর্মকাণ্ডের ফলেই দুবাই আজ স্বপ্নের শহরে পরিণত হয়েছে।

আমাদের দেশ বাংলাদেশও অপার সম্ভাবনার দেশ। এ দেশের নদী, পাহাড়, সাগর, সবুজ শ্যামলিমা এমনিতেই মানুষের মনকে আকৃষ্ট করে। ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা লাভের পর থেকে এখানেও একটি স্বপ্ন বাস্তবায়নের চেষ্টা চলছে। কিন্তু সে চেষ্টা বারবার হোঁটচ খাচ্ছে! বিশ্বদরবারে বাংলাদেশকে একটি সম্মানজনক স্থানে পৌঁছানোর জন্য বঙ্গবন্ধু যে স্বপ্ন দেখেছিলেন, তার সে স্বপ্ন বাস্তবায়নে বঙ্গবন্ধুকন্যা কাজ করে চলেছেন। বিভিন্ন বড় বড় কর্মসূচি হাতে নিয়ে তা বাস্তবায়নের চেষ্টা করা হচ্ছে। 

কিন্তু দুঃখের বিষয়, যাদের নিয়ে, যাদের মাধ্যমে স্বপ্ন বাস্তবায়নের প্রচেষ্টা চালানো হচ্ছে, তাদের মধ্যে বঙ্গবন্ধুর সেই স্বপ্নের বীজ যথাযথভাবে প্রোথিত হয়নি। কারণ যদি তাই হতো, তাহলে তারা প্রকল্পের টাকা এভাবে চুরিচামারি, লুটতরাজ করে বিদেশে পাচার করতেন না। এক একজন পৌর বা সিটি কমিশনার পর্যন্ত বিদেশের মাটিতে শত শত কোটি টাকার সম্পদ গড়ে তুলতেন না।

এবার দুবাই হয়ে আমেরিকার লং আইল্যান্ডের এক আত্মীয়র বাড়িতে বেড়াতে গিয়ে দেখে এলাম, সেখানে পর্যন্ত একজন কমিশনার পেট্রল পাম্পসহ বিশাল বাড়িঘর ও ধনসম্পদ গড়ে তুলেছেন। অন্য একজন থানা আওয়ামী লীগের নেতা তার পুত্রকে লেখাপড়া করাতে পাঠিয়ে সেই পুত্রের নামে ব্যবসা-বাণিজ্য গড়ে তুলেছেন। তাছাড়া তিনি নিজেও সেখানে ঘন ঘন যাতায়াতের মাধ্যমে সহায়-সম্পদ গড়ে তুলছেন।

একজন পৌর কমিশনার বা একজন থানা পর্যায়ের নেতা যদি এভাবে অর্থ পাচার করে বিদেশের মাটিতে সম্পদ গড়ে তুলতে পারেন, তাহলে একজন এমপি বা মন্ত্রী ইচ্ছে করলে কি-ই বা না করতে পারেন। কারণ একজন এমপি বা মন্ত্রীর হাত দিয়ে তো আরও অনেক বেশি টাকা খরচ করানো হয়।

কোনো কোনো এমপির বিষয়ে শোনা যায়, বিভিন্ন সংসদীয় কমিটির সদস্য হওয়ার সুবাদে তাদের কেউ কেউ বছরে অনেকবার বিদেশ ভ্রমণ করেন এবং এভাবে তারা টাকা পাচার করে বিদেশের মাটিতে বাড়িঘরের মালিক হয়েছেন। কারণ একজন এমপি নাকি ইচ্ছে করলেই বছরে ৫০ কোটি টাকা বানাতে পারেন। আর তা সম্ভব বলে সে টাকা দেশে না রেখে তিনি বা তারা সেসব অর্থ-সম্পদ বিদেশে পাচার করবেন, সেটাই স্বাভাবিক!

আর সে কারণেই বোধহয় বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন বাস্তবায়ন বারবার হোঁচট খাচ্ছে। অন্যথায় বঙ্গবন্ধু বাকশাল প্রতিষ্ঠা বা বাস্তবায়নের আগেই তাকে হত্যা করা হতো না! বাকশাল বাস্তবায়নের আগেই তার ভালো-মন্দ না বুঝেই তাকে দোষী সাব্যস্ত করা হতো না। আসলে সে সময়েও তার চারপাশের লোকজন যেভাবে লুটপাট এবং অরাজকতায় লিপ্ত হয়েছিলেন, বাকশাল প্রতিষ্ঠা হলে সেসব সম্ভব হবে না ভেবেই তারা বঙ্গবন্ধুর পেছনে উঠেপড়ে লেগেছিলেন।

বাকশাল কেউ যদি নীতিগতভাবে সমর্থন না-ও করেন, তবুও তাকে ভেবে দেখতে বলব, বাকশাল প্রতিষ্ঠা হলে ভালো-মন্দ কী হতো, তা আমরা কেউ জানি না। তাহলে সে অপরাধে অপরাধী হতে হবে কেন? বাকশাল প্রতিষ্ঠার পর দেশ ও জাতি যদি সুফল না পেয়ে কুফল পেত তাহলে তাকে অপরাধী বললে বা বাকশাল প্রতিষ্ঠা ভুল হয়েছে বললে, তা মেনে নেয়া যেত।

বঙ্গবন্ধু সে সময়ে দেশের লুটপাট, অরাজকতা বন্ধ করতেই হয়তো রাজনীতিতে একটি মোড় নিতে চেয়েছিলেন; কিন্তু অসাধু লুটেরা চক্র তা হতে দেয়নি। আবার বর্তমানে বঙ্গবন্ধুর কন্যাকেও সেই অসাধু লুটেরা চক্রই গ্রাস করতে চাচ্ছে, যেখান থেকে বঙ্গবন্ধুকন্যা বের হওয়ার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। এ অবস্থায় দেশের মানুষের উচিত হবে, শেখ হাসিনার সঙ্গে থেকে তার হাতকে শক্তিশালী করা।

আর বঙ্গবন্ধুকন্যার উদ্দেশে বলতে চাই, তার আশপাশে থেকে যারা রাস্তা, কালভার্ট, ব্রিজ, ফ্লাইওভার নির্মাণের মাধ্যমে হাজার হাজার কোটি টাকা লুটে নিয়েছে তাদের ধরা দরকার। কারণ পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি রেটে ওইসব কাজ বাগিয়ে নিয়ে পৃথিবীর সবচেয়ে নিুমানের কাজ করে ওইসব ব্যক্তি উন্নয়ন প্রকল্পের অর্থ লুট করেছে। সুতরাং দুর্নীতিবিরোধী অভিযানে টেন্ডারবাজ এসব এমপি-নেতাও যেন বাদ না পড়েন।

এখানে আরও উল্লেখ করা প্রয়োজন, বর্তমানে অর্ধেকেরও বেশি নেতা কিন্তু বঙ্গবন্ধুর আদর্শ বুকে ধারণ না করে টেন্ডারবাজিসহ বিভিন্ন ধরনের অপকর্মের মাধ্যমে অর্থ উপার্জনের জন্য রাজনীতি করেন। সুতরাং তাদের রাজনীতি থেকে বাদ দিতে পারলে চোর ধরার পেছনে অযথা এত বেশি শ্রম ও সময় ব্যয় করতে হবে না।

উপসংহারে বলতে চাই, ১৯৬৫ সালে সিঙ্গাপুর স্বাধীন হওয়ার পর কিছু মানুষের স্বপ্ন সততার সঙ্গে বাস্তবায়নের ফলেই সিঙ্গাপুর একটি উন্নত রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে। এত ছোট একটি রাষ্ট্রের টিকে থাকা নিয়েই অনেকে সন্দিহান ছিলেন। আবার আমেরিকার কৃষ্ণাঙ্গ নেতা মার্টিন লুথার কিং, দক্ষিণ আফ্রিকার নেলসন ম্যান্ডেলা একটি স্বপ্ন দেখেছেন, সে স্বপ্ন বাস্তবায়নে সততার সঙ্গে নিরলস কাজ করেছেন।

ফলে নেলসন ম্যান্ডেলার দক্ষিণ আফ্রিকার কৃষ্ণাঙ্গরা পৃথিবীতে মাথা তুলে দাঁড়িয়েছেন। অন্যদিকে মার্টিন লুথার কিংকে হত্যা করা হলেও বারাক ওবামা সে দেশের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ায় তার স্বপ্ন বাস্তবায়িত হয়েছে। আবার আমাদের স্বপ্নদ্রষ্টা বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করা হলেও তার কন্যা বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নকে বাস্তবায়ন করে চলেছেন। তবে একটি শুদ্ধি অভিযান অত্যন্ত পরিচ্ছন্ন ও দৃঢ়তার সঙ্গে বাস্তবায়ন করলেই বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন বাস্তিবায়িত হবে।

মুহাম্মদ ইসমাইল হোসেন : কবি, প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম