ইতিহাসের বিস্মৃত এক মুক্তিযোদ্ধা

একেএম শামসুদ্দিন
প্রকাশ: ১৪ নভেম্বর ২০১৯, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

জগতজ্যোতি দাস বীরবিক্রম। ফাইল ছবি
মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে প্রায় বিস্মৃত একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা জগতজ্যোতি দাস বীরবিক্রম ১৯৭১ সালের ১৬ নভেম্বর দখলদার পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সঙ্গে সম্মুখ সমরে নিহত হয়েছিলেন।
মৃত্যুর পর তার মৃতদেহের ওপর যে পৈশাচিক আচরণ করা হয়েছিল, সেই রোমহর্ষক কাহিনী আমাদের অনেকেরই অজানা। তার এ নির্মম কাহিনী মানব ইতিহাসের এক কলঙ্কজনক অধ্যায় হয়ে থাকবে। জগতজ্যোতি প্রকৃত অর্থেই একজন সাহসী বীর মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন।
তিনি বিশেষভাবে প্রশিক্ষিত যোদ্ধাদের নিয়ে গঠিত একটি চৌকস গেরিলা দলের কমান্ডার ছিলেন। তার নামের শেষাংশ নিয়েই তাদের এ দলটির নাম দেয়া হয়েছিল ‘দাসপার্টি’। সুনামগঞ্জের বৃহত্তর ভাটি অঞ্চল ছাতক, শাল্লা, দিরাই, আজমিরীগঞ্জ, বানিয়াচং, জামালগঞ্জ, তাহিরপুর, কিশোরগঞ্জ ও নেত্রকোনা অঞ্চল ছিল এ দাসপার্টির অপারেশন এলাকা।
মুক্তিযুদ্ধকালীন মাত্র ৩৬ সদস্য নিয়ে গঠিত দাসপার্টি অত্র এলাকায় পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ওপর প্রচণ্ড প্রভাব বিস্তার করতে সমর্থ হয়েছিল। ভৈরব-সুনামগঞ্জ নৌপথটি ছিল পাকিস্তানিদের লজিস্টিক্স সাপ্লাই রুট।
দাসপার্টির অব্যাহত অভিযানের মুখে পাকিস্তানিরা ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে শেষ পর্যন্ত নৌচলাচল বন্ধ ঘোষণা করতে বাধ্য হয়েছিল। জগতজ্যোতি যোগ্য নেতৃত্ব দিয়ে দিরাই, শাল্লা, রানীগঞ্জ ও কাদিরগঞ্জ এলাকায় সফল অভিযান চালিয়ে অসংখ্য রাজাকার সদস্যদের আটক করেন। গেরিলা যুদ্ধবিদ্যায় তিনি ছিলেন পারদর্শী।
একক চেষ্টায় মাত্র একটি হালকা মেশিনগান নিয়ে তিনি জামালগঞ্জ থানা দখল করে নেন। মাত্র এক সেকশন (১০-১২ জন) গেরিলা যোদ্ধা নিয়ে তিনি শ্রীপুর ও খালিয়াজুরী শত্রুমুক্ত করেন। মোট কথা মুক্তিযুদ্ধকালে বিস্তীর্ণ ভাটি অঞ্চলে জগতজ্যোতি ও তার দাসপার্টি পাকিস্তান সেনাবাহিনী ও রাজাকারদের কাছে মূর্তিমান এক আতঙ্কের নাম ছিল।
মুক্তিযুদ্ধের এ স্বল্পতম সময়ে যার নেতৃত্বে এতগুলো বীরত্বপূর্ণ সফল অভিযান পরিচালিত হয়েছিল, সেই জগতজ্যোতি দাস জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত শত্রুর বিরুদ্ধে লড়াই করে দেশের জন্য নিজেকে আত্মোৎসর্গ করেন।
দিনটি ছিল নভেম্বরের ১৬ তারিখ। ন্যাশনাল গ্রিডের বিদ্যুৎ লাইন ধ্বংসের উদ্দেশে ৩৬ জনের একটি দল নিয়ে জগতজ্যোতি নৌকাযোগে খালিয়াজুরী থেকে বাহুবলের উদ্দেশে রওনা দেন।
খুব ভোরে রওনা হয়ে সকাল আনুমানিক নয়টার সময় বদলপুর ইউনিয়ন পরিষদের কাছে পৌঁছে তারা দেখেন কয়েকটি নৌকা করে একদল রাজাকার ওই এলাকায় চলাচল করে এমন জেলেদের নৌকা থেকে চাঁদা তুলছে। জগতজ্যোতি মুহূর্ত দেরি না করে অস্ত্রহাতে ঝাঁপিয়ে পড়ে বেশ কয়েকজন রাজাকারকে হত্যা করেন।
তাদের এ আকস্মিক আক্রমণে রাজাকাররা ভেবাচেকা খেয়ে যায় এবং যারা প্রাণে বেঁচে গিয়েছিল তারা দুটো নৌকা নিয়ে পালিয়ে যেতে থাকে। জগতজ্যোতি তার দলের অধিকাংশ সদস্যকে পেছনে রেখে মাত্র বারোজন নিয়ে তাদের তাড়া করেন।
রাজাকারের দল নদীর ওপর তীরে নৌকা রেখে শুকিয়ে যাওয়া বিল পেরিয়ে জলসুখার দিকে পালিয়ে যায়। উল্লেখ্য, জলসুখা জগতজ্যোতিরই নিজ গ্রাম। জগতজ্যোতি নদীর তীরে নৌকা রেখে শুকনো বিলের ওপর দিয়ে রাজাকারদের বেশ কিছুদূর ধাওয়া করে ধরতে না পেরে যখন নিজেদের নৌকায় ফিরে যেতে থাকেন ঠিক তখনই আগে থেকে ওতপেতে থাকা পাকসেনারা দু’দিক থেকে ঘিরে তাদের ওপর বিরামহীনভাবে গুলিবর্ষণ করতে থাকে।
এভাবেই জগতজ্যোতি ও তার দল দিনের ঝকঝকে আলোয় বিলের মাঝখানে পাকসেনাদের ফাঁদে পড়ে যান। ওদিকে বদলপুরে রেখে আসা মূল দলও তাদের সাহায্যে এগিয়ে আসতে পারছে না। কারণ পাকসেনাদের অন্য একটি দল গানবোট নিয়ে তাদের মূল দলের ওপর অনবরত গুলিবর্ষণের মাধ্যমে পিন্ ডাউন করে রেখেছে।
দাসপার্টি ও পাকসেনা উভয় পক্ষের মধ্যে তখন আক্রমণ-প্রতিআক্রমণ চলতে থাকে। প্রচণ্ড গুলিবর্ষণকালে দাসপার্টির একে একে সাতজন গুলিবিদ্ধ হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। এদিকে যুদ্ধের রসদ কমে এলে জগতজ্যোতি বিনোদবিহারীসহ আরও দুজন মুক্তিযোদ্ধাকে বদলপুর মূল দল থেকে গোলাবারুদ আনতে পাঠিয়ে দেন।
বেলা গড়িয়ে যায়; কিন্তু গোলাবারুদ নিয়ে ওরা আর ফিরে আসে না। জগতজ্যোতিরা সংখ্যায় তখন মাত্র দুজন, জগতজ্যোতি ও ইলিয়াস। গোলাবারুদও তখন ফুরিয়ে আসছে। বিকাল সাড়ে তিনটা।
জগতজ্যোতি একটা এলএমজি হাতে শত্রুর ওপর গুলিবর্ষণ করে যাচ্ছেন। এমন সময় শত্রুর একটা বুলেট ইলিয়াসের বুকের বামপাশে এসে আঘাত করে পিঠ দিয়ে বেরিয়ে যায়। জগতজ্যোতি মাথার গামছা দিয়ে ইলিয়াসের জখমের জায়গাটি শক্ত করে বেঁধে দেন যাতে রক্তক্ষরণ কম হয়। একপর্যায়ে তিনি ইলিয়াসকে বলেন, আমি এলএমজি দিয়ে শত্রুর ওপর কভারিং ফায়ার দিচ্ছি তুমি চলে যাও।
ইলিয়াস প্রকৃত বন্ধুর পরিচয় দিয়ে জ্যোতিকে একা রেখে চলে যেতে অস্বীকার করেন এবং যুদ্ধ চালিয়ে যান। থেমে থেমে শত্রুর ঝাঁকে ঝাঁকে গুলি তাদের মাথার ওপর দিয়ে চলে যাচ্ছে। জগতজ্যোতি তখন হিসাব করে দেখেন সন্ধ্যা পর্যন্ত যদি টিকে থাকা যায় তাহলে অন্ধকারে মিশে গিয়ে তারা শত্রুর নিশানা থেকে বেরিয়ে যেতে সক্ষম হবেন।
জগতজ্যোতির সেই সন্ধ্যা আর আসে না। সন্ধ্যার ঠিক আগে আগে পাকসেনাদের একটি বুলেট জগতজ্যোতির মাথায় এসে আঘাত করে এবং তাৎক্ষণিক তিনি মৃত্যুবরণ করেন। চারদিক তখন প্রায় অন্ধকার। ইলিয়াসের চোখ ভারি হয়ে আসে।
সন্ধ্যার অন্ধকার যেন আরও অন্ধকার হয়ে নামে ইলিয়াসের চোখে। নিজেকে সামলে নিয়ে তিনি খুব সাবধানে তার দলনেতা জগতজ্যোতি দাসের নিথর দেহটি বিলের কাদা পানির ভেতর যতটুকু সম্ভব পুঁতে ফেলেন, যাতে মৃতদেহ পানিতে ভেসে ওঠে শত্রুর হাতে না পড়ে।
এরপর ইলিয়াস খুব সতর্কতার সঙ্গে সে স্থান ত্যাগ করে শত্রুর ফায়ারিং রেঞ্জ থেকে নিরাপদ দূরত্বে সরে যান। হানাদার বাহিনীর কাছে ত্রাস সৃষ্টিকারী অকুতোভয় বীর মুক্তিযোদ্ধা জগতজ্যোতির এভাবেই জীবনাবসান ঘটে। জীবনের অবসান ঘটলেও জ্যোতির ওপর পাকসেনা ও তাদের দোসরদের আক্রোশ তখনও কমেনি।
পরদিন ভোরে জগতজ্যোতির মৃতদেহ কাদা পানির ভেতর থেকে ভেসে উঠলে রাজাকাররা সে দেহ খুঁজে পায় এবং টেনেহিঁচড়ে নৌকার সম্মুখভাগে তুলে নিয়ে সাধারণ মানুষের ভেতর আতঙ্ক সৃষ্টির জন্য জলসুখা থেকে আজমিরীগঞ্জের ঘাটে ঘাটে তার মৃতদেহ প্রদর্শন করে তারা পাশবিক উল্লাস করতে থাকে।
এভাবে তারা আজমিরীগঞ্জ বাজারে পৌঁছায়। সেদিন ছিল হাঁটবার। বাজার ভর্তি মানুষ। রাজাকাররা তখন শত শত মানুষের সামনেই বাজারের ঠিক মাঝখানে একটি বৈদ্যুতিক খুঁটির সঙ্গে জগতজ্যোতির মৃতদেহকে বেঁধে পাশবিক অত্যাচার শুরু করে।
এভাবে তারা ক্ষতবিক্ষত করে ফেলে জগতজ্যোতির লাশ। রাজাকার সদস্যরা থুথু ফেলে তার দেহে। তারা জগতজ্যোতির লাশের ওপর শুধু অত্যাচার করেই বসে থাকেনি বরং তার মা-বাবাকে ধরে এনে তাদের সন্তানের বীভৎস লাশ দেখিয়ে পাশবিক উল্লাসও করে। এভাবে সারা দিন তার মৃতদেহের সঙ্গে অমানবিক আচরণ করে এবং একসময় ক্ষতবিক্ষত জগতজ্যোতিকে ভেড়ামোহনার পানিতে ভাসিয়ে দেয়।
মুক্তিযুদ্ধের এমন অনেক মর্মান্তিক ঘটনা আজও আমাদের অনেকের অজানা রয়ে গেছে। জগতজ্যোতির মতো যোদ্ধাদের সর্বোচ্চ ত্যাগের বিনিময়ে যে দেশ আমরা পেয়েছি, সে দেশের নাগরিক হিসেবে এ আত্মত্যাগী মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি কতটুকু সুবিচার আমরা করেছি তা ভেবে দেখতে হবে। মুক্তিযুদ্ধকে ব্যবহার করে, মুক্তিযুদ্ধের দোহাই দিয়ে একশ্রেণির মানুষ স্বার্থোন্মত্ত হয়ে উঠেছে। আমরা বীরের জাতি হিসেবে দাবি করি; কিন্তু আমাদের বীরদের প্রকৃত সম্মান দিতে জানি না।
এ কারণেই তাদের প্রতি আমরা প্রকৃতপক্ষে কতটুকু শ্রদ্ধাশীল সে প্রশ্ন থেকেই যায়। আমরা মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি যতটুকু সম্মান কিংবা শ্রদ্ধা দেখাই না কেন, সে সম্মান প্রদর্শন এবং শ্রদ্ধাঞ্জলি শুধু আনুষ্ঠানিকতার মধ্যেই আবদ্ধ হয়ে পড়েছে কিনা ভেবে দেখতে হবে। যদি তাই না হয়ে থাকে, তাহলে যারা বেঁচে আছেন, আমাদের সেই বীর মুক্তিযোদ্ধারা সাহায্যের জন্য এখনও কেন অন্যের মুখাপেক্ষী হয়ে থাকেন?
আমাদের সমাজে মুক্তিযোদ্ধা ও তাদের পরিবারের সদস্যদের প্রতি এখনও যে নিষ্ঠুর আচরণ করা হয় সে খবর আমরা মাঝে মধ্যেই মিডিয়ায় দেখতে পাই। সমাজের বিশিষ্ট ব্যক্তি থেকে শুরু করে রাষ্ট্রযন্ত্রের গুরুত্বপূর্ণ পদ ও পদবিধারী ব্যক্তিরা এমনও অনেক ঘটনার জন্ম দেন, যা দেশের সাধারণ মানুষের বিবেককে নাড়া নিয়ে যায়।
সম্প্রতি দিনাজপুরের বীর মুক্তিযোদ্ধা ইসমাইল হোসেন ও তার পুত্রের সঙ্গে স্থানীয় জেলা প্রশাসনের এক কর্মকর্তার এমনই একটি অমানবিক কাণ্ড প্রকাশিত হয়েছে। ২৫ অক্টোবর জাতীয় দৈনিক খবরের কাগজগুলো বিভিন্ন শিরোনামে সে খবর ছাপিয়েছে।
এর একটি শিরোনাম ছিল ‘বুকভরা অভিমান দিয়ে এক মুক্তিযোদ্ধার চিরবিদায়।’ সংবাদপত্রের মাধ্যমে এবং ব্যক্তিগতভাবে যোগাযোগ করে যা জেনেছি তাতে মন খুব খারাপ হয়ে গেছে। মৃত্যুর দুই দিন আগে দিনাজপুর সদর উপজেলার যোগীবাড়ি গ্রামের বাসিন্দা বিশিষ্ট মুক্তিযোদ্ধা ইসমাইল হোসেনের এক আবেগময়ী লেখা কার না হৃদয় স্পর্শ করেছে!
তিনি লিখেছেন, ‘তার ছেলে নূর হোসেন সহকারী কমিশনার (ভূমি) মো. আরিফুল ইসলামের গাড়ি চালাতেন। নূর হোসেনকে দিয়ে ভূমি কমিশনার শুধু গাড়ি চালাতেন না, পাশাপাশি বাবুর্চির মতো বাসার রান্নাসহ বিভিন্ন কাজ করাতেন।
সামান্য কারণে কমিশনার সাহেব তার ছেলের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করতেন। কাজে যেতে দেরি করায় এবং বাসার শৌচাগার পরিষ্কার করতে রাজি না হওয়ায় গত আগস্টে ছেলের কাছ থেকে গাড়ির চাবি নিয়ে নেয়া হয়। নূর হোসেন ঈদগাহবস্তি এলাকায় সরকারি একটি পরিত্যক্ত বাসায় পরিবার নিয়ে থাকতেন। সেখান থেকেও তার ছেলেকে বের করে দেয়া হয়। চাকরির পর বাসা থেকেও উচ্ছেদ হয়ে স্ত্রী-সন্তান নিয়ে বেশ কষ্টে দিন কাটাচ্ছেন নূর হোসেন।’
চিঠিতে মুক্তিযোদ্ধা ইসমাইল হোসেন প্রশ্ন করেন, ‘প্রশাসন কিসের জন্য সামান্য কারণ দেখিয়ে আমার ছেলেকে চাকরি ও বাস্তুচ্যুত করল? ছেলে চাকরিচ্যুত হওয়ায় আমি শারীরিক ও মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছি।
এ অবস্থায় আমার মৃত্যু হলে আমাকে যেন রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায় দাফন না করা হয়। কারণ এসি ল্যান্ড, ইউএনও, এডিসি, ডিসি যারা আমার ছেলেকে চাকরিচ্যুত করেছে, পেটে লাথি মেরেছে, তাদের সালাম-স্যালুট আমার শেষযাত্রার কফিনে আমি চাই না।’ কী সাংঘাতিক কথা! প্রচণ্ড ক্ষোভ ও অভিমান ঝরে পড়েছে তার চিঠির প্রতিটি শব্দে। বীর মুক্তিযোদ্ধা ইসমাইল হোসেন এই চিঠি লেখার দু’দিন পর মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন।
যদিও জেলা প্রশাসক চাকরি চলে যাওয়ার পক্ষে সাফাই গাইতে গিয়ে নূর হোসেনের কাজের প্রতি অবহেলার কথাই উল্লেখ করেছেন; কিন্তু তাকে দিয়ে যে বাসায় চাকরের মতো কাজ করানো হতো সে কথা তিনি উল্লেখ করেননি। সবচেয়ে খারাপ লেগেছে সহকারী কমিশনার মো. আরিফুল ইসলাম যখন নূর হোসেনকে মাদকাসক্ত বলে তার চরিত্র স্খলনের চেষ্টা করেছেন। বীর এ মুক্তিযোদ্ধার সন্তান নূর হোসেনের চাকরিটির ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন আরেক মুক্তিযোদ্ধার সন্তান হুইপ ইকবালুর রহিম।
স্মরণ করা যেতে পারে, ‘কোটা সংস্কার’ আন্দোলন নিয়ে দেশব্যাপী যে আলোড়ন সৃষ্টি হয়েছিল তার মূল কেন্দ্রবিন্দু কিন্তু ছিল ‘মুক্তিযোদ্ধা কোটা’। এ নিয়ে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীসহ সর্বস্তরের মানুষ বেশ সমালোচনা করেছিলেন। কেউ পক্ষে আবার কেউ বা তার বিপক্ষে।
মুক্তিযোদ্ধা কোটা রহিত কিংবা কমিয়ে দেয়ার বিপক্ষে তখন মুক্তিযোদ্ধার সন্তানরা তাদের একটি সংগঠন ‘আমরা মুক্তিযোদ্ধার সন্তান’ ব্যানারে বেশ সক্রিয় হয়ে উঠেছিলেন। মাঝে মধ্যেই তাদের মুক্তিযোদ্ধাদের পক্ষে কিছু কর্মকাণ্ডের খবর সংবাদপত্রে দেখতে পাই।
কিন্তু আফসোস, গরিব মুক্তিযোদ্ধা ইসমাইল হোসেনের সন্তান নূর হোসেনের সঙ্গে যে আচরণ করা হল এবং এরই জের ধরে ইসমাইল হোসেনের মৃত্যুর ঘটনাটি সম্ভবত ‘আমরা মুক্তিযোদ্ধার সন্তান’-এর কোনো সদস্যের বিবেককে তেমনভাবে নাড়া দিতে পারেনি।
তা না হলে তারা নিশ্চয়ই নূর হোসেনের পাশে এসে দাঁড়াতেন এবং এ ঘটনায় প্রতিবাদ করতেন। বাস্তবে তা ঘটল না। মুক্তিযোদ্ধার সন্তানদের সংগঠন নূর হোসেনের পাশে এসে না দাঁড়ালেও নূর হোসেন নিজেই কিন্তু সরকারি ওই কর্মকর্তার অন্যায়ের জবাবটি দিয়েছেন ভালোভাবেই।
নূর হোসেন দিনাজপুর জেলা প্রশাসনের চাকরি ফিরিয়ে দেয়ার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে মুক্তিযোদ্ধা বাবার উপযুক্ত সন্তানের কাজটিই করেছেন। উল্লেখ্য, হুইপ ইকবালুর রহিম অবশ্য তাকে অন্য একটি চাকরির ব্যবস্থা করে দিয়েছেন।
মুক্তিযোদ্ধা ইসমাইল হোসেনের অভিমান করে চলে যাওয়ার ঘটনা জানার পর আরেক বীর মুক্তিযোদ্ধার কথা মনে পড়ে গেল। তিনি হলেন তারামন বিবি বীরপ্রতীক। তিনি গত বছরের ১ ডিসেম্বর ইসমাইল হোসেনের মতোই আফসোস নিয়ে চলে গেছেন।
তারামন বিবি মারা যাওয়ার পর তার সঙ্গে আমার ব্যক্তিগত পরিচয় ও বেশ কিছুদিন মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে আলোচনার অভিজ্ঞতার আলোকে দৈনিক যুগান্তরে ‘বড় অভিমান নিয়ে চলে গেলেন তারামন বিবি’ নামক একটি নিবন্ধ লিখেছিলাম। সে নিবন্ধে দিনাজপুরের আরেক অভিমানী মুক্তিযোদ্ধা সতীশ কড়ার কথা বলেছিলাম। আমার সে নিবন্ধে মুক্তিযুদ্ধে একই পরিবারের চার ভাই জেমস এম দাস, রবার্ট আরএন দাস, জন এসকে দাস ও অ্যান্টনি এনএন দাসের অবদানের কথা উল্লেখ ছিল।
এ যুগের অনেকেই আছেন যারা এ বীর মুক্তিযাদ্ধাদের নামও হয়তো শোনেননি। আমরা ভুলে যাই ইসমাইল হোসেন, সতীশ কড়া, জেমস দাস, জগতজ্যোতিরা যদি নিজেদের জীবন বিপন্ন করে আমাদের এ দেশটাকে স্বাধীন করে না দিতেন, তাহলে আজ হয়তো আমরা আমাদের এ পদ-পদবি নিয়ে এত বড়াই করতে পারতাম না।
একেএম শামসুদ্দিন : অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তা