Logo
Logo
×

বাতায়ন

যে ধনে হইয়া ধনী মণিরে মান না মণি

Icon

জেহসান ইসলাম

প্রকাশ: ০৮ নভেম্বর ২০১৯, ০১:০০ পিএম

প্রিন্ট সংস্করণ

যে ধনে হইয়া ধনী মণিরে মান না মণি

প্রতীকী ছবি

প্রকৃতির নিয়মে পৃথিবীতে আমাদের আগমন। সময় হলে চলে যেতে হবে; সেটা মাতৃগর্ভে অস্তিত্ব সৃষ্টির মুহূর্ত থেকে যে কোনো সময় হতে পারে। চাইলেও কোনোভাবেই থাকার উপায় নেই। তবে মানুষের স্বাভাবিক জীবন বিবেচনা করলে বলা যায়, বাংলাদেশে একজন মানুষের বর্তমান গড় আয়ু বাহাত্তর বছর। উন্নত বিশ্বে এটি আরও বেশি এবং অনেক দেশে আরও কম।

বাংলাদেশের প্রেক্ষাপট বিবেচনায় নিয়ে ধরে নেয়া যায়, এখানে একজন মানুষ কমবেশি সত্তর-পঁচাত্তর বছর বাঁচবে। এর মধ্যে জীবনের প্রথম পাঁচ বছর শিশুকাল এবং পরের বিশ-পঁচিশ বছর বাকি জীবনের জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করা হয়। সে প্রস্তুতি সাধারণত পরিবারের শিক্ষাদীক্ষা, আর্থিক অবস্থা এবং সামাজিক মর্যাদা বা অন্যান্য নিয়ামকগুলো বিবেচনায় একেকজনের ক্ষেত্রে একেক রকম হয়ে থাকে।

এ প্রস্তুতির মাধ্যমে প্রত্যেকে এক একটি পেশা গ্রহণ করে থাকে। পেশার মাধ্যমে প্রত্যেকের লক্ষ্য থাকে প্রথমত নিজের এবং পরিবারের জন্য মানুষের জীবনে যেসব মৌলিক চাহিদা থাকে অর্থাৎ অন্ন, বস্ত্র, স্বাস্থ্য, বাসস্থান ও শিক্ষার ব্যবস্থা করে একটি নিরুদ্বিগ্ন, সুন্দর ও সচ্ছল জীবনের ব্যবস্থা করা। এর বাইরে সম্ভব হলে প্রতিবেশী থেকে শুরু করে যতদূর সম্ভব বিস্তার ঘটানো।

যে রাষ্ট্র বা সমাজ ব্যবস্থায় মানুষ জীবনযাপন করে, সে রাষ্ট্র বা সমাজ ব্যবস্থার মধ্যে নানা ধরনের অনিয়ম, অসঙ্গতি, বৈষম্য ইত্যাদি বিরাজমান থাকার কারণে মানুষের স্বাভাবিক জীবন ব্যবস্থা নানাভাবে বাধাগ্রস্ত হয়। এসব বাধা মোকাবেলা করতে গিয়ে মানুষ বৈধ বা অবৈধ পথ অবলম্বন করে থাকে। কমবেশি এটা পৃথিবীর সব রাষ্ট্র বা সমাজ ব্যবস্থার মধ্যেই বিদ্যমান থাকলেও যেসব রাষ্ট্র বা সমাজ মানুষের স্বাভাবিক জীবনযাপনের বাধাগুলো দূরীকরণে উপযুক্ত পদক্ষেপ নিতে সক্ষম হয়েছে, সেসব রাষ্ট্র বা সমাজ ব্যবস্থা উন্নততর এবং সভ্য।

পেশার সংখ্যার কোনো ইয়ত্তা নেই। সভ্যতা বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে প্রতিনিয়ত নতুন নতুন পেশা যেমন যুক্ত হচ্ছে তেমনই অনেক পুরনো পেশা বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে। সময়ের সঙ্গে খাপ খাওয়াতে বা মানানসই জীবনযাপনের জন্য মানুষ নিত্যনতুন পেশা গ্রহণে আগ্রহী হয় বা বাধ্য হয়। পৃথিবীতে যত পেশা আছে, সব পেশাকে প্রধানত দু’শ্রেণিতে দেখা যেতে পারে- ক্ষমতাযুক্ত ও ক্ষমতাবিযুক্ত।

ক্ষমতাযুক্ত পেশাদারীরা সাধারণভাবে ক্ষমতাবিযুক্ত পেশাদারীদের নানাভাবে নিয়ন্ত্রণ করে থাকেন। সেদিক থেকে বলা যায় ক্ষমতাযুক্ত পেশাদারীরা রাষ্ট্র বা সমাজের সবচেয়ে সুবিধাপ্রাপ্ত শ্রেণি। স্বাভাবিকভাবেই মানুষের এটা সহজাত প্রবণতা যে, তাদের সিংহভাগই চেষ্টা করে ক্ষমতাযুক্ত পেশা গ্রহণ করতে অথবা নিদেনপক্ষে নিজের ক্ষমতাবিযুক্ত পেশাকে যতটা সম্ভব ক্ষমতাযুক্ত পেশার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট করতে।

স্বীকার করতেই হবে, ব্যতিক্রমী হাতেগোনা দু-একটি ক্ষেত্র ছাড়া বাংলাদেশের রাষ্ট্র বা সমাজে এ প্রবণতা ভয়ঙ্কররূপে দেখা দিয়েছে। এখানে এখন এমন কাউকে খুঁজে পাওয়া মুশকিল, যিনি নিজেকে সানন্দে ক্ষমতাবিযুক্ত রাখতে চান। এর কারণও আছে। ক্ষমতাবিযুক্ত থাকা মানে সমাজে শুধু সুবিধাবঞ্চিত থাকাই নয়, অনেক ক্ষেত্রে নানামুখী অবহলো বা হয়রানিরও শিকার হওয়া।

ইতিহাস বলে, বন্য জীবন ছেড়ে মানুষ সমাজ গঠন করেছে একটি অলিখিত সাধারণ চুক্তি বা ইচ্ছায়- তারা পরস্পরকে পারস্পরিক প্রয়োজনে ও বিপদে-আপদে সাহায্য করবে, একটি সুশৃঙ্খল জীবনযাপন করবে, কেউ অপরাধ করলে তার সম্মিলিত প্রতিবিধান করবে; যাতে সবাই মিলে সুখে-শান্তিতে জীবনযাপন করতে পারে। সভ্যতার ক্রমবিকাশের ধারায় সমাজ রাষ্ট্রীয় কাঠামোয় পরিণত হয়েছে আর সব মানুষের সাধারণ চুক্তি বা ইচ্ছার প্রতিফলন রাষ্ট্র সংবিধান, আইন ইত্যাদির মাধ্যমে বাস্তবায়িত করছে। সমগ্র পৃথিবীকে বিবেচনায় নিলে জাতিসংঘকে এরূপ কাঠামোর সর্বোচ্চ ফোরাম হিসেবে দেখা যেতে পারে।

ইতিহাস আবার এর বিপরীত চিত্রও দেখাচ্ছে। এতকিছুর পরও ইতিহাসের কোনো পর্যায়েই পূর্ণাঙ্গ শান্তির তথ্য পাওয়া না; বরং পাওয়া যায় ব্যক্তিতে-ব্যক্তিতে, সমাজে-সমাজে, সাম্রাজ্যে-সাম্রাজ্যে, রাষ্ট্রে-রাষ্ট্রে যতসব ভয়ঙ্কর শোষণ, নিপীড়ন, হত্যা, যুদ্ধবিগ্রহের তথ্য। হয়তো এটাই পৃথিবীর বা বিশ্ববাসীর নিয়তি। এর বিপরীতে নগণ্য সংখ্যক বিবেকবান মানুষ সবসময় ছিলেন বা আছেন, যারা নিরন্তর চেষ্টা চালিয়ে যান এসবের অবসান ঘটাতে; যদিও অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ক্ষমতাবিযুক্ত এসব ব্যক্তিবর্গের কথা ক্ষমতাযুক্ত শ্রেণির কানে খুব একটা প্রবেশ করে না। তবুও তাদের প্রচেষ্টাকে অসফল বলা যাবে না। তাহলে আদিম বর্বরতা থেকে মানুষ এতদূর আসতে পারত না।

ধরে নেয়া যায়, সমাজ বা রাষ্ট্রের সিংহভাগ মানুষই চায় একটি শান্তিপূর্ণ, সুশৃঙ্খল, শোষণ-বৈষম্যহীন পরিবেশে বসবাস করতে। কিন্তু চাইলেই তো সেটা আপনাআপনি আকাশ থেকে বর্ষিত হবে না। প্রত্যেককে যার যার অবস্থান থেকে চেষ্টা করতে হবে। সেজন্য সর্বাগ্রে প্রয়োজন মানসিকতায় পরিবর্তন। আর এ পরিবর্তন মূলত নিজের মধ্যেই আনতে হবে, তারপর চেষ্টা করতে হবে পরিবার-পরিজন এবং নিজের আশপাশের লোকজনদের মধ্যে এর বিস্তার ঘটানো।

যে যেখানেই থাকুক, ক্ষুদ্র নয় বরং বৃহত্তর স্বার্থের কথা বিবেচনা করে সবাইকে দায়িত্ববোধ ও দায়িত্বশীলতার পরিচয় দিতে হবে। সমাজ বা রাষ্ট্রে সবাই সবার ওপর কোনো না কোনোভাবে নির্ভরশীল। সবাই যদি পরস্পরের নির্ভরশীলতাকে কষ্টদায়ক না করে সহযোগিতামূলক করতে পারে তাহলে একটি সুন্দর সমাজ বা রাষ্ট্র গঠন খুব কঠিন নয়। সেখানে তখন সবাই ভালো থাকতে পারবে। একটি উদাহরণ দেয়া যাক। একটি ভাগাড়ের মধ্যে প্রাসাদ করে থাকলেও তাতে স্বস্তি পাওয়া যাবে না; অপরদিকে একটি ফুলের বাগানের মধ্যে কুঁড়েঘরে, এমনকি খোলা জায়গায় থাকলেও অনেক শান্তি পাওয়া যায়।

আর এসব করার জন্য জীবনের প্রয়োজন বা চাহিদাকে যথাসম্ভব নিুপর্যায়ে আনতে হবে। সবার মনে রাখা উচিত, যতই চাকচিক্যময় জীবনযাপন করা হোক, একদিন চলে যেতেই হবে সবকিছু ছেড়ে। শুধু তাই নয়, জীবদ্দশায়ও যে কোনো মুহূর্তে যে কোনো ঘটনা ঘটে যেতে পারে, যা ইদানীং অহরহই দেখা যাচ্ছে। পতন আসতে সময় লাগে না। সুস্থ জীবনযাপন করতে গিয়ে অপরের জীবনকে দুর্বিষহ করে তুললে সেটা নিজের ওপরও যে কোনো সময় নেমে আসে। এসবের থেকে মুক্তির জন্যই রয়েছে ধর্মের এবং বিজ্ঞজনদের নানাবিধ উপদেশ।

রবীন্দ্রনাথের একটি কবিতায় বর্ণিত ঘটনা উল্লেখ করে এ লেখাটি শেষ করা যেতে পারে। কবিতাটির নাম স্পর্শমণি। অনেকেরই পড়া থাকতে পারে। সনাতন নামে একজন সাধু নদীতীরে ধ্যানমগ্ন ছিলেন। সেখানে জীবন নামের একজন ব্রাহ্মণ গিয়ে তাকে বললেন, তার কাছে অর্থাৎ সাধুর কাছে একটি পরশমণি আছে মর্মে ব্রাহ্মণ স্বপ্নে জানতে পেরেছেন। ওটা পেলে তার দারিদ্র্য দূর হবে।

সাধু দ্বিধাহীনভাবে সায় দিলেন এবং বালিতে পুঁতে রাখা পরশমণিটার জায়গাটা দেখিয়ে দিলেন। ব্রাহ্মণ গিয়ে মাটি খুঁড়ে পরশমণিটা পেলেন এবং পরীক্ষা করে দেখলেন ওটা আসলেই পরশমণি। তিনি বিস্ময়ে বসে পড়লেন, কী যেন ভাবলেন এবং কিছুক্ষণ পর ঋষির পায়ে লুটে পড়ে ‘যে ধনে হইয়া ধনী, মণিরে মান না মণি, তাহারই খানিক আমি মাগি নতশিরে’ বলে পরশমণিটি নদীতে ছুড়ে ফেললেন।

জেহসান ইসলাম : যুগ্ম সচিব, ডাক ও টেলি যোগাযোগ মন্ত্রণালয়

 

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম