
প্রিন্ট: ০১ মে ২০২৫, ০৫:৪৯ এএম
প্রত্যক্ষদর্শীর স্মৃতিতে ৭ নভেম্বর

নাজমুল আহসান শেখ
প্রকাশ: ০৭ নভেম্বর ২০১৯, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

আরও পড়ুন
কুয়াশাচ্ছন্ন সকাল। মধ্যরাত থেকেই গোলাগুলির আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছিল; কিন্তু ভোরের দিকে মনে হচ্ছিল বাসার সামনেই প্রচণ্ড গোলাগুলি হচ্ছে। আরও একটু সকাল হলে ব্যালকনি থেকে দেখলাম, বাসার সামনে বেশ কয়েকটি মিলিটারি ট্রাক এবং আমাদের বাসা থেকে (৩৩৯) দুই বাসা পরে ৩৩৬ এলিফ্যান্ট রোডের সামনে প্রচণ্ড ভিড়! বিদ্রোহী সৈনিকরা অটোমেটিক অস্ত্রের ফাঁকা গুলি ছুড়ে উল্লাস প্রকাশ করছিল। ‘যুদ্ধের কুয়াশার’ (Fog of War) মধ্যে কী হচ্ছে ঠিক বোঝা যাচ্ছিল না!
কর্নেল তাহের, অসমাপ্ত বিপ্লব না ভুল তত্ত্বের পরিণতি? ৭৫-এর কয়েক বছর আগে, ৩৩৬ এলিফ্যান্ট রোডে আসেন নতুন ভাড়াটিয়া, অবসরপ্রাপ্ত কর্নেল তাহের, বীর উত্তম। ৩৩৬ নম্বর এলিফ্যান্ট রোডের নিচতলাটি ভাড়া নেন কর্নেল তাহেরের বড় ভাই আবু ইউসুফ খান, বীরবিক্রম। বাসায় প্রধানত থাকত আমাদের চেয়ে পাঁচ-ছয় বছরের বড় তার দুই ছোটভাই বাহার ও বেলাল।
দুই বীরপ্রতীক! মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন তাহের মেজর জেনারেল মঞ্জুরের সঙ্গে একত্রে পাকিস্তান থেকে পালিয়ে এসে যোগ দেন মুক্তিযুদ্ধে এবং একটি পা হারান মুক্তিযুদ্ধে। স্বাধীনতার পর কিছুদিন কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্টে ব্রিগেড কমান্ডার ছিলেন তিনি। পরে সেনাবাহিনী থেকে পদত্যাগ করেন এবং ড্রেজার সংস্থার চেয়ারম্যান নিযুক্ত হন। তিনি সাধারণত নারায়ণগঞ্জে থাকতেন।
বাড়িটি ছিল আমার পাড়া ও নটর ডেম কলেজের বন্ধু ইফতেখার উজ্জামান তুহিনদের (আবাহনীর হকি খেলোয়াড়)। তুহিনরা থাকত কর্নেল তাহেরের ওপর তলায়। একটু পরে কর্নেল তাহেরের বাড়ির সামনে গেলাম, ঘটনা কী জানার জন্য! সেখানে কয়েকজন সিপাহি আমাদের বলছিল, ১৮৫৭ সালে সিপাহি বিদ্রোহ হয়েছিল বিদেশি অফিসারদের বিরুদ্ধে আর এবারের সিপাহি বিদ্রোহ হল দেশি অফিসারদের বিরুদ্ধে!!
১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বর সকালে এ বাড়িটিই হয়েছিল বাংলাদেশের রাজনীতির কেন্দ্রবিন্দু। এ বাড়িটি ‘নয়ন মার্কেট’ (বর্তমানে ‘ইস্টার্ন মল্লিকা’)-এর ঠিক বিপরীত দিকের গলিতে অবস্থিত। গলির মুখের প্রথম বাড়িটি ৩৩৪ নম্বরের একতলায় উত্তর দিকে ‘নোয়াখালী সমিতি’র অফিস ছিল আর দক্ষিণ দিকে থাকতেন সাংবাদিক মাহমুদ সাহেব।
এক সময় কর্নেল তাহেরকে দেখলাম বিদ্রোহী সিপাই পরিবেষ্টিত হয়ে আর্মির জিপে চড়ে কোথায় চলে গেলেন। আমাদের প্রশ্নের উত্তরে কর্নেল তাহেরের ছোটভাই বেলাল জানাল, ‘যে কোনো সময় রেডিও স্টেশনে জিয়া আসবে এবং তখন তাহের ভাই আর জিয়া মিলে জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেবেন’।
বাড়ির সামনে ভিড় কমে গেলে, আমরা কয়েক বন্ধু এলিফ্যান্ট রোড ধরে হাঁটতে হাঁটতে শাহবাগ মোড় হয়ে রেডিও স্টেশনের দিকে গেলাম। কাছে যেতেই শুনি কর্নেল তাহের ও খন্দকার মোশতাক দু’জনই রেডিও স্টেশনে ছিল। রেডিও স্টেশনের সামনে দেখলাম বিরাট জটলা! মানুষ বলাবলি করছে, কর্নেল তাহের একটু আগেই খন্দকার মোশতাককে রেডিও স্টেশন থেকে বের করে দিয়েছে।
বাসায় আসতে আসতে প্রায় ২-৩টা বেজে গেল। একটু পরে দেখি কর্নেল তাহের ৩৪৬ নম্বর বাসা (বাহার, বেলালের বন্ধু মিটি ভাইদের বাসা) থেকে বের হয়ে আসছেন। মুখে চিন্তার ছাপ সুস্পষ্ট। মিটি ভাইকে জিজ্ঞেস করলে বললেন, ওনার টেপরেকর্ডারের ‘স্পুলে’ কর্নেল তাহের ভাষণ রেকর্ড করে নিয়ে গেছেন, যে ভাষণ শহীদ মিনারে বা রেডিও স্টেশনে প্রচার করা হবে, কারণ জিয়াউর রহমান আর আপাতত আসছেন না।
সন্ধ্যার দিকে কর্নেল তাহেরের বাসায় বন্ধু টিংকুর বড় ভাই গণবাহিনীর অন্যতম সংগঠক হাসানুল হক ইনু ভাইকে প্রথম দেখলাম, সঙ্গে আরও জাসদ গণবাহিনীর নেতারা। সবাই প্রচণ্ড ব্যস্ত। বাহার, বেলাল বন্ধুদের নিয়ে মোটরবাইকে ঝড়ের গতিতে আসা-যাওয়া করছে। তখন মোবাইল ফোন আবিষ্কার হয়নি; কর্নেল তাহেরের বাসার টিএন্ডটি ফোনই সম্ভবত যোগাযোগের একমাত্র উপায় ছিল। বাসার সামনের অবস্থা এবং রেডিও’র ঘোষণা থেকে ৮ নভেম্বর সকালের মধ্যেই বোঝা গেল, বিপ্লবের ফসল কর্নেল তাহেরের বদলে জিয়াউর রহমানের গোলায় উঠেছে!
রোমান্টিক রেভ্যুলুশনারি : মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সিরাজুল আলম খানের মতো রাজনৈতিক নেতাদের সংস্পর্শে এসে বীর মুক্তিযোদ্ধা কর্নেল তাহের, মেজর জলিল ও কর্নেল জিয়াউদ্দিন আহমেদ, ফিদেল ক্যাস্ত্রোর মতো জাতীয়তাবাদী থেকে সমাজতন্ত্রীতে পরিণত হয়েছিলেন। স্বাধীনতার কিছু সময়ের মধ্যেই এ তিন সেক্টর কমান্ডার সেনাবাহিনী থেকে চাকরিচ্যুত হন বা পদত্যাগ করেন।
৬০-এর দশকে কিউবার বিপ্লবের প্রভাবে সারা পৃথিবীতে যে রোমান্টিক রেভ্যুলুশনারি ধারার সৃষ্টি হয়েছিল, তার ঢেউ আমাদের তীরেও এসে পৌঁছেছিল। যার ফলে আমাদের দেশেও সৃষ্টি হয়েছিল ক্যাস্ত্রো আর চে’র মতো সিরাজ শিকদার, তাহের, জিয়াউদ্দিন, জলিল, নিখিল সাহা এবং আরও অনেক রোমান্টিক রেভ্যুলুশনারি।
বীর মুক্তিযোদ্ধা মেজর জলিল যোগদান করেন জাসদে এবং সভাপতির পদ পান। সেনাবাহিনী থেকে পদত্যাগের পর কর্নেল তাহের ড্রেজার সংস্থার চেয়ারম্যান (এবং একইসঙ্গে গোপনে জাসদের গণবাহিনীর প্রধান) নিযুক্ত হন ও একইসঙ্গে সেনাবাহিনীর মধ্যে ‘বিপ্লবী সৈনিক সংস্থা’ গড়ে তোলেন।
স্বাধীনতার পর সিরাজ সিকদারের মেধা এবং ব্যক্তিত্বের কারণে কিছু মুক্তিযোদ্ধা তার দলেও যোগ দেন। তার মধ্যে কর্নেল জিয়াউদ্দিন আহমেদ বীর উত্তম উল্লেখযোগ্য। পরে মতবিরোধের কারণে তিনি সিরাজ সিকদারের দলত্যাগ করেন। পরে ৯০’র দশকে চট্টগ্রাম ওয়াসার চেয়ারম্যান পদে কিছুদিন কাজ করেন।
কর্নেল তাহেরের সীমাবদ্ধতা : এককালের পেশাগত সৈনিক, মুক্তিযোদ্ধা ও পরবর্তী সময়ে সমাজতন্ত্রী কর্নেল তাহের জাসদ নেতাদের কথায় যেমন খুব অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন, তেমনি তাদের অতিরঞ্জিত কথায় ও আশ্বাসে খুব বিশ্বাস করেছিলেন।
স্বল্পসংখ্যক অনুগত সৈনিক ছাড়া গোটা সেনাবাহিনীতে কর্নেল তাহেরের তেমন কোনো সমর্থন ছিল না বললে ভুল বলা হবে না। একইসঙ্গে জাসদ নেতারা তাদের প্রতিশ্রুতি মোতাবেক জনসমর্থনের এক শতাংশও রাজপথে নামাতে ব্যর্থ হন। তাই ক্যান্টনমেন্টের ভেতরে ও বাইরের পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ দ্রুত কর্নেল তাহেরের হাতছাড়া হয়ে যায়।
অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাস কর্নেল তাহেরের জন্য কাল হয়ে দাঁড়িয়েছিল। নির্মল সেনের সঙ্গে সাক্ষাৎকারে (কর্নেল তাহেরের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত) তিনি দাবি করেছিলেন বা বিশ্বাস করতেন, তার কিছু হলে সব ক্যান্টনমেন্টে বিদ্রোহের আগুন জ্বলে উঠবে! কিন্তু বাস্তবে তার কিছুই হয়নি।
ঢাকা ক্যান্টনমেন্টের সিগন্যাল, সাপ্লাই ও করণিক সিপাহিদের মধ্যেই কর্নেল তাহেরের ‘বিপ্লবী সৈনিক সংস্থা’র কার্যকলাপ ও প্রভাব সীমাবদ্ধ ছিল। ১৫ আগস্ট অভ্যুত্থানে অংশগ্রহণকারী ২ ইউনিট, ২ ফিল্ড রেজিমেন্ট ও বেঙ্গল ল্যান্সার বা ট্যাঙ্ক ইউনিট, নিজেদের স্বার্থেই এ বিদ্রোহে যোগ দেয়। তাদের আনুগত্য বরাবরই ছিল মোশতাক এবং ফারুক-রশীদ গংয়ের প্রতি, তাহেরের প্রতি নয়।
৩ নভেম্বর ফারুক-রশীদ গং দেশ ছাড়তে বাধ্য হলে তারা সামরিক নেতৃত্বহীন হয়ে পড়ে এবং এ দুটি ইউনিট মোশতাক কর্তৃক নিয়োজিত সেনাপ্রধান জেনারেল জিয়াউর রহমানের প্রতি স্বাভাবিক কারণেই আনুগত্য প্রকাশ করে। কারণ জেনারেল সফিউল্লাহর স্থলে জেনারেল জিয়াউর রহমানকে মোশতাক গংই সেনাপ্রধান নিযুক্ত করেন।
সেনাবাহিনী থেকে তিন বছর আগে রিটায়ার্ড ও সেনাবাহিনীর সঙ্গে সংস্পর্শহীন ‘ক্লাসলেস আর্মি’র প্রবক্তা কর্নেল তাহেরের সমর্থন এমনিতেই অফিসার পর্যায়ে ছিল প্রায় শূন্যের কোঠায়। শুধু মেজর জিয়াউদ্দিন (শরণখোলা থানা আক্রমণের নেতা, বর্তমানে চিংড়ি ব্যবসায়ী, যিনি দুবলার চরের জিয়াউদ্দিন নামে পরিচিত) ছাড়া আর কোনো সামরিক অফিসারকে তিনি দলে টানতে পারেননি! নিয়ন্ত্রণহীন, উচ্ছৃঙ্খল সৈনিকদের অফিসার হত্যার ফলে কর্নেল তাহের সেনাবাহিনীর অফিসারদের কাছে একেবারে অগ্রহণযোগ্য হয়ে পড়েন। তাহেরের পায়ের নিচ থেকে খুবই দ্রুত মাটি সরে যেতে থাকে। জাসদের গণবাহিনী ‘কাগুজে বাঘ’ বলে প্রতীয়মান হয়।
খালেদ মোশাররফের মতো তাহেরও রেডিওতে ভাষণ না দিয়ে ব্যাপক পরিচিত হওয়ার বা তার উদ্দেশ্য প্রচারের সবচেয়ে বড় সুযোগটি হেলায় হারান! সিজিএস হিসেবে খালেদ মোশাররফের সেনাবাহিনীতে ব্যাপক ও জনসাধারণের মধ্যে প্রয়োজনীয় পরিচিতি থাকলেও সেনাবাহিনী থেকে তিন বছর আগে রিটায়ার্ড তাহেরের পরিচিতি শুধু তার সমর্থকদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ করে দিয়েছিল। বিপ্লব সফল করার জন্য তার বিপ্লবের আদর্শ বা উদ্দেশ্য কী ছিল, তা অন্যান্য ক্যান্টনমেন্টের সিপাহিদের এবং জনসাধারণের কাছে পৌঁছানোর খুবই প্রয়োজন ছিল।
এর বিপরীতে আমরা দেখতে পাই, তাহেরের কথা অনুসারে জিয়াউর রহমান রেডিও স্টেশনে না গিয়েও (যেহেতু রেডিও স্টেশন ক্যান্টনমেন্টের বাইরে এবং তা দুপুর পর্যন্ত তাহেরের সমর্থকদের নিয়ন্ত্রণে ছিল) পরে তার ভাষণ রেকর্ড করে প্রচারের জন্য রেডিও স্টেশনে পাঠিয়ে দেন। রেডিওতে নাম প্রচারের সুফল যে কতটা ফলপ্রসূ, তা ৭১ সালেই জিয়াউর রহমান বুঝেছিলেন। জিয়াউর রহমান তার ভাষণ ‘বিসমিল্লাহ’ দিয়ে শুরু করেন এবং ‘বাংলাদেশ জিন্দাবাদ’ দিয়ে শেষ করেন এবং একইসঙ্গে তার রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি সম্পর্কে সুস্পষ্ট ইঙ্গিত দিয়ে দেন।
ক্ষমতার লড়াই ও তাহেরের হিসাবে গরমিল! সামরিক বাহিনীর রিটায়ার্ড এবং স্মার্ট অফিসার কর্নেল তাহের যে কোন হিসাবে ধরে নিয়েছিলেন তৎকালীন সেনাপ্রধান জেনারেল জিয়া তার কথা মতো চলবেন; তার হিসাব মেলানো সত্যিই অসম্ভব! সেনাপ্রধান জেনারেল জিয়া সেনাবাহিনীতে তাহেরের চেয়ে অনেক অনেক বেশি পরিচিত, সিনিয়র এবং জনপ্রিয় ছিলেন। ‘আর্মির চেইন অফ কমান্ড’ অনুযায়ী সব অফিসার সেনাপ্রধান জেনারেল জিয়ার কমান্ড ফলো করতে বাধ্য ছিল। অন্যদিকে যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা তাহেরের ব্যাপারে কারও কারও সহানুভূতি থাকলেও তার বিপ্লবের প্রতি কারও কোনো সমর্থন ছিল না।
জেনারেল জিয়াউর রহমান প্রথমে তাকে উদ্ধার করার জন্য কর্নেল তাহেরের কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করলেও নিজের অবস্থা সংহত করার পর থেকেই স্বাভাবিক কারণেই জেনারেল জিয়াউর রহমান কর্নেল তাহেরের সঙ্গে দূরত্ব বজায় রাখেন। জিয়া হাতছাড়া হয়ে যাওয়ার পর কর্নেল তাহের আবার বিদ্রোহের চেষ্টা চালাতে থাকেন এবং একপর্যায়ে কর্নেল তাহের ঢাকা ইউনিভার্সিটির এসএম হলের হাউস টিউটরের বাসা এবং হাসানুল হক ইনু হাতিরপুল এলাকা থেকে গ্রেফতার হন।
পরবর্তীকালে জেনারেল জিয়াউর রহমান কর্তৃক গঠিত সামরিক ট্রাইব্যুনাল কর্নেল তাহেরকে দোষী সাব্যস্ত করে এবং ১৯৭৬ সালের ২১ জুলাই ঢাকা সেন্ট্রাল জেলে এ ফাঁসি কার্যকর করা হয়। এভাবেই জেনারেল জিয়াউর রহমানকে সামনে রেখে কর্নেল তাহেরের মাধ্যমে জাসদের ক্ষমতা দখলের ফর্মুলা ব্যর্থ প্রমাণিত হয়। আর এ এক্সপেরিমেন্টের মূল্য হিসেবে দিতে হয় কর্নেল তাহেরের জীবন দিয়ে।
ব্রিগেডিয়ার সাখাওয়াত হোসেনের ভাষ্যমতে, তাহেরের প্লান ছিল, অফিসার হত্যার মধ্য দিয়ে আর্মির চেইন অফ কমান্ড ধ্বংস করে, আর্মির নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেয়া (এবং পরবর্তী সময়ে সুবিধাজনক অবস্থায় জেনারেল জিয়াকে হত্যা করা)। সাবেক আর্মি ইন্টেলিজেন্স অফিসার, সেনাপ্রধান জেনারেল জিয়ার পক্ষে সে উদ্দেশ্য বুঝতে খুব একটা দেরি হয়নি; তাই সময়মতো জিয়াই তাহেরকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে দেন। তাহের যেহেতু অনেকটা ‘ওয়ান ম্যান শো’ ছিলেন, তাই তার মৃত্যুর মধ্য দিয়ে তার স্বপ্নের সমাধি ঘটে।
জাসদের ভাষ্য ও দাবি অনুযায়ী, ‘তাহের জিয়ার প্রাণ রক্ষা করেন এবং জিয়া তার প্রতিদানে তাহেরের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেন এবং পরবর্তী সময়ে তাহেরকে ফাঁসি দেন!’ ব্যাপারটা কি আসলে তাই? মোটেই তা নয়। খালেদ মোশাররফ এবং শাফায়াত জামিল চাইলে ৩ নভেম্বরই জিয়াউর রহমানকে হত্যা করতে পারতেন। তারা শুধু জিয়াউর রহমানকে গৃহবন্দি করে রাখেন। তাই জিয়াউর রহমানের প্রাণ রক্ষা করার দাবি ধোপে টিকবে না। আর জিয়াউর রহমানকে মুক্ত করার দাবিদার ২ ফিল্ড রেজিমেন্টের সৈনিকরা। তবে তাহেরের সিপাহি বিদ্রোহ যে সেই মুক্ত করার পরিবেশ ও সুযোগ তৈরি করে দিয়েছিল, তা অবশ্যই স্বীকার করতে হবে।
জেনারেল জিয়া : অসাধারণ ইন্টুইসন, দ্রুত পরিস্থিতি অনুধাবন ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের অধিকারী ও স্মার্ট জেনারেল জিয়াউর রহমান মুক্ত হওয়ার পর সরাসরি তার প্রতি অনুগত ২ ফিল্ড রেজিমেন্টে চলে যান এবং নিজস্ব অবস্থান সুসংহত করেন। উল্লেখ্য, এ ২ ফিল্ড রেজিমেন্ট রশীদের নেতৃত্বে ১৫ আগস্ট অভ্যুত্থানে অংশগ্রহণকারী দুটি ইউনিটের একটি, অন্যটি ফারুকের নেতৃত্বাধীন বেঙ্গল ল্যান্সার বা ট্যাঙ্ক ইউনিট। এখানে আরও উল্লেখযোগ্য, ৩ নভেম্বরের অভ্যুত্থানে খালেদ মোশাররফ, শাফায়াত জামিলের নেতৃতে ৪৬ ইনফ্যান্ট্রি ব্রিগেডের ১ম, ২য় ও ৪ বেঙ্গল অংশগ্রহণ করে। অভ্যুত্থান ব্যর্থ হয়ে যাওয়াতে এ তিনটি ইউনিট নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়ে। ফলে ২ ফিল্ড রেজিমেন্ট ও বেঙ্গল ল্যান্সার বা ট্যাঙ্ক ইউনিট ঢাকা ক্যান্টনমেন্টের মূল চালিকাশক্তিতে পরিণত হয়!
নিরপেক্ষ বিচারে ৭ নভেম্বর হচ্ছে জেনারেল জিয়াউর রহমানের জীবনের চরম ও উজ্জ্বলতম ক্ষণ। ১৯৭১ সালে ‘সঠিক সময়ে সঠিক জায়গায়’ থাকার কারণে প্রথম সামরিক অফিসার হিসেবে জিয়াউর রহমান বঙ্গবন্ধুর পক্ষে স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠ করেন; যা মানুষকে সাহস জোগায়। সেখানে মেজর রফিক বা মেজর সফিউল্লাহ ঘোষণা পাঠ করলেও ফলাফল একই হতো, দেশ একই দিনে, ১৬ ডিসেম্বরই স্বাধীন হতো, কোনো হেরফের হতো না।
অন্যদিকে ৭ নভেম্বর জেনারেল জিয়াউর রহমান ছিলেন সেনাপ্রধান। একদিকে বঙ্গবন্ধু ও জাতীয় চার নেতা নিহত। অন্যদিকে জেনারেল সফিউল্লাহ অপসারিত, সিজিএস খালেদ মোশাররফ ও রংপুর ব্রিগেড কমান্ডার কেএন হুদা নিহত।
একদিকে নেতৃত্বে চরম শূন্যতা অন্যদিকে সিপাহি বিদ্রোহ কর্নেল তাহেরের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে, যা যে কোনো সময় অন্য ক্যান্টনমেন্টগুলোতে ছড়িয়ে পড়তে পারে। ঠিক সেই সময় জেনারেল জিয়াউর রহমানের সঠিক নেতৃত্ব সেনাবাহিনীকে অনেক প্রাণহানি ও চরম বিপর্যয়ের হাত থেকে বাঁচায়; কিন্তু পরবর্তী সময়ে জেনারেল জিয়া সেনানিবাসে থেকে রাজনৈতিক দল গঠন করলে স্বাধীনতা এবং মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতাকারী মুসলিম লীগ, নেজামে ইসলাম, জামায়াতে ইসলামী এবং ভাসানী ন্যাপের নেতারা (শাহ আজিজ, কাজী কাদের, আবদুল আলীম, মশিউর রহমান যাদু মিয়া, কাজী জাফর, সাকা চৌধুরী, আবুল হাসনাত) তার দলে যোগ দেন। ৭ নভেম্বরকে তাই স্বাধীনতা এবং মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতাকারীদের পুনরুত্থান এবং সংহতি দিবস বলা যেতে পারে।
জাসদের হঠকারী ও অদূরদর্শী রাজনীতি : জাসদের স্বপ্নদ্রষ্টা বা মূল হোতা সিরাজুল আলম খানের মতো মেধাবী, তাত্ত্বিক; কিন্তু বিপথগামী, ক্ষমতালিপ্সু এবং হঠকারী নেতাদের কারণে স্বাধীনতা-পরবর্তী (১৯৭২-১৯৭৫), অনেক প্রতিভাবান যুবক অকারণে জীবন বিসর্জন দিয়েছিল (কর্নেল তাহেরের ওয়েবসাইটে ‘প্রেরণা’র মুখ দেখুন)।
গণবাহিনীর মতো সংগঠনে যোগ দিয়ে অকারণে জীবন ও ভবিষ্যৎ বিসর্জন দিয়েছিল হাজার হাজার সম্ভাবনাময় তরুণ ও যুবক। একইসঙ্গে মেধাবী ও ক্ষমতালোভী এ তাত্ত্বিক নেতা নিজের ও দলের সীমাবদ্ধতা, বাংলাদেশের মানুষের মনমানসিকতা, সামাজিক ও অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপট, ধর্মীয় প্রভাব বুঝতে ব্যর্থ হয়েছিলেন। তাই তাদের শ্রেণি সংগ্রামের স্বপ্ন এ দেশের মাটিতে কখনই দৃঢ় শেকড় গাড়তে পারেনি।
সিরাজুল আলম খান ও তার অনুসারীরা স্বাধীনতার পর থেকেই নিজেদের ওভারএস্টিমেট করেছিলেন। তারা সবকিছুই তাড়াহুড়া করতে গিয়ে বারবার নিজেদের দলের বিপর্যয় ডেকে আনা ছাড়াও সদ্য স্বাধীন দেশে অস্থির পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছিলেন।
একই সময়ে জাসদ বঙ্গবন্ধুর মতো নেতাকে চ্যালেঞ্জ করার মধ্য দিয়ে নিজেদের দুর্বলতা বা সীমাবদ্ধতাই জনসমক্ষে প্রকাশ করে দেয়! একই সময়ে স্বাধীনতা যুদ্ধে পরাজিত মৌলবাদী শক্তিও তাদের ‘শেল্টারে’ এসে আশ্রয় নিয়েছিল। তাই আমরা দেখতে পাই, জিয়াউর রহমান ধর্মভিত্তিক রাজনীতির অনুমতি দেয়ার পর থেকেই জাসদের জনসমর্থন কর্পূরের মতো উবে যায়।
এ প্রসঙ্গে কয়েকটি উদাহরণ দেয়া যেতে পারে। ১৯৭৪-এ কুচক্রী মোশতাকের কুপরামর্শে বঙ্গবন্ধু তার সবচেয়ে মেধাবী ও যোগ্য সহকর্মী তাজউদ্দীন আহমদকে অবমূল্যায়ন করে দূরে সরিয়ে দেন। নির্লোভ ও বুদ্ধিমান তাজউদ্দীন আহমদ কিন্তু বঙ্গবন্ধুকে চ্যালেঞ্জ করেননি।
৩ নভেম্বর জেলহত্যার শিকার না হলে বঙ্গবন্ধুর অবর্তমানে তাজউদ্দীন আহমদই যে আরও একবার আওয়ামী লীগের হাল ধরতেন, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। আমরা দেখতে পাই মাও সে তুংয়ের সঙ্গে মতভেদ থাকা সত্ত্বেও শুধু ধৈর্য ধরার কারণে দেং জিয়াও পিং, (একযুগের পর মাও সে তুংয়ের মৃত্যুর পর) তার অনুসারীদের নিয়ে চীনের নীতিনির্ধারক হন!
সিরাজুল আলম খান ও তাদের অনুসারীরা সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশে অনেক গঠনমূলক ভূমিকা রাখতে পারতেন। আওয়ামী লীগ ত্যাগ না করলে ’৭৫-এর আগে তারা মোশতাকের মতো প্রতিক্রিয়াশীলদের বিপক্ষে তাজউদ্দীন আহমদের মতো প্রগতিশীল নেতাদের পক্ষে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে পারতেন। আর ’৭৫-এর ট্র্যাজেডির পর নিশ্চিতভাবে তারাই হতে পারতেন ( রাজ্জাক-তোফায়েলের জায়গায়) আওয়ামী লীগের কাণ্ডারি। দেং জিয়াও পিংয়ের মতো সিরাজুল আলম খান ও তার অনুসারীদের হয়তো এত বছর অপেক্ষা করতে হতো না।
সিরাজুল আলম খান (এক সময় দাদা নামে কর্মীদের মধ্যে ব্যাপক জনপ্রিয় থাকলেও পরবর্তী সময়ে তার হঠকারী ও ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপের জন্য ‘কাপালিক’ নামেই বেশি পরিচিতি পান) বীর মুক্তিযোদ্ধা কর্নেল তাহেরকে ফাঁসির মঞ্চের দিকে ঠেলে দিয়ে, হাজার হাজার মেধাবী তরুণ-যুবকের জীবন, মেধা ও সম্ভাবনার অপমৃত্যু ঘটিয়ে এখন স্বাভাবিক জীবনযাপন করছেন।
কর্নেল তাহেরের আগে সবার অলক্ষ্যে জাসদের অনুসারী আরেক দেশপ্রেমিক, বুয়েটের লেকচারার নিখিল সাহা ২৬ নভেম্বর ১৯৭৪-এ প্রাণ দেন। নিখিল সাহা তার উদ্ভাবিত গ্রেনেড, যা ‘নিখিল বোমা’ নামে গণবাহিনীর মধ্যে জনপ্রিয় ছিল, তার চূড়ান্ত পরীক্ষাকালে (জার্মানিতে পিএইচডি করতে যাওয়ার মাত্র কয়েকদিন আগে) বিস্ফোরণে নিহত হন। মেধার কী দারুণ অপচয়!
ভাগ্যের কী নির্মম পরিহাস, সিরাজুল আলম খানের যে অনুসারীরা, যেমন- রব, ইনু, বেলাল (৭২-৭৫) বঙ্গবন্ধুর চরম বিরোধিতা করেছিল; তারাই নিজেদের সীমাবদ্ধতা এবং বাস্তবতা বুঝতে পেরে দুই যুগ পর বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার উদারতায় মন্ত্রী, এমপি হয়েছেন!!
এক মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের কাহিনী : বীর মুক্তিযোদ্ধা কর্নেল তাহেরের আদর্শ ও দেশপ্রেম অনেক মেধাবী তরুণ, যুবককে অনুপ্রাণিত করেছিল, যেমনটি করেছিল তার তিন সহোদরকে। কর্নেল তাহের পরিবারই বাংলাদেশের একমাত্র পরিবার যার চার সদস্য মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করে বীরত্বের জন্য খেতাব পেয়েছেন।
তাহেরের অনুজ ওয়ারেসাত হোসেন বেলাল বীরপ্রতীক একসময়ের জাসদের গণবাহিনীর সক্রিয় জানবাজ সদস্য, অনেক ঘাত-প্রতিঘাত (প্রথমে ভারতীয় হাইকমিশনার সমর সেনকে অপহরণের চেষ্টাকালে আহত এবং পরে কারাবাস, ৮০’র দশকে লেবানন-এ ইসরাইলি আগ্রাসনের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী) অতিক্রম করে মুক্তিযুদ্ধের মূলধারায় ফিরে এসেছেন। তিনি এখন জাতীয় সংসদে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ দলীয় সংসদ সদস্য।
অন্য দুই সহোদর প্রয়াত আবু ইউসুফ খান, বীরবিক্রম ও সাখাওয়াত হোসেন বাহার, বীরপ্রতীক খেতাবপ্রাপ্ত বীর মুক্তিযোদ্ধা। সাখাওয়াত হোসেন বাহার বীরপ্রতীক কর্নেল তাহেরকে মুক্ত করার জন্য ভারতীয় হাইকমিশনার সমর সেনকে ‘জিম্মি হিসেবে’ অপহরণের চেষ্টাকালে আরও তিনজন গণবাহিনীর সদস্যদের সঙ্গে ধানমণ্ডি দুই নম্বর রোডে ভারতীয় হাইকমিশনে নিহত হন।
কর্নেল তাহের গ্রেফতার হওয়ার পর জাসদ বা তার গণবাহিনীর ভিত্তি যে কতটা দুর্বল, তা জনসমক্ষে চলে আসে। শুধু তাহেরের দুই ভাই ও চার গণবাহিনীর বন্ধু মিলে ২৬ নভেম্বর ’৭৫ ভারতীয় হাইকমিশনার সমর সেনকে অপহরণের মাধ্যমে জিম্মি করে ‘মুক্তিপণ’ হিসেবে কর্নেল তাহেরকে মুক্ত করার ব্যর্থ চেষ্টা করেন।
শেষ স্মৃতি : ২৬ নভেম্বর সকালে ইউনিভার্সিটি ল্যাবরেটরি স্কুলে ক্লাস নাইনের ফাইনাল পরীক্ষা চলছিল। সকালে স্কুলে যাওয়ার পথে দেখি, সবসময় টিশার্ট পরা দুই ভাই, বাহার ও বেলাল, ‘স্যুট’ পরে মোটরসাইকেল স্টার্ট দিচ্ছে! দুই ভাইকে স্যুটেড-বুটেড অবস্থায় দেখে আমি কিছুটা অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকলে বাহার হেসে ফেলে আর আমি স্কুলের পথে পা চালাই। পরীক্ষা শেষে বাসায় ফেরার সময় কর্নেল তাহেরের ওপর তলার বারান্দা থেকে তুহিন জানাল, ‘ওই শুনছস, ইন্ডিয়ান হাইকমিশনে বাহার মারা গ্যাছে’! দুপুর বারোটার খবরে শুনলাম, ইন্ডিয়ান হাইকমিশনের সেই মিশনে বাহারসহ চারজন নিহত হয়; আহত অবস্থায় বেলাল ও আরেকজন ধরা পড়ে। আজও মনে পড়ে, মৃত্যুর ঘণ্টাখানেক আগে বাহারের সেই হাসিটি।
ইতিহাসের শিক্ষা : রাজনীতিকদের নিজের সীমাবদ্ধতা সম্পর্কে এবং রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বীদের ক্ষমতা ও গ্রহণযোগ্যতা সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণা থাকা এবং সেইসঙ্গে দেশ ও মানুষের মনমানসিকতা, সামাজিক ও অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপট, ধর্মীয় প্রভাব বুঝতে পারাটা যে কত জরুরি, তা কর্নেল তাহেরের মর্মান্তিক পরিণতিই স্মরণ করিয়ে দেয়। শুধু সৎ ও দেশপ্রেমিক হলেই যে কোনো রাজনৈতিক বা ব্যক্তিগত মতবাদ সাধারণ মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য হবে- এমন কোনো গ্যারান্টি নেই। বাংলাদেশে, বিশেষত চরম ডান বা বাম দলের আবেদন কোনোকালেই গ্রহণযোগ্য হয়নি।
কর্নেল তাহেরের নেতৃত্বে সিপাহিরা যে দাবি পেশ করে, জিয়াউর রহমান তার কিছু কিছু মেনে নেন; ফলে সিপাহিদের মধ্যে জিয়াউর রহমানের গ্রহণযোগ্যতা অনেক বেড়ে যায়। এখানে লক্ষ করার বিষয় হল, কর্নেল তাহের ও কর্নেল জিয়াউদ্দিন দু’জনই স্বাধীনতার পরপর কুমিল্লা ও ঢাকা ব্রিগেড কমান্ডার ছিলেন। এ দুই চৌকস মুক্তিযোদ্ধা অফিসার পদত্যাগ না করে সেনাবাহিনীতে থেকে চেষ্টা করলে সেনাবাহিনীর মধ্যে আরও অনেক সহজে, অনেক আগেই, সব না হলেও কিছু দাবি পূরণ করা সম্ভব হতো।
যদিও বলা হয়ে থাকে, কোনো আত্মদানই বৃথা যায় না- কথাটা কতটুকু সত্য, তা নিয়ে মতভেদ আছে; কিন্তু ইতিহাস প্রমাণ করে, ভুল নেতৃত্বের নির্দেশনার জন্য অনেক আত্মত্যাগই অপচয়ের কাছাকাছি পর্যায়ে চলে যেতে পারে। কর্নেল তাহেরের ‘মত ও পথ’ নিয়ে অনেক বিতর্কের অবকাশ থাকলেও দেশ ও দেশের মানুষের জন্য তার ও তার পরিবারের সততা, ভালোবাসা ও আত্মত্যাগ নিয়ে কোনো তর্কের অবকাশ নেই।
৭০-৮০’র দশকে ঢাকার দেয়ালে জাসদের লিখন ছিল, ‘বিপ্লব ধ্বংসের তাণ্ডবলীলা নয়, সৃষ্টির প্রসব বেদনা মাত্র’। সিরাজুল আলম খানের ব্রেইন চাইল্ড- জাসদ, বিপ্লবের নামে অনেক অমূল্য প্রাণ ধ্বংস করলেও অরাজকতা এবং রব, শাজাহান সিরাজ, ইনুর মতো হাজারও দেশপ্রেমিক ছাত্র, যুবককে বিভ্রান্ত করা ছাড়া আর কোনো কিছুই সৃষ্টি করতে পারেনি। সিরাজুল আলম খানের মতো হাতুড়ে ডাক্তারের ভুল প্রেসক্রিপশনের ফলে বারবার জাসদের নরমাল ডেলিভারির বদলে মিসক্যারেজ হয়েছে। সেই মিসক্যারেজের রক্তক্ষরণ হিসেবে ঝরে গেছে কর্নেল তাহের ও নিখিল সাহার মতো অজস্র দেশপ্রেমিকের জীবন।
নাজমুল আহসান শেখ : প্রকৌশলী
victory1971@gmail.com