স্বদেশ ভাবনা
কঠিন হলেও বাস্তবায়ন নিশ্চিত করতে হবে
আবদুল লতিফ মন্ডল
প্রকাশ: ০৫ নভেম্বর ২০১৯, ০১:০০ পিএম
প্রিন্ট সংস্করণ
সরকার আসন্ন আমন মৌসুমে ধান ও চাল সংগ্রহের নীতিমালা ঘোষণা করেছে। ঘোষিত নীতিমালা অনুযায়ী, আসন্ন আমন মৌসুমে ১০ লাখ টন ধান ও চাল সংগ্রহ করবে সরকার। এর মধ্যে ছয় লাখ টন ধান, সাড়ে তিন লাখ টন সিদ্ধ ও ৫০ হাজার টন আতপ চাল সংগ্রহ করা হবে।
এবার প্রতি কেজি ধান ২৬ টাকা, সিদ্ধ চাল ৩৬ টাকা ও আতপ চাল ৩৫ টাকা দরে কেনা হবে। আগামী ২০ নভেম্বর থেকে ধান এবং ১ ডিসেম্বর থেকে চাল কেনা শুরু হয়ে এ কার্যক্রম ২৮ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত চলবে। আগামী ১০ নভেম্বরের মধ্যে কৃষকদের তালিকা ইউনিয়ন পরিষদে জমা দিতে হবে। এরপর যাচাই করে তা চূড়ান্ত করা হবে। গত ৩১ অক্টোবর বাংলাদেশ সচিবালয়ে খাদ্য পরিকল্পনা ও পরিধারণ কমিটির সভায় এসব নীতিনির্ধারণী সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।
এবার আমন ধান ও চাল সংগ্রহে সরকার যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে তাকে ব্যতিক্রমধর্মী বললে বোধহয় অত্যুক্তি হবে না। এর কারণ- এক. বেশ ক’বছর পর এবার আমন মৌসুমে সরকার ধান কেনার সিদ্ধান্ত নিল; দুই. সংগ্রহের জন্য নির্ধারিত মোট ১০ লাখ টন চাল তৈরির জন্য যে ধান ক্রয় করা প্রয়োজন হবে, তার বেশিরভাগ কেনা হবে সরাসরি কৃষকের কাছ থেকে। আর সরকারনির্ধারিত দামে খাদ্য অধিদফতরকে চাল সরবরাহ করতে যেসব চালকল মালিক দফতরটির সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হবেন, তারা বাজার থেকে প্রয়োজনীয় অবশিষ্টাংশ ধান কিনবেন।
সরাসরি কৃষকদের কাছ থেকে ছয় লাখ টন আমন ধান কেনার সিদ্ধান্তটি যতটা ভালো, একাধিক কারণে এর বাস্তবায়ন ততটা সহজ হবে না। কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে- এক. সরকারের ধান ও চাল সংগ্রহের মূল উদ্দেশ্য হল ধান কাটা ও ঘরে তোলার মৌসুমে বাজারে দাম স্থিতিশীল রাখা, যাতে ধানচাষীরা ক্ষতিগ্রস্ত না হন এবং অধিক পরিমাণে ধান উৎপাদনে উৎসাহিত হন।
অন্যান্য উদ্দেশ্যের মধ্যে রয়েছে- সরকারি গুদামে চালের নিরাপত্তা মজুদ গড়ে তোলা, বাজারে চালের দাম বাড়লে সরকারি মজুদ থেকে খোলাবাজারে ও ন্যায্যমূল্যের দোকানে চাল বিক্রির মাধ্যমে দাম স্থিতিশীল রাখা এবং সরকারের লক্ষ্যমুখী খাদ্য বিতরণ কর্মসূচির বাস্তবায়ন করা।
আমাদের দেশে ধানচাষীদের বেশিরভাগই ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক। তারা ধারদেনা করে ফসল ফলান। এ ছাড়া তাদের সংসারে নানা অভাব-অনটন লেগেই থাকে। ফলে ধান কাটার পরপরই বহু কষ্টে ফলানো ফসল বিক্রি করতে বাজারে নিতে হয়।
ধান বিক্রির টাকা দিয়ে তাদের পরিশোধ করতে হয় ধারদেনা, মেটাতে হয় পরিবারের ন্যূনতম চাহিদা। আগামী ২০ নভেম্বর থেকে কেজিপ্রতি ২৬ টাকা দরে সরকার ধান কিনবে বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
কিন্তু এর আগে সরকার আমন ধান না কেনায় বা কৃষকদের কাছ থেকে সরাসরি খুবই কম পরিমাণ ধান কেনার সিদ্ধান্ত নিয়েও ধান কাটা মৌসুমের শুরুতে সংগ্রহ অভিযান শুরু না করায় কৃষকরা, বিশেষ করে, ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক চাষীরা চালকল মালিকদের সিন্ডিকেটের কাছে কম দামে তাদের উৎপাদিত পণ্যটি বিক্রি করতে বাধ্য হয়েছেন। এতে তারা আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। এ বছরও আমন মৌসুমের শুরুতেই ধান সংগ্রহ অভিযান পুরোদমে শুরু না করলে যে একই অবস্থার পুনরাবৃত্তি হবে না তার নিশ্চয়তা কোথায়?
দুই. সরকার সরাসরি ধানচাষীদের কাছ থেকে ধান কেনার সিদ্ধান্ত নিলেও মাঠ পর্যায়ে যারা এ দায়িত্বে থাকেন, তাদের ধানচাষীদের চেয়ে ফড়িয়া বা সিন্ডিকেটের লোকজনের কাছ থেকে ধান কিনতে বেশি আগ্রহী দেখা যায়।
ধানচাষীদের ধান ক্রয় কেন্দ্রে নানারকম অসুবিধার সম্মুখীন হতে হয়। তাই তারা ফড়িয়া ও সিন্ডিকেটের লোকদের কাছে সরকারনির্ধারিত দামের চেয়ে কম দামে ধান বিক্রি করতে বাধ্য হন। এতে ধানচাষীরা সরকারনির্ধারিত মূল্য থেকে বঞ্চিত হন। অভিযোগ রয়েছে, ফড়িয়া ও সিন্ডিকেটের লোকজন প্রকৃত কৃষকদের কার্ড ম্যানেজ করে সরকারি গুদামে ধান বিক্রি করে। ক্ষমতাসীন দলের তৃণমূল পর্যায়ের নেতাকর্মীরাই সাধারণত সিন্ডিকেট গঠনের ভূমিকায় অবতীর্ণ হন। এবারও এর থেকে বেরিয়ে আসা সহজ হবে না।
তিন. ধানচাষীরা সংগ্রহযোগ্য ধানের বিনির্দেশ যথা- আর্দ্রতা, বিজাতীয় পদার্থ, চিটা ইত্যাদির সর্বোচ্চ গ্রহণযোগ্য পরিমাণ সম্পর্কে তেমন সচেতন নন। সংগ্রহযোগ্য ধানে এসব বিনির্দেশ গ্রহণযোগ্য পরিমাণে বিদ্যমান না থাকলে ধানচাষীরা সরকারি ক্রয় কেন্দ্রে ধান বিক্রি করতে পারেন না। সরকারের পক্ষ থেকে সংগ্রহযোগ্য ধানের বিনির্দেশ সম্পর্কে চাষীদের সচেতন করার তেমন পদক্ষেপ না নেয়ায় একদিকে তারা সরকারি ক্রয় কেন্দ্রে ধান বিক্রি করতে পারছেন না, অন্যদিকে সরকারও বিনির্দেশ পূরণকারী ধান কিনতে অসুবিধার সম্মুখীন হচ্ছে।
চার. ইতঃপূর্বে সরকার আমন ধান কেনায় খুব কম আগ্রহ দেখিয়েছে। ধানচাষীরাও সরকারনির্ধারিত দামে আমন ধান বিক্রিতে উৎসাহ দেখাননি। ক্রমাগতভাবে উৎপাদন ব্যয় বৃদ্ধি পাওয়ায় কৃষকরা কেজিপ্রতি ২৬ টাকা দামে ধান বিক্রি করতে কতটা আগ্রহী হবেন, তা এ মুহূর্তে নিশ্চিত করে বলা কঠিন।
পাঁচ. প্রচলিত অভ্যন্তরীণ ধান-চাল সংগ্রহ নীতিমালায় সরকার চাল সংগ্রহের জন্য চালকল মালিকদের ওপর সম্পূর্ণভাবে নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে। ২০০৬ সালের জাতীয় খাদ্যনীতিতে উন্মুক্ত প্রতিযোগিতার মাধ্যমে অভ্যন্তরীণ বাজার থেকে খাদ্যশস্য কেনার বিধান থাকলেও তা বাস্তবায়িত হচ্ছে না।
এ সুযোগের সদ্ব্যবহার করছেন চালকল মালিকরা। তারা সিন্ডিকেশনের মাধ্যমে শুধু চালের সংকট তৈরি করে মুনাফা লোটেন না, অভ্যন্তরীণ ধান-চাল (আমন ও বোরো) সংগ্রহ অভিযানেও সরকারকে প্রভাবিত করার চেষ্টা করেন।
তারা অভ্যন্তরীণ ধান-চাল সংগ্রহে চালের উচ্চমূল্য দাবি করেন এবং ধান কেনায় সরকারকে নিরুৎসাহিত করেন অথবা ধানের দাম কম রাখার জন্য সরকারকে চাপ দেন। কারণ সরকার ধান না কিনলে ধানের দাম কম থাকে এবং তারা কম দামে ধান কিনে বিপুল মজুদ গড়তে পারেন। ধান কাটার মৌসুম শেষে যখন ক্ষুদ্র, প্রান্তিক ও মাঝারি কৃষকের কাছে ধান মজুদ থাকে না, তখন তারা মজুদ ধান চালে রূপান্তর করে চুক্তি অনুযায়ী সরকারকে সরবরাহ করেন এবং সিন্ডিকেশনের মাধ্যমে চালের বাজার নিয়ন্ত্রণ করে অবশিষ্ট চাল উচ্চমূল্যে বিক্রি করে প্রচুর লাভ করেন।
গত বছরের মতো এ বছরও চালকল মালিকদের কাছ থেকে সংগ্রহতব্য আমন চালের কেজিপ্রতি দাম ৩৬ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। পার্থক্য হচ্ছে, এবার চালকল মালিকদের কাছ থেকে সংগ্রহতব্য অধিকাংশ চালের জন্য সরকার ধান কিনে তাদের সরবরাহ করবে।
গত ক’বছর সরকার আমন ধান না কেনায় এবং ধানের দাম নির্ধারণ করে না দেয়ায় চালকল মালিকরা কম দামে ধান কেনার যে সুযোগ পেয়েছিলেন, এবার তা থেকে তারা কিছুটা হলেও বঞ্চিত হবেন। তাই এবার কেজিপ্রতি ৩৬ টাকা দরে সরকারকে চাল সরবরাহে তারা কতটা সহযোগিতা করবেন, তা দেখার জন্য অপেক্ষা করতে হবে। কারণ ইতঃপূর্বে ধান-চাল সংগ্রহ অভিযান চলাকালে চুক্তিবদ্ধ দামে চাল সরবরাহে তাদের অস্বীকৃতি জানানো এবং চালের দাম বাড়িয়ে দিতে সরকারকে বাধ্য করার নজির রয়েছে।
গত অর্থবছরে ১ কোটি ৪১ লাখ টন আমন উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয় (বাংলাদেশ অর্থনৈতিক সমীক্ষা, ২০১৯)। কৃষিমন্ত্রী ড. আবদুর রাজ্জাক জানিয়েছেন, গত অর্থবছরে আমনের উৎপাদন ছিল ১ কোটি ৫৩ লাখ টন, অনুকূল আবহাওয়ার কারণে এ অর্থবছরে উৎপাদন আরও বাড়বে।
সে ক্ষেত্রে চালের আকারে ১০ লাখ টন সংগ্রহ মোট উৎপাদনের তুলনায় তেমন ধর্তব্যের মধ্যেই আসে না। তবুও সরকারের সংগ্রহ অভিযান চালকল মালিকদের সিন্ডিকেশনের প্রভাব কমিয়ে ধানচাষীদের ন্যায্যমূল্য পেতে কিছুটা সহায়তা করবে।
ধানচাষীদের কাছ থেকে সরাসরি ৬ লাখ টন ধান কেনার কর্মসূচি সফল করতে সরকারের গ্রহণীয় পদক্ষেপগুলোর মধ্যে রয়েছে- ঘোষিত তারিখ ২০ নভেম্বর সারা দেশে ধান কেনা শুরু করা; ফড়িয়া বা সিন্ডিকেটের কাছ থেকে ধান না কিনে প্রকৃত ধানচাষীদের কাছ থেকে সরাসরি ধান কেনা; সংগ্রহযোগ্য ধানের বিনির্দেশ সম্পর্কে ধানচাষীদের সচেতন করা এবং আর্দ্রতা পরিমাপের জন্য প্রতিটি ইউনিয়ন ও সুবিধাজনক অন্যান্য স্থানে মিটার সরবরাহ করা।
কৃষকদের দাবি এবং অভিজ্ঞজনদের পরামর্শে সরকার এবার আমন মৌসুমে কৃষকদের কাছ থেকে সরাসরি উল্লেখযোগ্য পরিমাণ ধান কেনার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। সরকারের এ সিদ্ধান্তকে সাধুবাদ জানাই এবং ভবিষ্যতে বোরো ও আমন মৌসুমে কৃষকদের কাছ থেকে সরাসরি ধান কেনার পরিমাণ উল্লেখযোগ্য পরিমাণে বৃদ্ধি পাবে- এটাই আমাদের প্রত্যাশা।
আবদুল লতিফ মন্ডল : সাবেক সচিব, কলাম লেখক
latifm43@gmail.com