সব সত্য কি সবসময় বলা যায় না!

একেএম শামসুদ্দিন
প্রকাশ: ২৮ অক্টোবর ২০১৯, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

ছবি: সংগৃহীত
বেশ কয়েকদিন ধরে বাংলাদেশের বিভিন্ন মিডিয়ায় ১৪ দলীয় জোটের অন্যতম শরিক দল বাংলাদেশ ওয়ার্কার্স পার্টির নেতা রাশেদ খান মেননের কিছু বক্তব্য ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হওয়ার পর এ নিয়ে রাজনৈতিক মহলে তোলপাড় শুরু হয়ে গেছে।
তিনি বিগত কয়েকটি সমাবেশে বর্তমান সরকারের কর্মকাণ্ড নিয়ে বেশ কড়া সমালোচনা করেছেন, যা সরকারের জন্য বিব্রতকর পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে। তিনি একাদশ নির্বাচনসহ চলমান দুর্নীতি নিয়ে এমন কিছু কথা বলেছেন, যা বিভিন্ন মিডিয়াসহ দেশের সর্বত্র আলোচিত হচ্ছে।
নির্বাচন নিয়ে রাশেদ খান মেনন নতুন কিছু বলেছেন বলে মনে হয়নি। কারণ নির্বাচনের অনিয়ম নিয়ে তিনি যা বলেছেন, তার পক্ষে কিছু কিছু তথ্য আমরা প্রধান নির্বাচন কমিশনারসহ অন্য নির্বাচন কমিশনারদের বিভিন্ন বক্তব্য থেকে ইতিমধ্যেই জেনেছি।
সম্প্রতি বাংলাদেশ ওয়ার্কার্স পার্টির বরিশাল জেলা কমিটির সম্মেলনের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তৃতায় মেনন বলেন, ‘আমিসহ যারা গত একাদশ সংসদীয় নির্বাচনে নির্বাচিত হয়েছি, তাতে আমাদের দেশের কোনো মানুষ ভোট দেয়নি।
ভোটাররা কেউ ভোট কেন্দ্রে আসতে পারেননি। উপজেলা ও ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে কোথাও ভোট দিতে পারেনি দেশের মানুষ। আজ দেশের মানুষের ভোটাধিকার হরণ করেছে সরকার। উন্নয়নের নামে দেশের গণতন্ত্রকে হত্যা করা হয়েছে, মানুষের মতপ্রকাশের স্বাধীনতাকে কেড়ে নিয়েছে সরকার, তাই মুখ খুলে মতপ্রকাশ করতে পারে না কেউ।’
সরকারের শরিক দলের অন্যতম প্রভাবশালী নেতার মুখে এমন কথা শোনার পর অনেকে বিস্মিত হলেও একদিন এমনটি যে হবে, তা অনুমান করা গিয়েছিল অনেক আগেই।
একদিন প্রকৃত সত্য যে বেরিয়ে আসবে, তা দেশের রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও বিশিষ্টজনরা বিভিন্ন সভা ও সেমিনারে অনেক আগেই ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন। বক্তব্য দেয়ার পরদিনই অবশ্য মেনন এক বিবৃতিতে তার বক্তব্যের আংশিক প্রকাশিত হয়েছে বলে দাবি করে গণতন্ত্র রক্ষায় ১৪ দলের অবদান ও সফল নির্বাচনের পক্ষে এক বিবৃতি দিয়েছেন।
তিনি এ নিয়ে এখন যত সাফাই গান না কেন, মানুষ কিন্তু তার ব্যাখ্যার চেয়ে মিডিয়ায় প্রচারিত ইতঃপূর্বে দেয়া তার বক্তব্যকেই গ্রহণ করেছেন বলে মনে হয়। কারণ বাস্তব অভিজ্ঞতার সঙ্গে যখন কারও বক্তব্য বা বর্ণনা মিলে যায়, তখন মানুষ কিন্তু সেটাকেই সত্য বলে গ্রহণ করে।
এটাই মানুষের সাধারণ প্রবৃত্তি। এ কারণে মেননের পরবর্তী বিবৃতিকে তার এক রকম রাজনৈতিক সমঝোতা বা মীমাংসার চেষ্টা বলেই মানুষ ধরে নিয়েছে।
ওয়ার্কার্স পার্টির বরিশাল জেলা কমিটির সম্মেলনের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে মেননের বক্তব্য প্রকাশের পরপর ক্ষমতাসীন দলের সাধারণ সম্পাদক যে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন, তা বেশ তাৎপর্যপূর্ণ বলে মনে হয়েছে। রাশেদ খান মেননের বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে তিনি যে পাল্টা বক্তব্য দিয়েছেন, তা দেশের প্রধান প্রধান সংবাদমাধ্যমে খবরের শিরোনামও হয়েছে।
এর মধ্যে দৈনিক যুগান্তরের শিরোনামটি ছিল এরকম, ‘মন্ত্রী হলে তিনি কি এ কথা বলতেন?’ সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া দেখে মনে হচ্ছে, মেননের বক্তব্যে শাসক দলের নেতারা বেশ অসন্তুষ্ট হয়েছেন।
যদিও ওবায়দুল কাদের রাশেদ খান মেননের বক্তব্য ‘মিস কোটেড’ হয়েছে কি না, সে ব্যাপারে আশঙ্কা পোষণ করছেন। তিনি বলেছেন, ‘আর যদি মেনন এ কথা বলেই থাকেন, তাহলে প্রশ্ন, এতদিন পরে কেন? আর এই সময়েই বা কেন?’
ওবায়দুল কাদেরের হাজার কেজি ওজনের এ প্রশ্ন অনেকের কাছেই বেশ কৌতূহলোদ্দীপক মনে হয়েছে। মেননের প্রতি আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকের ছুড়ে দেয়া এ প্রশ্ন শুনে জনমনে প্রশ্ন জেগেছে, মন্ত্রী হলে কি অনেক কথাই বলা যায় না? নাকি বলতে হয় না? অর্থাৎ সব সত্য কথা বলা যায় না বা না বলা উচিত। মন্ত্রিপরিষদের বাইরে থাকলেই কি শুধু সত্য কথা বলা যায়!
এ প্রসঙ্গে ২০১১ সালে ওবায়দুল কাদের এবং পরলোকগত সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের নিজ দল সম্পর্কে দেয়া বেশ কিছু বিবৃতির কথা মনে পড়ে গেল। মন্ত্রিপরিষদে তখনও তারা অন্তর্ভুক্ত হননি। তখন প্রায় প্রতিদিনই ওবায়দুল কাদের অথবা সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের কোনো না কোনো বক্তৃতা-বিবৃতি খবরের কাগজের শিরোনাম হতো।
দলের অভ্যন্তরের নানা অসঙ্গতি এবং কারও কারও দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়া নিয়ে তারা উভয়েই দ্বিধাহীন সমালোচনায় মুখর ছিলেন। তাদের ওই বক্তৃতা-বিবৃতিতে ক্ষমতাসীন দলের অনেককেই বিব্রতবোধ করতে দেখা গেছে তখন।
ক্ষমতাসীন দল করে আমার এমন অনেক বন্ধুকেও বিরক্ত হতে দেখেছি। অতঃপর ওই বছরের নভেম্বরে যখন সুরঞ্জিত সেন ও ওবায়দুল কাদেরকে মন্ত্রী করা হল, তারপর থেকে তাদের আগের মতো আর কোনো বক্তৃতা বা বিবৃতি দিতে দেখা যায়নি।
আমার বন্ধুরা তখন মুচকি হেসে বলেছিলেন, মন্ত্রী হয়ে তাদের মুখ বন্ধ হয়ে গেছে। এতদসংক্রান্ত কিছু রসাত্মক খবরও তখন বেরিয়েছিল জাতীয় দৈনিকগুলোতে।
সত্য বলায় যে সমস্যা আছে, সে ব্যাপারে ১৪ দলের অন্য শরিক দলের এক নেতার বক্তব্যেও প্রকাশ পেয়েছে। আমি জাসদের একাংশের কার্যকরী পরিষদের সভাপতি মইনউদ্দিন খান বাদলের কথা বলছি। ১৩ সেপ্টেম্বর জাতীয় প্রেস ক্লাবে এক আলোচনা সভায় সত্যকথনে সংশয়ের কথা তিনি বলেছিলেন।
মইনউদ্দিন খান বাদলের ওই বিবৃতি নিয়ে আমি আমার আগের একটি নিবন্ধে কিছু আলোচনা করেছিলাম। আজকের লেখার বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে বলে আবারও তার সেই বক্তব্যটি উল্লেখ না করে পারছি না। তিনি বলেছিলেন, ‘আমরা সরকারি দলে আছি।
কিন্তু প্রধানমন্ত্রী পারমিশন দিয়েছেন যাতে আমরা বিরোধী দলের মতো কথা বলি। তারপরও অনেক সত্য কথা বলতে পারি না। আজও অনেক সত্য কথা বলতে পারব না। তবে ইতঃপূর্বে সংসদে যেসব কথা বলেছি, সেসব কথাই বলব। তাহলে সরকার আমাকে ধরতে পারবে না।’ মইনউদ্দিন খান বাদলের কথা যদি আমরা সঠিক বলে ধরে নেই, তাহলে বলতে হয়, প্রধানমন্ত্রীর অনুরোধ অনুসারে মেনন সঠিক কাজটিই করেছেন।
বিরোধী দল যে ভাষায় কথা বলে, তিনিও সে ভাষায়ই কথা বলেছেন। তাহলে সমস্যাটা কোথায়? মেনন সাহেবের কপাল খারাপ, বড় অসময়ে তিনি এ ধরনের বক্তব্য দিয়ে কিছুটা বেকায়দায় পড়ে গেছেন।
যুবলীগের কতিপয় দুর্নীতিগ্রস্ত নেতার কর্মকাণ্ডের সঙ্গে তার সংশ্লিষ্টতার আভাস পাওয়ার পর তার এসব বক্তব্য সরকারি দলের নেতাদের পছন্দ হয়নি। এ কারণে হয়তো তিনি বিরোধী দলের মতো কথা বলেও সরকারি দলের নেতাদের রোষানলে পড়েছেন।
সরকারের কোনো কোনো মন্ত্রী বলেই দিয়েছেন ক্যাসিনো কেলেঙ্কারির সঙ্গে রাশেদ খান মেননের সংশ্লিষ্টতা পাওয়া গেলে তার বিরুদ্ধেও দেশের প্রচলিত আইন অনুযায়ী প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে।
খবর বেরিয়েছে, বাংলাদেশের ক্যাসিনো সম্রাট সরকারি কর্মকর্তাসহ ক্ষমতাসীন দলের ২৫ জনকে ক্যাসিনো থেকে অবৈধ উপায়ে অর্জিত অর্থ জোগান দিয়ে আসছিলেন।
মন্ত্রীদের বক্তব্যে অবশ্য মেননের কথা বলা হলেও বাকিদের কোনো পরিচয় কিংবা তাদের বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে, সে ব্যাপারে কোনো কথা উচ্চারিত হয়নি।
দীর্ঘ বাম রাজনৈতিক ঐতিহ্যের অন্যতম ধারক রাশেদ খান মেনন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ থেকে শুরু করে গণতন্ত্র উত্তরণে বিশেষ অবদান রেখেছেন। এ দেশের ছাত্র রাজনীতির ইতিহাসে তিনি একটি সম্মানজনক স্থান দখল করে আছেন, সন্দেহ নেই। তার নাম বিশেষ করে উচ্চারিত হবে এরশাদের সামরিক সরকার উৎখাত ও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় জোটবদ্ধ আন্দোলনের অন্যতম নেতা হিসেবে।
১৯৯১ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত পঞ্চম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তিনি প্রথমবারের জন্য সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। পরবর্তী সময়ে আওয়ামী লীগের সঙ্গে জোট বেঁধে শুধু সংসদ সদস্যই নির্বাচিত হননি, আওয়ামী লীগ সরকারের মন্ত্রী হওয়ার সৌভাগ্যও হয়েছে তার।
অনেকের ধারণা- জোটবদ্ধ নির্বাচনে অংশ না নিলে মন্ত্রী হওয়া তো দূরে থাক, সংসদ সদস্য হওয়াও তার জন্য কঠিন ছিল। এ জন্য হয়তো ক্ষমতাসীন দলের নেতারা ভাবেন রাশেদ খান মেননের আওয়ামী লীগের কাছে সব সময় কৃতজ্ঞ থাকা উচিত।
বাম রাজনীতির চমৎকার রেকর্ড থাকার পরও যখন তিনি অনায়াসে ক্ষমতায় আহরণের সুযোগ গ্রহণ করেন, তখন থেকেই তার রাজনৈতিক ক্যারিয়ারের স্খলন শুরু বলে অনেকের ধারণা।
তবে সরকারি দলের অঙ্গসংগঠনগুলোর যে চরম রাজনৈতিক স্খলন ঘটেছে, তা বলাই বাহুল্য। অবাক লাগে বঙ্গবন্ধুর পরম স্নেহধন্য শেখ মণির প্রতিষ্ঠিত যুবলীগের আজকের এ পরিণতি দেখে। এতদিন যা ইচ্ছে তাই ঘটেছে এ সংগঠনটিকে ঘিরে।
ক্যাসিনো কেলেঙ্কারির মধ্য দিয়ে সংগঠনটির যে চিত্র জাতির সম্মুখে উন্মোচিত হয়েছে, তা মোটেও আশাব্যঞ্জক নয়। বরং সাংগঠনিক ব্যর্থতার চরম লজ্জাজনক এপিসোড জাতি অবলোকন করল।
এ ব্যর্থতার দায় আওয়ামী লীগের দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতারা কি এড়াতে পারবেন? তৈল চোর সাঈদ, টং দোকানদার রাজীব ও পিয়ন আনিসের মতো লোকেরা যাদের চাল-চুলো নেই, তারা কীভাবে যুবলীগের নেতা বনে যান তা খুঁজে বের করতে হবে। যুবলীগ কি এতই দেউলিয়া ছিল যে, এসব কুরুচিপূর্ণ ব্যক্তিকে দলে ভিড়িয়ে দল চালাতে হবে? অথচ ত্যাগী এবং নিঃস্বার্থ এমন অনেক কর্মী ছিলেন, যারা দলের সাইড লাইনেই পড়েছিল দিনের পর দিন।
স্বাভাবিক কারণেই এখন প্রশ্ন জাগে, এসব চরিত্রহীন ব্যক্তি যুবলীগের পোর্টফলিও ব্যবহার করে যে শত শত কোটি টাকা লুটপাট করেছে, সে দায়িত্ব কে নেবে? লুটপাটের এই অর্থ দলের কোন কোন নেতার মধ্যে বিলি-বণ্টন হয়েছে, গোটা জাতি না হোক অন্তত দলের কর্মীদের তা জানার অধিকার আছে। এসব লোক এতদিন যে হরিলুটের রাজত্ব করেছে, তা নীতিনির্ধারক মহলের কেউ জানতেন না বলে যে দাবি করা হয়- তা দেশের মানুষ এখন আর বিশ্বাস করে না।
দুটো অপ্রিয় কথা বলার জন্য রাশেদ খান মেননকে যে লক্ষ্যবস্তু করা হয়েছে, তা বোঝার জন্য রাজনীতির কোনো পাঠ গ্রহণ করার প্রয়োজন হয় না।
কেলেঙ্কারির সঙ্গে জড়িত থাকার প্রমাণ পাওয়া গেলে তার পরিণতি যে তাকে ভোগ করতে হবে তাতে কোনো সন্দেহ নেই; কিন্তু তাকে নিয়ে ব্যস্ত রেখে অপরাধীদের স্বীকারোক্তিতে যাদের নাম বেরিয়ে এসেছে, তাদের যেন আড়াল করার চেষ্টা করা না হয়। তাহলে পরম ঝুঁকি নিয়ে এবং অসীম সাহসের সঙ্গে ক্ষমতাসীন দলের নেত্রী শেখ হাসিনা যে প্রশংসনীয় উদ্যোগ গ্রহণ করেছেন, তা অচিরেই ব্যর্থ হবে বলা যায়।
একেএম শামসুদ্দিন : অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তা