Logo
Logo
×

বাতায়ন

বড়পুকুরিয়ায় পুকুর চুরি কি চলতেই থাকবে?

Icon

মুঈদ রহমান

প্রকাশ: ২৬ অক্টোবর ২০১৯, ০২:০০ পিএম

প্রিন্ট সংস্করণ

বড়পুকুরিয়ায় পুকুর চুরি কি চলতেই থাকবে?

গত ২০ অক্টোবর একটি দৈনিকের লিড নিউজ ছিল ‘কোথায় গেল ৮৪৬ কোটি টাকার কয়লা’। প্রতিবেদনটি দিনাজপুরের বড়পুকুরিয়ার কয়লাখনির অনিয়ম সংক্রান্ত।

বড়পুকুরিয়ার কয়লাখনি নিয়ে অভিযোগের অন্ত নেই। বেশ কয়েক বছর ধরেই আমরা বিভিন্ন অনিয়মের কথা শুনে আসছি। এই তো বছরখানেক আগের কথা, কোটি কোটি টাকার কয়লা নাকি বাতাসে উবে গেছে। এ কি কয়লা, না কর্পূর? এ নিয়ে পত্রপত্রিকায় বিস্তারিত লেখালেখি হয়েছিল, দুদকও হাত বাড়িয়েছিল; কিন্তু অভিযোগের শেষ নিষ্পত্তি হয়নি।

এবারের অভিযোগটি ভিন্ন রকমের- ওজনের কারসাজি। সাধারণত বড়পুকুরিয়ার খনি থেকে কয়লা উত্তোলন করে চীনের দুটি প্রতিষ্ঠান। বড়পুকুরিয়া কোল মাইনিং কোম্পানি লিমিটেড (বিসিএমএল) এ কয়লা উত্তোলনের বিল পরিশোধ করে থাকে। ২০০৫ থেকে ২০১৮ সাল- এ ১৩ বছরে চীনা কোম্পানিকে বিসিএমএল সর্বমোট ১ কোটি ৬৬ লাখ টন কয়লা তোলার বিল পরিশোধ করে। এ পর্যন্ত কোনো অনিয়ম নেই, অনিয়ম হয়েছে কয়লা তোলার পর। সাধারণত কয়লা তোলার মান হিসেবে একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ আর্দ্রতার সীমা থাকে। সে হিসেবে চীনা কোম্পানি ৫.১ শতাংশ পানিসহ কয়লা সরবরাহ করে। কিন্তু বিসিএমএল এ কয়লা যখন পাশে অবস্থিত বিদ্যুৎ কেন্দ্র ও খোলাবাজারে বিক্রি করে তাতে পানির পরিমাণ ছিল ১০ শতাংশের বেশি। এতে করে কয়লার ওজন বেড়ে দাঁড়ায় ৫ লাখ টনেরও বেশি। খোলাবাজারে এক টন কয়লার দাম ১৬ হাজার ৯২৭ টাকা, তাহলে ৫ লাখ টনের মূল্য গুনতে হবে ৮৪৬ কোটি টাকা। এ বিশাল অঙ্কের টাকার কাগজে-কলমে কোনো হিসাব নেই। নিশ্চয়ই তা কারসাজির মাধ্যমে আত্মসাৎ করা হয়েছে।

আমরা জানি, কোনো একটি জায়গায় যদি অনিয়মের ঘটনা প্রকাশিত হয়, তারপর অনেকদিন সেখানে আর দুর্নীতি করার সাহস হয় না। কিন্তু বড়পুকুরিয়া খয়লাখনির অনিয়ম আর দুর্নীতির যেন কোনো শেষ নেই। ২০১৮ সালে অনেক বড় দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছিল। ১ লাখ ৪৪ হাজার টন কয়লা মজুদ থেকে উধাও হয়ে গিয়েছিল যার বাজারমূল্য ছিল ২৪৩ কোটি টাকা। এ ঘাটতির ফলে বড়পুকুরিয়ায় বিদ্যুৎ উৎপাদন বন্ধ হয়ে যায়। কর্তৃপক্ষের বয়ান ছিল ওই কয়লা নাকি বাতাসে উবে গেছে! পরে দুদক বিষয়টির তদন্তে হাত বাড়ায় এবং সম্প্রতি অভিযোগপত্র জমাও দেয়া হয়েছে। তাতে স্পষ্টতই বলা হয়েছে, ‘খোয়া যাওয়া কয়লা খনি-কর্মকর্তারাই আত্মসাৎ করেছেন। এসব কয়লা খনির গেট দিয়ে ট্রাকে করে বেরিয়ে গেছে।’ ৬ চাকার একটি ট্রাক আইনগতভাবে ৭ টন মালামাল বহন করতে পারে। সে হিসাবে চুরির ওই কয়লা সরাতে প্রয়োজন পড়ার কথা ২০ হাজার ৫৭১টি ট্রাক। ভাবতে পারেন কতখানি ‘বীরত্বে’র সঙ্গে অপকর্মটি হয়েছে! দুদকের অভিযোগপত্র জমা দেয়ার পর আদালত ১৫ অক্টোবর কয়লাখনির সাবেক ৭ এমডিসহ ২৩ জনের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করেন। আমরা অপেক্ষায় রইলাম এর পরিণতি দেখার প্রত্যাশায়। তবে মনে রাখতে হবে, ‘জাস্টিজ ডিলেইড, জাস্টিজ ডিনাইড’। অতিমাত্রায় বিলম্বিত বিচার অনেক সময় সুবিচারের প্রতিফলন ঘটাতে ব্যর্থ হয়।

বড়পুকুরিয়া নিয়ে ১১ বছর আগে করা একটি মামলার এখনও সুরাহা হয়নি। কয়লাখনি থেকে কয়লা উত্তোলন, ব্যবস্থাপনা ও রক্ষণাবেক্ষণে ঠিকাদার নিয়োগে অনিয়ম এবং রাষ্ট্রের ১৫৮ কোটি ৭১ লাখ টাকা ক্ষতি ও আত্মসাতের অভিযোগে দুদকের সহকারী পরিচালক নাজমুল আলম ২০০৮ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি শাহবাগ থানায় একটি মামলা করেন। সেই মামলার আসামি করা হয় সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়াকে। এর ঠিক ১১ বছর পর ২৬.০২.২০১৯ তারিখের যুগান্তরের রিপোর্ট হল- ‘বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়াসহ ১০ জনের বিরুদ্ধে করা বড়পুকুরিয়া কয়লাখনি দুর্নীতি মামলা ৬ মাসের মধ্যে নিষ্পত্তির নির্দেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট।’ সেটার সুরাহা কিন্তু আজও হয়নি। যদিও বিএনপি বলছে, এ মামলা সম্পূর্ণভাবে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য থেকে করা হয়েছে। আর আওয়ামী লীগ বলছে, এ মামলা তো আমরা করিনি, ১/১১’র সরকার করেছে। আমরা যা চাই তা হল, যে কোনো দুর্নীতি মামলার দ্রুত নিষ্পত্তি। তা না হলে দুর্নীতিবাজরা উৎসাহিত হবে। বিলম্বিত বিচার কোনোভাবেই কাম্য নয়।

বড়পুকুরিয়ার কয়লাখনি নিয়ে আমাদের বিশেষ আগ্রহ-মনোযোগের কারণটা বলা প্রয়োজন। ভূতাত্ত্বিক জরিপ বাংলাদেশ (জিএসবি) ১৯৮৫ সালে বড়পুকুরিয়ার এ কয়লা আবিষ্কার করে। এখানকার কয়লায় ৪৮.৪ শতাংশ স্থায়ী কার্বন থাকায় এটিকে মানসম্পন্ন কয়লা হিসেবে বিবেচনা করা হয়ে থাকে। তাছাড়া কয়লায় রয়েছে ০.৫৩ শতাংশ সালফার, যা তাপ উৎপাদনে অধিকতর সহায়ক। এ কারণে বড়পুকুরিয়ার পাশে ২০০৬ সালে গড়ে তোলা হয় বাংলাদেশের একমাত্র কয়লাভিত্তিক তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্র। প্রথমদিকে বিদ্যুৎ উৎপাদন হতো দুটি ইউনিটে ১২৫ করে মোট ২৫০ মেগাওয়াট। ২০১৫ সালে ২৭৫ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন তৃতীয় ইউনিট নির্মাণ শেষে কেন্দ্রটির মোট বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা দাঁড়ায় ৫২৫ মেগাওয়াটে; যা আমাদের জাতীয় উৎপাদন ক্ষমতার প্রায় আড়াই শতাংশ। বড়পুকুরিয়ার মোট কয়লা উৎপাদনের ৬৬ শতাংশই যায় এ তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্রে। বাদবাকি ৩৪ শতাংশ বিক্রি হয় খোলাবাজার ও ইটভাটায়। সুতরাং দেশের একমাত্র কয়লাভিত্তিক তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্রটির প্রাণই হল বড়পুকুরিয়া কয়লাখনি। এ খনির যে কোনো অনিয়মের কুফল ভোগ করতে হয় এ বিদ্যুৎ কেন্দ্রটিকে। খনির কয়লা চুরি যাওয়ায় এবং জোগান দিতে না পারায় ২০১৮ সালের ২২ জুলাই রাত ১০টা ২০ মিনিটে সব বিদ্যুৎ কেন্দ্র বন্ধ হয়ে যায়। ভাবতে পারেন অন্যায়ের মাত্রা কতখানি! যে দেশে বিদ্যুতের আকাল, সে দেশে কয়লা চুরি আমাদের নাকাল করে দিল! অথচ বড়পুকুরিয়া কয়লাখনির ‘ভিশনে’ বলা আছে, ‘বাংলাদেশের জ্বালানি চাহিদা পূরণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখার জন্য কয়লা উৎপাদন’ এবং ‘মিশনে’ বলা আছে, ‘দেশের প্রাথমিক জ্বালানি প্রাকৃতিক গ্যাসের বিকল্প কয়লা সম্পদ উন্নয়ন।’ এই হল ভিশন-মিশনের বিপর্যস্ত হাল।

বড়পুকুরিয়া কয়লাখনির এই যে ধারাবাহিক অনিয়ম-দুর্নীতি, তা বিচ্ছিন্ন কোনো ঘটনা নয়। সারা বাংলাদেশে অর্থনৈতিক দুর্বৃত্তায়নের যে সংস্কৃতি বিদ্যমান এটি তারই একটি অংশ মাত্র। আইন, সমাজ, অধিকারকে একটি শ্রেণি অত্যন্ত বেপরোয়াভাবে উপেক্ষা করে চলেছে এবং তা ক্ষেত্রবিশেষে লাগামহীন। আমাদের মাঝে এক ধরনের মানসিক দাসত্ব তৈরি হয়েছে। আমরা প্রায়ই বলতে স্বচ্ছন্দবোধ করি- অমুক ক্ষমতাশালী, তমুক প্রভাবশালী, অমুক ক্ষমতাধর। আমরা যে অর্থে ক্ষমতাশালী কিংবা ক্ষমতাবান বলছি, সেটি একটি স্বৈরাচারী শব্দ না হোক- একটি অগণতান্ত্রিক শব্দ। আমরা প্রত্যেকেই যার যার কর্মগুণে ক্ষমতাশালী। আপনার হয়তো একটি প্রতিষ্ঠান পরিচালনার ক্ষমতা আছে; কিন্তু আপনার দ্বারা উড়োজাহাজ চালানো সম্ভব নয়। সে ক্ষমতা পাইলটের। তেমনি মাটি কাটার কাজটি করার ক্ষমতা মজুরের কিংবা মেশিন চালানোর ক্ষমতা শ্রমিকের। এখানে কাউকে উপেক্ষা করার সুযোগ নেই। তাই গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় কেউ দাপট দেখালে তাকে ক্ষমতাশালী বলা যাবে না। সেই অর্থে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীও সুষ্ঠুভাবে সরকার পরিচালনার দায়িত্বপ্রাপ্ত মাত্র। এই দায়িত্ব পাওয়ার ক্ষেত্রে যে নির্বাচনব্যবস্থা রাখা হয়েছে তাতে রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী থেকে শুরু করে প্রত্যেক ব্যক্তিরই এক ভোট। ছোট-বড়’র কোনো ব্যাপার নেই, নেই আশরাফ-আতরাফের বিষয়। তাহলে একটি দেশে প্রধানমন্ত্রীই যদি যা ইচ্ছে তাই করার অধিকার না পান, তাহলে কোনো ব্যক্তি কী করে সব আইনের ঊর্ধ্বে থাকেন? আশা করি, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বড়পুকুরিয়ার বিষয়টি বিশেষ বিচেনায় নেবেন।

সরকারের পক্ষ থেকে বিভিন্ন পদক্ষেপের কথা আমরা গত ১০ বছর ধরে শুনে আসছি; তবে এর কার্যকারিতা নিয়ে প্রশ্ন আছে। ‘দুর্নীতিবিরোধী অভিযান’, ‘সন্ত্রাসবিরোধী অভিযান’, ‘জঙ্গিবিরোধী অভিযান’, ‘মাদকবিরোধী অভিযান’, হালে ‘ক্যাসিনোবিরোধী অভিযান’ ও ‘শুদ্ধি অভিযানের’ কথা আমরা শুনেছি। এই ‘অভিযান’ শব্দটির একটি অন্তর্নিহিত নিজস্ব ‘ক্যারিশমা’ আছে। অভিযান শব্দটি আমাদের সাহস জোগায়, সুন্দর থাকার আশা জাগায়। কিন্তু বাস্তব অবস্থা হল, দিনকে দিন শব্দটি দায়সারা ও প্রথাগত হয়ে যাচ্ছে, হারাচ্ছে তার তেজস্বীতা। এর একটি কারণ হতে পারে, অভিযান পরিচালনার ক্ষেত্রে লক্ষ্যবস্তু ঠিক না করা। কোথায় আঘাত করলে পূর্ণ সফলতা আসবে তা না জানা, অথবা জানা থাকলেও অজানা কারণে তা প্রয়োগ না করা। একটি উদাহরণ দেয়া যেতে পারে। কয়েক বছর ধরে চলছে ‘মাদকবিরোধী অভিযান’। শ’খানেক মানুষ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে প্রাণ হারিয়েছে; কিন্তু পরিস্থিতি আগের মতোই। এর মূল কারণ হচ্ছে লক্ষ্যবস্তু ঠিক না করা। দেশে মাদক গ্রহণকারীর সংখ্যা আনুমানিক ৭০ লাখ; যারা ক্যারিয়ার বা খুচরা ব্যবসায়ী হিসেবে পরিচিত তাদের সংখ্যা ৩ লাখ; আর যারা গডফাদার হিসেবে পরিচিত তাদের সংখ্যা মাত্র ১৫০-১৬০। তাহলে আমাদের তা প্রতিরোধ করার যে শক্তি তাতে কোথায় আঘাত করাটা বাঞ্ছনীয়? দুঃখজনক হল, আমরা ভিন্ন লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত করে চলেছি, যে কারণে কয়েক বছরেও পরিস্থিতির উন্নতি হয়নি।

দুর্নীতিবিরোধী অভিযানে আমরা চাই প্রত্যাশিত লক্ষ্যবস্তু। নামকাওয়াস্তে বা লোক দেখানো কিছু করার ভেতর দিয়ে বাংলাদেশের অর্থনীতি থেকে ‘দুর্বৃত্তায়ন’ দূর করা যাবে না। আমরা ভালো কিছু আশা করতে ভালোবাসি।

মুঈদ রহমান : অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম