আমাজন অগ্নিকাণ্ডের কী প্রভাব পড়বে বাংলাদেশে
ড. আহমদ কামরুজ্জমান মজুমদার
প্রকাশ: ৩১ আগস্ট ২০১৯, ০৬:০০ পিএম
প্রিন্ট সংস্করণ
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
দক্ষিণ আমেরিকার নয়টি দেশের প্রায় ৫৫ লাখ বর্গকিলোমিটার এলাকাজুড়ে আমাজন বনের বিস্তৃতি। চিরহরীৎ বৃষ্টিবহুল এই বন পৃথিবীর সর্ববৃহৎ। এর আয়তন ব্রিটিশ দ্বীপপুঞ্জের প্রায় ১৭ গুণ বেশি।
ব্রাজিল, পেরু, কলম্বিয়া, বলিভিয়া, ইকুয়েডর, ভেনিজুয়েলা, গুয়ানা, চিলি ও আর্জেন্টিনায় আমাজন বনের বিস্তৃতি থাকলেও শুধু ব্রাজিলেই আমাজনের প্রায় ৬০ শতাংশ। পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে থাকা অক্সিজেনের ২০ শতাংশের উৎস এ আমাজন বনের গাছপালা। এজন্য এ বনকে ‘পৃথিবীর ফুসফুস’ও বলা হয়। বায়ুমণ্ডলের প্রায় ২৫ শতাংশ কার্বন ডাই-অক্সাইড (২.২ বিলিয়ন মেট্রিক টন) শোষণ করে আমাজন বনের গাছপালা।
আমাজনে ৪০ হাজার প্রজাতির উদ্ভিত এবং ৩ হাজার প্রজাতির ফল জন্মে; ১৩০০ প্রজাতির পাখি, ৩০০০ প্রজাতির মাছ, ৪৩০ প্রজাতির স্তন্যপায়ী, ২৫ লাখ প্রজাতির পোকামাকড় এবং ৪০০ প্রজাতির উভচর প্রাণী রয়েছে। আধুনিক ওষুধ শিল্পের ২৫ শতাংশ কাঁচামাল আসে আমাজন থেকে। দক্ষিণ আমেরিকার ৭০ শতাংশ জিডিপির উৎস হচ্ছে আমাজন। আমাজন বনের পুরোটার মধ্য দিয়ে প্রবাহিত আমাজন নদী। সমুদ্রের ২০ শতাংশ মিঠাপানির সরবরাহ করে এই নদী। ১০ লাখ আদিবাসী মানুষের বসবাস এ বনে, যাদের অনেকেই এখন সভ্যতার সঙ্গে পরিচিত হয়নি।
আমাজন বনে অগ্নিকাণ্ড বা দাবানলের ঘটনা নতুন কিছু নয়। রেইন ফরেস্ট হওয়ায় আমাজন বন পৃথিবীর আর্দ্র জায়গাগুলোর একটি। প্রতি বছর আমাজনে প্রায় ২০০ সেন্টিমিটার বৃষ্টিপাত হয়। আগস্ট থেকে নভেম্বর সময়ে আমাজন বন শুষ্ক থাকে। এ সময়ে প্রাকৃতিকভাবে প্রায়ই অগ্নিকাণ্ড ঘটে থাকে এবং গত বছর পর্যন্ত এটি একটি স্বাভাবিক ঘটনা ছিল। তবে এ বছর অস্বাভাবিকভাবে অগ্নিকাণ্ড বৃদ্ধি পেয়েছে।
ব্রাজিলের মহাকাশ গবেষণা কেন্দ্র, ন্যাশনাল ইন্সটিটিউট ফর স্পেস রিসার্চের তথ্যমতে, আমাজন বনে ২০১৮ সালের তুলনায় ২০১৯ সালে ৮৫ শতাংশ বেশি অগ্নিকাণ্ড সংঘটিত হয়েছে, যা বিগত সব বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। ২০১৮ সালে অগ্নিকাণ্ডের সংখ্যা ছিল ৪০ হাজার; কিন্তু ২০১৯ সালে মাত্র ৮ মাসের মধ্যে শুধু ব্রাজিলের অংশে ৭৫ হাজার বার অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। ২৫ আগস্টের সংবাদপত্রের তথ্যানুযায়ী, ২৩ আগস্ট পর্যন্ত আমাজনের ব্রাজিল অংশের প্রায় ২৫০০ স্থানে অগ্নিকাণ্ড সক্রিয় রয়েছে।
এত বেশি আগুন লাগার পেছনে প্রাকৃতিক ও মানবসৃষ্ট কারণ রয়েছে। প্রাকৃতিক কারণগুলোর মধ্যে বজ্রপাত অন্যতম। এছাড়া গাছে গাছে ঘর্ষণের ফলেও অনেক সময় অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। অন্যদিকে World Wildlife Fund (WWF)-এর মতে, আমাজন বনের যেখানে গাছ কাটার ক্ষেত্রে যন্ত্র ব্যবহার করা যায় না সেখানে আগুন ধরিয়ে বন উজাড় করা হয়, পরবর্তী সময়ে সে জায়গাগুলো মানুষের বাসস্থান, কৃষি উৎপাদন, গবাদি পশুচারণের জন্য ব্যবহার করা হয়। এক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য, সারা পৃথিবীতে গরুর মাংসের চাহিদার ২৩ শতাংশ সরবরাহ করে ব্রাজিল। এছাড়াও বিপুল পরিমাণ প্যাকেটজাত দুধ সরবরাহ করা হয়ে থাকে ব্রাজিল থেকে। তাই তাদের প্রচুর পরিমাণে পশুচারণ ভূমির প্রয়োজন রয়েছে এবং অগ্নিকাণ্ডে বন পুড়ে পশুচারণ ভূমির বিস্তার ঘটছে বলে অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে।
ব্রাজিলের মহাকাশ গবেষণা কেন্দ্র ন্যাশনাল ইন্সটিটিউট ফর স্পেস রিসার্চের হিসাবমতে, দাবানলের ফলে প্রতি মিনিটে আমাজনের প্রায় ১০ হাজার বর্গমিটার এলাকা পুড়ে যাচ্ছে। এ হিসাব অনুযায়ী দৈনিক ১৪ হাজার ৪০০ বর্গকিলোমিটার জায়গা পুড়ছে এবং গত ১৫ দিনে সম্পূর্ণ আমাজনের প্রায় ২.৬ শতাংশ (যা বাংলাদেশের আয়তনেরও বেশি) ধ্বংস হয়ে গেছে।
এ বিস্তৃত এলাকায় বসবাসরত বিভিন্ন উদ্ভিত, প্রাণী জ্বলে যাচ্ছে এবং নদীর পানি ফুটতে শুরু করেছে। ফলে মাছ ও জলজপ্রাণী মর্মান্তিকভাবে মারা যাচ্ছে। ইউরোপীয় ইউনিয়নের কোপারনিকাস অ্যাটমস্ফিয়ার মনিটরিং সার্ভিসের (ক্যামস) তথ্যমতে, এই আগুনের ধোঁয়া ছড়িয়ে পড়ছে আটলান্টিকের উপকূল পর্যন্ত। উল্লেখ্য, প্রায় ৩ হাজার কিলোমিটার দূরে অবস্থিত সাও পাওলোর আকাশ আগুনের ধোঁয়ায় অন্ধকার হয়ে গেছে।
এ আগুন থেকে প্রচুর পরিমাণ কার্বন ডাই-অক্সাইড নির্গত হচ্ছে, যা এ বছর দাঁড়িয়েছে ২২৮ মেগাটনের সমপরিমাণ। ক্যামসের তথ্যমতে, ২০১০ সালের পর সবচেয়ে বেশি এ বছরই কার্বন নির্গত হচ্ছে। কার্বন ডাই-অক্সাইড ছাড়াও পার্টিকুলেট কার্বন, সালফার ডাই-অক্সাইড, কার্বন-মনো-অক্সাইড, মারকারি, ডাইঅক্সিন ইত্যাদি গ্যাস নির্গত হচ্ছে।
বাংলাদেশ থেকে ব্রাজিলের দূরত্ব ১৬ হাজার ৩০০ কিলোমিটার। আমাজন বনের অগ্নিকাণ্ড বাংলাদেশের ওপরও প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে প্রভাব ফেলবে। প্রথমত, অগ্নিকাণ্ড থেকে সৃষ্ট তাপ ও গ্রিনহাউস গ্যাসের ফলে বৈশ্বিক উষ্ণায়ন বৃদ্ধি পাবে এবং জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব বাংলাদেশের ওপরও পড়বে। যে পরিমাণ বন ধ্বংস হয়েছে তাতে মোট অক্সিজেনের সরবরাহ ০.০৩ শতাংশ এবং কার্বন শোষণের পরিমাণ ০.০৪ শতাংশ কমে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। এ অগ্নিকাণ্ডের ফলে সৃষ্ট পার্টিকুলেট ম্যাটার, ধোঁয়াশা, কার্বন ডাই-অক্সাইড, কার্বন-মনো-অক্সাইড, সালফার ডাই-অক্সাইড, মারকারি, ডাইঅক্সিন ইত্যাদি বায়ুদূষণ করছে। এই বায়ুদূষণ শুধু আমাজন বা পার্শ্ববর্তী এলাকার জন্য নয়, এটি একটি ট্রান্সবাউন্ডারি বা আন্তর্জাতিক সমস্যায় রূপ নেবে এবং বাংলাদেশের ওপরও এর প্রভাব পড়বে।
উল্লেখ্য, যুক্তরাষ্ট্রের হেলথ ইফেক্টস ইন্সটিটিউট এবং ইন্সটিটিউট ফর হেলথ মেট্রিক্স অ্যান্ড ইভ্যালুয়েশনের যৌথ উদ্যোগে State of Global Air 2019 প্রতিবেদন অনুযায়ী, বিশ্বের নয়টি দেশের মধ্যে বায়ুদূষণে মৃত্যুর সংখ্যায় পঞ্চম অবস্থানে রয়েছে বাংলাদেশ। সেক্ষেত্রে যদি আমাজনের অগ্নিকাণ্ডের ফলে বাংলাদেশে বায়ুদূষণ বাড়ে, তাতে মানুষের স্বাস্থ্যের ওপর প্রভাব আরও বেশি বেড়ে যাবে। বায়ুতে মিশে থাকা এসব দূষক গ্যাস আবার এসিড বৃষ্টির জন্য দায়ী, যা প্রাকৃতিক ও সামাজিক পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর।
এ অবস্থায় প্রয়োজন এ অগ্নিকাণ্ডের কারণগুলো খুঁজে বের করে তার স্থায়ী সমাধান করা। এজন্য দক্ষিণ আমেরিকার আমাজন অববাহিকার নয়টি দেশকে সমন্বিত পদক্ষেপ নিতে হবে। আমাজন রক্ষায় একটি ফান্ড তৈরি করা যেতে পারে, যেখানে বিশ্বের প্রতিটি দেশ অংশগ্রহণ করবে। একজন মানুষের বেঁচে থাকার জন্য যে পরিমাণ অক্সিজেন প্রয়োজন তা দুটি পূর্ণবয়স্ক গাছ সরবরাহ করতে পারে। আমাজনের এ ক্ষয়ক্ষতি পুরো পৃথিবীর। প্রয়োজন আমাজনে পুনঃবনায়ন ও পৃথিবীর অনান্য স্থানে বনায়ন বৃদ্ধি করা। ইতিমধ্যে আমাজন রক্ষায় বৈঠকের ডাক দিয়েছে ল্যাটিন আমেরিকার দেশগুলো। ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ২২ আগস্ট সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম টুইটারে লিখেছেন, ‘জি সেভেন সম্মেলনের সব মেম্বারের উচিত জরুরি ভিত্তিতে দুই দিনের মধ্যে আমাজন নিয়ে বৈঠকে বসা।’ এরই ধারাবাহিকতায় জি সেভেনের নেতারা আমাজন রক্ষায় ২ কোটি মার্কিন ডলারের সহায়তার ঘোষণা দিয়েছেন।
অধ্যাপক ড. আহমদ কামরুজ্জমান মজুমদার : বিভাগীয় প্রধান, পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগ, স্টামফোর্ড ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ
kamrul_sub@hotmail.com
