চাকরি এবং ঔপনিবেশিক মানসিকতা

আসাদুজ্জামান বুলবুল
প্রকাশ: ২৩ আগস্ট ২০২৩, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
বিয়ে করব পাত্রী খোঁজা হচ্ছে। কন্যার বাবার প্রথম এবং প্রধান প্রশ্ন, ছেলে কী করে? যদি উত্তর হয় সরকারি চাকরি করে তাহলে তো একাদশে বৃহস্পতি অবস্থা। আর যদি উত্তর হয় ছেলে পেশায় প্রাইভেট কোম্পানিতে চাকরি করে কিংবা উদ্যোক্তা, তাহলে তো মাছের মায়ের মতো আচরণ শুরু করেন কন্যাদায়গ্রস্ত পিতাও। বর্তমান সময়ে পেশা নিয়ে তরুণরা একটা বিশাল সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। কারণ হচ্ছে, আমরা যেহেতু সামাজিক প্রাণী তাই চাইলেও টক্সিক সোসাইটির বাইরে গিয়ে বসবাস করার সুযোগ নেই। তাই আমরা কী করছি, কী খাচ্ছি, কীভাবে চলছি সবকিছুর স্ট্যান্ডার্ড ঠিক করে দেয় আমাদের আশপাশের মানুষগুলোই। তাদের চোখে যেটা মানানসই সেটাই ভালো বলে বিবেচ্য হবে। চলুন দেখা যাক আমাদের সমাজের মানুষেরা ভালো চাকরি বলতে কি বোঝেন। তারা মনে করেন একজন স্যুট-কোট পরে অফিস করবে, তাদের সামনে একটা ল্যাপটপ থাকবে, তারা হুকুম করবে অন্যরা শুনবে, সবাই স্যার স্যার করবে, প্রাইভেট কারে যাতায়াত করবে। এর বাইরেও যে অনেক কিছু করা যায় সেটি তাদের বোঝানো খুবই কষ্টসাধ্য ব্যাপার। সেটি ভালো চাকরি হিসাবে তাদের কাছে কখনোই গ্রহণযোগ্য হবে না। আমরা যখন থেকে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদীদের দ্বারা পরাজিত এবং শোষিত হলাম, এই ভালো চাকরির বাতিক এ বঙ্গসমাজের ভেতরে বদ্ধমূল কুসংস্কারে পরিণত হয়েছে তখন থেকে। আমাদের পূর্বপুরুষেরা যখন দেখত তাদের অর্ডার করছে একদল স্যুট-কোট পরা মানুষ, তাদের খাজনা আদায় কিংবা জমিজমাসংক্রান্ত ঝামেলা মীমাংসা করছে ডিস্ট্রিক্ট কালেক্টর নামের ফিটফাট এক শহুরে বাবু, তখন থেকে তারা স্বপ্ন দেখল তাদের সন্তানদেরও এমন হতে হবে।
আসল ব্যাপারটা হচ্ছে যখন একটা জাতি শাসিত হয় অন্য জাতি দ্বারা, স্বভাবতই পরাজিত জাতিটি অনুকরণ প্রিয় হয়ে পড়েন এবং তাদের ভেতর উপনিবেশিক মানসিকতার জন্ম হয়। উপনিবেশিক মনোভাবাপন্ন মানুষেরা মনে করে, তাদের যারা শাসন করছে তারা উন্নত, সভ্য এবং রুচিশীল তাই অবচেতন মনে তাদের সংস্কৃতির ওপর ভালোলাগা ও দুর্বলতা তৈরি হতে থাকে। উপনিবেশিক মানসিকতা অর্থনৈতিক, সামাজিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক প্রতিটি ক্ষেত্রে স্বতঃস্ফূর্তটাকে ধ্বংস করে এবং ব্যাহত করে মানুষের স্বাভাবিক মানসিক বিকাশকে। উপনিবেশিক সময়ে গড়ে উঠা মানসিকতা ধকল যাচ্ছে বর্তমান সময়ের তরুণ প্রজন্মের ওপরও। তারাও নানা কারণে তাদের পেশা নিয়ে হীনমন্যতায় ভুগছে। আমাদের সমাজ বুঝছে না তারা যেটা ভালো চাকরি মনে করছে, সেটি ব্রিটিশ কলোনির অত্যাচারী কর্মচারীদের বিমূর্ত রূপ। পৃথিবীর কোনো সভ্য দেশে আমাদের দেশের মতো ভালো চাকরি ডেফিনিশন নেই। যারা ব্রিটিশ সাম্রাজ্য গড়ে তুলেছিল সেই যুক্তরাজ্যের বরিস জনসনের দিকে তাকালে সহজে বিষয়টি অনুধাবন হবে। প্রধানমন্ত্রিত্ব থেকে অব্যাহতির পর চাকরি নিয়েছেন কনজারভেটিভ পার্টির এ নেতা। যুক্তরাজ্যের সংবাদপত্র ডেইলি মেইলে কলাম লেখক হিসাবে যোগ দিয়েছেন তিনি। ডেইলি মেইলের সঙ্গে চুক্তি অনুযায়ী, বরিস জনসন সংবাদপত্রটিতে প্রতি সপ্তাহে একটি করে কলাম লিখবেন। এতে তার মানসম্মানের কিন্তু কোনো ক্ষতি হচ্ছে না। আর আমাদের সমাজের ধারণা হচ্ছে, একজন এমপি হলে তার চৌদ্দপুরুষকে পায়ের ওপর পা তুলে খেতে হবে।
পেশাগত সংকট এবং ভালোমন্দ নির্ধারণ করার যে উপনিবেশিক রোগ রয়েছে, সেটি থেকে আমাদের সমাজকে বেরিয়ে আসতে হবে। উপনিবেশিক ভাবধারার যে কুসংস্কার ও বিজিত জাতির প্রতি যে দুর্বলতা তৈরি হয়েছে, সেটি থেকে বেড়িয়ে আসতে হবে। নয়তো আমরা দাসত্বের শৃঙ্খল থেকে মুক্ত হতে পারব না। প্রত্যেক পেশাজীবী তার নিজ কর্মক্ষেত্রে মেধার স্বাক্ষর রেখে দেশের অর্থনৈতিক কাঠামোকে যে ধরে রেখেছে সেটির মূল্যায়ন করতে হবে।
শিক্ষার্থী, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়