
নদীমাতৃক এ দেশের বুকের ওপর দিয়ে বহমান শত শত নদী। নদীকে ঘিরেই অনেক মানুষের জীবন-জীবিকা। যাতায়াত, যোগাযোগ, ব্যবসা-বাণিজ্য চলছে নদীকে ঘিরে। নদী দিয়েছে ‘মাছে ভাতে বাঙালি’ উপাধি। এ ছাড়া এদেশে অনেক মানুষের যাতায়াতের জনপ্রিয় একটি মাধ্যম নৌপথ।
তুলনামূলকভাবে খরচ কম এবং আরামদায়ক হওয়ায় অনেক মানুষই যাতায়াতের জন্য নৌপথকে বেছে নেন। দেশের এক-তৃতীয়াংশ মানুষ কম-বেশি নৌপথে যাতায়াত করে।
দক্ষিণাঞ্চলের মানুষের গণপরিবহণ বলতে নৌযানকেই বোঝায়। কিন্তু এতকিছু সত্ত্বেও আমাদের দেশের নৌপথ কতটুকু নিরাপদ? এ প্রশ্নের উত্তর পেতে একদমই ভাবতে হয় না। কিছুদিন পরপরই ছোট-বড় দুর্ঘটনাই তার প্রমাণ। একটা শোকের মাতম না কাটতেই আবার দুর্ঘটনা হানা দেয়। নৌপথে নিরাপত্তার এমন বেহাল দশা চলবে কতকাল? আর কত প্রাণ হারালে নৌ-পরিবহণ সংশ্লিষ্টদের জ্ঞান ফিরবে?
নৌপথে সংঘটিত প্রতিটি দুর্ঘটনার পরে তদন্ত কমিটি হয়। নিয়ম অনুযায়ী কিছু তদন্ত কমিটি প্রতিবেদনও জমা দেয়। তদন্তে উঠে আসে নানা অনিয়ম-অব্যবস্থাপনার কথা-অদক্ষ চালক, ত্রুটিযুক্ত এবং লাইসেন্সবিহীন নৌযান, বন্দর তত্ত্বাবধায়ক, নৌযান মালিকের দায়িত্বহীনতা এবং পর্যাপ্ত সেফটি ইকুইপমেন্টের অভাব ইত্যাদি। নৌদুর্ঘটনার পুনরাবৃত্তি যাতে না ঘটে, এজন্য অভিযোগের সঙ্গে তদন্ত কমিটি কিছু সুপারিশও করে। কিন্তু এরপর এসব তদন্ত প্রতিবেদন এবং সুপারিশ কোনোটিই আলোর মুখ দেখে না।
আসলে নৌপথে ঘটে যাওয়া মর্মান্তিক ঘটনাগুলোকে দুর্ঘটনা বললে ভুল হবে। এগুলো এক প্রকার হত্যাকাণ্ড। হত্যার বিচারের মতোই এগুলোর বিচার হওয়া উচিত। কিন্তু তা যখন হয় না, তখন ঘটনার পুনরাবৃত্তি হওয়া অস্বাভাবিক কিছু নয়। কখনো দুর্ঘটনার কবলে পড়লে, তখন করণীয় কী-তা যাত্রার শুরুতেই যাত্রীদের অবহিত করা উচিত। অনেক সময় প্রয়োজনীয় সবকিছু থাকলেও দুর্ঘটনা থেকে উদ্ধার পাওয়ার উপায় না জানার কারণে সব বিফলে যায়।
জীবনরক্ষাকারী সব উপকরণ পর্যাপ্ত আছে কিনা, যাত্রার শুরুতেই তা দেখা উচিত। অতিরিক্ত যাত্রী বহন করার কারণেও অনেক দুর্ঘটনা ঘটে। এক্ষেত্রে যাত্রীদের দোষও কোনো অংশে কম নয়। বিশেষ করে ঈদ-পূজার সময় যাত্রীদের চাপ বেশি থাকে। এ সময় অতিরিক্ত যাত্রী বহনের প্রবণতা বেশি লক্ষ করা যায়। তাই যাত্রীদের পাশাপাশি কর্তৃপক্ষকেও এ ব্যাপারে কঠোর হতে হবে।
সর্বশেষ ঘটে যাওয়া ঝালকাঠির সুগন্ধা নদীতে পাঁচ শতাধিক যাত্রীসহ ঢাকা থেকে বরগুনাগামী অভিযান-১০ লঞ্চে বৃহস্পতিবার রাত ৩টার দিকে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। গণমাধ্যমের তথ্য মতে, এতে এখন পর্যন্ত প্রায় ৪২ জনের মৃত্যু হয়েছে। এ ছাড়া বরিশালের শেরেবাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ও ঝালকাঠি সদর হাসপাতালে শতাধিক যাত্রী দগ্ধ অবস্থায় চিকিৎসাধীন। বৃদ্ধ, শিশুসহ অনেকে নিখোঁজ। স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন নিরাপদ সড়ক চাই আন্দোলনের পরিসংখ্যান মতে, ২০২০ সালে নৌপথে ছোট-বড় ৭০টি দুর্ঘটনা ঘটেছে। এতে প্রাণ হারিয়েছে ২১২ জন। আহত ও নিখোঁজ হয়েছে আরও অন্তত ১০০ জন। নিঃসন্দেহে এ পরিসংখ্যান আমাদের জন্য অশনিসংকেত। সবশেষে বলতে চাই, নৌপথের সব অনিয়ম-অব্যবস্থাপনা দূর হোক। প্রয়োজনীয় সব পদক্ষেপ গ্রহণ করে নৌপথকে নিরাপদ করতে হবে। অন্যথায় এমন হৃদয়বিদারক ঘটনা ঘটতেই থাকবে।
শিক্ষার্থী, খাদ্য ও পুষ্টি বিজ্ঞান অনুষদ, পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়
anisurpstu@gmail.com