নতুন শিক্ষাক্রম : বিশ্বনাগরিক সৃষ্টির মূলমন্ত্র
![Icon](https://cdn.jugantor.com/uploads/settings/icon_2.jpg)
সহিদুল ইসলাম
প্রকাশ: ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
সিনিয়র শিক্ষক, কলাগাছিয়া ইউনিয়ন উচ্চ বিদ্যালয় বন্দর, নারায়ণগঞ্জ
শিক্ষাক্রমের ইংরেজি হলো Curriculum. Curriculum শব্দের উৎপত্তি হয়েছে ল্যাটিন শব্দ ‘currere’ থেকে। ‘currere’ অর্থ পাঠ্যসূচি। কেউ কেউ মনে করেন এটি ল্যাটিন শব্দ ‘Currer’ থেকে এসেছে, যার অর্থ হলো- ‘ঘোড় দৌড়ের মাঠ’। ‘কুরিয়ার’ অর্থ দৌড়ের পথ। দৌড়ের মাঠে যেমন কেউ একটি পথ ধরে নিজের সামর্থ্য অনুযায়ী দ্রুত লক্ষ্যে পৌঁছে, তেমনি শিক্ষাক্ষেত্রে শিক্ষার্থীরাও কারিকুলামের সাহায্যে তার চাহিদা ও সামর্থ্য অনুযায়ী শিক্ষার পূর্ব নির্দিষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছাতে চেষ্টা করে।
এ শিক্ষাক্রম নিয়ে আমেরিকান শিক্ষাবিদ রাফটাইলার (শিক্ষাক্রমের জনক) ১৯৫৬ খ্রি. বলেন, শিক্ষাক্রম হলো শিক্ষার লক্ষ্য অর্জনের জন্য স্কুল কর্তৃক পরিকল্পিত ও পরিচালিত শিক্ষার্থীর সব শিখন অভিজ্ঞতা।
এ বিষয়ে জনকার (১৯৬৮) বলেন, ‘বিদ্যালয় কর্তৃক পরিকল্পিত ও পরিচালিত যাবতীয় শিখন যা বিদ্যালয় এবং বিদ্যালয়ের বাইরে দলগত বা ব্যক্তিগতভাবে সম্পন্ন করা হয় তাই শিক্ষাক্রম’।
‘বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত থেকে উন্নয়নশীল দেশে পদার্পণ করছে এবং ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত দেশে পদার্পণের লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখেছে। এ লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের জন্য মানসম্মত শিক্ষার কোনো বিকল্প নেই। আর এ লক্ষ্যকে সামনে রেখেই জাতীয় শিক্ষাক্রম রূপরেখা ২০২১ প্রণীত হয় এবং যেখানে শিক্ষার প্রতিটি স্তরের পরিকল্পনা বিন্যস্ত করা হয়েছে’।
‘জাতীয় শিক্ষাক্রম রূপরেখা ২০২১-এর আলোকে জাতীয় শিক্ষাক্রম ২০২২ ও শিখন সামগ্রী প্রণয়ন করা হয়। প্রণীত এ শিক্ষাক্রমে পাঠ্যপুস্তকের পাশাপাশি প্রয়োজনীয় অন্যান্য শিখন সামগ্রী ব্যবহার করে কিভাবে শ্রেণি কার্যক্রমকে যৌক্তিকভাবে আরও আনন্দময় এবং শিক্ষার্থীকেন্দ্রিক করা যায় তার ওপর জোর দেওয়া হয়। শ্রেণি কার্যক্রমকে শুধু শ্রেণিকক্ষের ভিতরে সীমাবদ্ধ না রেখে শ্রেণির বাইরে নিয়ে যাওয়ার কথা বলা হয়। এ শিক্ষাক্রমে ডিজিটাল প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে পাঠ পরিচালনাকে আরও আকর্ষণীয় করারও সুযোগ রাখা হয়েছে’। পূর্বের শিক্ষাক্রম ছিল জ্ঞানভিত্তিক। কিন্তু নতুন এ শিক্ষাক্রম যোগ্যতাভিত্তিক, যেখানে- জ্ঞান, দক্ষতা, মূল্যবোধ ও দৃষ্টিভঙ্গির সমন্বয়ে যোগ্যতা নির্ধারণ করা হয়েছে। শিখন সামগ্রী প্রণয়নের ক্ষেত্রে বিষয়ভিত্তিক যোগ্যতাগুলোকে এক বা একাধিক শিখন অভিজ্ঞতায় রূপান্তর করা হয়েছে। শিক্ষার্থীরা এ শিখন অভিজ্ঞতার মাধ্যমে কাক্সিক্ষত যোগ্যতা অর্জন করতে সমর্থ হবে। এক্ষেত্রে মূল্যায়নের ভিত্তি হবে ‘যোগ্যতা অর্জন’।
একটি শিক্ষাক্রম প্রণয়ন করতে অনেক ধাপ পেরোতে হয়। ১৯১৭-১৯১৮ সালে নতুন এ শিক্ষাক্রম প্রণয়নের যাত্রা শুরু হয়। প্রথমে জাতীয় পর্যায়ে এর কর্মশালা হয়, দ্বিতীয়ত জাতীয় পর্যায়ে রূপরেখা তৈরি হয়, তৃতীয়ত কারিকুলাম উন্নয়ন ও পরিমার্জনের জন্য কোর কমিটি গঠন করা হয়, চতুর্থ পর্যায়ে কার্য সম্পাদন কমিটি গঠন করা হয়, পঞ্চম পর্যায়ে বিষয়ভিত্তিক বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠন করা হয়, ষষ্ঠ পর্যায়ে কারিকুলামের খসড়া কপি জনগণের জন্য ওয়েবসাইটে উন্মুক্ত করা হয়, সপ্তম পর্যায়ে ন্যাশনাল কারিকুলাম কোর কমিটিতে প্রেরণ করা হয়, অষ্টম পর্যায়ে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর অনুমোদনের জন্য প্রেরণ করা হয়, নবম পর্যায়ে উপদেষ্টা কমিটিতে প্রেরণ ও চূড়ান্ত করা হয়, অবশেষে দশম পর্যায়ে এনসিটিবি চূড়ান্ত অনুমোদন দেয়। এভাবেই নতুন কারিকুলামের শুভ সূচনা হয়। আর এ ধাপগুলো অতিক্রম করতেই প্রায় পাঁচ বছর সময় অতিবাহিত হয়ে যায়। তারপর ২০২২ সালে ৬২টি নির্বাচিত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ষষ্ঠ শ্রেণিতে জাতীয় শিক্ষাক্রম রূপরেখা ২০২১ অনুযায়ী জাতীয় শিক্ষাক্রম ২০২২ পাইলটিং কার্যক্রম পরিচালনা শুরু হয়।
নতুন এ শিক্ষাক্রমের প্রবক্তা হলেন ডেভিড অ্যালেন কোব (১২ ডিসেম্বর ১৯৩৯) একজন মার্কিন শিক্ষাতত্ত্ববিদ। তার শিখন অভিজ্ঞতাচক্র হলো : ১. প্রেক্ষাপট নির্ভর /বাস্তব অভিজ্ঞতা ২. প্রতিফলনমূলক পর্যবেক্ষণ-৩. বিমূর্ত ধারণায়ন ৪. সক্রিয় পরীক্ষণ।
যেমন উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, একজন ছেলে রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে, হঠাৎ সে একটি বস্তুর সঙ্গে ধাক্কা খেল, এটাই হলো তার প্রেক্ষাপট, মানে এখানে একটি প্রেক্ষাপট তৈরি হলো। এবার সে ভালোভাবে খেয়াল করে দেখল সে একটি ইটের সঙ্গে ধাক্কা খেয়েছে- এটা হলো প্রতিফলনমূলক পর্যবেক্ষণ। এ অবস্থায় সে চিন্তা করল, অন্য কেউ যেন তার মতো এমন হোঁচট না খায়! এর জন্য কী করা যায়? সে চিন্তা করে মনে মনে ঠিক করল, এখানে সে একটি বিপদ সংকেত লাগিয়ে রাখবে- এটাই হলো বিমূর্ত ধারণায়ন। এবার সে একটি সাইনবোর্ড জোগাড় করল এবং লিখে রাখল সাবধান! এখানে বিপদ! রাস্তার অন্য পাশ দিয়ে হাঁটুন- এটাই হলো সক্রিয় পরীক্ষণ।
এ শিক্ষাক্রমের একটি স্লোগান হলো- ‘শিখন হবে অভিজ্ঞতায়- মূল্যায়ন হবে যোগ্যতায়’।
আর এ অভিজ্ঞতাভিত্তিক শিখনের কিছু বৈশিষ্ট্য রয়েছে। এ অভিজ্ঞতা ভিত্তিক শিখনের মূল বৈশিষ্ট্যগুলো হলো- ১. শিক্ষার্থী তার প্রেক্ষাপট অনুযায়ী একটি শিখন অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যাবে। ২. শিক্ষার্থী নিজেই তার কাজের পরিকল্পনা প্রণয়নে অংশগ্রহণ করবে। ৩. পরিকল্পনা অনুযায়ী শিক্ষার্থী শ্রেণিকক্ষের ভেতরে, বাহিরে, দলগত কাজ, একক কাজ ইত্যাদিতে অংশগ্রহণ করবে। ৪. পরিকল্পনা অনুযায়ী শিক্ষা কার্যক্রমে অভিভাবকসহ অন্যান্য অংশীজনের অংশগ্রহণ থাকবে। ৫. স্থানীয় পরিবেশ থেকে শিক্ষার্থীরা বিভিন্ন শিখন সামগ্রী ব্যবহার করবে।
৬. শিক্ষার্থী তার প্রেক্ষাপটে বাস্তব সমস্যা সমাধান করতে গিয়ে অর্জিত দক্ষতা প্রয়োগ করে একটি ফলাফলে উপনীত হবে। ৭. প্রতিটি অভিজ্ঞতা চলাকালে শিক্ষার্থী নিয়মিতভাবে মূল্যায়ন কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করবে এবং সে অনুযায়ী শিখন উন্নয়নে প্রয়োজনীয় সহায়তা পাবে।
শিক্ষাক্রম ২০২১ এ যে বিষয়গুলো বিবেচনা করা হয়েছে তা হলো- শিক্ষার্থীকেন্দ্রিক ও আনন্দময় পড়াশোনার পরিবেশ সৃষ্টি, বিষয় এবং পাঠ্যপুস্তকের বোঝা ও চাপ কমিয়ে দক্ষতা ও যোগ্যতায় গুরুত্ব আরোপ, গভীর শিখন ও তার প্রয়োগে গুরুত্ব প্রদান, মুখস্থ নির্ভরতার পরিবর্তে অভিজ্ঞতা ও কার্যক্রম ভিত্তিক শিক্ষা, প্রেক্ষাপট নির্ভর শিখনে অগ্রাধিকার, খেলাধুলা ও সৃজনশীল কার্যক্রমে গুরুত্বারোপ, হোম ওয়ার্কের চাপ কমানো ও নির্দিষ্ট দিনের শিখনকাজ যেন আনন্দময় কাজের মাধ্যমে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেই শেষ হয় সে বিষয়ে গুরুত্বারোপ, নির্দিষ্ট সময়ে অর্জিত পারদর্শিতার মূল্যায়ন ও সনদ প্রাপ্তির প্রতি গুরুত্ব আরোপ, জীবন ও জীবিকার সঙ্গে সম্পর্কিত শিক্ষা।
পূর্বে শুধু পরীক্ষার ওপর গুরুত্ব দেওয়া হতো, কিন্তু বর্তমানে প্রথাগত পরীক্ষার চেয়ে শিখনকালীন মূল্যায়নে গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। মূল্যায়নে অংশীজনের সম্পৃক্তকরণ এবং কোনো বিভাগ না থাকায় বিভিন্ন বিষয় সম্পর্কে শিক্ষার্থীদের যোগ্যতা অর্জন হবে।
নতুন কারিকুলামে যে পরিবর্তনগুলো আমাদের চোখে পড়ে- অভিজ্ঞতাভিত্তিক শিক্ষা, কোনো বিভাগ (বিজ্ঞান, মানবিক, বাণিজ্য) নেই, গাইড বই থেকে দূরে থাকা যাবে, পরীক্ষাভীতি দূর হবে, মূল্যায়নে আমূল পরিবর্তন, জীবন ও জীবিকার সঙ্গে সম্পর্কিত শিক্ষা, যোগ্যতাভিত্তিক শিক্ষাক্রম, অনুসন্ধানভিত্তিক শিক্ষা, বইয়ের বোঝা হ্রাস, দশম শ্রেণিতে আলাদা বই এবং দশম শ্রেণির পাঠ্য বইয়ের ওপর ভিত্তি করেই এসএসসি পরীক্ষা।
নতুন শিক্ষাক্রমে মূল্যায়নের ক্ষেত্রেও আমূল পরিবর্তন হয়েছে। যেমন- প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় শ্রেণিতে শতভাগ শিখনকালীন মূল্যায়ন নির্ধারণ করা হয়েছে, চতুর্থ এবং পঞ্চম শ্রেণিতে ৫টি বিষয়ে (বাংলা, ইংরেজি, গণিত, বিজ্ঞান, ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞান)-৬০% শিখন কালীন মূল্যায়ন এবং ৪০% সামষ্টিক মূল্যায়ন নির্ধারণ করা হয়েছে। আর বাকি ৫টি বিষয়ে শতভাগ শিখনকালীন মূল্যায়ন নির্ধারণ করা হয়েছে। ষষ্ঠ-১০ম শ্রেণিতে ৫টি বিষয়ে (বাংলা, ইংরেজি, গণিত, বিজ্ঞান, ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞান) শিখনকালীন ৫০% এবং সামষ্টিক ৫০% মূল্যায়ন নির্ধারণ করা হয়েছে। অপর পাঁচটি বিষয়ে শতভাগ শিখনকালীন মূল্যায়ন নির্ধারণ করা হয়েছে। পূর্বে মূল্যায়নের ক্ষেত্রে লিখিত পরীক্ষাকে অধিক গুরুত্ব দেওয়া হতো, কিন্তু বর্তমানে শিখনকালীন মূল্যায়ন ১২টি ক্যাটাগরিতে দেওয়ার ওপর গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে। যেমন- অ্যাসাইনমেন্ট, প্রকল্প, খেলাধুলা, একক কাজ, দলগত কাজ, পোস্টার প্রদর্শন, দলগত কুইজ, সতীর্থ মূল্যায়ন, শিক্ষক, অংশীজন, অনুসন্ধান এবং স্বমূল্যায়ন। যোগ্যতার যে ৪টি উপাদান রয়েছে তা ব্যাখ্যা করলে বিষয়টি আরও স্পষ্ট হয়। যেমন- গাড়ি চালানোর ক্ষেত্রে :
১) জ্ঞান : গাড়ি চালানোর নিয়মকানুন জানা হলো জ্ঞান। ২) দক্ষতা : গাড়ি ভালোভাবে চালাতে পারা হলো দক্ষতা। ৩) দৃষ্টিভঙ্গি : সিগন্যালে গাড়ি নেই, সার্জেন্ট নেই, নিয়ম মানবে কিনা- সেটা দৃষ্টিভঙ্গি।
৪) মূল্যবোধ : সব সময় নিয়ম মেনে গাড়ি চালানোর প্রতি ইতিবাচক মনোভাব তৈরি হওয়া হলো মূল্যবোধ।
যোগ্যতা : নিয়ম-কানুন মেনে ভালো ভাবে গাড়ি চালিয়ে গন্তব্যে পৌঁছতে পারা হচ্ছে তার যোগ্যতা।
অনেকের ধারণা নতুন কারিকুলামে তেমন মূল্যায়ন নেই, পূর্বে শুধু লিখিত মূল্যায়ন হতো। কিন্তু বর্তমানে মূল্যায়নের ব্যাপকতা অনেক বেড়েছে এবং পদ্ধতিগত পরিবর্তন হয়েছে। সম্প্রতি মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ড খসড়া মূল্যায়ন প্রক্রিয়া ঘোষণা করেছেন। এক্ষেত্রে মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষায় খসড়া মূল্যায়ন প্রক্রিয়া অনুযায়ী প্রতিটি বিষয়ে মিড টার্ম ও বার্ষিক চূড়ান্ত পরীক্ষা হবে পাঁচ ঘণ্টার। এসএসসি ও এইচএসসির মতো পাবলিক পরীক্ষাও ৫ ঘণ্টাব্যাপী অনুষ্ঠিত হবে। মূল্যায়ন পরীক্ষা দুটি পর্যায়ে হবে- মিড টার্ম ও বার্ষিক চূড়ান্ত পরীক্ষা। পরীক্ষার সময় হবে পাঁচ ঘণ্টা। এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষাও হবে পাঁচ ঘণ্টা। পরীক্ষা চলবে সকাল ১০টা থেকে বিকাল ৪টা পর্যন্ত, মাঝে ১ ঘণ্টা বিরতি। চার ঘণ্টা হবে ব্যবহারিক পরীক্ষা ও এক ঘণ্টা তাত্ত্বিক পরীক্ষা। তত্ত্বীয় পরীক্ষার উত্তরপত্র সংশ্লিষ্ট বোর্ডে পাঠানো হবে। (পাবলিক পরীক্ষার ক্ষেত্রে)
মিড টার্ম ও বার্ষিক চূড়ান্ত পরীক্ষা হবে সামষ্টিক মূল্যায়ন এবং ধারাবাহিক মূল্যায়ন আগের মতো চলবে।
তবে পরীক্ষায় মার্কিং সিস্টেম বা কোনো নম্বর থাকবে না। মূল্যায়ন পরীক্ষা চতুর্থ হতে নবম শ্রেণির ক্ষেত্রে প্রযোজ্য ও একই সিস্টেমে দশমে হবে পাবলিক পরীক্ষা। মূল্যায়ন হবে তিন ভাগে বিভক্ত- রিপোর্টিং ভালো, অর্জনের পথে এবং প্রাথমিক পর্যায়ে। আগামী বছর ২০২৫-এ ৪র্থ, পঞ্চম, দশম শ্রেণিতে নতুন কারিকুলাম চালু হবে। সবকিছু ঠিক থাকলে আগামী জুন মাস থেকে এ প্রক্রিয়ায় মূল্যায়ন শুরু হবে।
মূল্যায়নের ক্ষেত্রে আরেকটি নতুন বিষয় সংযোজিত হয়েছে। সেটা হলো আচরণিক মূল্যায়ন। আচরণিক মূল্যায়নের ক্ষেত্রে দশটি ইন্ডিকেটর নির্বাচন করা হয়েছে। সেগুলো হলো- ১. দলগত কাজে সক্রিয় অংশগ্রহণ করছে, ২. নিজের বক্তব্য ও মতামত দলের সবার সঙ্গে শেয়ার করছে এবং অন্যের বক্তব্য শুনে গঠনমূলক আলোচনায় অংশ নিচ্ছে। ৩. নির্দিষ্ট সমস্যা সমাধানে পূর্বনির্ধারিত প্রক্রিয়া অনুযায়ী কাজের ধাপগুলো যথাযথভাবে অনুসরণ করছে। ৪. শিখন অভিজ্ঞতা চলাকালে পাঠ্যপুস্তকে বর্ণিত কাজগুলো সম্পন্ন করছে এবং বইয়ে নির্ধারিত স্থানে প্রয়োজনীয় ছক/ অনুশীলনী পূরণ করছে। ৫. পরিকল্পনা অনুযায়ী যথাসময়ে নির্ধারিত কাজ সম্পন্ন করছে। ৬. দলগত ও একক কাজের বিভিন্ন ধাপে সততার পরিচয় দিচ্ছে। ৭. নিজের দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি অন্যদের কাজে সহযোগিতা করছে এবং দলে সমন্বয় সাধন করছে। ৮. অন্যদের দৃষ্টিভঙ্গির ভিন্নতা ও বৈচিত্র্যের প্রতি শ্রদ্ধা রেখে তাদের মতামতের গঠনমূলক সমালোচনা করছে। ৯. দলের অন্যদের কাজের ওপর ভিত্তি করে গঠনমূলক ফিডব্যাক দিচ্ছে। ১০. ব্যক্তিগত যোগাযোগ, উপস্থাপন, মডেল তৈরি, উপকরণ নির্বাচন ও ব্যবহার ইত্যাদির ক্ষেত্রে পরিমিতিবোধ, বৈচিত্র্য ও নান্দনিকতা বজায় রেখে সিদ্ধান্ত নিচ্ছে।
পূর্বে এ ধরনের কোনো মূল্যায়ন ছিল না, বর্তমানে আচরণের এ দশটি ক্যাটাগরি নির্বাচন করায় শিক্ষার্থী ক্লাসের ভিতরে এবং বাইরে সর্বদা সক্রিয় থাকবে।
নতুন শিক্ষাক্রমে দশম শ্রেণি শেষে একজন শিক্ষার্থী তিনটি যোগ্যতা অর্জন করবে। যেমন- ১. সেবা (সব চাকরি), ২. শিল্প (উদ্যোক্তা), ৩. কৃষি (কৃষির সঙ্গে সম্পর্কিত)।
প্রত্যেক শিক্ষাক্রমেরই অভিলক্ষ থাকে। নতুন এ শিক্ষাক্রমেরও কিছু অভিলক্ষ রয়েছে। যথা- সব শিক্ষার্থীর অন্তর্নিহিত সম্ভাবনা বিকাশে কার্যকর ও নমনীয় শিক্ষাক্রম প্রণয়ন, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে শিক্ষার্থীর বিকাশ ও উৎকর্ষের সামাজিক কেন্দ্র হিসাবে গড়ে তোলা, প্রাতিষ্ঠানিক পরিবেশের বাইরেও বহুমাত্রিক শিখনের সুযোগ সৃষ্টি ও স্বীকৃতি প্রদান। সংবেদনশীল, জবাবদিহিমূলক, একীভূত ও অংশগ্রহণমূলক শিক্ষাব্যবস্থা নিশ্চিত করণ, সংবেদনশীল, জবাবদিহিমূলক, একীভূত ও অংশগ্রহণমূলক শিক্ষাব্যবস্থা নিশ্চিতকরণ।
পাঠ পরিচালনার ক্ষেত্রে পূর্বের এবং নতুন শিক্ষাক্রমের সামান্য দিক এভাবে ফুটিয়ে তোলা যায়। উদাহরণস্বরূপ ‘নিয়ম শৃঙ্খলার গুরুত্ব’ বুঝাতে গিয়ে পূর্বের শিক্ষা ব্যবস্থায় একজন শিক্ষক ক্লাসে মিনি লেকচার দিতেন। তারপর শিক্ষার্থীদের এ বিষয়ে খাতায় লিখতে বলতেন। শিক্ষার্থীরা শিক্ষকের কথা শুনে চিন্তা করে খাতায় লিখত। কিন্তু নতুন শিক্ষাক্রমে এ ‘নিয়ম শৃঙ্খলার গুরুত্ব’ বুঝাতে গিয়ে শিক্ষক একটি অভিনব পদ্ধতি ব্যবহার করবেন। যেমন- তিনি শ্রেণিকক্ষে একটি ফুটবল নিয়ে যাবেন এবং শিক্ষার্থীদের দুজন অধিনায়ক নির্বাচন করতে বলবেন। তারপর অধিনায়কদ্বয় খেলোয়াড় নির্বাচন করে দুটি দল গঠন করবে। এবার শিক্ষক তাদের নিয়ে মাঠে যাবেন এবং বলবেন, এবার কোনো নিয়ম-শৃঙ্খলা না মেনে যে যেভাবে পারো খেলা শুরু করও। ছাত্ররা খেলা শুরু করল, কিন্তু কোনো গোল হলো না। বরং নানা বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হলো। কিছু সময় অতিবাহিত হওয়ার পর খেলা বন্ধ করে এবার শিক্ষক নিয়মমতো খেলতে বললেন। এবার গোল হলো, আনন্দ হলো, কোনো বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হলো না। এবার শিক্ষক শ্রেণিকক্ষে এসে শিক্ষার্থীদের ৬-৮ জন করে বিভিন্ন দলে ভাগ হয়ে নিয়ম মেনে ফুটবল খেলার গুরুত্ব লিখতে বলবেন। এভাবে শিক্ষার্থীরা অভিজ্ঞতা অর্জন করে দলগত কাজ সম্পন্ন করবে। তারপর সবাই আলোচনা করে উপলব্ধি করবে জীবনের সর্বক্ষেত্রে নিয়ম মানার গুরুত্বও অপরিসীম। তারপর শিক্ষক বুঝিয়ে বলবেন- শ্রেণিকক্ষ, বিদ্যালয়, পরিবার, সমাজ রাষ্ট্র, সর্বত্রই নিয়মের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। এভাবে শিক্ষার্থীরা অভিজ্ঞতার মাধ্যমে যা শিখবে এটা হবে তার ডিপ লার্নিং। অর্থাৎ এ শিখন একজন শিক্ষার্থীর স্থায়ী শিখন হবে। কাজেই এ শিক্ষা ব্যবস্থাকে যুগোপযোগী এবং উত্তম ভাবতে হবে।
ইউরোপের বিভিন্ন দেশ, শ্রীলঙ্কা, জাপান এবং ভারতের কোনো কোনো প্রদেশসহ বিশ্বের প্রায় ৫১টি দেশে এ শিক্ষাব্যবস্থা চালু আছে। এ শিক্ষা ব্যবস্থার সবচেয়ে পজিটিভ দিক হলো অভিজ্ঞতাভিত্তিক শিক্ষা। এ শিক্ষা ব্যবস্থায় প্রতিটি বিষয়ের জন্য একটি ডাইমেনশন নির্ধারণ করা হয়েছে। প্রতিটি বিষয়ের ডাইমেনশন অনুযায়ী একজন শিক্ষার্থী যোগ্যতা অর্জন করে একটি নির্দিষ্ট শ্রেণি অতিক্রম করার পর সে জাতীয়তাবোধসম্পন্ন বিশ্ব নাগরিক হিসাবে গড়ে উঠবে। আমাদের এ নতুন শিক্ষাক্রমকে সর্বদা স্বাগত জানানো উচিত। এ শিক্ষাক্রম সম্পর্কে তিনটি ‘বি’ দিয়ে লেখার ইতি টানব। নতুন এ শিক্ষাক্রম সম্পর্কে ‘বি’ পজেটিভ, থিং পজেটিভ, ‘ডু’ পজেটিভ। এ কারিকুলাম বাস্তবায়ন হলে আমাদের দেশ অনেক এগিয়ে যাবে। সুনাগরিক সৃষ্টি হবে, আমাদের শিক্ষার্থীরা বিশ্বের অন্যান্য দেশের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে পারবে। কাজেই আমাদের প্রত্যেকেরই এ কারিকুলাম নিয়ে পজেটিভ ভাবা উচিত।
পরিশেষে, আমাদের এমন যুগোপযোগী, চমৎকার একটি শিক্ষাক্রম উপহার দেওয়ার জন্য বর্তমান সরকার, শিক্ষা মন্ত্রণালয়, মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তর, জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড এবং এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট সব সম্মানিত কর্মকর্তার প্রতি শ্রদ্ধা ও গভীর কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি।
তথ্য সহায়ক : জাতীয় শিক্ষাক্রম ২০২২ বিস্তরণ বিষয়ভিত্তিক প্রশিক্ষণ ম্যানুয়াল, মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তর, জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড, ইন্টারনেট, পাঠ্যপুস্তক, প্রশিক্ষকবৃন্দ।