শ্বাস চললেও বেঁচে নেই আফগান নারীরা
যুগান্তর ডেস্ক
প্রকাশ: ১১ আগস্ট ২০২২, ০২:০০ পিএম
প্রিন্ট সংস্করণ
তালেবানদের আফগানিস্তানের ক্ষমতা দখলের এক বছর পূর্ণ হবে ১৫ আগস্ট। এই এক বছরে তালেবানদের কড়া শরিয়াশাসনের বলি হয়েছেন আফগান নারীরা। নিষিদ্ধ হয় নারীদের উচ্চশিক্ষা, পুরুষের পাশাপাশি চাকরির অধিকারও হারিয়েছেন তারা। প্রায় দমবন্ধ অবস্থায় বছর কাটানো নারীরা বলেছেন, ‘আমাদের শ্বাস চললেও বেঁচে নেই আমরা। তালেবান দখলের পর থেকেই আমাদের মৃত্যু নিশ্চিত হয়েছে।’
আফগানিস্তানের নতুন সরকার মহিলা সরকারি কর্মচারীদের সরাসরি বরখাস্ত না করলেও কর্মক্ষেত্রে মহিলাদের প্রবেশে সীমাবদ্ধ করেছে। ক্ষমতায় ফিরে আসার পর থেকে তালেবান নারীদের স্বাধীনতার ওপর বেশ কিছু সীমাবদ্ধতা আরোপ করেছে। আর সেই সীমাবদ্ধতার বলি হয়েছেন হাজার হাজার নারী পেশাজীবী। আফগানিস্তানের একটি মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র কর্মকর্তা ছিলেন ৪৩ বছর বয়সি মাসুদা সামার (ছদ্মনাম)।
গত বছরের ১৫ আগস্ট তালেবান দখলের কয়েকদিন পর তিনি যখন অফিসে পৌঁছান, তখন তাকে সাফ জানিয়ে দেওয়া হলো-আপনাকে আমাদের প্রয়োজন নেই। সঙ্গে সঙ্গে ওই অফিসে প্রবেশাধিকার হারিয়েছেন মাসুদা- যেখানে তিনি কাটিয়েছেন তার জীবনের মূল্যবান ১৭টি বছর।
আরও অপমানজনক : তালেবানরা মাসুদাকে চাকরি থেকে বরখাস্ত না করে বাড়িতে থাকার হুকুম দিয়েছে। নামমাত্র বেতন দিচ্ছে। শুধু মাসুদাই নয়, আফগান সরকারের সব মহিলা কর্মীর অবস্থা তথৈবচ। মাসুদা বলেন, ‘এভাবে অফিসে না গিয়ে কম বেতন নেওয়াও আমাদের জন্য অপমানজনক। এ কারণে আমরা সরকারের সিদ্ধান্ত পরিবর্তনের জন্য আরও বেশ কয়েকবার তাদের দরবারে দৌড়ঝাঁপ করেছি। কিন্তু তারা তাদের সিদ্ধান্তে অনড়। বরং বলেছে অচিরেই আমাদের চাকরি থেকে সরিয়ে দেবে।’ পরিবারের আর্থিক চাপের কারণে সামার নিয়মিত তার সামান্য বেতন তুলে নিচ্ছেন। মাসুদা বলেন, ‘যতবার আমি ব্যাংকে যেতাম, আমি প্রথমে আমার চোখের জল মুছতাম। কারণ আমি এই পরিমাণ টাকা নিতে এতটা অপমানিত বোধ করি যেন আমার কাজ করার বা উপার্জন করার অধিকার নেই, ক্ষমতাও নেই। যেন মনে হয় আমি একজন ভিখারি।’ মাসুদা দুঃখ করে বলেন, ‘অথচ আমি সেই একজন-যে চাকরি পাওয়ার জন্য পড়াশোনা করেছি, র্যাংকে ওঠার জন্য পরিশ্রম করেছি, ওপরের স্তরে ওঠার কঠিন চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করেছি। অথচ এখন সরকার বলছে, আমার স্বামী কিংবা ভাইয়ের কাছে আমার চাকরিটি ছেড়ে দিতে হবে। এটা কি মানা যায়? আপনিই বলুন!’
ইতোমধ্যে বেসরকারি খাতেও বেশ কয়েকটি সংস্থা আর্থিক সংকটের কারণে এবং তালেবানের জবরদস্তি ক্রোধ এড়াতে সতর্কতামূলক ব্যবস্থা হিসাবে মহিলাদের চাকরি থেকে তাড়িয়ে দিয়েছে। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) একটি সমীক্ষা অনুযায়ী এই এক বছরে আফগানিস্তানে নারীদের কর্মসংস্থান অসম হারে হ্রাস পেয়েছে। বিশেষ করে দখলের পরের মাসগুলোতে এই হার হয়েছে ১৬ শতাংশ। এর বিপরীতে পুরুষদের চাকরি গেছে মাত্র ৬ শতাংশ। রিপোর্টে আশঙ্কা করা হয় মহিলাদের চাকরি হারানোর হার শিগগিরই ২৮ শতাংশে পৌঁছতে পারে। তালেবান ক্ষমতা দখলের আগে আফগান কর্মশক্তির ২২ শতাংশই ছিল নারী।
মারাত্মক প্রভাব : আফগান অর্থনীতিবিদ সায়েদা নাজাফিজাদা বলেন, ‘আফগানিস্তানে তালেবান ক্ষমতা দখলের আগে নারী শ্রমশক্তির অংশগ্রহণ গত কয়েক দশকে ব্যাপকভাবে বেড়েছে। কিছু ক্ষেত্রে আমাদের আঞ্চলিক প্রতিবেশীদের তুলনায় ভালো ছিল।’ সেই সঙ্গে তিনি জানান, আফগানিস্তানে কর্মজীবী নারীরাও বিদ্যমান অর্থনৈতিক সংকট, তালেবানদের দ্বারা নারীদের চলাচলে বিধিনিষেধ এবং প্রচলিত পিতৃতন্ত্রের কারণে বেকারত্বের ধাক্কার ঝুঁকিতে রয়েছে। তিনি বলেন, ‘যদিও আফগানিস্তানে নারীদের সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা কম।’
নাজাফিজাদা জানান, এর প্রভাব অর্থনীতির জন্য ধ্বংসাত্মক। কারণ এর ফলে আরও বেশি দারিদ্র্যসীমার নিচে নেমে আসবে। তিনি বলেন, ‘আফগানিস্তানে কর্মক্ষেত্রে মহিলাদের অনুপস্থিতি শুধু তাদের পরিবারকেই প্রভাবিত করে না বরং সমগ্র অর্থনীতিকে অকার্যকর করে তোলে।’ তালেবানদের ওপর পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞার কারণে আফগান অর্থনীতি মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হলেও নারীদের ওপর অতিরিক্ত নিষেধাজ্ঞার কারণে নারীকেন্দ্রিক ব্যবসাগুলো সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বিশ্বব্যাংকের সাম্প্রতিক এক সমীক্ষায় উল্লেখ করা হয়েছে-আফগানিস্তানে ৪২ শতাংশ নারী মালিকানাধীন ব্যবসা সাময়িকভাবে বন্ধ হয়ে গেছে। পক্ষান্তরে পুরুষ মালিকানাধীন ব্যবসা বন্ধ হয়েছে ২৬ শতাংশ। উপরন্তু প্রায় ৮৩ শতাংশ ব্যবসায়ী নারী ইঙ্গিত দিয়েছেন তারা পরবর্তী ছয় মাসে রাজস্ব ক্ষতির আশঙ্কা করছেন। যে কারণে কর্মীসংখ্যা কমানোর বিকল্প পাচ্ছেন না তারা, আর এদের অধিকাংশই নারী। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এক-চতুর্থাংশ নারী-মালিকানাধীন ব্যবসা বন্ধের ইঙ্গিত পাওয়া গেছে।
নারীকর্মীদের দক্ষতা : যদিও কর্মক্ষেত্রে নারীদের অনুপস্থিতি তাদের পুরুষ সহকর্মীরাও অনুভব করছেন। তাদের কর্মদক্ষতা নিয়ে প্রশংসা করেছেন অনেক উদ্যোক্তাও। কাবুলের একটি সংস্থার তত্ত্বাবধায়ক গফুর (ছদ্মনাম) বলেন, ‘আমাদের বিভাগের মহিলারা সবচেয়ে দক্ষ পেশাদার ছিলেন-যারা আমাদের মহিলা ক্লায়েন্টদের প্রযুক্তিগত পরিষেবা দিয়েছিলেন।’ তিনি আরও বলেন, ‘তাদের সম্পর্কে আমার কখনোই কোনো অভিযোগ ছিল না। এ কারণে আমাদের পরিষেবায় তাদের অনুপস্থিতি অপূরণীয় ক্ষতি।’