ভোটাধিকার নিশ্চিতে গুরুত্ব দিতে হবে
ড. বদিউল আলম মজুমদার
প্রকাশ: ০২ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে বিগত সরকারের পতনের পর প্রফেসর ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হয়েছে। এ সরকারের ওপর মানুষের আকাশচুম্বী প্রত্যাশা রয়েছে। তার মধ্যে একটি হলো, যারা বিভিন্ন ধরনের অন্যায় করেছে, দুর্নীতি করেছে, দুর্বৃত্তায়িত হয়েছে, লুটপাট করেছে, মানবতাবিরোধী অপরাধ করেছে, যারা গুম-খুন করেছে, যারা মানুষের অধিকার হরণ করেছে, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে-তাদের যেন বিচারের আওতায় আনা হয় এবং তাদের দৃষ্টান্তমূলক সর্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিত করা হয়। একইসঙ্গে জাতির আরও প্রত্যাশা হচ্ছে, বিগত কর্তৃত্ববাদী সরকার গত ১৫-১৬ বছর ধরে আমাদের ওপর যে স্টিমরোলার চালিয়েছে, সেটির যেন পুনরাবৃত্তি না ঘটে। আমরা যেন আবার আমাদের অধিকার থেকে বঞ্চিত না হই, নানা অন্যায়-অবিচারের শিকার না হই। এটি জনগণের একটি সুনির্দিষ্ট প্রত্যাশা।
আশার কথা, বিচার প্রক্রিয়া এরই মধ্যে শুরু হয়েছে; কিন্তু বিচার প্রক্রিয়ার কিছু কিছু বিষয়ে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। যেমন ঢালাওভাবে মামলা দেওয়া হচ্ছে, মামলাগুলো সঠিকভাবে সাজানো হয়েছে কিনা, এ নিয়ে অনেকের মনে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। কারা কারা অপরাধ করেছে, সেগুলো চিহ্নিত না করেই গণহারে মামলা হচ্ছে। ফলে এদিকেও নজর দেওয়া দরকার, যাতে সত্যিকারের দোষী যারা, তারা পার পেয়ে না যায়।
গত ফ্যাসিবাদী সরকার আমাদের ওপর যে স্টিমরোলার চালিয়েছে, তার পুনরাবৃত্তি যদি ঠেকাতে হয়, তাহলে আমাদের বুঝতে হবে কেন তা ঘটেছে। এর অনেকগুলো জটিল কারণ আছে। শেখ হাসিনা সরকার মোটামুটি একটি সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে ২০০৯ সালে ক্ষমতায় আসে; কিন্তু পরবর্তীকালে তারা দানবে পরিণত হয়। তারা কেন দানবে পরিণত হয়েছিল? এর অনেকগুলো জটিল ব্যাখ্যা আছে। সবচেয়ে বড় কারণ হলো, আমাদের ভোটাধিকার হরণ করা হয়েছে। যে লক্ষ্যে বাংলাদেশ সৃষ্টি হয়েছিল, তা হলো আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার প্রতিষ্ঠিত হবে। অর্থাৎ আমরা আমাদের নির্বাচিত প্রতিনিধির মাধ্যমে ঠিক করব রাষ্ট্র কীভাবে পরিচালিত হবে এবং রাষ্ট্র কী সিদ্ধান্ত নেবে। আমরা আমাদের ভোটের মাধ্যমে প্রতিনিধি নির্বাচিত করব। কিন্তু পাকিস্তানিরা আমাদের সেই সুযোগ থেকে বঞ্চিত করেছিল। সে সময় বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ নির্বাচনে নিরঙ্কুশ বিজয় অর্জন করার পরও বঙ্গবন্ধুকে সরকার গঠন করতে দেওয়া হয়নি। যার প্রেক্ষাপটে ও আরও অন্যান্য বঞ্চনা-বৈষম্যকে কেন্দ্র করেই আমাদের মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয় এবং রক্তের বিনিময়ে আমরা স্বাধীনতা অর্জন করি। আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার এবং আমাদের যে রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক বৈষম্য দূর করার লক্ষ্য ছিল, দুর্ভাগ্যবশত ২০০৮ সালের ডিসেম্বরের নির্বাচনে শেখ হাসিনা বিপুল ভোটে ভূমিধস বিজয় নিয়ে ক্ষমতায় এলেও তারা সে লক্ষ্যের পক্ষে কাজ করেনি। দিনবদলের যে অঙ্গীকার করে এসেছিল সেই সরকার অর্থাৎ আমাদের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে আরও কার্যকর করা, প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে দলীয়করণ না করা, দুর্নীতির অবসান ঘটানো ইত্যাদি কাজগুলো তারা করেনি। অনেক সংস্কার ও পরিবর্তনের কথা বলে তারা ক্ষমতায় এসেছিল। এসব অঙ্গীকার পূরণে তারা ব্যর্থ হয়। এ প্রেক্ষিতেই বিচারপতি হাবিবুর রহমান ২০১১ সালে বলেছিলেন, দেশটা বাজিকরদের হাতে চলে গেছে।
যদিও সেই সরকার ক্ষমতায় এসেছিল চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, দলবাজি ইত্যাদি দূর করার অঙ্গীকার নিয়ে; কিন্তু দু’বছরের মাথায়ই তারা এমন অবস্থানে পৌঁছায় যে, বিচারপতি হাবিবুর রহমানের মতো একজন নিরপেক্ষ ব্যক্তি এমন কথা বলতে বাধ্য হয়েছিলেন। তার মানে হচ্ছে, বিগত সরকার তার অঙ্গীকার পালনে ব্যর্থ হয়েছে এবং জনপ্রিয়তা হারিয়েছে। জনপ্রিয়তা হারানোর প্রেক্ষিতেই তারা ঠিক করেছিল যে, কারসাজির মাধ্যমে তারা ক্ষমতায় টিকে থাকবে। সে কারণেই তারা ২০১৪ সালে একতরফা নির্বাচন করে ক্ষমতায় আসে। আবার ২০১৮ সালে তারা মধ্যরাতের ভোটের মাধ্যমে ক্ষমতা কুক্ষিগত করে। এর আগে তারা ২০১১ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল করেছিল, যার মাধ্যমে দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের বিধানে ফিরে আসে। আমরা জানি, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে যেসব নির্বাচন হয়েছিল, সে সময় যারা ক্ষমতায় ছিল, তারা ক্ষমতাচ্যুত হয়েছে। আর দলীয় সরকারের অধীনে যখন নির্বাচন হয়েছে, তখন যারা ক্ষমতায় ছিল, তারাই ক্ষমতায় ফিরে এসেছে। এই কারণে ২০১১ সালে পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল করা হয়েছিল।
এভাবে ২০২৪ সালেও তারা একতরফা নির্বাচন করে ক্ষমতায় এলে মানুষের মধ্যে ব্যাপক ক্ষোভের সৃষ্টি হয়। ভোটের অধিকার মানুষের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ভোটের অধিকার মানুষের নাগরিকত্বেরই প্রতিফলন এবং বাংলাদেশকে মনে করা হয় তারা ভোটপাগল জাতি। সারা পৃথিবীতে আমরা সুনাম অর্জন করেছি এভাবে যে, বাংলাদেশের মানুষ বিশেষ করে নারীরা লাইনে দাঁড়িয়ে থেকে তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করে। কিন্তু সেই নির্বাচনি ব্যবস্থাই নির্বাসনে পাঠিয়ে দেয় বিগত সরকার। অর্থাৎ আমাদের ভোটের অধিকার হরণ করার মাধ্যমে যা ঘটেছে, তাতে সরকারের দায়বদ্ধতার কাঠামো ভেঙে ফেলা হয়েছে। সরকারে যারা থাকেন, প্রতি ৫ বছর অন্তর যদি জনগণের কাছে ভোট চাওয়ার বাধ্যবাধকতা থাকত, তাহলে কিন্তু জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষা, সুখ-দুঃখ তাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ বিবেচিত হতো। বিতর্কিত জালিয়াতির নির্বাচনের মাধ্যমে যারা সংসদ-সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন, তারাও সরকারের সমান্তরালে জবাবদিহিতা অর্থাৎ সংসদে দাঁড়িয়ে কিংবা অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে পারেনি। এভাবে একটা জবাবদিহিতাহীন সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। এবং সরকার তাদের স্বার্থ দেখেছে, যারা তাদের ক্ষমতায় এনেছে এবং টিকিয়ে রাখতে সাহায্য করেছে। ওই শ্রেণিও সেই সুযোগে দুর্নীতি, লুটপাট, স্বজনপ্রীতি অব্যাহত রেখেছিল। সেটা তারা পারত, কারণ তাদের জবাবদিহিতার প্রয়োজন ছিল না। এই ব্যাপারগুলো মানুষকে ব্যাপকভাবে ক্ষুব্ধ করেছে। মানুষের মধ্যে একটা বিস্ফোরণোন্মুখ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছিল। আমরা একটা বারুদের স্তূপের ওপর দাঁড়িয়ে পড়েছিলাম। মানুষের ক্ষোভ, অসন্তোষ, সরকারের প্রতি অনাস্থা; সেটারই বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে কোটা আন্দোলনের মাধ্যমে। বলতে গেলে কোটা আন্দোলনটা ছিল রোগের উপসর্গ। রোগটা হলো: ভোটাধিকার হরণ, দুর্নীতি-দুর্বৃত্তায়ণ, নানারকম অন্যায়-অবিচার।
আমাদের ছাত্র-তরুণরা এই যে বিস্ফোরণোন্মুখ পরিস্থিতি, মানুষের অসন্তোষের বারুদের যে স্তূপের ওপর আমরা দাঁড়িয়ে ছিলাম, সেখানে তারা দেশলাইয়ের জ্বলন্ত কাঠি ছুড়ে দিতে পেরেছিল। যার ফলে এই বিস্ফোরণ ঘটেছে এবং বিস্ফোরণের ফলেই শেখ হাসিনা দেশ ছেড়ে পালাতে বাধ্য হয়েছেন।
তাহলে যেটা গুরুত্বপূর্ণ, তা হলো মানুষের ভোটাধিকার নিশ্চিত করা। দুর্নীতি-দুর্বৃত্তায়ণ, লুটপাট, স্বজনপ্রীতি; এগুলো তো ছিলই, তবে মানুষ সবচেয়ে বেশি যেটায় ক্ষুব্ধ ছিল, তা হলো ভোটাধিকার হরণ। ভবিষ্যতে আমাদের যদি এই রকম পরিস্থিতি ঠেকাতে হয়, অর্থাৎ কর্তৃত্ববাদী সরকার আবারও যাতে ফিরে আসতে না পারে, সেক্ষেত্রে আমাদের রাজনৈতিক অধিকার, নাগরিক অধিকার নিশ্চিত করার পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে হবে। মানুষের ভোটাধিকার, সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতা বদল এবং একইসঙ্গে সরকারের জবাবদিহিতা; এসব বিষয় নিশ্চিত করতে হবে। তাহলেই এমন মর্মান্তিক ঘটনার আর পুনরাবৃত্তি হবে না।
ড. বদিউল আলম মজুমদার : সম্পাদক, সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন)