Logo
Logo
×

উপসম্পাদকীয়

সংস্কার : রাষ্ট্র পরিচালনা ও ক্ষমতা কাঠামো

Icon

ড. এম এল আর সরকার

প্রকাশ: ৩০ আগস্ট ২০২৪, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

সংস্কার : রাষ্ট্র পরিচালনা ও ক্ষমতা কাঠামো

কোটা সংস্কার আন্দোলনের ফলে দেশ একটি শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতি থেকে মুক্তি পেয়েছে। দেশে পরিবর্তন এসেছে এবং আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির দিন দিন উন্নতি হচ্ছে। এ পরিবর্তনকে আরও মহিমান্বিত করা যেত, যদি শেখ হাসিনার পদত্যাগের পর কিছু অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা এড়ানো সম্ভব হতো।

কিন্তু আমাদের দুর্ভাগ্য, কিছু মানুষের কারণে ক্ষমতার পালাবদলের পর অতীতেও এ ধরনের ঘটনা ঘটেছে এবং সেই একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি হয়েছে। ভবিষ্যতে এ রকম ঘটনার পুনরাবৃত্তি যাতে না হয়, সে ব্যবস্থা গ্রহণের জন্যই বর্তমানে ক্ষমতাসীন হয়েছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। এ সরকারের কাছে মানুষের প্রত্যাশা অনেক। প্রত্যাশা পূরণের জন্য প্রায়োজন ব্যাপক সংস্কার সাধন।

সংস্কার নিঃসন্দেহে একটি কঠিন কাজ। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার বলছে, তারা ইতোমধ্যে তা শুরু করেছে। তবে কিছু কিছু ক্ষেত্রে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের অগোচরেই চলছে মাঠ দখলের পালা। চলছে হুমকি, পদত্যাগ, অব্যাহতি এবং নতুন পদায়ন। এরকম কাজ আগেও হয়েছে এবং ফলাফল শেষ পর্যন্ত শূন্যই থেকে গেছে। জনগণ ভেবেছিল, এবারের বিষয়গুলো মনে হয় অন্যরকম হবে, কিন্তু এখন পর্যন্ত সে রকম কোনো নজির স্থাপিত হয়নি।

সংস্কারের জন্য কিছু পরিবর্তন অবশ্যই প্রয়োজন। কিন্তু অমুকের পদত্যাগ বা তমুকের নিয়োগ চাই, এ ধরনের কাজ কি সংস্কারের অংশ হতে পারে? মানুষ ভাবছে, কিছু স্বার্থান্বেষী মহল ইচ্ছা করে বা ব্যক্তিগত স্বার্থসিদ্ধির জন্য এরকম কাজ করছে বা করাচ্ছে। যদি কাউকে কোনো পদ থেকে অপসারণের প্রয়োজন হয়, তাহলে সে কাজটি এ সরকারই অনায়াসে করতে পারে। যেখানে রাষ্ট্রীয়ভাবেই অযোগ্য বা অসৎ লোকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা সম্ভব, সেখানে জোরাজুরি বা অন্য কোনো পন্থা অবলম্বন করার কি কোনো প্রয়োজন আছে?

সংস্কারের অর্থ শুধু শুদ্ধি অভিযান নয়। সংস্কারের অর্থ হচ্ছে পদ্ধতিগত পরিবর্তন-সংশোধন বা সংযোজন। অনেকেই সংস্কার নিয়ে ‘স্বল্পমেয়াদি’, ‘দীর্ঘমেয়াদি’ ইত্যাদি নানা কথা বলছে। সরকার যেভাবেই সংস্কার করুক না কেন, একথা অবশ্যই বিবেচনায় রাখা প্রয়োজন যে, কেন বারবার শুদ্ধি অভিযানের প্রয়োজন হয়। কেন কিছু লোক অশুদ্ধ হয়। কেন কিছু লোক তোষামোদি করে এবং কীভাবে তোষামোদকারীরা অবৈধ সম্পদ অর্জন করে।

আমাদের রাষ্ট্রব্যবস্থা এমন যে, ক্ষমতাসীন সরকার ইচ্ছা করলেই কাউকে পুরস্কৃত বা শাস্তি প্রদান করতে পারে। রাষ্ট্রের একজন কর্মকর্তা-কর্র্মচারী ইচ্ছা করলেই কাউকে সুবিধা প্রদান বা হয়রানি করতে পারে। ইচ্ছাধীন এ ব্যবস্থাই হচ্ছে সর্বনাশের মূল। এটি ব্যবহার করেই সরকার রাষ্ট্রের কর্মকর্তা-কর্মচারীকে নিয়ন্ত্রণ করে এবং এটি ব্যবহার করে রাষ্ট্রের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা জনগণকে বঞ্চিত করে অবৈধ সম্পদ অর্জন করে।

সরকারের জবাবদিহিতা এবং কর্মের মূল্যায়ন পদ্ধতি ত্রুটিপূর্ণ বা নেই বললেই চলে। সুতরাং পরিবর্তন বা সংস্কার যাই করি না কেন, সেটি করতে হবে আমাদের রাষ্ট্রকাঠামোর পরিচালনা ব্যবস্থায়। রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ থেকে সর্বনিম্ন স্তরের কর্মকর্তা-কর্মচারীসহ ছাত্র-শিক্ষক সবাইকেই একটি সুচিন্তিত ও সুনির্দিষ্ট জবাবদিহিতা ও মূল্যায়ন কাঠামোর মধ্যে আনা খুবই জরুরি।

এ কাজ কঠিন, তবে অসাধ্য নয়। হ্যাঁ, সরকারের প্রতিটি স্তরই আলাদা বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত এবং এজন্য প্রয়োজন পৃথক পৃথক সংস্কার কাঠামো। তবে সংস্কার কাঠামো তৈরির জন্য সর্বাগ্রে যা প্রয়োজন তা হচ্ছে সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে আলোচনা, মতামত গ্রহণ এবং পরীক্ষামূলক পাইলট প্রকল্প গ্রহণের মাধ্যমে সফলতা ও ব্যর্থতার মূল্যায়ন। অতঃপর, বাস্তবায়ন। বিষয়গুলো সময় ও কষ্ট সাপেক্ষ এবং এজন্য প্রয়োজন বিজ্ঞ উপদেষ্টাদের নিরলস প্রচেষ্টা। আশা করি তা তারা করতে পিছপা হবেন না।

সংস্কার নিয়ে আমরা যত কথাই বলি না কেন বা যত প্রচেষ্টাই করি না কেন, সব প্রচেষ্টা বা কষ্টই বিফলে যাবে, যদি রাষ্ট্র পরিচালনা কাঠামোর সঙ্গে সঙ্গে রাষ্ট্রের ক্ষমতা কাঠামোর সংস্কার করা না হয়। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ক্ষমতার যে প্রাসাদে বসে আছে, তার মালিক হচ্ছে জনগণ। জনগণই একদিন এ প্রাসাদের দায়িত্ব দিয়েছিল শেখ হাসিনাকে।

কিন্তু শেখ হাসিনা জনগণের ইচ্ছার মূল্য দেননি। নানা কলাকৌশলে তিনি এটি দখল করে রেখে প্রাসাদের অনেক কিছুই তছনছ করেছেন। অতীতেও এরকম হয়েছে, তবে কলেবরে কম। ক্ষমতাসীনদের এই তছনছ করার ক্ষমতার কারণেই তৈরি হয় অশুদ্ধ বা দূষিত মানুষ। ক্ষমতা পরিবর্তনের সঙ্গে বারবার এ জন্যই চালাতে হয় শুদ্ধি অভিযান, যা অত্যন্ত বেদনাদায়ক।

কয়েক দিন আগে ‘সংস্কার : উপাচার্য নিয়োগ’ শিরোনামে আমার একটি লেখা প্রকাশিত হয়েছে। এক ছাত্র আমাকে লিখেছে, ‘স্যার আমরা ধরে নিলাম যে, বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার নির্দলীয় ও নিরপেক্ষ উপাচার্য নিয়োগ প্রদান করলেন, কিন্তু এরপর যখন দলীয় সরকার ক্ষমতায় আসবে, তখন কী হবে?’ আমি তাকে আশার কথা শুনিয়ে আশ্বস্ত করার চেষ্টা করেছি। জানি না আমার উত্তরে সে সন্তুষ্ট হয়েছে কিনা। তবে আমি নিজেই সেই উত্তরে সন্তুষ্ট হতে পারিনি, কারণ তার যে উদ্বেগ তা শুধু বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্যই প্রযোজ্য নয়, এ আশঙ্কা দেশের সব ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য।

ক্ষমতার দম্ভে আওয়ামী লীগ একদিন মনে করেছিল, এদেশে বিরোধী দল থাকতে পারে না, বিরোধী দলের প্রতিবাদ করার অধিকার থাকতে পারে না, বিরোধী দলের ন্যায়বিচার পাওয়ার অধিকার থাকতে পারে না, বিরোধী দলের ভোট করার অধিকার থাকতে পারে না, বিরোধী দলের ক্ষমতায় যাওয়ার অধিকার থাকতে পারে না। শেখ হাসিনা আজ চলে গেছেন।

কিন্তু আগামী ৫ বা ১০ বা ১৫ বছরে শেখ হাসিনার মতো আরেকজন যে তৈরি হবে না, তার নিশ্চয়তা কোথায়? এরকম ঘটনা আবারও ঘটতে পারে, শুধু পরিবর্তিত হতে পারে ক্ষমতাসীন ও ক্ষমতাহীন দলের নাম। আমরা কি বারবার এরকম দেখতে চাই? আমরা কি আবারও রক্তক্ষয়ী ছাত্র আন্দোলন দেখতে চাই? না, আমরা আর বিশৃঙ্খলা চাই না। আমরা চাই একটি স্বচ্ছ গণতান্ত্রিক সরকারব্যবস্থা।

দেশে গণতান্ত্রিক সরকারব্যবস্থা আছে। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হচ্ছে, যে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা আমরা দেখেছি, তাতে স্বচ্ছতার ঘাটতি প্রকট। আমরা এমন একটি গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার স্বাদ গ্রহণ করেছি, যেখানে ক্ষমতার একচ্ছত্র মালিক হচ্ছেন ক্ষমতাসীনরা। হইচই ছাড়া বিরোধী দলের কোনো কিছুই করার থাকে না। নীতিনির্ধারণ থেকে শুরু করে সবকিছুই হয় ক্ষমতাসীনদের ইচ্ছামাফিক।

এই গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা কি আমরা চাই? আমাদের অবশ্যই মনে রাখতে হবে, যে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় ১৫১ আসন পেয়েই সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী হওয়া যায় এবং ১৪৯টি আসন পেয়ে শূন্য হাতে বিরোধী দলের আসনে বসে থাকতে হয়, সেই গণতন্ত্র আমাদের প্রয়োজন নেই। আমাদের প্রয়োজন হচ্ছে এমন একটি ব্যবস্থা, যেখানে শুধু কাগজে-কলমে নয়, প্রকৃত অর্থেই সরকারি ও বিরোধী দলের সম্মিলিতভাবে দেশ পরিচালনার নিশ্চয়তা থাকবে।

একটি কার্যকর গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থা তৈরি করতে হলে যা অতীব প্রয়োজন তা হচ্ছে, রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা কাঠামের সংস্কার সাধন। কীভাবে এ সংস্কার সাধন করা যেতে পারে, তা নিয়ে অতীতেও অনেকে অনেক কথা বলেছেন। কেউ বলেছেন রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর মধ্যে ক্ষমতার ভারসাম্যের কথা, কেউ বলেছেন ন্যায়পাল বা অন্য কিছুর কথা। তবে কার্যকর কিছু করতে হলে এ বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা এবং বিশেষজ্ঞের মতামত গ্রহণ করা প্রয়োজন। কীভাবে এ সংস্কার সাধন করা যায়, তা বিশ্লেষণ করা এ লেখার উদ্দেশ্য নয়। তবে অতি সংক্ষেপে এটুকু বলা প্রয়োজন যে, রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা বণ্টনের ব্যবস্থা এমনভাবে করতে হবে, যাতে ক্ষমতার একটি ন্যায্য হিস্যা বিরোধী দলের থাকে।

যেভাবেই হোক না কেন, রাষ্ট্রের ক্ষমতা কাঠামোর সংস্কার আমাদের করতেই হবে। তবে সংস্কারের জন্য সর্বোপরি যা প্রয়োজন তা হচ্ছে, রাজনৈতিক দলগুলোর সম্মতি গ্রহণ। এ মুহূর্তে যে দুটি দলের সম্মতি বেশি প্রয়োজন তা হচ্ছে, বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীর। কিন্তু তারা হয়তো ভাবতেই পারে আমরাই তো পরবর্তী নির্বাচনে একসঙ্গে ক্ষমতায় আসব, তাহলে ক্ষমতার বণ্টনের কি এমন প্রয়োজন আছে? রাজনীতিতে চিরস্থায়ী বন্ধু বা শক্র বলে কিছু নেই।

আজ যারা বন্ধু, ক্ষমতার দ্বন্দ্বে আগামীকালই তারা শত্রুতে পরিণত হতে পারে। তদুপরি নির্বাচনের আগে যে নতুন কোনো রাজনৈতিক দলের আবির্ভাব হবে না, সে কথা বলা যায় না। তাই এখনই এ শত্রুতার পথ বন্ধ করতে হবে। বন্ধু শত্রুতে পরিণত হওয়ার রাজনীতির অবসান প্রয়োজন। এ অসুস্থ রাজনীতি পরিবর্তনের এখনই সময়। প্রশাসনিক কাঠামো সংস্কারের সঙ্গে সঙ্গে ক্ষমতা কাঠামোর সংস্কারের এখনই সময়। কোনোভাবেই এ সুযোগ নষ্ট করা যাবে না।

ড. এম এল আর সরকার : প্রফেসর, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়

lrsarker@yahoo.com

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম