Logo
Logo
×

উপসম্পাদকীয়

জাতীয় শিক্ষাক্রম : ফিরে যাওয়া, নাকি পরিমার্জন?

Icon

ড. আবদুস সাত্তার মোল্লা

প্রকাশ: ২৯ আগস্ট ২০২৪, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

জাতীয় শিক্ষাক্রম : ফিরে যাওয়া, নাকি পরিমার্জন?

স্বাধীন বাংলাদেশে এ পর্যন্ত জাতীয় শিক্ষাক্রমের চারটি আবর্তন শেষ হয়েছে; ২০১৯ সালে শুরু হলো পঞ্চম আবর্তনের কাজ। কোনো দেশের প্রথম আবর্তনের শিক্ষাক্রমকে ‘তৈরি করা’ বলা যেতে পারে। পরেরগুলো ‘পরিমার্জন’ হিসাবে পরিচিত হয়। কিন্তু দীর্ঘ ৫ বছরে ঢিমেতালে চলা পরিমার্জন প্রক্রিয়াধীন শিক্ষাক্রমকে অনেকেই ‘নতুন’ নামের তকমা পরিয়েছেন। দেশের সব আবর্তনের শিক্ষাক্রমেই শিক্ষার উদ্দেশ্যাবলি বিস্তৃতভাবে লিপিবদ্ধ আছে। অথচ এবারের শিক্ষাক্রমে কিছু উদ্দেশ্যকে নতুনভাবে সংযোজনের দাবি করে অনেক লেখা প্রকাশিত হয়েছে এবং টিভি আলোচনায় ও বক্তৃতা-বিবৃতিতে অবিরাম ঢোলক বাজানো হয়েছে। ২০২৩ সাল থেকে এ অনুপযোগী শিক্ষাক্রমের আংশিক বাস্তবায়ন শুরু হয়েছে। একজন শিক্ষা গবেষক হিসাবে আমি শুরু থেকেই এ শিক্ষাক্রমের অসারতা সম্পর্কে লিখে আসছি। কিন্তু ডাক্তার বা আইনজ্ঞ, শিক্ষামন্ত্রী কেউই কর্ণপাত করেননি। শেষ পর্যন্ত গণআন্দোলনে তৃতীয় টার্মের ‘অনির্বাচিত’ সরকারের পতন হলে সংক্ষিপ্ত উপদেষ্টা পরিষদের সরকার আগের (জাতীয় শিক্ষাক্রম ২০১২) শিক্ষাক্রমে ফিরে যাওয়ার কথা বলছেন। এ নিবন্ধে আমি এ সম্পর্কে আমার চিন্তাভাবনা ও মতামত তুলে ধরছি।

আশু কর্তব্য : বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের শিক্ষা উপদেষ্টা ড. ওয়াহিদ উদ্দিন মাহমুদ একজন অর্থনীতিবিদ, শিক্ষাবিদ নন। তিনি পরিমার্জনাধীন ও আংশিক বাস্তবায়নাধীন শিক্ষাক্রমের বিরুদ্ধে শিক্ষক-অভিভাবক এবং কিছু শিক্ষার্থীর আন্দোলন দেখেই হয়তো আগের শিক্ষাক্রমে ফিরে যাওয়ার কথা বলছেন। এ মুহূর্তে অবশ্য এটাই করণীয়। কিন্তু ১২-১৩ বছর আগের শিক্ষাক্রমে ফিরে যাওয়া কোনো স্থায়ী সমাধান হতে পারে না। এর কারণ ত্রিবিধ।

১. জ্ঞানবিজ্ঞান ও সামাজিক পরিবর্তনের কারণে সারা বিশ্বে ১০-১২ বছরের মধ্যে/ব্যবধানে শিক্ষাক্রমের পরিমার্জন করা হয়। বাংলাদেশ কোনোভাবেই শিক্ষাক্রম পরিমার্জনের এ স্বাভাবিক প্রক্রিয়া থেকে বিচ্যুত হতে পারে না।

২. ২০১১-১২ সালে যখন শিক্ষাক্রম পরিমার্জন করা হয়, তখনো ২০৩০ সালকে টার্গেট করে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারিত হয়নি। ২০১৫ সালে গৃহীত এ টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের কাজ ২০১৬ সালে শুরু হয়েছে। শিক্ষার জন্য সুনির্দিষ্ট টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা-৪ বাস্তবায়নের প্রধান কৌশল ‘অন্তর্ভুক্তি’। দেশের শিক্ষাব্যবস্থাকে অন্তর্ভুক্তিমূলক করার মাধ্যমে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা-৪ অর্জনের উদ্দেশ্যে শিক্ষাক্রম পরিমার্জন জরুরি হয়ে আছে সেই ২০১৬ সালেই।

৩. একসময় শিক্ষাক্রম ছিল শিক্ষার বিষয়বস্তুভিত্তিক (Content-based)। তারপর ব্লুমের শিক্ষার উদ্দেশ্যাবলির শ্রেণিবিন্যাস (Bloom's Taxonomy of Educational Objectives, 1956) প্রকাশিত হলে ১৯৬০ দশক থেকে শিক্ষাক্রম হয় উদ্দেশ্যভিত্তিক (Objective-based)। ১৯৮০-’৯০-এর দশকে, বিশেষত কোবের ‘অভিজ্ঞতাভিত্তিক শিখন’ (Experiential learning, 1984) এবং জে ডেলরের Learning-The treasure within শীর্ষক প্রতিবেদন (১৯৯৬) প্রকাশের পর থেকে ব্লুমের শিক্ষার উদ্দেশ্যের তিন প্রধান ক্ষেত্রকে একত্রে একটি ককটেলের মতো বানিয়ে শিক্ষার উদ্দেশ্যগুলোর নাম দেওয়া হলো যোগ্যতাগুলো (Competencies)। উল্লেখ্য, ডেভিড কোব এক্সপেরিয়েন্সিয়াল লার্নিং মডেল তৈরি করেছিলেন বয়স্কশিক্ষা তথা প্রশিক্ষণ কোর্সের জন্য, শিশু-কিশোরদের শিক্ষার জন্য নয়। তাছাড়া, কোবের চার স্তরবিশিষ্ট শক্ত বাঁধনের মডেলে শিক্ষামনোবিজ্ঞানীরা বেশকিছু ত্রুটি পেয়েছেন। যেমন-বার্গস্টেইনার দেখিয়েছেন, কোবের শিখন-চক্রে ব্যবহৃত স্থির পয়েন্টগুলোর পরিবর্তে চলমান রেখা ব্যবহার করা জরুরি।

যা হোক, এ শতাব্দীর দ্বিতীয় দশক থেকেই সারা বিশ্বে যোগ্যতাভিত্তিক শিক্ষাক্রমের ঢেউ ছড়িয়ে পড়ে। এখন সারাবিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে শিক্ষাক্রমকে অবশ্যই যোগ্যতাভিত্তিক করা দরকার।

উপর্যুক্ত উদ্দেশ্যাবলি অর্জনের জন্য বাংলাদেশ শিক্ষাক্রমের যথোপযুক্ত পরিমার্জন আবশ্যিক। তেমন পরিমার্জনের ভিত্তিতে ভালোমানের পাঠ্যপুস্তক রচনা করে আগামী দুই বছরের মধ্যে সেসব পাঠ্যপুস্তক প্রাথমিক স্তর থেকে শুরু করে ক্রমান্বয়ে উপরের শ্রেণিতে বাস্তবায়ন করতে হবে।

দীর্ঘমেয়াদি কার্যকর পরিকল্পনা : শিক্ষাক্রমের যথাযথ পরিমার্জন প্রক্রিয়া : কোনো দেশের জাতীয় শিক্ষাক্রম প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষার নীলনকশা। শিক্ষাক্রম পরিমার্জন করতে হয় একসঙ্গে। তাতে পুরো জিনিসটি একসঙ্গে চিন্তা করা যায়, প্রক্রিয়া ও বিষয়বস্তুর উল্লম্ব অর্থাৎ একই বিষয়ে বিভিন্ন শ্রেণির শিক্ষাক্রমের মধ্যে সম্পর্ক এবং আনুভূমিক অর্থাৎ একই শ্রেণির বিভিন্ন বিষয়ের শিক্ষাক্রমের মধ্যে সম্পর্ক পর্যালোচনা করে শিক্ষাক্রমের মান যথার্থ করা যায়। এভাবে পরিমার্জিত শিক্ষাক্রম বাস্তবায়ন করতে হয় ক্রমান্বয়ে নিচের শ্রেণি থেকে উপর দিকে। জাতীয় শিক্ষাক্রম ২০১২ একসঙ্গে পরিমার্জন করা হয়েছিল। কিন্তু বাস্তবায়ন পর্যায়ক্রমে না করে (সম্ভবত সরকার পরিবর্তনের ভয়ে) একসঙ্গে করে ফেলা হয়েছিল।

বলা বাহুল্য, জাতীয় শিক্ষাক্রম ২০২১ নামে যা বাস্তবায়নের (অপ) চেষ্টা করা হয়েছে, তা অত্যন্ত কাঁচা হাতে তৈরি। তারা পুরো শিক্ষাক্রম একসঙ্গে পরিমার্জন করেননি। পিসমিল প্রক্রিয়ায় প্রথমে শুধু প্রথম ও দ্বিতীয় এবং ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণির শিক্ষাক্রম আধাখেচড়া পরিমার্জন করে অনুপযুক্ত এবং দুর্নীতিগ্রস্ত প্রক্রিয়ায় পাঠ্যপুস্তক রচনা করিয়ে শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নের চেষ্টা করেছিলেন।

এমন হওয়ার কারণ, যারা শিক্ষাক্রম তৈরি করার চেষ্টা করেছেন, তারা শিক্ষাক্রম-বোদ্ধা তো ননই, আসলে শিক্ষাক্রমের লোকই নন। বাংলার যে অধ্যাপক জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের সদস্যের (মাধ্যমিক শিক্ষাক্রম) দায়িত্বে থেকে প্রাথমিক শিক্ষাক্রমের সদস্য এবং প্রধান সম্পাদকের ওপর ছড়ি ঘুরিয়েছেন, তিনি শিক্ষাক্রম তো পরের কথা, নিজ বিষয় বাংলায়ও ডক্টরেট নন, তিনি শিক্ষায় কোনো ডিগ্রিবিহীন সাদামাটা এমএ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের যে অধ্যাপক তাকে টেকনিক্যাল সাপোর্ট দেওয়ার চেষ্টা করেছেন, সেই ড. মো. তারিক আহসান নিজের ক্ষেত্র-বিশেষ শিক্ষা, অন্যকথায় প্রতিবন্ধীদের শিক্ষায় বেশ ভালো বিশেষজ্ঞ। কিন্তু তিনি শিক্ষাক্রমের লোকই নন। অথচ তাদের খুব ভাবসাব ছিল। বলা যায়, শিক্ষাক্রমে মূর্খ মশিউজ্জামান কথায় কথায় বলতেন আমি জাতির জন্য ‘কন্ট্রিবিউট’ করার জন্য এখানে আছি। আর ড. আহসান শিক্ষাক্রম সভায় প্রায়ই বলতেন, তিনি কবে কটা আন্তর্জাতিক শিক্ষা সম্মেলনে অ্যাটেন্ড করেছেন?

শিক্ষাক্রম ২০২১-এর কয়েকটি গুরুতর সমস্যা : পরিমার্জনাধীন ও আংশিক বাস্তবায়নাধীন শিক্ষাক্রম কিছু নতুন রোগ সৃষ্টি করেছে; কিন্তু সেগুলো সারানোর ব্যবস্থাপত্র দেননি এ শিক্ষাক্রমের প্রশংসায় মুখর লেখকদের কেউ। ফলাফলভিত্তিক শিক্ষাক্রম সারাবিশ্বে চলছে প্রায় ছয় দশক ধরে; এখনো শিখনফল লেখার জন্য নতুন নতুন সক্রিয় ক্রিয়াপদ তৈরি করা হচ্ছে। অথচ এ শিক্ষাক্রমের দায়িত্বশীল ব্যক্তিবর্গ ‘যোগ্যতার নির্যাস নষ্ট’ হওয়ার ভয়ে গো ধরে বসে আছেন, ‘শিখনফল’ তারা লিখবেনই না। শিক্ষাক্রমকে শিখনফলের সূক্ষ্ম স্তরে না পৌঁছানোতে লেখকরা বই লিখতে হিমশিম খাচ্ছেন, শিক্ষকরা শিক্ষণ-পরিকল্পনা করতে বিপদে না হলেও আপদে পড়বেন, মূল্যায়নকারীরা তো মূল্যায়ন করতেই পারবেন না। এসবের সমাধান তারা কীভাবে করবেন?

নবম-দশম শ্রেণিতে ১৯৬১ সাল থেকে শাখাভিত্তিক শিক্ষাপদ্ধতি এবং ৬২ সাল থেকে ম্যাট্রিকুলেশনের পরিবর্তে মাধ্যমিক স্কুল সার্টিফিকেট পরীক্ষা চলে এসেছে। এতে এ উপস্তরের শিক্ষা ব্রিটেন ও আমেরিকার ‘ও লেভেলের’ সমতুল্য হয়। ফলে ইংরেজি ও বাংলা মাধ্যমের শিক্ষার মধ্যে ব্যবধান কমে আসে। ৬০ বছর পর এখন এ শিক্ষাকে একমুখী করার পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করলে সব শিক্ষার্থী এক চিমটি করে প্রকৃতিবিজ্ঞান ও সামাজিকবিজ্ঞান পড়ে উচ্চমাধ্যমিক উপস্তরে গিয়ে এসব বিষয়ের প্রায় ছয়গুণ কলেবরের কোর্স কীভাবে আয়ত্ত করবে?

শিক্ষাক্রম রূপরেখার মূল্যায়ন বিষয়ে নিম্নরূপ পরিকল্পনা করা হয়েছে : শিক্ষক/অভিভাবক/বন্ধুদের দিয়ে শিখনকালীন মূল্যায়ন প্রথম থেকে তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত ১০০ শতাংশ, চতুর্থ থেকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত ৬০ শতাংশ, নবম-দশম শ্রেণিতে ৫০ শতাংশ, একাদশ-দ্বাদশ শ্রেণিতে ৩০ শতাংশ। শিক্ষকদের হাতে এত বেশি নম্বর কোন খাতে ব্যবহৃত হবে? কোচিং, প্রাইভেটের হিড়িক কীভাবে ঠেকাবেন? নিরীহ শিক্ষার্থীদের কীভাবে নিজ শিক্ষকের অবিচার থেকে রক্ষা করবেন? ম্যানেজিং কমিটি ও গভর্নিং বডির সদস্যদের সঙ্গে এবার ছাত্রনেতাদের অত্যাচার যুক্ত হলে শিক্ষকদের কীভাবে বাঁচাবেন?

শেষ কথা : জাতীয় শিক্ষাক্রম ২০১২ তে ফিরে গিয়ে এবার সে অনুসারে পাঠ্যপুস্তক প্রকাশের টেন্ডার করার ফাঁকে ফাঁকে দেশের প্রথিতযশা শিক্ষাবিদদের নিয়ে শিক্ষাক্রম পরিমার্জন কমিটি গঠন করা দরকার। ব্যক্তির নাম বলা হয়তো ঠিক হবে না। তবু বলি, বর্তমান বাংলাদেশে সবচেয়ে জ্ঞানী, পারদর্শী ও অভিজ্ঞ শিক্ষাবিদ ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ইমেরিটাস ড. মো. মনজুর আহমদের নেতৃত্বে ওই কমিটি গঠন করা যেতে পারে। কমিটির অন্যতম সদস্য হতে পারেন জাতীয় শিক্ষাক্রম ২০১২-এর পরামর্শক (ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের সাবেক পরিচালক) ড. মো. ছিদ্দিকুর রহমান এবং জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের সাবেক সদস্য (শিক্ষাক্রম) অধ্যাপক সালেহ মতিন। দেখে-শুনে কিছু অরাজনৈতিক মধ্যবয়সি ও তরুণ প্রকৃত শিক্ষাক্রম বিশেষজ্ঞকে কোর কমিটিতে রাখা যায়। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়, কলেজ, স্কুল ও মাদ্রাসার শিক্ষকরা হতে পারেন বিভিন্ন বিষয় কমিটির সদস্য। এভাবে গঠিত শিক্ষাক্রম কোর কমিটি এবং বিভিন্ন বিষয় কমিটির কাজ দেখভাল করার জন্য যথারীতি দায়িত্বে থাকবে জাতীয় শিক্ষাক্রম সমন্বয় কমিটি। সাধারণত এ কমিটির প্রধানের দায়িত্বে থাকেন শিক্ষা সচিব। তবে এবার এ দায়িত্ব শিক্ষা উপদেষ্টা স্বয়ং পালন করলে বেশি ভালো হয়; কারণ দুঃখজনকভাবে আমলাদের অধিকাংশ পতিত সরকারের প্রতিনিধিত্ব করেন।

ড. আবদুস সাত্তার মোল্লা : শিক্ষাক্রম গবেষক এবং অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক (বিসিএস সাধারণ শিক্ষা)

asmolla@ymail.com

 

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম