দলমত নির্বিশেষে একটা জাতীয় সনদ প্রণয়ন করতে হবে
ড. বদিউল আলম মজুমদার
প্রকাশ: ১৬ আগস্ট ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চল বিক্ষোভে উত্তাল হয়ে ওঠে। ৫ আগস্ট সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পদত্যাগের মাধ্যমে এর পরিসমাপ্তি ঘটে। কোটা সংস্কার নিয়ে আন্দোলনটি শুরু হলেও এ আন্দোলনটা ছিল সরকারি চাকরিতে সম-সুযোগের অধিকার নিয়ে। যারা ক্ষমতাসীন দলের সঙ্গে যুক্ত নয়, তারা চাকরির সম-সুযোগ থেকে ছিল বঞ্চিত। শুধু সরকারি চাকরিতেই নয়, আধা-সরকারি চাকরিতেও তারা বঞ্চিত ছিল। সরকার আর দলের মধ্যে বিভাজন দূরীভূত হয়ে গেছে বলেই চাকরির ক্ষেত্রে এ ধরনের বঞ্চনার শিকার হতে হয়েছে ক্ষমতাসীন দলের বাইরে থাকা লোকজনকে। তাই সরকারি এবং আধা-সরকারি চাকরিতে শুধু দলের লোকদেরই একচ্ছত্র আধিপত্য ছিল। সরকারি দলের বাইরে থাকা দু-চারজন পিএসসির পরীক্ষাগুলো পার হয়েও সুযোগ পেতেন না। কারণ তারা সব পরীক্ষায় পাশ করলেও কোটার কারণে চাকরিতে সুযোগবঞ্চিত ছিলেন। সরকারি চাকরিতে তারা চাকরি পেলেও তাদের আটকে দেওয়া হতো পুলিশ ভেরিফিকেশনের মাধ্যমে। সরকারি, আধা-সরকারি এবং পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় পুরোপুরিই ছিল সরকারি দলের অঙ্গসংগঠনগুলোর করায়ত্তে। সুতরাং যত মেধাবীই হোক না কেন, কর্মসংস্থানের সুযোগ থেকে এবং সম-সুযোগের অধিকার থেকে তারা ছিল বঞ্চিত।
এটা হচ্ছে একটা অধিকার বঞ্চনার কথা মাত্র। চাকরিতে এ অধিকার বঞ্চনা ছাড়াও এসব ছাত্রছাত্রী আরও অনেক অধিকার থেকে বঞ্চিত ছিল। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ক্ষমতাসীন দলের আনুকূল্যে থাকা ছাত্রদের দ্বারা তারা চরমভাবে মানবাধিকার লঙ্ঘনের শিকার হয়েছিল। এর মধ্যে অন্যতম গণরুম কালচার। এ গণরুম কালচারের দ্বারা অনেক শিক্ষার্থীর মানবাধিকার লঙ্ঘিত হয়েছে। মানবাধিকার লঙ্ঘিত ও নির্যাতিত এসব শিক্ষার্থীকে সবকিছুই নীরবে মুখ বুজে সহ্য করতে হয়েছে। কেউ কিছু বলার সাহস পায়নি। সবচেয়ে বড় মানবাধিকার লঙ্ঘন হচ্ছে নরীদের প্রতি নিগ্রহ, লাঞ্ছনা, নির্যাতন, ধর্ষণের দ্বারা। আমাদের মনে আছে, ১৯৯৮ সালে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে শততম ধর্ষণ উদযাপন করেছিল ‘সেঞ্চুরিয়ান মানিক’ নামের এক ছাত্রলীগ নেতা। সেঞ্চুরিয়ান মানিকের ধর্ষণের শিকার হয়েও কেউ তার বিরুদ্ধে কিছু বলতে পারেনি। এই শততম ধর্ষকের কোনো বিচারও হয়নি।
এসব নির্যাতন-নিপীড়নের বিরুদ্ধে কেউ কিছু বলতে না পারলেও সাধারণ শিক্ষার্থীদের মনে ক্ষোভের সৃষ্টি হতে থাকে। পুঞ্জীভূত ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ ঘটে এ ছাত্র আন্দোলনের মাধ্যমে। এ ছাত্র আন্দোলনটি শুধু চাকরিতে সম-সুযোগের অধিকার নিয়ে নয়, মানবাধিকার লঙ্ঘন, নিপীড়ন, নির্যাতনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের ভাষায় ছিল মুখরিত। তারা অন্যান্য নাগরিক অধিকার এবং অন্যান্য মৌলিক অধিকার থেকেও বঞ্চিত ছিল। যেমন, বাকস্বাধীনতা থেকে বঞ্চিত, তারা জীবনের অন্যান্য অধিকার থেকে ছিল বঞ্চিত। যেমন, তারা অন্য কোনো দলের সদস্য হলে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে থাকতে পারত না। প্রতিবাদ করতে গিয়ে, বাকস্বাধীনতা প্রয়োগ করতে গিয়ে তাদের অনেকেই জীবনের অধিকার হারিয়েছে। যেমন, বুয়েটের আবরার ফাহাদের কথা এখানে উল্লেখ করা যায়। ন্যায্য অধিকারের কথা বলতে গিয়ে তাকে সরকারদলীয় ছাত্রদের হাতে নির্মমভাবে প্রাণ বিসর্জন দিতে হয়েছে।
এ আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা তাদের ভোটাধিকার থেকেও বঞ্চিত ছিল। সুতরাং শিক্ষার্থীদের এ আন্দোলন শুধু কর্মক্ষেত্রে সম-সুযোগের জন্যই নয়, এটা সার্বিকভাবে তারা যেসব অধিকার থেকে বঞ্চিত ছিল, সেগুলো অর্জনের জন্যও আন্দোলন। তাদের রাজনৈতিক অধিকার এবং নাগরিক অধিকার হরণের মাত্রা বৃদ্ধি পেতে থাকায় তাদের মধ্যে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছিল। এই কোটা আন্দোলনের মাধ্যমে তারা এ ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়েছে। বলা যায়, কোটা আন্দোলনের বা কোটা সংস্কারের দাবিটা ছিল রোগের উপসর্গ মাত্র। আর এ রোগটা ছিল এসব বঞ্চনা, অধিকারহীনতা, নিপীড়ন, নির্যাতন-যেগুলো তাদের মধ্যে ব্যাপক ক্ষোভের সৃষ্টি করে। আর এ ক্ষোভগুলো বাড়তে বাড়তে অগ্নিস্ফুলিঙ্গে রূপলাভ করে।
আদালতের মাধ্যমে সরকার রোগের উপসর্গটার চিকিৎসা করার চেষ্টা করেছে মাত্র, কিন্তু মূল রোগের তো চিকিৎসা হয়নি। এ রোগটাই শেষ পর্যন্ত সরকারের বিরুদ্ধে একদফা দাবির আন্দোলনে রূপলাভ করে। এর মানে হচ্ছে, এটা শুধু কোটা সংস্কার আন্দোলন নয়, এটা ছিল মানুষের অধিকার অর্জনের আন্দোলন। তাদের ভোটাধিকার থেকে শুরু করে সব অধিকার রক্ষার আন্দোলন।
কোটা সংস্কার আন্দোলন একদফা আন্দোলনে পরিণত হয়। এ আন্দোলনের মাধ্যমে মোটা দাগে দুটো দাবি মানুষের মুখে মুখে উচ্চারিত হয়েছে। এর একটা হলো, যারা অন্যায় করেছে, অপরাধ করেছে, তাদের বিচারের আওতায় এনে কঠোর শাস্তি দিতে হবে। প্রশ্ন হচ্ছে, তারা কী ধরনের অপরাধ করেছে? তারা মানবতাবিরোধী অপরাধ করেছে। বিরাটসংখ্যক নিরস্ত্র মানুষকে নির্বিচারে পিটিয়ে, গুলি করে হত্যা করা অবশ্যই মানবতাবিরোধী অপরাধ। আরেকটা হলো, সরকারি বাহিনী কতগুলো ফৌজদারি অপরাধ করেছে, সেগুলোরও বিচার করতে হবে। এগুলো হলো-আন্দোলনকারীদের অন্যায়ভাবে সরকারি বাহিনী গ্রেফতার করেছে, অন্যায়ভাবে মামলা দিয়েছে। দণ্ডবিধির সব বিধান তারা লঙ্ঘন করে মানুষকে নিপীড়ন করেছে। অবশ্যই এসবের বিচার হতে হবে। মানবতাবিরোধী অপরাধ, এর পাশাপাশি দণ্ডবিধির বিধান অনুযায়ী যেসব অপরাধ-সবগুলোরই বিচার করতে হবে।
এর পরে আছে তাদের অর্থনৈতিক অপরাধ। ব্যাংক লুট, দুর্নীতি, দুর্বৃত্তায়ন এবং বিদেশে অর্থ পাচার-এগুলো হলো আর্থিক খাতের দুর্নীতি। মানুষের মোটা দাগে একটা দাবি ছিল যে, আর্থিক খাতের প্রতিটি দুর্নীতির যেন একটা সুষ্ঠু বিচার হয়। নিরপেক্ষভাবে এগুলোর তদন্ত করতে হবে এবং তদন্তের পর যারা অভিযুক্ত হবে, তাদের যেন সুষ্ঠু বিচার হয়, সেটা নিশ্চিত করতে হবে। আর্থিক খাতের এসব দুর্নীতির তদন্তের জন্য জনমনে একটা দাবি উঠেছে। সে দাবিটি হলো, জাতিসংঘের সহযোগিতায় যেন এ তদন্ত করা হয়। তদন্ত প্রতিবেদনে যাদের নাম আসবে, তাদেরকে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির আওতায় আনতে হবে, যাতে করে ভবিষ্যতে আর কেউ দুর্নীতি করতে না পারে।
এটা হলো একটা দিক। আরেকটা দিক হলো, এ গণদাবির একটা দাবি হলো, কর্তৃত্ববাদী সরকার সৃষ্টির মাধ্যমে মানুষকে যেসব অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হয়েছিল, অন্যায়-অবিচার হয়েছিল, সেসবের পুনরাবৃত্তি যেন আর না ঘটে। এখন প্রশ্ন হলো, এর পুনরাবৃত্তি না ঘটার জন্য বা ঠেকানোর জন্য কী করতে হবে? এর জন্য কতগুলো পরিবর্তন করতে হবে। আমাদের পদ্ধতি ও প্রক্রিয়ায় পরিবর্তন আনতে হবে। আমাদের প্রতিষ্ঠানগুলোকে সংস্কারের আওতায় এনে সেগুলোকে ঢেলে সাজাতে হবে। আরও কতগুলো কার্যক্রমের ক্ষেত্রে পরিবর্তন আনতে হবে। এ কাজগুলো সঠিকভাবে করতে পারলে এ আন্দোলনটি সার্থকতায় রূপলাভ করবে। পদ্ধতি প্রক্রিয়ার পরিবর্তনের ক্ষেত্রে তাদের কতগুলো আইন প্রণয়ন করতে হবে কিংবা সংশোধন করতে হবে। আমাদের সংবিধানকে প্রয়োজন অনুযায়ী পরিবর্তন করতে হবে। অনেক পরিবর্তন বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার শুরু করতে পারবে। এ সরকার হয়তো আইন প্রণয়ন করতে পারবে, কিন্তু প্রয়োগ করতে পারবে না। সংবিধান সংশোধন করতে পারবে না। কারণ সংবিধান সংশোধন করতে সংসদের অনুমোদন লাগবে। তবে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার যেটা করতে পারে সেটা হলো, এ দীর্ঘমেয়াদি ও সুদূরপ্রসারি সংস্কারের জন্য তারা রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে বসে সংলাপ করে, আলাপ-আলোচনা করে দলগুলোর ঐকমত্যের ভিত্তিতে একটা চুক্তি করতে পারে। এসব চুক্তির মাধ্যমে একটা জাতীয় সনদ প্রণয়ন করতে পারে। যে যে ক্ষেত্রে পরিবর্তন দরকার যেমন, নির্বাচনকালীন সরকার কেমন হবে, সংবিধানে কী কী পরিবর্তন আনা হবে, প্রশাসনে কী কী পরিবর্তন আনতে হবে ইত্যাদি। এগুলো তারা অধিকাংশই প্রয়োগ করতে পারবে না, কিন্তু তারা হয়তো আইডিয়াগুলো, আইনকানুনগুলো প্রণয়ন করে এগুলো প্রস্তুত করতে পারবে। এজন্য রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে যদি আলাপ-আলোচনা করে একটা চুক্তি করা যায়, যেটাকে আমরা বলছি জাতীয় সনদ, এ চুক্তিগুলো দলমত নির্বিশেষে স্বাক্ষরিত হতে হবে এবং একটি অবাধ, নিরপেক্ষ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে যারা নির্বাচিত হবে, তারা এগুলো বাস্তবায়ন করতে বাধ্য থাকবে। এর মাধ্যমেই আমাদের যে আকাশচুম্বী জনআকাঙ্ক্ষা, সেটা বাস্তবায়নের পথ সুগম হবে বলে আমার মনে হয়। (অনুলিখন : জাকির হোসেন সরকার)
ড. বদিউল আলম মজুমদার : সম্পাদক, সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন)