দ্রুত নির্বাচন, নাকি বিচার ও সংস্কার?
হাসান মামুন
প্রকাশ: ১৪ আগস্ট ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
ছবি: সংগৃহীত
শেখ হাসিনা পদত্যাগ করে ভারতে আশ্রয় গ্রহণের পর তার পুত্র সজীব ওয়াজেদ জয় তাৎক্ষণিকভাবে কিছু বক্তব্য রাখেন। এতে স্বভাবতই প্রাধান্য পায় ‘কাঁচা আবেগ’। পরবর্তীকালে তার বক্তব্য অবশ্য বদলেছে। শেখ হাসিনা ও তার বোন গণঅভ্যুত্থানের মুখে দেশত্যাগ করলেও বড় একটি দল তো রেখে গেছেন। তার সরকারের সদস্যদেরও অনেকে রয়ে গেছেন দেশে। বিভিন্ন স্তরের নেতাকর্মী তো রয়েছেনই। তাদের একটা বড় অংশ রয়েছেন প্রতিশোধমূলক হামলাসহ কঠিন চাপের মুখে। শেখ হাসিনার রাজনৈতিক জীবনের কঠিনতম সময়ে তাদের উদ্দেশে জনাব জয়ের ‘পাশে থাকার’ কথা বলাটা তাই স্বাভাবিক। যা হোক, পরবর্তীকালে সেটা তিনি বলেছেন।
এতে অবশ্য আছে কিছু অসংগতি; অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতি এক ধরনের হুমকিও। হুমকি প্রদান না করলেই ভালো হতো। কেননা এরই মধ্যে কিছু ‘অস্বাভাবিক ঘটনা’ ঘটেছে-যেগুলোর সঙ্গে জনাব জয়ের বক্তব্যের যোগসূত্র আছে বলে মনে করা হচ্ছে। উচ্চ আদালতের ঘটনাবলি ও ‘হিন্দু কার্ড’ খেলার চেষ্টার কথা বলছেন অনেকে। একই দিন গোপালগঞ্জে একদল লোক নেমেছিল রীতিমতো ঢাল-সড়কি, রামদা নিয়ে। তারা সাবেক প্রধানমন্ত্রীকে ‘দেশে ফিরিয়ে আনার’ দাবি জানাচ্ছিলেন। কিন্তু ঢাল-সড়কি নিয়ে নামার কারণ কী? তারা কি দেখেননি, শিক্ষার্থীসহ সাধারণ মানুষ কীভাবে নেমেছিল অস্ত্রধারী গুন্ডা ও রণসাজে সজ্জিত পুলিশের সামনে? আত্মরক্ষায় তাদের হাতে বড়জোর ছিল লাঠি। শান্তিপূর্ণ এ বিক্ষোভ ক্রমে সহিংস হয়ে ওঠে বিগত সরকারের কাণ্ডজ্ঞানহীন আচরণে।
অপরদিকে আমরা দেখলাম, গোপালগঞ্জে সহিংস বিক্ষোভকারীরা সেখানে টহল দেওয়া সেনাসদস্যদের জখম করে, অস্ত্র ছিনিয়ে নেয় এবং পুড়িয়ে দেয় বাহন। এমন বিচারবুদ্ধিহীন হামলার মাশুল তাদের দিতে হবে। তবে আশা করব, মানবাধিকার সমুন্নত রেখেই এর প্রতিকার করা হবে। গোপালগঞ্জের আওয়ামী লীগ নেতারাও বুঝতে পেরেছেন, কাজটা ঠিক হয়নি। এমন দু-চার জায়গায় এসব করে পরিবর্তিত পরিস্থিতিকে বিপরীতমুখী করা যাবে বলেও মনে হয় না। জনাব জয় কিংবা তার মা যদি কোনোভাবে এদের উসকিয়ে থাকেন, তবে বলব, ভুলের গহ্বর থেকে বেরিয়ে আসার ইচ্ছা তাদের নেই।
ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে একটি সরকার ইতোমধ্যে কার্যক্রম শুরু করেছে। এটি সেনাসমর্থিত শুধু নয়; গণঅভ্যুত্থান থেকে সৃষ্ট। নজিরবিহীন আত্মদানের পথ বেয়ে এসেছে। একে হালকা করে দেখা যাবে না। তবে জনাব জয়ের বক্তব্য পরে কিছুটা হলেও ‘রাজনৈতিক রূপ’ নিতে দেখা গেল। প্রভাবশালী বার্তা সংস্থা এএফপিকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে তিনি দ্রুত নির্বাচন দেওয়াটাই অন্তর্বর্তী সরকারের জন্য ‘সবচেয়ে মঙ্গলজনক’ বলে বর্ণনা করলেন। নইলে নাকি ‘সম্পূর্ণ বিশৃঙ্খল পরিস্থিতির সৃষ্টি হবে’। বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি কিন্তু সৃষ্টি হয়েছিল শেখ হাসিনা পদত্যাগ করে পালিয়ে যাওয়ার পর। ১৭-১৮ কোটি মানুষের দেশ থেকে দুই লাখেরও বেশি পুলিশ সদস্য কার্যত গা-ঢাকা দিয়েছিলেন। তাদের কিছুসংখ্যক সদস্য নিহত হন উত্তেজিত জনতার হাতে।
এ পরিস্থতির আরও অবনতি ঘটলেও অবাক হওয়া যেত না। পুলিশকে রাজনৈতিকভাবে ব্যবহার করে করে এমন একটা জায়গাতেই এনে দাঁড় করানো হয়েছে। রাজনৈতিক পক্ষগুলোর পালটাপালটি হানাহানির কথা এখানে না-ই বা তুললাম। জনাব জয় কি মনে করছেন, নিকট ভবিষ্যতে এর চেয়েও বেশি ‘বিশৃঙ্খল পরিস্থিতির সৃষ্টি হবে’? আর দ্রুত নির্বাচন দিয়ে ‘জনগণের কাছে বৈধতা’ আছে, এমন সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর না করলেই সেটা ঘটবে? আর কাজটা সেরে ফেললেই দেশ হয়ে যাবে ‘সুশৃঙ্খল’? ব্যাপারটা কি এত সরল?
তিনি সম্ভবত এখনো বুঝে উঠতে পারছেন না, আওয়ামী লীগের কঠোর সমর্থক বাদে প্রায় সবার সমর্থন রয়েছে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতি। তারা এর সাফল্যও দেখতে চাইছেন। সাফল্য কীসে? দ্রুত একটি নির্বাচিত সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরেই কি সেটা নিহিত? যাদের নিয়ে অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হয়েছে, তাদের একাংশ কিন্তু বিগত সরকার দ্বারা বিভিন্নভাবে নির্যাতিত। ড. ইউনূসের প্রতি খোদ শেখ হাসিনার আচরণ তো সবার স্মৃতিতে তরতাজা। অন্য যারা উপদেষ্টা হিসাবে দায়িত্ব নিয়েছেন, তাদেরও প্রায় সবাই ‘সংস্কারবাদী’।
এর আগেও একটি সরকার এসেছিল, যেটি চেষ্টা করেছিল জরুরি কিছু সংস্কার আনতে। কিন্তু তারা ব্যর্থ হন। এরপর তাদের কাছ থেকে ক্ষমতা গ্রহণকারী হাসিনা সরকার দেশকে নিয়ে যায় সংস্কারের যতটা সম্ভব বিপরীতে। নির্বাচন ব্যবস্থাও ধূলায় মিশিয়ে দেয়। এখন জয়ের দাবি অনুযায়ী নির্বাচন আয়োজন করতে গেলেও তো এক্ষেত্রে ন্যূনতম কিছু সংস্কার আনতে হবে। সংস্কার-টংস্কার না করে ‘দ্রুত’ একটা নির্বাচন আয়োজন করে সরকার নিজের ‘মঙ্গল’ দেখলে বর্তমান পরিস্থিতিতে কারা আসবে বলে মনে করেন তিনি? জনাব জয়ের কঠোর সমর্থকরাও বলবেন-বিএনপি। তিনি কি তবে মনে করছেন, অন্তর্বর্তী সরকারের চেয়ে বিএনপি নিরাপদ?
এএফপিকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে তিনি কিন্তু বিএনপির সঙ্গে ‘একসঙ্গে কাজ করা’র বিষয়ে আগ্রহ দেখিয়েছেন। এটা ‘কৌতূহলোদ্দীপক’ ঠেকতে পারে, কেননা আওয়ামী মহল থেকে বিএনপিকে ‘আগুনসন্ত্রাসী’ বলে বর্ণনা করে জামায়াতের সঙ্গে তাকেও নিষিদ্ধের দাবি উঠছিল। ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মধ্যেই জামায়াতকে নিষিদ্ধ করেছিল সরকার। সেটা করে আন্দোলনকারীদের বিষয়ে বহির্বিশ্বে একটা সুবিধাজনক বার্তা দিতে চাইছিল বোধহয়। কিন্তু ততদিনে অনেক দেরি হয়ে গেছে। আন্দোলন চলে গেছে সফলতার দিকে। আর এর পরিণতিতে আওয়ামী লীগই গেছে মাঠ থেকে হারিয়ে!
এ প্রেক্ষাপটে অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হয়েছে আন্দোলনে অংশগ্রহণকারীদের সমর্থনে। স্বভাবতই এতে ‘আওয়ামীপন্থি’ বলে পরিচিত কেউ স্থান পাননি। এ সরকার সত্যি বলতে নির্বাচনকালীন ‘তত্ত্বাবধায়ক সরকার’ও নয়। তার সুযোগও নেই; কেননা সে পথ রুদ্ধ করে দিয়েছিল বিগত সরকারই। ড. ফখরুদ্দীন আহমদের নেতৃত্বাধীন সর্বশেষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারটিও কিন্তু ৩ মাসের মধ্যে নির্বাচন দেয়নি। প্রায় ২ বছর ছিল ক্ষমতায়-সেনাসমর্থিত হয়ে। আর এ সরকার তো গণঅভ্যুত্থান থেকে সৃষ্ট। তারা কতদিন থাকবেন, সেটা স্পষ্ট হতেও সময় লাগবে।
আন্দোলনকারীদের দাবি-জরুরি সব সংস্কার সেরে তবেই নির্বাচন। ‘রাষ্ট্র সংস্কার’র দাবিও কম জোরালো নয়। ভবিষ্যতে যাতে আর কোনো স্বেচ্ছাচারী সরকারের জন্ম না হয়, সেটা নিশ্চিত করতেই চাওয়া হচ্ছে সংস্কার। জনাব জয় তা না চাইতেই পারেন। তার মতো করে দাবি কিন্তু প্রাথমিকভাবে জানিয়েছিল বিএনপিও। তারা ৩ মাসের মধ্যে নির্বাচন চেয়েছিলেন। কিন্তু জনাব জয়সহ সবাইকে খেয়াল করতে হবে, এমন দাবি আর জোরালোভাবে জানাচ্ছে না বিএনপি। তারা খুব বেশিদিন অপেক্ষা করতে চাইবেন, তা অবশ্য নয়। সুদীর্ঘ সময় রাষ্ট্রক্ষমতার বাইরে তারা আছেন অন্যায়ভাবে। তা সত্ত্বেও তাদের বোধহয় একটা ‘যৌক্তিক সময়’ পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে।
এ অবস্থায় আওয়ামী লীগের দায়িত্ব গ্রহণকারী কেউ চাইলেও বিএনপি কীভাবে তার সঙ্গে ‘একসঙ্গে’ কাজ করবে? তেমন সম্পর্কও কি রেখেছে হাসিনা সরকার? একটি নির্বাচনে অংশ না নিয়ে বিপর্যস্ত অবস্থায় পরবর্তী নির্বাচনে এলেও বিএনপিকে কি বোকা বানানো হয়নি? ‘রাতের ভোট’র কথা কার না জানা! বলতে গেলে, পুলিশই করে দিয়েছিল সেই ভোট। তারা তখন থেকে নিজেদের বলত ‘দেশের রাজা’। হাসিনা সরকারকে রক্ষায় তাই সর্বোচ্চ বাড়াবাড়ি করতেও পুলিশ পিছপা হয়নি।
এখন এর নির্দেশদাতাদের বিচার না করেই কি সেরে ফেলতে হবে নির্বাচন? আর বিএনপি সেক্ষেত্রে ‘একসঙ্গে কাজ’ করবে জনাব জয় ও তার অনুগামীদের সঙ্গে? গুম-খুনের জন্য যারা দায়ী, তাদের বিচার করতে হবে না? ধরতে হবে না জনগণের অর্থসম্পদ আত্মসাৎকারীদের? সাবেক প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন, তার পিয়নও নাকি ৪০০ কোটি টাকার মালিক। এমনভাবে বলেছিলেন, যেন এর দায়টা অন্য কারও! জনাব জয় কি মনে করেন, এসবের বিচার করবে নির্বাচনের মাধ্যমে আসা আরেকটি সরকার? নাকি মনে করেন, দ্রুত নির্বাচন হলে আওয়ামী লীগই জিতবে! মনে করলেও করতে পারেন। তারা তো বুঝতেই পারেননি, ছাত্র-জনতার পুঞ্জীভূত ক্রোধ তথা বারুদের ওপর বসে আছেন। যখন সেটা টের পেলেন, তখন ধীরেসুস্থে বিদায় নেওয়ার সুযোগও অনুপস্থিত। জনাব জয়কে অবশ্য ধন্যবাদ দিতে হয় তার মাকে বুঝিয়ে-সুঝিয়ে গণভবন থেকে নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নিতে রাজি করানোর জন্য। নইলে কী হতো, সেটা কল্পনা করতেও গা শিউরে ওঠে।
এএফপির সঙ্গে সাক্ষাৎকারে জনাব জয় অবশ্য একটা কাজের কথা বলেছেন। তা হলো, আওয়ামী লীগ ছাড়া নির্বাচন হলে ‘দেশের অন্তত অর্ধেক মানুষের কাছে’ তা গ্রহণযোগ্য হবে না। ‘অন্তত অর্ধেক মানুষ’ অবশ্য আওয়ামী লীগের সঙ্গে কখনো ছিল না। গ্রহণযোগ্য নির্বাচনগুলো সেটাই বলে। বিএনপির ভোটও ঘুরেফিরে তার প্রায় সমান। জাতীয় পার্টিরও উল্লেখযোগ্য ভোট ছিল। আর ভোট ছিল হাসিনা সরকারের হাতে নিষিদ্ধ জামায়াতে ইসলামীর। জনাব জয়ের কি ধারণা, তাদের ১৫ বছর আগেকার জনপ্রিয়তা এখনো অটুট? ‘অল্প কিছু লোক’ ‘বিদেশি মহলবিশেষের চক্রান্তে’ হঠাৎ গোলমাল পাকিয়ে সরকারের পতন ঘটিয়ে ফেলল? এসব অদ্ভুত চিন্তাভাবনায় না থেকে তাদের এখন বিপর্যয়ের গভীরতা উপলব্ধি করতে হবে।
সামনেই ১৫ আগস্ট। আওয়ামী লীগের মধ্যে যাদের এ দিবস পালনের নৈতিক জোর রয়েছে, তারা পারেন সেদিন সীমিত ও শান্তিপূর্ণভাবে কর্মসূচি পালন করতে। কোনোরকম গোলযোগে না গিয়ে দলটিকে অধিকতর বিপর্যয় থেকে রক্ষা করা তাদের কর্তব্য এখন। জনাব জয় বলেছেন-‘আমাদের লাখ লাখ সমর্থক রয়েছেন। তারা (দেশ ছেড়ে) কোথাও যাচ্ছেন না।’ আর এদের একটা বড় অংশই জড়ায়নি গুরুতর অপরাধে। আওয়ামী লীগ করা কিংবা তাকে সমর্থন করা তো অপরাধ নয়।
জনাব জয় কি এখন দলটির নেতৃত্ব দিতে চান? নাকি কর্মী-সমর্থকদের বলবেন দেশে উপস্থিত কাউকে খুঁজে নিতে? নাকি শেখ হাসিনাই প্রবাস থেকে নেতৃত্ব দেবেন নতুন বিপর্যয়ের শিকার দলটিকে? এসব প্রশ্ন সামনে আসবে। এ অবস্থায় বিএনপি অবশ্য জানাতে পারে-‘দ্রুত নির্বাচন’ নিশ্চিত করতে জনাব জয়ের কথামতো তারা ‘একসঙ্গে কাজ’ করতে রাজি কি না!
হাসান মামুন : সাংবাদিক, বিশ্লেষক