ডায়াবেটিক রেটিনোপ্যাথি অন্ধত্বের একটি প্রধান কারণ
ড. রাশিদুল হক
প্রকাশ: ০৮ আগস্ট ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
ডায়াবেটিস একটি দীর্ঘমেয়াদি বিপাকীয় রোগ। এ রোগে রক্তে শর্করার মাত্রা স্বাভাবিকের চেয়ে বেড়ে যায়। দীর্ঘদিন ধরে অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিসের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হয় চোখও, বিশেষ করে চোখের নিউরো-সংবেদনশীল রেটিনা। রেটিনার রক্তনালি ক্ষতিগ্রস্ত হলে ডায়াবেটিক রেটিনোপ্যাথি নামক একটি রোগ হয়, যা নষ্ট করে দিতে পারে আমাদের দৃষ্টিশক্তি। ডায়াবেটিক রেটিনোপ্যাথির প্রাথমিক পর্যায়ে রেটিনার অংশে সরু রক্তনালিগুলো দুর্বল হয়ে পড়ে। ফলে এক ধরনের তরলের ক্ষরণ শুরু হয়। এতে দৃষ্টিশক্তি কমে যায়। এর পরবর্তী পর্যায়ে রক্তনালিগুলোতে রক্ত চলাচলের সমস্যা আরও বেড়ে যায়। ফলে রেটিনার বিভিন্ন অংশে ঠিকমতো অক্সিজেন পৌঁছতে না পেরে চোখের ভিট্রিয়াস গহ্বরে রক্তক্ষরণ শুরু হয়। এ অবস্থাকে বলা হয় ভিট্রিয়াস হেমারেজ। এর থেকে অন্ধত্ব আসতে পারে। চোখের যেসব অসুখের কারণে চোখ অন্ধ হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে, ডায়াবেটিক রেটিনোপ্যাথি তার অন্যতম। বিশ্বব্যাপী ডায়াবেটিক রোগীদের মধ্যে ডায়াবেটিক রেটিনোপ্যাথির প্রাদুর্ভাব অনুমান করা হয় ২৭ শতাংশ। জনসংখ্যাভিত্তিক বিভিন্ন গবেষণায়/সমীক্ষায় বাংলাদেশে টাইপ-২ ডায়াবেটিস রোগীদের মধ্যে রেটিনোপ্যাথির প্রাদুর্ভাবের হার দেখা গেছে ৩০ শতাংশের বেশি।
প্রকারভেদ : ডায়াবেটিক রেটিনোপ্যাথির দুটি প্রধান ধরন রয়েছে-নন-প্রলিফেরেটিভ ডায়াবেটিক রেটিনোপ্যাথি (এনপিডিআর) এবং প্রলিফেরেটিভ ডায়াবেটিক রেটিনোপ্যাথি (পিডিআর), যা ডায়াবেটিক রেটিনোপ্যাথির একটি গুরুতর রূপ। এনপিডিআর ডায়াবেটিক রেটিনোপ্যাথির প্রাথমিক পর্যায়ে রেটিনার রক্তনালিগুলো দুর্বল হয়ে পড়ে, দেখা যায় রেটিনায় রক্তসংবহনে (ভাস্কুলার) ব্যাপ্তিযোগ্যতা, মাইক্রোএনিউরিজম (রক্তনালির স্থানীয়ভাবে স্ফীত হওয়া) গঠন এবং চোখের ভেতরে রক্তরস ও রক্তক্ষরণ। ডায়াবেটিক রেটিনোপ্যাথির পূর্বপর্যায় হচ্ছে ‘পিডিআর’, যেখানে দেখা যায় রেটিনা স্তরের ইনফ্রাক্ট (রক্তপ্রবাহ বন্ধ হওয়ায় চোখের স্ট্রোক), অস্বাভাবিক নতুন রক্তনালিকা প্রসারণ, নতুন রক্তনালিগুলোর ভঙ্গুরতা এবং চোখের ভেতরে রক্তপাত (ভিট্রিয়াস হেমোরেজ)। এটি রেটিনাল ডিটাচমেন্ট এবং রক্তক্ষরণজনিত দৃষ্টি প্রতিবন্ধকতার ঝুঁকি বাড়িয়ে দেয়।
প্রধান যে ফ্যাক্টর দায়ী : ডায়াবেটিক রেটিনোপ্যাথি বিকাশের জন্য সবচেয়ে প্রাসঙ্গিক ঝুঁকির কারণ হলো স্বাভাবিক গ্লাইসেমিক নিয়ন্ত্রণ। ডায়াবেটিক রেটিনোপ্যাথি রেটিনার রক্তনালিগুলোর একটি রোগ (মাইক্রোভাস্কুলোপ্যাথি) হিসাবে স্বীকৃত। সূক্ষ্ম রক্তনালিগুলো রেটিনায় অক্সিজেন ও পুষ্টি পৌঁছাতে সাহায্য করে। রক্তনালিগুলোর বর্ধিত ব্যাপ্তিযোগ্যতার পাশাপাশি দেখা যায় রক্ত-রেটিনা প্রতিবন্ধকের (বিআরবি) ভাঙন এবং রেটিনার স্নায়ুকোষ, এন্ডোথেলীয় কোষ ও পেরিসাইটের অ্যাপোপটোটিক মৃত্যু, সেই সঙ্গে মাইক্রোএনিউরিজম ও নিউক্লিয়াসবিহীন অকোষীয় রক্তনালির উপস্থিতি।
যেহেতু পেরিসাইটগুলো রক্তনালির জন্য কাঠামোগত সহায়তা প্রদান করে, তাই তাদের ক্ষতির ফলে রক্তনালির প্রাচীরে স্থানীয়ভাবে স্ফীত (মাইক্রোএনিউরিজম) হতে দেখা যায়, যা ডায়াবেটিক রেটিনোপ্যাথির প্রথমদিকের ক্লিনিক্যাল লক্ষণ। পেরিসাইট ও এন্ডোথেলীয় কোষের ক্ষতির ফলে স্বাভাবিক রক্তসঞ্চালনে বাধা বা রেটিনাল ইস্কেমিয়া হয়, যা হাইপোক্সিয়াকে (কম অক্সিজেন পারফিউশন) প্ররোচিত করে। ফলে ভাস্কুলার এন্ডোথেলীয় গ্রোথ ফ্যাক্টরের সংশ্লেষণও বৃদ্ধি পায়। ভেইজেফ হলো একটি সংকেতবাহী গ্রোথ ফ্যাক্টর বা প্রোটিন, যা টিস্যুতে পর্যাপ্ত অক্সিজেন সরবরাহ করার জন্য বিদ্যমান রক্তনালি থেকে নতুন রক্তনালি সৃষ্টি করে। এ পদ্ধতিকে বলা হয় নিওভাসকুলারাইজেশন।
অন্যান্য রিস্ক ফ্যাক্টর : স্থূলতা : প্রত্যেক মানুষের ওজন নির্ভর করে তার উচ্চতার ওপর। পূর্ণবয়স্ক মানুষের ওজনাধিক্য ও স্থূলতা নিরূপণের জন্য উচ্চতা ও ওজনের যে আনুপাতিক হার উপস্থাপন করা হয়, তাকে ‘বডি মাস ইনডেক্স’, সংক্ষেপে ‘বিএমআই’ বলে। বিএমআই ছাড়াও কোমর ও নিতম্বের মাপের অনুপাত দিয়েও ওজনাধিক্য ও স্থূলতা নিরূপণ করা যায়। এ সূচক দুটি বেশ কয়েকটি স্বাস্থ্যঝুঁকি যেমন উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস, হৃদরোগের পাশাপাশি পুষ্টির ঘাটতির পরিমাপের একটি সূচক।
উচ্চরক্তচাপ : উচ্চরক্তচাপ ডায়াবেটিক রেটিনোপ্যাথির একটি গুরুত্বপূর্ণ ঝুঁকির কারণ। বিভিন্ন ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালেও এর প্রমাণ মিলেছে। এছাড়া কিছু জনসংখ্যাভিত্তিক গবেষণায় দেখানো হয়েছে, মূলত সিস্টোলিক রক্তচাপ ধারাবাহিকভাবে ডায়াবেটিক রেটিনোপ্যাথির সঙ্গে যুক্ত। ডায়াস্টোলিক রক্তচাপের সঙ্গে এ রোগের কোনো উল্লেখযোগ্য সম্পর্ক পাওয়া যায়নি। টাইপ ২ ডায়াবেটিসে ‘রেনিন-অ্যাঞ্জিওটেনসিন সিস্টেম’র রেটিনোপ্যাথি অবরোধেও নির্দিষ্ট ভূমিকা রয়েছে, যেখানে এটি মাইক্রো/ম্যাক্রোঅ্যালবুমিনুরিয়াসহ নেফ্রোপ্যাথি ও হৃদসংবহন রোগের ঝুঁকিও হ্রাস করতে দেখা গেছে।
রক্তমেদাধিক্য বা হাইপারলিপিডেমিয়া : হাইপারলিপিডেমিয়াকে সংজ্ঞায়িত করা হয় যখন রক্তে উচ্চ-ঘনত্বের লাইপোপ্রোটিন কোলেস্টেরল (এইচডিএল) কম থাকে এবং কম ঘনত্বের লাইপোপ্রোটিন কোলেস্টেরল (এলডিএল), ট্রাইগ্লিসারাইড ও খুব কম-ঘনত্বের লাইপোপ্রোটিন কোলেস্টেরল (ভি-এলডিএল) বেশি থাকে। এ ধরনের অস্বাভাবিকতা বা ভারসাম্যহীনতাকে কখনো ডিসলিপিডেমিয়াও বলা হয়ে থাকে। অতিরিক্ত লিপিডের উপস্থিতি, বিশেষ করে অক্সিডাইজড এলডিএল কোলেস্টেরল, অক্সিডেটিভ স্ট্রেস বাড়িয়ে দেয়। এছাড়া ডায়াবেটিস রোগীদের মোট কোলেস্টেরলের মাত্রাও বেশি পাওয়া যায়। রক্তের এ অবস্থাটি দেহের কার্ডিও-বিপাকীয় সমস্যাগুলোর সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কযুক্ত, যেমন স্থূলতা, উচ্চরক্তচাপ ও করোনারি হৃদরোগ। সম্প্রতি হাইপারলিপিডেমিয়াকেও ডায়াবেটিক রেটিনোপ্যাথির বিকাশের জন্য সবচেয়ে শক্তিশালী ঝুঁকির কারণ হিসাবে বিবেচনা করা হয়েছে। লিপিড-হ্রাসকারী চিকিৎসা, বিশেষ করে স্ট্যাটিন ও ফাইব্রেট ব্যবহার করে ডায়াবেটিক রেটিনোপ্যাথি কমানোর জন্য পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।
জীবনধারা : ডায়াবেটিস ও রেটিনোপ্যাথি প্রতিরোধে মানুষের দৈনন্দিন জীবনযাত্রা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ডায়াবেটিস রোগীদের খাদ্য তালিকায় ‘লং-চেইন এন-৩ পলিআনস্যাচুরেটেড ফ্যাটি অ্যাসিড’ (যেমন ওমেগা-৩ ফ্যাটি অ্যাসিড, কমপক্ষে ৫০০ মিলিগ্রাম/দিন) গ্রহণ করার পরামর্শ দেওয়া হয়, যা ডায়াবেটিক রেটিনোপ্যাথির আপেক্ষিক ঝুঁকি ৪৮ শতাংশ হ্রাস করে। এছাড়া ওমেগা-৩-এর ব্যবহার টাইপ ২ ডায়াবেটিক রোগীদের মধ্যে এলডিএল/এইচডিএল অনুপাতও কমাতে পারে। এ ফ্যাটি অ্যাসিডটি যে কোনো তেলযুক্ত মাছে প্রচুর পরিমাণে পাওয়া যায়। এছাড়া পর্যাপ্ত ভিটামিন ডি ডায়াবেটিক রেটিনোপ্যাথির বিকাশ ও অ্যাঞ্জিওজেনেসিস প্রক্রিয়াকে বাধা দেয়। উল্লেখ্য, চোখের ভিটামিন ডি স্থানীয়ভাবেই উৎপাদিত, সক্রিয় ও নিয়ন্ত্রিত হয়। প্রকৃতপক্ষে ভিটামিন ডি৩ তৈরিতে যেসব এনজাইম প্রয়োজন, তার সবই সংশ্লেষিত হয় চোখে। অন্যান্য ভিটামিন যেমন ‘ভিটামিন এ’ দৃষ্টিগত প্রক্রিয়ায় অপরিহার্য এবং এটি রোডোপসিন রঞ্জক প্রোটিনের একটি প্রধান উপাদান। তাই ‘ভিটামিন এ’ বা ক্যারোটিনয়েডের উৎস, যেমন-পালংশাক, ব্রকলি, গাজর বা মিষ্টি আলুযুক্ত খাবার নিয়মিত খাওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়। ভিটামিন বি১ (থায়ামিন) এবং ভিটামিন সি ডায়াবেটিক রেটিনোপ্যাথির বিকাশের বিরুদ্ধেও একটি প্রতিরক্ষামূলক উপাদান হিসাবে কাজ করে। এছাড়া ধূমপান পরিহার এবং নিয়মিত শারীরিক পরিশ্রম ডায়াবেটিক রেটিনোপ্যাথি হওয়ার ঝুঁকি কমায়।
চিকিৎসাব্যবস্থা : চোখে ডায়াবেটিক রেটিনোপ্যাথি ও এডিমা নিরূপণের জন্য প্রযুক্তি হিসাবে ব্যবহৃত হয় প্রধানত অপটিক্যাল কোহেরেন্স টমোগ্রাফি (ওসিটি)। ওসিটি হলো একটি নন-ইনভেসিভ উচ্চ-রেজোলিউশন সম্পন্ন ক্রস-সেকশনাল ইমেজিং, যা চোখের রেটিনার (রেটিনা ও অপটিক স্নায়ুর স্তরগুলোর) ছবি তৈরি করতে প্রতিফলিত একটি কম-পাওয়ার লেজার/আলোক তরঙ্গ ব্যবহার করে। এ প্রযুক্তিটি টিস্যুর যথাস্থানে (ইন সিটু) এবং বাস্তব সময়ে মাইক্রোন স্কেলে রেটিনার স্তরগুলোর পুরুত্ব পরিমাপ করতে সাহায্য করে। এটি ডায়াবেটিস সম্পর্কিত রেটিনোপ্যাথি ও ম্যাকুলার এডিমা, গ্লুকোমা এবং বয়সজনিত ম্যাকুলার অবক্ষয়ের মতো রোগ নির্ণয়ে ব্যবহার করা হয়। এসব চোখের রোগ অন্ধত্বের প্রধান কারণ। ডায়াবেটিক রেটিনোপ্যাথির যে কোনো চিকিৎসার লক্ষ্য হলো এ রোগের অগ্রগতিকে ধীর বা বন্ধ করা। ডায়েট, শারীরিক অনুশীলন এবং রক্তে শর্করার মাত্রা নিয়ন্ত্রণ রোগের অগ্রগতি নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করতে পারে।
ফার্মাকোথেরাপি : ডায়াবেটিসের কারণে ভেইজেফ প্রোটিনটির বর্ধিত প্রকাশ রেটিনোপ্যাথির, বিশেষ করে প্রলিফারেটিভ ডায়াবেটিক রেটিনোপ্যাথির অন্যতম কারণ হিসাবে চিহ্নিত। অ্যান্টি-ভেইজেফ থেরাপির আবির্ভাব ডায়াবেটিক রেটিনোপ্যাথির চিকিৎসায় এক বৈপ্লবিক পরিবর্তন এনেছে। চোখের পেছনে নতুন রক্তনালি তৈরি হওয়া রোধ করতে অ্যান্টি-ভেইজেফ এন্টিবডি নামক ওষুধের (ইন্ট্রাভিট্রিয়াল) ইনজেকশন সরাসরি চোখে প্রয়োগ করা হয়। বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের খাদ্য ও ওষুধ প্রশাসন (এফডিএ) অনুমোদিত প্রচলিত অ্যান্টি-ভেইজেফ ওষুধের মধ্যে রয়েছে র্যার্নিবিজুমাব (লুসেন্টিস, জেনেনটেক), এফলিবারসেপ্ট (আইলিয়া, রিজেনেরন) এবং বেভাসিজুমাব (অ্যাভাসটিন)। বর্তমানে অ্যান্টি-ভেইজেফ ছাড়াও অন্যান্য অ্যান্টি-এনজিওজেনিক ওষুধও ম্যাকুলার এডিমা রোগীদের নিয়ন্ত্রণে ব্যবহার করা হয়, যেমন-অ্যান্টি-প্লেটলেট-ডেরাইভড গ্রোথ ফ্যাক্টর এবং অ্যান্টি-বি-ফাইব্রোব্লাস্ট গ্রোথ ফ্যাক্টর।
লেজার ফটোকোয়াগুলেশন : যদিও অ্যান্টি-ভেইজেফ থেরাপি ক্রমবর্ধমানভাবে ডায়াবেটিক রেটিনোপ্যাথি চিকিৎসার প্রধান ভিত্তি হয়ে উঠেছে, তথাপি লেজার থেরাপি এখনো একটি সহায়ক চিকিৎসা বা রেসকিউ থেরাপি হিসাবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এ থেরাপির মাধ্যমে লেজারের তাপ ব্যবহার করে রেটিনায় অস্বাভাবিক ফুটো হওয়া রক্তনালিগুলোকে সিল/বন্ধ করা হয়। ডায়াবেটিক রেটিনোপ্যাথির কারণে দৃষ্টিশক্তি হ্রাসের ঝুঁকি কমাতে এ চিকিৎসা দেওয়া হয়। ফটোকোয়াগুলেশনের সময় দুটি পদ্ধতির একটি ব্যবহার করা যেতে পারে : ১. ফোকাল ফটোকোয়াগুলেশন-ফোকাল ট্রিটমেন্ট রেটিনার একটি ছোট অংশে, সাধারণত ম্যাকুলার কাছাকাছি নির্দিষ্ট ফুটো হওয়া রক্তনালিগুলোকে সিল করতে ব্যবহৃত হয়। এটি ননপ্রোলিফেরেটিভ রেটিনোপ্যাথির কারণে ম্যাকুলার এডিমার জন্য হারানো দৃষ্টি ফিরিয়ে আনতে সাহায্য করতে পারে; ২. স্ক্যাটার (প্যান-রেটিনাল) ফটোকোয়াগুলেশন : রেটিনার বিস্তীর্ণ এলাকায় বিকশিত নতুন অস্বাভাবিক রক্তনালিগুলোর বৃদ্ধিকে ধীর করতে স্ক্যাটার ট্রিটমেন্ট ব্যবহার করা হয়। এটি প্রলিফারেটিভ রেটিনোপ্যাথির চিকিৎসার জন্য ব্যবহৃত হয়। এ চিকিৎসায় রোগীদের কিছু ঝুঁকিও রয়েছে। লেজার তাপের কারণে রেটিনার কিছু অংশ পুড়ে কিছুটা স্থায়ী দৃষ্টিশক্তি নষ্ট করতে পারে। ফলে কেন্দ্রীয় ও পার্শ্বীয় দৃষ্টিশক্তির মৃদু ক্ষতি হতে পারে। ভবিষ্যতে লেজার প্রযুক্তির উন্নয়নগুলো ডায়াবেটিক রেটিনোপ্যাথির চিকিৎসায় লেজার ফটোকোয়াগুলেশনের সুরক্ষা ও কার্যকারিতা আরও বাড়িয়ে তুলতে পারে।
প্রদাহরোধী থেরাপি : ইন্ট্রাভিট্রিয়াল স্টেরয়েড : ইন্ট্রাভিট্রিয়াল কর্টিকোস্টেরয়েডগুলো ডিএমই’র চিকিৎসার ক্ষেত্রে ক্রমবর্ধমান গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে, বিশেষত যেসব ক্ষেত্রে অ্যান্টি-ভেইজেফ থেরাপি প্রতিক্রিয়ার অভাব রয়েছে। সক্রিয় অ্যান্টি-ইনফ্ল্যামেটরি এজেন্ট হিসাবে কর্টিকোস্টেরয়েডগুলো ভেইজেফ, টিউমার নেক্রোসিস ফ্যাক্টর-আলফা, ইন্টারলিউকিন-১বিটা, লিউকোস্টেসিস এবং টাইট-জাংশন প্রোটিনের ফসফোরিলেশনসহ ডিএমই ও ডায়াবেটিক রেটিনোপ্যাথির সঙ্গে জড়িত মধ্যস্থতাকারীদের দমন করে। তবে এর গুরুতর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হিসাবে দেখা গেছে চোখে ছানি পড়া এবং চোখের চাপ (আইওপি) বেড়ে যাওয়ার প্রবণতা। কিছু ননস্টেরয়েড অ্যান্টি-ইনফ্লেমেটরি এজেন্টও রয়েছে, যা ডিএমই ও ডায়াবেটিক রেটিনোপ্যাথির চিকিৎসার জন্য এফডিএ দ্বারা অনুমোদিত হয়েছে। এর একটি হলো নেপাফেনাক।
অস্ত্রোপচার : ভিট্রেক্টমি হলো এক ধরনের চোখের সার্জারি, যার মাধ্যমে কিছু ভিট্রিয়াস অপসারণ করে রক্তকে পরিষ্কার করা হয়, যাতে করে অনেকটা স্বাভাবিক দৃষ্টি ফিরিয়ে আনা সম্ভব হয়। পোস্টেরিয়র ভিট্রিয়াস ডিটাচমেন্ট (পিভিডি), রেটিনাস্তরের স্থানচ্যুত হওয়া (রেটিনাল ডিটাচমেন্ট) বা ভিট্রিয়াস হেমোরেজ হলে ভিট্রেক্টমির প্রয়োজন হয়। ভিট্রিয়াস হলো একটি জেলের মতো পদার্থ, যা চোখের মাঝখানের অংশকে ভরাট করে। এ পদ্ধতির কিছু ঝুঁকিও আছে, যেমন-সংক্রমণ, অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ, চোখে উচ্চচাপ এবং অস্ত্রোপচারের কারণে নতুনভাবে রেটিনা বিচ্ছিন্নতা বা লেন্সের ক্ষতি।
শেষ কথা : ডায়াবেটিক রেটিনোপ্যাথি রেটিনার সূক্ষ্ম রক্তনালিগুলোর একটি রোগ হিসাবে পরিচিত। এছাড়া প্রদাহ এবং রেটিনার স্নায়ু অবক্ষয় ভিন্নভাবেও ডায়াবেটিক রেটিনোপ্যাথিতে ভূমিকা রাখতে পারে। এ যাবৎ ডায়াবেটিক রেটিনোপ্যাথির থেরাপিউটিক চিকিৎসা হিসাবে ইন্ট্রাভিট্রিয়াল অ্যান্টি-ভেইজেফ এজেন্টগুলো ডিএমই ও পিডিআরের জন্য বেশ জনপ্রিয় থেরাপি হলেও চোখের ভেতরে এর ঘনঘন ইনজেকশন, রোগীদের আর্থিক বোঝা এবং তাদের ক্রমেই নিস্পৃহতার কারণে অ্যান্টি-ভেইজেফ ওষুধের ব্যবহার সীমিত হয়ে পড়েছে। তবে লেজার ফটোকোয়াগুলেশন এবং ইন্ট্রাভিট্রিয়াল কর্টিকোস্টেরয়েডগুলো এখনো যথেষ্ট সহায়ক চিকিৎসা হিসাবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। ডায়াবেটিক রেটিনোপ্যাথির নিয়ন্ত্রণে বিকল্প পদ্ধতি হিসাবেও অনেক বিজ্ঞানী মাইক্রো-আরএনএ প্রযুক্তির প্রয়োগেরও পরামর্শ দিয়েছেন। যা হোক, উল্লিখিত এসব চিকিৎসা শুধু ক্রমাগত অবক্ষয়জনিত রোগকে বিলম্বিত বা প্রতিরোধ করতে পারে। এক্ষেত্রে স্টেম সেলভিত্তিক গবেষণা এবং ডায়াবেটিক রেটিনোপ্যাথির থেরাপিউটিক সম্ভাবনা রোগীদের জন্য নিঃসন্দেহে আশার আলো দেখাচ্ছে। তবে স্টেম কোষের ভিন্নতা, কোষ বিতরণ, এবং ক্ষতিগ্রস্ত টিস্যুতে স্টেম কোষের কার্যকর প্রতিস্থাপন এক প্রধান চ্যালেঞ্জ।
ড. রাশিদুল হক : অধ্যাপক ও সাবেক উপ-উপাচার্য, বরেন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী; সাবেক অধ্যাপক, এমোরি বিশ্ববিদ্যালয়, আটলান্টা, যুক্তরাষ্ট্র ও প্রাণিবিদ্যা বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়
rhaque2011@gmail.com