Logo
Logo
×

উপসম্পাদকীয়

নীতি দুর্নীতি অর্থনীতি

অর্থনীতিতে আর কত বিপর্যয় মোকাবিলা করতে হবে?

Icon

ড. আর এম দেবনাথ

প্রকাশ: ০৩ আগস্ট ২০২৪, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

অর্থনীতিতে আর কত বিপর্যয় মোকাবিলা করতে হবে?

২০২৩-২৪ অর্থবছর শেষে সরকার তার হিসাব দিয়েছে বাজেটের মাধ্যমে। এবার হিসাব দেওয়ার পালা আমাদের করদাতাদের। আসছে নভেম্বর মাসের মধ্যেই আয় থাক আর নাই থাক কর পরিশোধ করতে হবে। এতে কোনো রেয়াত নেই। এর আলামত ইতোমধ্যেই শুরু হয়েছে। সেদিন ব্যাংকে এক ক্ষুব্ধ গ্রাহকের সঙ্গে দেখা। তিনি করদাতা। কর পরিশোধের সার্টিফিকেট নিতে এসে দেখেন ব্যাংক ১০ শতাংশের স্থলে ১৫ শতাংশ করে আয়কর কেটেছে-‘ট্যাক্স অ্যাট সোর্স’। কীভাবে? বর্তমান ‘জমিদারি’ নিয়ম হচ্ছে-একজন যে কর পরিশোধ করেছেন, তার প্রমাণ হিসাবে রিটার্ন জমা রসিদ লাগে। এটা ব্যাংকে জমা দিতে হয় প্রতিবছর। করদাতা বলেছেন, তিনি তা যথারীতি জমা দিয়েছেন, একদম সময়মতো। ব্যাংক বলেছে, তাদের কাছে এমন কোনো রেকর্ড নেই। অতএব, ১৫ শতাংশ হারে সুদের ওপর ‘ট্যাক্স অ্যাট সোর্স’। কর পরিশোধের প্রমাণ হিসাবে রিটার্ন জমা দেওয়া থাকলে ১০ শতাংশ। কোথায় ১০ শতাংশ, আর কোথায় ১৫ শতাংশ।

শাস্তির একটা সীমা থাকা দরকার। এমনিতেই ১০ শতাংশ কর কাটা হলেই লাখ লাখ করদাতার ক্ষেত্রে অনেক বেশি ট্যাক্স কাটা হয়-সরকারি পাওনার চেয়ে বেশি। অথচ সেই টাকা করদাতাকে ফেরত দেওয়া হয় না। একে নাকি বলে দায় পরিশোধের চূড়ান্ত নিষ্পত্তি। কী বিচার চলছে! অথচ এর ওপর আরও ৫ শতাংশ মানে ১৫ শতাংশ হিসাবে ট্যাক্স কাটা। বলা হচ্ছে, কিছুই করার নেই। ব্যাংকে সবকিছুই এখন ‘সেন্ট্রালাইজ্ড কম্পিউটার’ পদ্ধতিতে হয়। ট্যাক্স কাটা হয়েছে এবং তা সরকারের কোষাগারে জমাও হয়ে গেছে। বোঝা গেল বিচারটা। করদাতা বিনা দোষে ৫ শতাংশ হারে বেশি কর দিলেন এমন সময়ে যখন সব করদাতা, মধ্যবিত্ত ও জনসাধারণের আয় হ্রাস পেয়েছে। ক্রয়ক্ষমতা হ্রাস পেয়েছে। মূল্যস্ফীতিতে সবই জর্জর। করদাতারা তাদের নিজেদের হিসাবটা মেলাতে পারছেন না। মজা হচ্ছে, হিসাব মেলাতে না পারলে কী হবে, অতিরিক্ত কর তাদের দিতেই হচ্ছে। এদিকে দেখা যাচ্ছে, এরপরও সরকারের রাজস্বের হিসাব মিলছে না। ভীষণ খবর।

দুদিন আগেই জানা গেল আমাদের রপ্তানির হিসাব ঠিক নেই। কমপক্ষে ২০-৩০ শতাংশ করে রপ্তানি আয় বেশি দেখানো হচ্ছে। এরও আগে দেখলাম আমাদের বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভের হিসাবে গন্ডগোল। কোথায় ৪৫-৪৮ বিলিয়ন বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভ, আবার কোথায় ২০-২২ বিলিয়ন ডলার। প্রকৃত রিজার্ভ হিসাবের ফেরে প্রায় অর্ধেক হয়ে গেল। চালের হিসাবের নির্ভরযোগ্যতা নেই। বলছি আলুতে আমরা উদ্বৃত্ত। আবার আলু করছি আমদানি। চালে বলছি স্বয়ংসম্পূর্ণ। অথচ প্রতিবছর চাল আমদানি হচ্ছে ৫ থেকে ১০ লাখ টন। গম আমদানির কথা বাদই দিলাম। বিষয়টি কী? কোনো জিনিসেরই হিসাব মিলছে না কেন? মাছের হিসাবে, দুধের হিসাবে গন্ডগোল। আর আমদানির হিসাব? এর মধ্যে যে কী ভূত আছে একমাত্র উপরওয়ালাই বলতে পারবেন। বিলিয়ন বিলিয়ন (এক বিলিয়ন মানে শত কোটি) ডলারের আমদানি। অথচ পণ্যের অভাব। পণ্য আসে কম, ডলার পরিশোধ বেশি। পাচার, অর্থ পাচার আর কী! এটা আমার কথা নয়। স্বয়ং কেন্দ্রীয় ব্যাংকই আমদানি নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা নেওয়ার সময় এ কথা বলেছে। কীভাবে চোরাচালান/অর্থ পাচারের মদদদাতা ব্যাংকগুলো এ জঘন্য কাজটি করছে। সম্প্রতি এই ‘লাইনে’ যোগ হয়েছে আমাদের ‘রাজস্ব আয়ের’ হিসাব। বিশাল খবর একটি দৈনিকে। ওই খবরে বলা হচ্ছে, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে রাজস্ব আয় আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৪ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা। পরে তা কমিয়ে আনা হয় ৪ লাখ ১০ হাজার কোটি টাকায়। সরকার রাজস্ব আয় দেখিয়েছে ৩ লাখ ৮২ হাজার কোটি টাকা। অথচ প্রধান হিসাবরক্ষক অফিস বলছে, এত টাকা তারা পায়নি হিসাবে। তারা পেয়েছে মাত্র ২ লাখ ৮৫ হাজার কোটি টাকা। বলে কী? ৯৭ হাজার কোটি টাকা নেই? নেই তখন, যখন আমাদের টাকার দরকার সবচেয়ে বেশি।

সরকার সমানে ধার করছে দেশ-বিদেশ থেকে। ব্যাংক থেকে ধার নেওয়ার ফলে ব্যাংকে ব্যাংকে তারল্য সংকট দেখা দিচ্ছে বলে খবরে বলা হচ্ছে। সেই তারল্য আবার জোগান দিচ্ছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এরও কোনো প্রকৃত হিসাব নেই। একেক কাগজ একেক হিসাব দিচ্ছে। কেউ কেউ তো গুজবও ছড়াচ্ছে সরকার সমানে টাকা ‘ছাপাচ্ছে’ বলে। ‘ছাপানো’ টাকা দিয়ে সরকার দায় শোধ করছে। কী আর বলব? টাকা ছাপানো তো একটা অবিরাম কাজ। সারা বছর টাকা ছাপানো হয়-পুরোনো নোট বদলে দিতে হয়। আবার বাজারে নতুনভাবে মুদ্রা দিতে হয়। অবশ্যই এ কাজ একটা হিসাবের মধ্যে হয়। ‘ছাপানো’ টাকা ইচ্ছা করলেই বাজারে দেওয়া যায় না। দিতে হলে ওই টাকা ‘ইস্যু’ করতে হয়। ‘ইস্যু’ করার নিয়ম আছে। অতিরিক্ত ইস্যু মূল্যস্ফীতির জন্ম দেয়। এসব ব্যাপার আছে। অথচ গুজব আর গুজব। দেশ এখন অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সামাজিক গুজবের দেশে পরিণত হয়েছে/হচ্ছে। এই যেমন এক ‘গুজব’-কে বা কারা বিদেশে অবস্থানরত বাংলাদেশিদের নাকি বলেছে দেশে সরকারিভাবে ডলার না পাঠাতে। উদ্দেশ্য কী? উদ্দেশ্য হচ্ছে একটাই-ডলারের সংকটকে আরও গভীর করা। এমনিতেই ডলারের অভাব বাজারে। তারপর যদি নিয়মিত ডলার প্রবাসীরা না পাঠায়, তাহলে সংকট নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাবে। মনে হচ্ছে, একশ্রেণির লোক এটাই চায়। হয়তো হুন্ডিওয়ালারাও চায়। কারণ এতে তাদের রাজত্ব সম্প্রসারিত হয়। কিন্তু প্রশ্ন হলো, হুন্ডিতে ডলার পাঠানোরও সমস্যা আছে। ডলার দেশে এসে টাকা হবে। টাকা ব্যাংকে ঢুকবে। সেখানে হিসাব হবে। আবার ‘হোস্ট কান্ট্রিরও’ হিসাব আছে। সরকারিভাবে ডলার পাঠানো হচ্ছে না। অতএব, সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির হিসাবে ডলার থাকার কথা। দেখা যাচ্ছে নেই। খবর হবে-ডলার কোথায় গেল? অতএব, হিসাবটা এত সহজ নয়। কিন্তু এসব উলটাপালটা জিনিস ঘটছে। চেষ্টা চলছে অর্থনৈতিক অস্থিরতা সৃষ্টির। অবশ্যই উসিলা হচ্ছে কোটা সংস্কার আন্দোলন। কোটাব্যবস্থা রহিত থাকার পরও দেখা যাচ্ছে একের পর এক দাবি আসছে। শেষ পর্যন্ত এ দাবিগুলো কোথায় গিয়ে ঠেকবে, তা কেউ জানে না। অথচ এটি আগস্ট মাস, ২০২৪-২৫ অর্থবছরের দ্বিতীয় মাস। অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড মোটামুটি স্থবির। মূল্যস্ফীতি এখনো তুঙ্গে। সরবরাহ ব্যবস্থা এখনো স্বাভাবিক হয়নি। দেশে দু’-দু’বার বন্যা হয়ে গেছে। অতিবৃষ্টিতে ফসলের ক্ষতি হয়েছে। আমন ফসলের সমস্যা হচ্ছে। আমদানি-রপ্তানি ব্যবসা স্থবির। ব্যবসায়ীরা সুযোগ বুঝে ক্ষয়ক্ষতির হিসাব করে সরকারের কাছে হাজির হচ্ছেন নানা সুযোগ-সুবিধার জন্য। কথা একটাই-‘লাভ আমাদের, ক্ষতি সরকারের’। অবশ্যই সরকারকে তাদের লোকসান পুষিয়ে দিতে হবে। আসছে জুলুম ব্যাংকের ওপর। তারা প্রস্তুত ব্যাংকে তদবিরের জন্য। ঋণ পুনঃতফশিল করা হোক। এই কয়েকদিনের স্থবিরতায় তারা ভীষণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত।

অনেকে বলছেন, আমরা ‘গ্রেট গেমে’-পড়ে গেছি। একদিকে আমেরিকা, একদিকে চীন এবং আরেক দিকে প্রতিবেশী ভারত। আমেরিকা আমাদের রপ্তানির গন্তব্যস্থল। চীন আমাদের আমদানির এক নম্বর উৎস। ভারত নিকটতম প্রতিবেশী। তিন দেশের সঙ্গেই আমাদের সুসম্পর্ক চাই, করছিও তা-ই। মাঝেমাঝে ছন্দপতনের মতো অবস্থা হয়। অথচ আমরা এখন তিন নম্বর ‘সংকট’ সামলাতে ব্যস্ত। এমনিতেই অর্থনৈতিকভাবে আমরা কাহিল অবস্থায় আছি বা ছিলাম। এটা শুরু হয় ২০১৯ সালে। অজানা এক অতিমারি ‘করোনা’ আমাদের সর্বনাশ করে দেয়। হাজার হাজার লোক মারা যায়। অর্থনীতি হয় ক্ষতিগ্রস্ত। ব্যবসা-বাণিজ্য হয় স্থবির। মানুষে-মানুষে সম্পর্ক পর্যন্ত স্থগিত হয়ে যায়। সবাই আতঙ্কে, গৃহবন্দি। বিশ্ব কম্পমান। কেউ বুঝতে পারছে না ‘অসুখটা’ কী। সরকারকে লক্ষাধিক কোটি টাকা দিয়ে, প্রণোদনা দিয়ে অর্থনীতিকে ধরে রাখার চেষ্টা করতে হয়। প্রায় ৬.৫০ শতাংশ অবিরাম ‘জিডিপি’ প্রবৃদ্ধির হার হঠাৎ নেমে আসে ৩-৪ শতাংশের কোঠায়। সব সূচক হয় নিম্নমুখী। মানুষ হয় বেকার। বহু লোক চাকরিচ্যুত হয়। আমাদের বাঁচিয়ে রাখে গরিব ও ‘অশিক্ষিত’ কৃষকরা। ভাতের অভাব হয়নি দুবছর করোনাকালে। ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করা হয়। দাঁড়াচ্ছিলামও। হঠাৎ না বলে, না কয়ে আসে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ। দ্বিতীয় বড় বিপদ। প্রথম বিপদ যতটা না ব্যাপক ছিল, দ্বিতীয়টি হয় আরও মারাত্মক। এক ধাক্কায় ডলারের দাম ৮৫-৮৬ টাকার স্থলে হয়ে যায় ১১৮-২০ টাকা। পণ্যের দাম দেড়গুণ-দ্বিগুণ হয়ে যায়। ঠিক যেমন হয়েছিল স্বাধীনতার পর ১৯৭২-৭৪ সালের দিকে। সারা বিশ্বে তেলের দাম বেড়ে যায়। বিপদ কাকে বলে! বাংলাদেশে সব জিনিসের দাম বেড়ে হয় দ্বিগুণ, তিনগুণ, চারগুণ। একটি শ্রেণির লোক তখন বলতে শুরু করে, বুঝহে স্বাধীনতা কাকে বলে। এটা হচ্ছে মুক্তিযুদ্ধের ফল। খারাপ কথায়-‘পাকিস্তান ভাঙার’ ফল। কী মারাত্মক অভিযোগ, যার পরিণতি ছিল ভয়াবহ।

এবারও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ আমাদের বড় বিপদে ফেলেছে। আমাদের সব অর্জন আজ মলিন হওয়ার পথে। ঋণ বাড়ছে, সুদের পরিমাণ বাড়ছে। দুর্নীতি বাড়ছে। অর্থ পাচার হচ্ছে। খেলাপি ঋণ বাড়ছে। ব্যাংক বিপন্ন হচ্ছে। শেয়ারবাজার নেই। আমদানি-রপ্তানি বিঘ্নিত। সমাজ ও অর্থনীতির রন্ধ্রে রন্ধ্রে সমস্যা। চাপা দেওয়া সমস্যা ধীরে ধীরে মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে। বেনজীর-মতিউরের ঘটনা মানুষকে স্তম্ভিত করেছে। এরই মধ্যে ঘটল কোটা সংস্কার বা বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন। রাস্তায় হাজার হাজার ছাত্রছাত্রী। তারা মেধার ভিত্তিতে চাকরি চায়-সরকারি চাকরি, যেখানে ভালো বেতন আছে, সুযোগ-সুবিধা আছে। এ আন্দোলনে বেসরকারি হিসাবে দুই শতাধিক লোক প্রাণ হারিয়েছে। বিপরীতে সরকারি স্থাপনায় ভাঙচুর হয়েছে। বিটিভি ভবনে হামলা হয়েছে। জেলখানা ভাঙা হয়েছে। ধ্বংসযজ্ঞ চারদিকে। করোনা, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের পর তিন নম্বর সংকটে পড়েছি আমরা। পারব কি উন্নয়নের ধারা অব্যাহত রাখতে, নাকি সব বিসর্জন দিতে হবে?

ড. আর এম দেবনাথ : অর্থনীতি বিশ্লেষক; সাবেক শিক্ষক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম