Logo
Logo
×

উপসম্পাদকীয়

শতফুল ফুটতে দাও

স্তম্ভিত হয়েই ভাবি

Icon

ড. মাহবুব উল্লাহ্

প্রকাশ: ০১ আগস্ট ২০২৪, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

স্তম্ভিত হয়েই ভাবি

শিক্ষার্থীদের কোটা সংস্কার আন্দোলনকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশের রাজনীতিতে যে মহাসংকট সৃষ্টি হয়েছে, তার মূলে রয়েছে জনগণের মধ্যে দীর্ঘদিনের পুঞ্জীভূত ক্ষোভ। এ কথাগুলো আমি বলেছি দৈনিক প্রথম আলোতে এক সাক্ষাৎকারে। আরও বলেছি, সরকার এ পুঞ্জীভূত ক্ষোভের বিস্ফোরণ কত ভয়াবহ এবং ব্যাপক হবে, তা বুঝতে সক্ষম হয়নি। তাই ক্ষোভের এ বিস্ফোরণকে বুলেট, টিয়ারগ্যাস ও সাউন্ড গ্রেনেডের বিস্ফোরণ দিয়ে দাবিয়ে দিতে চেয়েছে। আমাদের এ মুলুকের ইতিহাসে কখনই ঘটেনি এমন কায়দায় হেলিকপ্টার থেকে বিস্ফোরক বাণ নিক্ষেপ। সরকারের মুখপাত্র অস্বীকার করেছেন হেলিকপ্টার থেকে গুলি নিক্ষেপ করা হয়নি। তাই যদি সত্য হয় ঘরের ভেতরে থাকা নিষ্পাপ শিশুর মৃত্যু হবে কেন? এমন অনেক হৃদয়বিদারক ঘটনা কোটা সংস্কার আন্দোলনজাত অভ্যুত্থানের সময় ঘটে গিয়েছে। মায়ের বুক খালি হয়েছে, বোন ভাইকে হারিয়েছে, পিতা সন্তানকে হারিয়েছে। এত মৃত্যু এত কম সময়ের ব্যবধানে ১৯৭১-এর ভয়াল রাত ছাড়া আর কখনো এদেশে ঘটেনি। ১৯৬৯-এ গণঅভ্যুত্থান হয়েছিল। সেই অভ্যুত্থানে আমরা হারিয়েছি আমাদের অনেক ভাই-বোনদের। সেই অভ্যুত্থানের ২১ ফেব্রুয়ারি শহিদ দিবসে শহিদ মিনারের আশপাশে সাজানো হয়েছিল শিল্পীর তুলিতে আঁকা হৃদয় ছুঁয়ে যাওয়া অনেক ছবি। এ রকম একটি ছবিতে শহিদের লাশ কোলে তুলে নেওয়া অবস্থায় লেখা হয়েছিল, ‘এ লাশ আমরা রাখব কোথায়?’ প্রখ্যাত সাংবাদিক কবি সন্তোষ গুপ্ত দৈনিক সংবাদের পাতায় দুটি ছত্র উৎকীর্ণ করে দিয়েছিলেন। এ ছত্র দুটি ছিল, ‘মৃত্যুর জানাজা মোরা করিব না পাঠ/কবরের ঘুম ভাঙে জীবনের দাবি এতোই বিরাট।’ সেদিন জীবনের দাবির কথা বলা যেত, যদিও দেশের শাসকরা ছিল ঔপনিবেশিক শাসক। এবারের অভ্যুত্থানে দুই শতাধিক মানুষের মৃত্যু হয়েছে। এদের মধ্যে রয়েছে শিশু, কিশোর, যুবক প্রৌঢ়সহ সব বয়সের মানুষ। কারও কারও মতে মৃতের সংখ্যা আরও অনেক বেশি। জানা হিসাবের বাইরে রয়ে গেছে আরও অনেক অজানা মানুষ। আহত হয়েছেন সহস্রাধিক। যারা আহত হয়ে হাসপাতালে মৃত্যুর সঙ্গে লড়ে মৃত্যুবরণ করেছেন, এক দিক থেকে বলতে হয় তারা বেঁচে গেছেন। কিন্তু যারা চোখে গুলির আঘাতে আহত হয়ে দৃষ্টিশক্তি হারিয়েছেন, যাদের হাত-পা কেটে ফেলতে হয়েছে, তারা যদি বেঁচে থাকেন, তাদের জীবন হবে ঘোর বেদনাময়। এভাবে বেঁচে থাকার কষ্ট কি কোনো অর্থমূল্যে পরিশোধ করা সম্ভব?

শুরুতেই বলেছিলাম, অচিন্তনীয় এ গণবিস্ফোরণের মূলে রয়েছে মানুষের পুঞ্জীভূত ক্ষোভ। কোটা সংস্কারের মতো একটি নিরীহ আন্দোলন কী করে এমন গণবিস্ফোরণে পরিণত হলো, তার ঘটনাপঞ্জি দেশের মানুষের অজানা নয়। কাদের দাম্ভিকতা, কাদের উসকানি এবং কাদের ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ শান্তিপূর্ণ আন্দোলনটিকে আগ্নেয়গিরির বিস্ফোরণে পরিণত করল, তা নতুন করে ব্যাখ্যা করার দরকার নেই। এগুলো ছিল অভ্যুত্থানের আশু কারণ। এরও পেছনে ছিল অনেক অনিয়ম, অন্যায়, বৈষম্য, মানুষের মর্যাদা হরণ, ইনসাফের ব্যত্যয়, শোষণ, দুর্নীতি, জুলুম-নির্যাতন এবং সর্বোপরি অধিকার হরণ। পাকিস্তান আমলে আমরা শুনতাম অধিকারহারা মানুষকে কোনো শৃঙ্খল দিয়েই বেঁধে রাখা সম্ভব নয়। বাংলাদেশের মানুষ বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করে সেই অমোঘ সত্যের বাস্তবায়ন ঘটিয়েছে।

হ্যাঁ, এদেশে এখনো অনেক মানুষ আছেন, যারা মানতে চান না এবারের গণঅভ্যুত্থানে মানুষের পুঞ্জীভূত ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে। সম্প্রতি সরকারের কাঠামোতে অন্তর্ভুক্ত হওয়া একজন অতিকথনবাজ সাংবাদিক একটি টিভি চ্যানেলের সংবাদ পর্যালোচনামূলক অনুষ্ঠানে বিস্ময় প্রকাশ করে বলেছেন, ‘কোথায় পুঞ্জীভূত ক্ষোভের বিস্ফোরণ? এ আন্দোলনে কেউ কি এমন স্লোগান দিয়েছে, নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের দাম মানুষের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে চলে গেছে! এ রকম আরও কিছু কথা তিনি বলেছেন। বাংলাদেশের সাংবাদিক সমাজের মধ্যে তার অঙ্গভঙ্গি অনন্য। এভাবে যারা জাতীয় সমস্যা ও সংকট নিয়ে বিভ্রান্তির প্রচারণায় মত্ত হন, তাদের উপলব্ধির জন্য পুরোনো দিনের একটি কাহিনি তুলে ধরতে চাই। মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী ছিলেন অনলবর্ষী বক্তা। তার বক্তৃতায় ইতিহাস, উপাখ্যান, দর্শন, সাহিত্য ও ধর্ম স্থান পেত। পাকিস্তান আমলে বিভিন্ন জনসভায় জনতার ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ কত ভয়ংকর হতে পারে তা দৃষ্টান্ত দিতে গিয়ে তিনি ১৯৫৮ সালের ১৪ জুলাই ইরাক বিপ্লবের দৃষ্টান্ত দিতেন। ইরাকি সেনাবাহিনীর প্রধান ব্রিগেডিয়ার আব্দুল করিম কাসেমীর নেতৃত্বে যে সামরিক অভ্যুত্থান হয়, তাতে ইরাকের রাজা ফয়সল ও তার পরিবারের সব সদস্যকে রাজপ্রাসাদের সামনে দাঁড় করিয়ে টমি গানের ব্রাশফায়ারে হত্যা করে নির্মূল করা হয়। রাজা ফয়সলের প্রধানমন্ত্রী নূরী আস সাঈদ জনরোষ আঁচ করতে পেরে মহিলার ছদ্মবেশে বাগদাদ থেকে পালিয়ে যাচ্ছিলেন। জনগণ তাকে পাকড়াও করে ফেলে। তাকে ল্যাম্প পোস্টে ঝুলিয়ে দেওয়া হয়। তার শরীর থেকে চামড়া ছিলে নেওয়া হয়। বাগদাদের অনেক মানুষ তার রক্ত চেটে খেয়েছে। যখন বাগদাদের জনতা এ বিভৎস উন্মুক্ততায় মত্ত হয়েছিল, তখন কি তারা বলেছিল এক দুই তিন করে নূরী আস সাঈদ সাধারণ মানুষের ওপর কত ধরনের জুলুম করেছিল। মওলানা ভাসানী বিভিন্ন জনসভায় এ গল্পটি বলতেন শাসকগোষ্ঠীকে হুঁশিয়ার করে দেওয়ার জন্য। মানুষ জেগে উঠলে কত ভয়ানক প্রতিশোধ নিতে পারে! দুর্ভাগ্যের বিষয় হলো, দেশের হর্তাকর্তা, বিধাতাদের আশপাশে এমন কিছু মানুষ, এমন কিছু মোসাহেব ঠাঁই করে নেয়, যারা দেশের বাস্তব পরিস্থিতি তাদেরকে বুঝে উঠতে দেয় না। বরং ‘সাব কুচ ঠিক হ্যায়’ বলে সমস্যাগুলো আড়াল করে রাখে। শাসক বলি, সরকার বলি, তাদের সবচেয়ে বড় দুশমন এসব ব্যক্তি; দুঃখ, কষ্ট, অন্যায়, অবিচারে ক্ষুব্ধ জনগণ নয়।

১৯৬৯-এর গণঅভ্যুত্থানের সময় একপর্যায়ে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের গ্রামাঞ্চলে এক ব্যতিক্রমধর্মী ঘটনা ঘটতে শুরু করে। সেই সময় আন্দোলনের তোড়ে পুলিশ প্রশাসন নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়েছিল। গ্রামাঞ্চলে, বিশেষ করে জামালপুর ও চাঁদপুরের হাইমচরে কৃষকরা গরু চোরদের জবাই করা শুরু করে দিয়েছিল, সনাতন কৃষককে আমরা যারা জানি, তারা বুঝতে পারি কৃষকের কাছে তার হালের পশু মাতৃসম। কৃষকের জন্য এ চতুষ্পদ জন্তুটি এক অমূল্য সম্পদ। এগুলো চুরি করে যারা কৃষকের চাষাবাদকে বাধাগ্রস্ত করে, তাদের প্রতি কৃষকের থাকে প্রবল ঘৃণা ও ক্রোধ। সেই সময় ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকরা রাষ্ট্রীয় প্রশাসন ভেঙে পড়ার সুযোগে গরু চোরদের ওপর প্রতিশোধ নিতে শুরু করে। এ প্রতিশোধ নেওয়া ছিল খুবই ভয়াবহ। ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকের মন ও চোখ দিয়ে না দেখলে এই ভয়াবহ দৃশ্য সহ্য করা কঠিন। ছাত্রসংগ্রাম পরিষদের ১১ দফা কর্মসূচিতে কৃষকদের কিছু দাবিদাওয়া অন্তর্ভুক্ত থাকলেও গরু চুরির সমস্যা নিয়ে কিছুই ছিল না। কিন্তু ওর মধ্যেই ছিল কৃষকের পুঞ্জীভূত ক্ষোভ। উল্লিখিত মহাজ্ঞানী সাংবাদিক মহোদয় কি বুঝতে পারছেন অনুচ্চারিত অনেক ক্ষোভ সময় এলে বিস্ফোরণের আকার ধারণ করে? রাষ্ট্রক্ষমতা টেকসই করতে হলে এমন উপলব্ধি প্রয়োজন। মাও সেতুং হুনানের কৃষক বিদ্রোহ নিয়ে লিখতে গিয়ে একদল লোকের প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে লিখেছিলেন, তারা বলছিল কী ভয়ানক, কী মারাত্মক! আরেক দল লোক পেছন থেকে ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ ও টিপ্পনি কাটছিল। মাও সেতুংয়ের মতে যারা কৃষকের মিছিলের সামনে দাঁড়িয়ে উৎসাহ দিয়ে মিছিলটিকে এগিয়ে নিচ্ছিল, তারাই সঠিক ও সাহসের কাজ করছিল। ছোটবেলায় সাহিত্য পুস্তকের একটি প্রবন্ধে পড়েছিলাম, ‘ভাবের যখন জোয়ার আসে, খঞ্জগিরি লঙ্ঘন করে, মূকও বাচাল হয়।’ তেমনি একটি সমাজে বিশাল পরিবর্তনের সময় এলে মানুষ অসাধ্য সাধন করতে সক্ষম হয়।

কোটা সংস্কার আন্দোলনকে কেন্দ্র করে বেশকিছু রাষ্ট্রীয় সম্পদের ক্ষতি হয়েছে। এজন্য সরকার কোনোরকম তদন্ত না করেই বিরোধী দলের ওপর দোষ চাপাচ্ছে। এ যেন রবীন্দ্রনাথের সেই পুরোনো কথা, ‘যা কিছু হারায় গিন্নি বলেন কেষ্টা বেটাই চোর।’ ব্যাপারটা অনেকটা এই রকম। তবে সম্পদের ক্ষতি তো দুঃখজনক ও নিন্দনীয়ও বটে। এতদিনে এ ব্যাপারগুলো নিয়ে নানারকম তত্ত্ব সামনে আসছে। একটি মত অনুসারে মেট্রোরেল চালু হওয়ার ফলে যে বাস মালিকরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন, এটা তাদেরই কাজ। অন্যদিকে দুর্নীতিবাজরা দুর্নীতির নথিপত্র গুম করে দিতে সেতু ভবন ও স্বাস্থ্য ভবনে গান পাউডার দিয়ে অগ্নিসংযোগ করেছে। এমন কাজ ছাত্রদের পক্ষে সম্ভব নয়। তাই মনে রাখতে হবে কঠোর নিরপেক্ষতা এবং বস্তুনিষ্ঠতা নিয়ে এ দুর্ভাগ্যজনক ঘটনাগুলোর তদন্ত করতে হবে। এর ব্যত্যয় ঘটলে সমস্যা আরও জটিল হয়ে পড়বে।

কথা উঠেছে মানুষের জীবনের চেয়ে কিছু বস্তুগত সম্পদ বা স্থাপনার মূল্য কি বেশি? মানুষের জীবন অমূল্য। যে জীবন হারিয়ে যায়, তা আর ফিরে আসে না। কিন্তু বস্তুগত সম্পদ ক্ষতিগ্রস্ত হলে তা প্রতিস্থাপন বা মেরামত করা সম্ভব। সরকারনিয়ন্ত্রিত মিডিয়া এবং তার সঙ্গে সরকারের চাপে থাকা মিডিয়াগুলো এমন একটি বয়ান তুলে ধরেছে, যা থেকে মনে হয় মানুষের জীবনের চেয়ে সম্পদ যেন বেশি দামি। এ দৃষ্টিভঙ্গি অমানবিক। মানুষের জীবনের প্রতি যাদের শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা আছে, যারা মানুষের জীবনকে অমূল্য মনে করেন, তারা এমন বস্তুতান্ত্রিক হতে পারেন না।

একটি সমাজে যখন এ রক্তাক্ত জুলাইয়ের মতো ঘটনা ঘটে, তখন আমি একে নিম্নবর্গের ইতিহাসবিদ বা Subaltern history-র দৃষ্টিতে বিচার করতে চাই। বক্ষমান প্রবন্ধে তার সূত্রপাত করা গেল না। তবে কোনোদিন যদি মত প্রকাশের সুযোগ হয়, তাহলে সে রকম প্রয়াস গ্রহণ করব। নিম্নবর্গের ইতিহাস ও উত্তর-উপনিবেশ তত্ত্বের প্রথিতযশা অধ্যাপক, বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগো ইউনিভার্সিটির ইতিহাস বিভাগের লরেন্স এ কিম্পটন ডিস্টিংগুইশ্ড সার্ভিস প্রফেসর দীপেশ চক্রবর্তী বাংলাদেশের সাম্প্রতিক ঘটনাবলি নিয়ে লিখেছেন, ‘‘স্তম্ভিত হয়েই ভাবি, বস্তুত না ভেবে পারি না যে আজ ‘বাংলাদেশের হৃদয় হতে’ এক বিশাল আগ্নেয়গিরির মতো এত ক্ষোভের উদ্গিরণ কোথা থেকে, কিভাবে হলো? একটি গোটা দেশ ও জাতির এই যে মানসিক আঘাত বা ইংরেজিতে বললে ট্রমা-এর অভিঘাত কী হবে, আর এর ভবিষ্যৎটাই বা কী?’’

ড. মাহবুব উল্লাহ : শিক্ষাবিদ ও অর্থনীতিবিদ

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম