কথায় বলে, ‘ব্যক্তি কখনোই প্রতিষ্ঠানের চেয়ে বড় হতে পারে না’। কিন্তু কিছু কিছু মানুষ আছেন, যারা তাদের স্বীয় কর্মের দ্বারা নিজেদের অনন্য উচ্চতায় নিয়ে যান, যেখানে তাদের স্পর্শ করা সম্ভব হয় না। তারা কাজের মাধ্যমে প্রতিনিয়তই নিজেকে অতিক্রম করে যান। নুরুল ইসলাম ছিলেন তেমনই একজন মানুষ। গত ১৩ জুলাই ছিল দেশের খ্যাতিমান এই উদ্যোক্তার চতুর্থ মৃত্যুবার্ষিকী। করোনায় আক্রান্ত নুরুল ইসলাম বেশ কিছুদিন রাজধানীর একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন থাকা অবস্থায় ২০২০ সালের ১৩ জুলাই ইন্তেকাল করেন। তার ইন্তেকালে দেশ একজন বরেণ্য শিল্পোদ্যোক্তাকে হারিয়েছে।
নুরুল ইসলাম ১৯৪৬ সালের ৩ মে ঢাকা জেলার নবাবগঞ্জে এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবার নাম ছিল আমজাদ হোসেন এবং মায়ের নাম জোমিলা খাতুন। ছোটবেলা থেকেই নুরুল ইসলাম ছিলেন সৃজনশীল প্রতিভার অধিকারী। ১৯৭১ সালে মহান স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু হলে তিনি দেশমাতৃকার ডাকে সাড়া দিয়ে অস্ত্র হাতে তুলে নেন। মুক্তিযুদ্ধে নুরুল ইসলাম অত্যন্ত সাহসিকতার পরিচয় দেন। এ সময় তার বয়স ছিল ২৫ বছর। তিনি অত্যন্ত বীরত্বের সঙ্গে স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। স্বাধীনতার পর দেশে ফিরে এসে তিনি নিজের কর্মসংস্থান নিয়ে ভাবতে থাকেন। সেই সময় তরুণদের একাংশ পারমিটবাজি থেকে শুরু করে টেন্ডারবাজির মতো নানা অন্যায় কর্মে নিয়োজিত হয়, তখন নুরুল ইসলাম নিজেকে সযত্নে এসব থেকে দূরে সরিয়ে রাখেন। তিনি নিজেকে একজন উদ্যোক্তা হিসাবে গড়ে তোলার নিরন্তর প্রচেষ্টায় নিয়োজিত হন। স্বাধীনতার পর বাংলাদেশের মতো একটি বিধ্বস্ত জনপদে উদ্যোক্তা হওয়ার স্বপ্ন দেখা যে কতটা কঠিন ছিল, তা একমাত্র ভুক্তভোগীরাই বলতে পারবেন। কারণ বাংলাদেশে তখন উদ্যোক্তা সংস্কৃতি ছিল একেবারেই অচেনা। কিন্তু কিছু উদ্ভাবনী শক্তিসম্পন্ন মানুষ সবসময়ই নতুনত্বের প্রতি আগ্রহী থাকেন। নুরুল ইসলাম ছিলেন তেমনই একজন মানুষ, যিনি কোনো অবস্থাতেই থেমে থাকার পাত্র নন। তিনি স্বপ্ন দেখতে এবং দেখাতে ভালোবাসতেন। স্বাধীনচেতা নুরুল ইসলাম কারও অধীনতা মেনে নিতে প্রস্তুত ছিলেন না। তার ইচ্ছা ছিল কারও অধীনে চাকরি না করে নিজেই শিল্পপ্রতিষ্ঠান গড়ে তুলবেন এবং সেখানে মানুষের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করবেন। তিনি এলাকার দরিদ্র মানুষের আহাজারি দেখেছেন। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন, মানুষের উপযুক্ত কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা না করা গেলে টেকসই দারিদ্র্যবিমোচন কোনোভাবেই সম্ভব নয়।
নুরুল ইসলাম ১৯৭৪ সালে যমুনা গ্রুপ তৈরি করেন। সেই সময় কোনো শিল্পপ্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা যে কতটা সাহসী কাজ ছিল, তা এখন কল্পনাও করা যাবে না। স্বাধীন হওয়ার আগে বাংলাদেশ ছিল একটি কৃষিপ্রধান দেশ। দেশে যে সামান্য কিছু শিল্পপ্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছিল, সেসবের মালিক ছিলেন মূলত অবাঙালিরা। সদ্য স্বাধীন দেশের একজন তরুণের পক্ষে নিজেকে উদ্যোক্তা হিসাবে গড়ে তোলার চিন্তা করাটাও ছিল অনেকটাই দুঃসাহসের ব্যাপার। স্বাধীন বাংলাদেশে ব্যাংকিং ব্যবস্থাও সঠিকভাবে গড়ে ওঠেনি। চাইলেই একজন উদ্যোক্তা ব্যাংক থেকে ঋণ পেতেন না। তাই নুরুল ইসলামকে তার নিজস্ব পুঁজি নিয়েই এ দুঃসাহসিক কাজে অবতীর্ণ হতে হয়েছিল। এরপর তাকে আর কখনোই পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি। একের পর এক শিল্পপ্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছেন। প্রতিটি ক্ষেত্রেই তিনি সফল হয়েছে। বর্তমানে যমুনা গ্রুপের আওতায় মোট ৪১টি বিভিন্ন শিল্প-কারখানা ও অন্যান্য প্রতিষ্ঠান রয়েছে। এতে হাজার হাজার মানুষের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। সৃজনশীল ও উদ্ভাবনী শক্তির অধিকারী নুরুল ইসলাম যেখানেই হাত দিয়েছেন, সেখানেই সোনা ফলেছে। শীর্ষস্থানীয় জাতীয় দৈনিক যুগান্তর এবং জনপ্রিয় যমুনা টেলিভিশন তারই চিন্তার ফসল। দায়িত্বশীল সাংবাদিকতা এবং নিউজ প্রচারের ক্ষেত্রে এ দুটি মিডিয়ার সুনাম রয়েছে।
নুরুল ইসলাম ছিলেন অত্যন্ত সহজ-সরল প্রকৃতির একজন মানুষ। তিনি চাইলে প্রতিদিনই একাধিকবার টিভিতে তার নিউজ প্রচার করতে পারতেন; কিন্তু একান্ত প্রয়োজন না হলে তিনি কখনোই টিভি পর্দায় আসতেন না। যমুনা ফিউচার পার্ক নুরুল ইসলামের স্বপ্নের ফসল। দক্ষিণ এশিয়ার সবচেয়ে বড় ও আকর্ষণীয় এ শপিংমল সবারই দৃষ্টি আকর্ষণ করে। নুরুল ইসলামের একটি অসাধারণ গুণ ছিল। তিনি এতগুলো শিল্পপ্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছেন। বিশাল কর্মযজ্ঞ সমাপন করেছেন। পুঁজির প্রয়োজনে বিভিন্ন সময় ব্যাংক থেকে ঋণ গ্রহণ করেছেন; কিন্তু কখনোই ঋণখেলাপি হননি। তিনি যখন শিল্প প্রতিষ্ঠা শুরু করেন, তখনো আমাদের দেশে ব্যাংক ঋণ কালচার সেভাবে গড়ে ওঠেনি। ব্যাংকিং লেনদেনে আন্তরিকতার কারণেই তিনি কখনো ঋণখেলাপিতে পরিণত হননি। উদ্যোক্তা হিসাবে কার্যক্রম পরিচালনা করতে গিয়ে অনেক সময় তিনি নানা ধরনের মিথ্যা অপবাদের শিকার হয়েছেন, কিন্তু কখনোই ভেঙে পড়েনি। তিনি নিরলসভাবে তার দায়িত্ব পালন করে গেছেন।
তিনি একজন মিডিয়াবান্ধব মানুষ ছিলেন। তার মালিকানাধীন দৈনিক যুগান্তর ও যমুনা টেলিভিশন জনপ্রিয়তার দিক দিয়ে দেশের শীর্ষস্থানীয় দুটি গণমাধ্যম। এ বিপুল জনপ্রিয়তার প্রধান কারণ মালিক হলেও নুরুল ইসলাম পত্রিকা ও টেলিভিশনের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে তেমন কোনো হস্তক্ষেপ করতেন না। তিনি সাংবাদিকদের স্বাধীনভাবে কাজ করার সুযোগ দিয়েছিলেন।
নুরুল ইসলাম ছিলেন দেশের ফার্স্ট জেনারেশন ইন্ডাস্ট্রিয়ালিস্ট। তার মতো সামান্য কিছু উদ্যোক্তার হাত ধরেই বাংলাদেশের শিল্পভিত্তি মজবুত হয়েছে। বাংলাদেশকে কৃষিনির্ভর দেশ থেকে শিল্পনির্ভরতার দিকে নিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে যাদের অবদান কৃতজ্ঞতার সঙ্গে উচ্চারিত হয়, নুরুল ইসলাম তাদের অন্যতম। গুণিজনরা বলেন, কাউকে বাইরে থেকে দেখে অথবা অন্যের মুখে শুনে গুণাগুণ বিচার করা উচিত নয়। এজন্য সরাসরি সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির সঙ্গে মেশার দরকার আছে। একটি মহল নুরুল ইসলাম সম্পর্কে নানা ধরনের গুজব রটাতেন। তার সাফল্যে ঈর্ষান্বিত হয়েই তারা তার সম্পর্কে এসব রটাতেন।
আমি নুরুল ইসলাম সম্পর্কে মোটামুটি খোঁজখবর রাখতাম। আমার বাড়ি মানিকগঞ্জে এবং নুরুল ইসলামের বাড়ি নবাবগঞ্জে। অর্থাৎ আমরা কাছাকাছি এলাকার মানুষ। সেই হিসাবে তাকে আমাদের নিজেদের মানুষ বলেই ভাবতাম। কিন্তু তার সঙ্গে আমার সেভাবে মেলামেশা করার সুযোগ হয়নি। দূর থেকেই তার সম্পর্কে জেনেছি। তার সঙ্গে শুধু একবারই সরাসরি সাক্ষাৎ হয়েছিল। আমি লেখাসংক্রান্ত কাজে যমুনা ফিউচার পার্কসংলগ্ন যুগান্তর পত্রিকায় যাচ্ছিলাম। ভবনের নিচতলায় মসজিদের কাছে যাওয়ার পর এক ব্যক্তি ইশারায় আমাকে কাছে ডাকলেন। দেখেই চিনলাম তিনি যমুনা গ্রুপের চেয়ারম্যান নুরুল ইসলাম। আমি কিছুটা দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে পড়লাম। কারণ শুনেছিলাম, তিনি অত্যন্ত মেজাজি মানুষ, যে কোনো কারণে একজন মানুষের ওপর রেগে যেতে পারেন। আমি তার কাছে গেলাম। তিনি এতটাই সাধারণ পোশাকে ছিলেন যে, তাকে দেখে আমার মনেই হয়নি এত বড় একজন শিল্পোদ্যোক্তার সামনে আমি দাঁড়িয়ে আছি। তিনি আমার পরিচয় জানতে চাইলেন। আমি কোথায় এবং কার কাছে যাব, তা জানতে চাইলেন। কোথায় যাব বলার পর তিনি আমার কাছে পত্রিকার মান সম্পর্কে মতামত জানতে চাইলেন। আমি আমার মতামত তাকে জানালাম। তিনি আমাকে উদ্দিষ্ট ব্যক্তির কাছে যাওয়ার অনুমতি দিলেন।
সেদিনের পরিচয় এবং সামান্য আলোচনার পর নুরুল ইসলাম সম্পর্কে আমার ধারণা অনেক বদলে যায়। বাইরে থেকে তাকে যত কঠিনই মনে হোক না কেন, তিনি ছিলেন আসলে একজন নরম দিলের মানুষ। সেদিনে পর থেকে নুরুল ইসলামের ওপর আমার শ্রদ্ধাবোধ অনেক বেড়ে যায়। আল্লাহ এই মহান উদ্যোক্তাকে বেহেশত নসিব করুন, এ দোয়াই করছি।
বাংলাদেশের শিল্পায়নের ইতিহাসে নুরুল ইসলামের নাম স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে। আগামী প্রজন্ম তার অবদান স্মরণ করে নিজেদের উদ্যোক্তা হিসাবে গড়ে তোলার প্রেরণা পাবে।
এমএ খালেক : অবসরপ্রাপ্ত জেনারেল ম্যানেজার, বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক লিমিটেড; অর্থনীতিবিষয়ক লেখক