Logo
Logo
×

উপসম্পাদকীয়

শতফুল ফুটতে দাও

রেমিট্যান্সের ইনফ্লো ও আউটফ্লো

Icon

ড. মাহবুব উল্লাহ্

প্রকাশ: ১১ জুলাই ২০২৪, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

রেমিট্যান্সের ইনফ্লো ও আউটফ্লো

গত ২৯ জুন দৈনিক যুগান্তর বাংলাদেশে রেমিট্যান্স প্রেরণ এবং বাংলাদেশ থেকে রেমিট্যান্স প্রেরণের তুলনামূলক চিত্র নিয়ে একটি চাঞ্চল্যকর প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। এ প্রতিবেদনের শিরোনাম ছিল, ‘রেমিট্যান্সের চেয়ে বিদেশিদের বেতনভাতা তিনগুণ’। গত কিছুদিন ধরে ডলার সংকটের পরিপ্রেক্ষিতে একটি আলোচনা জোরদার হয়ে উঠেছে। এটি হলো বাংলাদেশের কর্মজীবীরা বিদেশে কাজ করে তাদের আয় থেকে কী পরিমাণ ডলার দেশে রেমিট্যান্স হিসাবে পাঠায়। এর পাশাপাশি আলোচনায় উঠে আসে বিদেশি কর্মী ও কর্মকর্তারা বাংলাদেশে কাজ করে কী পরিমাণ ডলার তাদের নিজ নিজ দেশে রেমিট্যান্স হিসাবে পাঠায়। এ দুয়ের হিসাব দিয়েই নির্ধারিত হয় রেমিট্যান্স বাবদ নিট কত ডলার বাংলাদেশ আয় করতে পারছে। বিষয়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আমরা কথায় কথায় বলি, আমাদের দেশের মেহনতি মানুষ ও অন্যান্য কর্মী বিদেশে কাজ করে যে রেমিট্যান্স দেশে পাঠায়, তা আমাদের অর্থনীতির চাকা সচল রাখতে বিশাল ভূমিকা পালন করে। কিন্তু এতে খুব উৎফুল্ল হওয়ার সুযোগ নেই। দেখতে হবে অন্যান্য দেশের কর্মী ও কর্মকর্তারা বাংলাদেশে এসে চাকরি করার সুবাদে কী পরিমাণ ডলার নিজ নিজ দেশে বাংলাদেশ থেকে পাঠায়। বাংলাদেশে কর্মরত বিদেশি কর্মীদের মধ্যে ভারতীয় কর্মীর সংখ্যাই সর্বাধিক।

২০১৫ সালের সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) তথ্যমতে, বাংলাদেশ ছিল ভারতের প্রবাসী আয়ের তৃতীয় উৎস। টিআইবির তথ্যমতে, প্রতিবছর ৩ বিলিয়ন ডলারের বেশি অবৈধভাবে দেশের বাইরে পাঠাচ্ছেন বিদেশিরা। বাংলাদেশে এনজিও, আইটি এবং গার্মেন্টসহ প্রায় ৩২টি ক্ষেত্রে চাকরি করছেন বিদেশিরা। পোশাকশিল্প মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ-এর এক কর্মকর্তা বলেন, আমাদের দেশে ভারত ও শ্রীলংকানদের চাহিদা প্রচুর। বিভিন্ন কারণে এ চাহিদা তৈরি হয়েছে। সেটা হতে পারে পেশাগত কর্মক্ষমতা ও অভিজ্ঞতার কারণে। তারা আমাদের দেশীয় কর্মকর্তাদের তুলনায় বেশি বেতনভাতা পায় তাদের কর্মক্ষমতা ও অভিজ্ঞতার কারণেই। টিআইবির তথ্যমতে, বিভিন্ন এনজিওতে কর্মরত বিদেশি নাগরিকরা প্রতিবছর বাংলাদেশ থেকে ২৬ হাজার কোটি টাকা নিয়ে যাচ্ছেন।

অন্য একটি গবেষণা বলছে, বাংলাদেশে কমপক্ষে ৫ লাখ বিদেশি কর্মরত রয়েছেন। এ পরিমাণ জনশক্তি প্রতিবছর ৫ বিলিয়ন ডলারের বেশি অর্থ নিয়ে যাচ্ছেন তাদের নিজ দেশে, যা থেকে খুব অল্প পরিমাণ রাজস্ব পাচ্ছে সরকার। অথচ এসব বিদেশির আয়ের ৩০ শতাংশ কর নির্ধারণ করে দিয়েছে সরকার। কেননা বাংলাদেশে অবস্থিত বিদেশি নাগরিকরা তাদের প্রকৃত বেতনভাতা গোপন করছেন। এ ক্ষেত্রে তাদের সহযোগিতা করছেন এদেশের নিয়োগকারী সংস্থা। এ কারণে এনজিওতে কর্মরত বিদেশি নাগরিকদের সত্যিকারের বেতনের চিত্র উঠে আসে না। ফলে রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হচ্ছে সরকার।

যুগান্তরের প্রতিবেদন অনুযায়ী, প্রবাসীদের দেশে পাঠানো রেমিট্যান্স প্রবাহের তিনগুণের বেশি অর্থ বৈদেশিক মুদ্রায় বাংলাদেশ থেকে বেতনভাতা বাবদ নিয়ে গেছেন বিদেশি কর্মীরা। ২০০০ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত ২৪ বছরে প্রবাসীদের রেমিট্যান্স প্রবাহ বেড়েছে সোয়া ১১ গুণ। একই সময়ে বাংলাদেশে কর্মরত বিদেশি কর্মীদের বেতন-ভাতা নিজ দেশে বৈদেশিক মুদ্রায় নেওয়ার হার বেড়েছে ৩৭ গুণ। অর্থাৎ বাংলাদেশে বিদেশ থেকে আসা রেমিট্যান্স Inflow যে হারে বেড়েছে, তার তুলনায় বহুগুণ হারে বেড়েছে বাংলাদেশ থেকে রেমিট্যান্স outflow ।এর ফলে বৈদেশিক মুদ্রার ওপর চাপ বাড়ছে। শুধু ২০২৩ সালেই বিদেশি কর্মীরা বাংলাদেশ থেকে বেতনভাতা বাবদ বৈদেশিক মুদ্রায় নিয়েছেন ১৫ কোটি ডলার, ওই সময়ে ডলারের দাম অনুযায়ী ১৬৫০ কোটি টাকা। বৈধভাবে নেওয়ার চেয়ে আরও বেশি অর্থ নেওয়া হচ্ছে হুন্ডির মাধ্যমে। এর মাধ্যমে দেশ থেকে টাকা পাচারের নজিরও রয়েছে। অতি সাম্প্রতি প্রকাশিত বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদনে বিভিন্ন দেশ থেকে রেমিট্যান্স পাঠানো ও রেমিট্যান্স আসার চিত্র তুলে ধরা হয়।

সরকারের সুরক্ষা সেবা বিভাগ ও পুলিশের স্পেশাল ব্রাঞ্চের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২৩ সাল পর্যন্ত দেশে অবস্থানরত বৈধ বিদেশি নাগরিকের সংখ্যা ছিল ১ লাখ ৭ হাজার ১৬৭। এর মধ্যে ভারতীয় নাগরিকরাই বেশি, দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে চীনের নাগরিক। ভারতীয় ৩৭ হাজার ৪৬৪ এবং চীনের ১১ হাজার ৪০৪ জন। বাকিরা অন্যান্য দেশের। তাদের বেশির ভাগই বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে কর্মী হিসাবে নিয়োজিত। এর বাইরে অবৈধভাবে আরও অনেক বিদেশি আছেন, যাদের হিসাব এর মধ্যে নেই।

নির্ভরযোগ্য অনুমান হলো, বাংলাদেশে ৫ লাখ বিদেশি নাগরিক কর্মরত আছেন। অর্থাৎ বৈধভাবে থাকা বিদেশি নাগরিকদের তুলনায় বৈধ ও অবৈধ হিসাবে থাকা বিদেশি নাগরিকের সংখ্যা প্রায় ৫ গুণ।

বাংলাদেশের যে বিপুলসংখ্যক বৈদেশিক কর্মী অবৈধভাবে অবস্থান করে চাকরি করছে, তারা দেশের নিরাপত্তার জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়াচ্ছে কি না, তা অবশ্যই ভেবে দেখতে হবে। এদের অনেকে অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড, যেমন: মানব পাচার ও মাদক আমদানির সঙ্গে জড়িত থাকতে পারে। এমনকি এদের অনেকে অন্তর্ঘাতমূলক তৎপরতার সঙ্গে জড়িয়ে পড়তে পারে। এভাবে বিবেচনা করলে দেখা যায়, অবৈধভাবে অবস্থানকারী বিদেশি নাগরিকরা বাংলাদেশের জন্য নিরাপত্তার ঝুঁকি তৈরি করছে।

বাংলাদেশে প্রতিবছর কমপক্ষে ২০ লাখ মানুষ শ্রমের বাজারে প্রবেশ করে। কিন্তু এদের বেশির ভাগই বেকার। এর পাশাপাশি আমরা যখন দেখি ৫ লাখ বিদেশি নাগরিক বৈধ ও অবৈধভাবে এদেশে কাজ করছে, তাতে বোঝা যায়, বিদেশিরা বাংলাদেশিদের প্রতিদ্বন্দ্বী হিসাবে শ্রমবাজারে অবস্থান করছে। যেসব বাংলাদেশি নতুন করে প্রতিবছর শ্রমবাজারে প্রবেশ করে, তাদের একটি বিরাট অংশ শিক্ষিত বেকার। কেন তারা চাকরি পাচ্ছে না, এর একটি বড় কারণ হতে পারে তাদের অর্জিত জ্ঞান বা দক্ষতা শ্রমবাজারের চাহিদার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। বিশেষ করে তাদের ইংরেজি ভাষায় কথা বলা ও লেখার দক্ষতা খুবই নিম্নমানের। পোশাকশিল্পের মতো রপ্তানিমুখী শিল্পে যে ধরনের বড়, মাঝারি ও নিম্নস্তরের ব্যবস্থাপক প্রয়োজন হয়, তাদের জন্য ইংরেজি ভাষার দক্ষতা খুবই জরুরি। এদিক থেকে বাংলাদেশি নাগরিকদের মধ্যে ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের কর্মী ও বিভিন্ন স্তরের ব্যবস্থাপক পদে নিয়োগপ্রার্থীরা নিয়োগের জন্য নিয়োগকর্তাদের কাছে অনুপযুক্ত বলে বিবেচিত হন। বাংলাদেশে শিক্ষাব্যবস্থার মান ক্রমাগতভাবে নিম্নগামী। এ অবস্থায় শিক্ষার মানবৃদ্ধি করা এবং বাজারের চাহিদা অনুযায়ী দক্ষ মানবসম্পদ সৃষ্টি করাই উচিত শিক্ষার লক্ষণ। অত্যন্ত দ্রুততার সঙ্গে সময় উপযোগী পদক্ষেপ গ্রহণ না করলে দেশে নানামুখী বিপর্যয় দেখা দেবে।

আইন অনুযায়ী, বাংলাদেশে অবস্থান করে কাজ করলে আয়কর প্রদান ও ওয়ার্ক পারমিট নেওয়া বাধ্যতামূলক। দেশে কাজ করতে হলে বিদেশিদের এ-থ্রি ভিসা নেতে হয়। ২০০৬ সালে প্রণীত ভিসা নীতিমালা সংশোধন করে প্রকল্পে কাজ করলে এ-থ্রি ভিসা নেওয়ার বিধানটি তুলে দেওয়া হয়। ফলে ওই সময়ের পর থেকে এ-থ্রি ভিসা ছাড়াই বিদেশি কর্মীরা কাজ করতে পারছেন। এতে দেশে আসা বিদেশিদের কাজের ধরন সম্পর্কে প্রকৃত তথ্য সরকারের কোনো সংস্থার কাছে নেই। তবে কিছুটা আশ্বস্ত হওয়ার বিষয় হলো, বাংলাদেশে অবস্থানরত বিদেশিদের একটি তথ্যভান্ডার গড়ে তোলার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এসব তথ্য জানা গেছে যুগান্তরের প্রতিবেদন থেকে।

বৈধ বিদেশি কর্মীরা যেমন বাংলাদেশ থেকে বৈধ ও অবৈধ পথে রেমিট্যান্স পাঠাচ্ছেন, তেমনই অবৈধ কর্মীরা হুন্ডির মাধ্যমেও রেমিট্যান্স পাঠাচ্ছেন। ২০০৭ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে টস্কফোর্সের এক তদন্তে বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের কর্মীদের উচ্চতর বেতনভাতা দেওয়ার নামে দেশ থেকে টাকা পাচারের ঘটনা ধরা পড়েছে। এমন ঘটনাও ধরা পড়েছে, বিদেশি কর্মী নেই, অথচ তার নামে বিদেশে বেতন-ভাতা পাঠানো হচ্ছে ব্যাংকিং চ্যানেলে। বোঝা গেল, ব্যাংকিং চ্যানেল ব্যবহার করলেও তা বৈধ নাও হতে পারে। দেশ থেকে কী দারুণ বুদ্ধিমত্তা ব্যবহার করে অর্থ পাচার করা হয়, তা এই আলোচনা থেকে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।

অতি সম্প্রতি প্রকাশিত বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদনে বিভিন্ন দেশ থেকে রেমিট্যান্স পাঠানো ও রেমিট্যান্স আসার চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। এতে দেখা যায়, ২০০০ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত ২৪ বছরে বাংলাদেশ থেকে বিদেশি কর্মীদের বেতনভাতা পাঠানোর প্রবণতা বেড়েছে ৩৭.২৬ গুণ। একই সময়ে বিদেশ থেকে প্রবাসীদের বাংলাদেশে রেমিট্যান্স পাঠানোর প্রবণতা বেড়েছে ১১.২৬ গুণ। আলোচ্য সময়ে দেশে আসা রেমিট্যান্সে ৩ গুণের বেশি বেড়েছে বিদেশি কর্মীদের বেতনভাতা বাবদ বৈদেশিক মুদ্রা নেওয়ার প্রবণতা। বছরভিত্তিক হিসাবেও দেখা যাচ্ছে, রেমিট্যান্সের চেয়ে বেশি বাড়ছে বিদেশি কর্মীদের বেতনভাতা নেওয়ার পরিমাণ। বাংলাদেশে এখন বড় বড় অবকাঠামো প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। এর সুবাদে বিদেশি নাগরিকদের বাংলাদেশে এসে কাজ করার সুযোগও বাড়ছে। বর্তমানে বিদেশি কর্মীরা যে বেতনভাতা পান, এর ৭৫ শতাংশ তারা নিজ দেশে বা অন্য কোনো দেশে বৈদেশিক মুদ্রায় পাঠাতে পারেন। মোদ্দা কথা, বাংলাদেশ থেকে বিদেশি নাগরিকদের রেমিট্যান্স নিজ দেশে বা অন্য দেশে পাঠানোর প্রবণতা যদি অব্যাহত থাকে, তাহলে দেখা যাবে বাংলাদেশের নিট রেমিট্যান্স আয় ঋণাত্মক হয়ে পড়ছে।

ড. মাহবুব উল্লাহ : শিক্ষাবিদ ও অর্থনীতিবিদ

Jamuna Electronics
wholesaleclub

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম