Logo
Logo
×

উপসম্পাদকীয়

সীমাবদ্ধ আইনের সুফল পাচ্ছে দুর্নীতিবাজরা

Icon

মো. ফিরোজ মিয়া

প্রকাশ: ০৫ জুলাই ২০২৪, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

সীমাবদ্ধ আইনের সুফল পাচ্ছে দুর্নীতিবাজরা

কর্মচারীরা দুর্নীতি করে ক্ষমতার অপব্যবহার করে। ঘুস, তহবিল তছরুপ, আত্মসাৎ, পক্ষপাতিত্ব, স্বজনপ্রীতি এবং অন্যান্য অনৈতিক কার্যক্রম দ্বারা কর্মচারীরা দুর্নীতি করে। তাদের এ দুর্নীতি প্রশাসনের প্রতি জনগণের আস্থা বিনষ্ট করে, সরকার এবং সরকারি প্রতিষ্ঠানের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করে। এছাড়া দুর্নীতি সর্বদাই সুশাসন ও গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে ব্যাহত করে। দুর্নীতিবিরোধী কঠোর আইনি ও প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতার দ্বারাই কেবল সরকারি কার্যক্রমে স্বচ্ছতা, জবাবদিহি ও ন্যায্যতা নিশ্চিত করে জনআস্থা প্রতিষ্ঠা করা যায়; কিন্তু প্রশ্ন হলো, দুর্নীতিবিরোধী আইনি ও প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা বৃদ্ধি না করে, বরং তা আরও শিথিল ও নমনীয় করে দুর্নীতিকে লাগামহীনভাবে চলতে দেওয়ার দায় কার?

স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি দুর্নীতি দমনের উপায় ও কৌশলের মধ্যে অন্যতম হলেও প্রাথমিক ও প্রধানতম উপায় ও কৌশল হলো কঠোর আইনি ও প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্যি, দুর্নীতি দমনের জন্য বাংলাদেশের আইনি ও প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো অত্যন্ত নমনীয় ও শিথিল।

পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের কর্মচারী আচরণবিধি অনুযায়ী, প্রতিবছর সম্পদের হিসাব দাখিল বাধ্যতামূলক এবং তা নজরদারির জন্য নির্ধারিত কর্মকর্তাও রয়েছে। এছাড়া স্থাবর সম্পত্তি অর্জনের ক্ষেত্রে পূর্বানুমোদন এবং অস্থাবর সম্পত্তি অর্জনের বিষয়টি কর্তৃপক্ষকে অবহিত করারও কঠোর বিধান রয়েছে। অথচ বাংলাদেশে প্রতি পাঁচ বছর অন্তর সম্পদের হিসাব দাখিলের শিথিল বিধান থাকলেও এখতিয়ারাধীন এলাকার বাইরে স্থাবর সম্পত্তি অর্জনের ক্ষেত্রে পূর্বানুমোদনের এবং অস্থাবর সম্পত্তি অর্জনের বিষয়টি কর্তৃপক্ষকে অবহিত করার কোনো বিধান নেই। নজরদারির জন্য কোনো কর্মকর্তাও নির্ধারণ করা নেই। দুটি আচরণবিধি পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে, ভারতের সরকারি কর্মচারীদের আচরণবিধির তুলনায় বাংলাদেশের সরকারি কর্মচারীদের আচরণবিধি কতটা শিথিল ও নমনীয়। সংবাদ মাধ্যমে জানা যায়, ইদানীং এ শিথিল ও নমনীয় আচরণবিধি আরও শিথিল করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, যা শুধু হতাশাজনকই নয়, দুঃখজনকও।

ভারতীয় শৃঙ্খলাবিধিতে ঘুস গ্রহণের তথা দুর্নীতির শাস্তি চাকরি থেকে অপসারণ বা চাকরি থেকে বরখাস্ত। অর্থাৎ ভারতে ঘুস গ্রহণ বা দুর্নীতির অপরাধে অভিযুক্ত কর্মচারীকে চাকরিতে বহাল রাখার বা অবসর ভাতাদি প্রদানের কোনো সুযোগ নেই। অথচ দুঃখজনক হলেও সত্যি, ২০১৮ সালের সরকারি চাকরি আইনের বিধান অনুযায়ী, ঘুস-দুর্নীতিসহ নৈতিকস্খলনজনিত অপরাধের জন্য কোনো কর্মচারীর এক বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড বা সীমাহীন জরিমানায় দণ্ডিত করা গেলেও তাকে চাকরিচ্যুত করা যাবে না। তাকে চাকরিতে বহাল রাখতে হবে এবং কেবল ‘তিরস্কার’ দণ্ড বা অন্য কোনো লঘুদণ্ড প্রদান করা যাবে। অর্থাৎ এক বছর কারাদণ্ড ভোগ করে দুর্নীতিবাজ ওই কর্মচারী স্বপদে বহাল হবেন, চাকরি করে যাবেন এবং অবসরের পর অবসর ভাতাদিও পাবেন। এছাড়া দুর্নীতির দায়ে এক বছরের অধিক অর্থাৎ সর্বোচ্চ কারাদণ্ডে দণ্ডিত কর্মচারীরও রাষ্ট্রপতির বিবেচনায় চাকরিতে পুনর্বহালের আইনি সুযোগ রয়েছে। দুর্নীতির দায়ে জেলখাটা দুর্নীতিবাজ সরকারি কর্মচারীর কাছ থেকেই জনগণকে সেবা নিতে হবে, এটা কি জনগণের সঙ্গে পরিহাস নয়? দুর্নীতিবাজ ওই কর্মচারী যে আবারও দুর্নীতিতে জড়াবে না, মামলার কারণে যে অর্থ খুয়েছে, তা পূরণে আরও বেপরোয়া হবে না, এর নিশ্চয়তা কে দেবে? দুর্নীতির অপরাধে এক বছর কারাদণ্ড ভোগকারী কর্মচারীকে চাকরিতে বহাল রাখার মতো আইনি বিধান বিশ্বের কোন কোন দেশে আছে, তা আইনটি প্রণয়নের সঙ্গে সংশ্লিষ্টরাই কেবল বলতে পারবেন। এছাড়া দুর্নীতিসহায়ক এ আইনটির দ্বারা বাতিল করা হয়েছে ‘ডিসমিসাল অন কনভিকশন অধ্যাদেশ’। বাতিলকৃত অধ্যাদেশ অনুযায়ী, ঘুস-দুর্নীতি বা নৈতিকস্খলনজনিত অপরাধে কোনো কর্মচারী যে কোনো মেয়াদেরই কারাদণ্ডে বা যে কোনো পরিমাণ জরিমানা দণ্ডে দণ্ডিত হোক না কেন, তাৎক্ষণিকভাবে চাকরিচ্যুত হতো। অর্থাৎ দণ্ডিত উক্ত কর্মচারীকে চাকরিতে বহাল রাখার বা অবসর ভাতাদি দেওয়ার আইনি সুযোগ ছিল না। দুর্নীতিবিরোধী এ কঠোর অধ্যাদেশটি বাতিল করে কোন কারণে এবং কোন যুক্তিতে দুর্নীতিসহায়ক সরকারি চাকরি আইন প্রণয়ন করা হলো, জনমনের এ প্রশ্নের জবাব কেবল আইন প্রণেতারাই দিতে পারবেন।

বাংলাদেশের আচরণ ও শৃঙ্খলা বিধিতে ঘুস/উৎকোচ শব্দটিই ব্যবহার করা হয়নি। যার কারণে ঘুস/উৎকোচ অপরাধের জন্য শৃঙ্খলাবিধি অনুযায়ী অসদাচরণের অভিযোগে বিভাগীয় মামলা করতে হয় এবং এ অপরাধে ‘তিরস্কার’ দণ্ড প্রদানেও কোনো বাধা নেই।

১৯৮৫ সালের শৃঙ্খলাবিধিতে দুর্নীতিপরায়ণতার সর্বনিম্ন শাস্তি ছিল ‘চাকরি হতে বাধ্যতামূলক অবসর’। অর্থাৎ দুর্নীতিপরায়ণ কোনো কর্মচারী চাকরিতে বহাল থাকতে পারত না। এ বিধিটি বাতিল করে ২০১৮ সালে যে শৃঙ্খলাবিধি করা হয়েছে, তাতে দুর্নীতিপরায়ণতার সর্বনিম্ন শাস্তির বিধান করা হয়েছে ‘তিরস্কার’। এমনকি অবাক করার মতো বিষয় হলো, এ বিধিতে একাধিকবার দুর্নীতিপরায়ণতার অভিযোগের ক্ষেত্রেও সর্বনিম্ন ‘তিরস্কার’ দণ্ড প্রদানের একই বিধান রাখা হয়েছে। এখন প্রশ্ন হলো, দুর্নীতিপরায়ণতার শাস্তি যদি ‘তিরস্কার’ হয়, তাহলে কর্মচারীরা দুর্নীতি বন্ধে কি আদৌ আগ্রহী হবেন এবং এরূপ দণ্ডের বিধান কি সুশাসন প্রতিষ্ঠায় সহায়ক?

দুর্নীতি প্রতিরোধের উদ্দেশ্যে ১৮৬০ সালের দণ্ডবিধির ১৬১ থেকে ১৬৫এ ধারার দণ্ডের বিধানসমূহ দুদক আইনে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে; যা বর্তমান প্রেক্ষাপটে অত্যন্ত নমনীয় এবং এ ধারাসমূহে অতিপ্রচলিত ‘ব্রাইব’ অর্থাৎ ঘুস/উৎকোচের উল্লেখ নেই, আছে ‘গ্র্যাটিফিকেশন’ অর্থাৎ সন্তোষ বিধান/বাসনা পূরণের উল্লেখ। এছাড়া শাস্তির বিধানও অতি নমনীয় অর্থাৎ সর্বোচ্চ তিন বছর। অথচ ভারত দণ্ডবিধির এ নমনীয় ধারাগুলো বাতিল করে তার পরিবর্তে ১৯৮৮ সালের প্রিভেনশন অফ করাপশন অ্যাক্টে কঠোর শাস্তির বিধান করেছে। ভারতের দুর্নীতিবিরোধী উক্ত আইনে ‘ব্রাইব’ তথা ঘুস বা উৎকোচ শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে এবং শাস্তির মেয়াদ সর্বনিম্ন তিন বছর এবং সর্বোচ্চ সাত বছর রাখা হয়েছে। ভারতীয় উক্ত আইনে জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের জন্য ন্যূনতম শাস্তির বিধান চার বছর থাকলেও দুদক আইনে আছে তিন বছর। এছাড়া ভারতীয় আইনে জরিমানা আরোপের ক্ষেত্রে দুর্নীতির মাধ্যমে আহরিত সম্পদের পরিমাণের বিষয়টি বিবেচনার উল্লেখ আছে, রয়েছে দুর্নীতির জন্য সংক্ষিপ্ত বিচারেরও সুযোগ, যা দুদক আইনে নেই।

চীন, ইন্দোনেশিয়া, মরক্কো, থাইল্যান্ড, ভিয়েতনামসহ অনেক দেশেই দুর্নীতির জন্য মৃত্যুদণ্ডের বিধান আছে। এছাড়া অনেক দেশে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডেরও বিধান আছে। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, সিঙ্গাপুর, ভারতসহ প্রায় সব দেশেই দুর্নীতির জন্য বাংলাদেশের চেয়ে অধিকতর কঠোর দণ্ডের বিধান রয়েছে। দুর্নীতির জন্য বাংলাদেশে দণ্ডের বিধান অত্যন্ত নমনীয় ও শিথিল, যা দুর্নীতি দমনের ক্ষেত্রে অন্তরায়। নিশ্চয়ই এটি দুদকের অজানা থাকার কথা নয়। সরকারকে এ ব্যাপারে পরামর্শ দেওয়া দুদকের দায়িত্বের আওতাভুক্ত নয় কি? আদুরে চাপড় মেরে যেমন বিড়ালের দুধ খাওয়া বন্ধ করা যায় না, তেমনি নমনীয় দণ্ডের বিধান দিয়েও দুর্নীতি বন্ধ করা যায় না। আগ্রাসী দুর্নীতির থাবা থেকে রক্ষার জন্য প্রয়োজন কঠোর দণ্ডের বিধানসংবলিত আইনি কাঠামো এবং এর যথাযথ প্রয়োগ। আইন প্রণেতারা যেহেতু আইন প্রণয়ন করেন এবং বিধিবিধান যেহেতু নীতিনির্ধারকদের অনুমোদনক্রমে প্রণীত হয়, সেহেতু দুর্নীতি প্রতিরোধের জন্য রাজনীতিবিদদেরই অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে হবে।

মো. ফিরোজ মিয়া : অবসরপ্রাপ্ত অতিরিক্ত সচিব, চাকরি ও আইন সংক্রান্ত গ্রন্থের লেখক

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম