Logo
Logo
×

উপসম্পাদকীয়

বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা কি ‘টেস্ট কেস’?

Icon

আবুল কাশেম উজ্জ্বল

প্রকাশ: ০৪ জুলাই ২০২৪, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা কি ‘টেস্ট কেস’?

পেনশন হচ্ছে সামাজিক নিরাপত্তার অন্যতম মাধ্যম, যা পৃথিবীর অনেক দেশেই বিদ্যমান। বাংলাদেশে সরকারি চাকরি করার প্রতি মানুষের আগ্রহ থাকার অন্যতম কারণ হচ্ছে পেনশন। অবসর জীবনে অন্তত আর্থিক অনিশ্চয়তা থেকে মুক্ত থাকতে অনেকেই সরকারি চাকরিতে আগ্রহী হন। একটা সময় ছিল, কেবল পেনশন গ্রহীতাই পেনশন পেতেন। এখন তার মৃত্যুতে স্ত্রীও পেনশন পেয়ে থাকেন। এমনকি নতুন পে-স্কেল বা মুদ্রাস্ফীতির সঙ্গে বেতনের পরিবর্তনের সঙ্গে পেনশনের অর্থের পরিমাণ বৃদ্ধির সুযোগ থাকায় মানুষের মধ্যে এটি নিয়ে আগ্রহ অনেক। এর আওতায় সরকারি, আধা-সরকারি, স্বায়ত্তশাষিত ও সামরিক বাহিনী থেকে অবসর নেওয়া সবারই একই নিয়মে পেনশন পাওয়ার বিধান ছিল এবং এখানে বৈষম্য হওয়ার কোনো সুযোগ ছিল না।

অনেক বছর ধরে দেশের শিক্ষকসমাজ আশায় ছিলেন, বর্তমান সরকার শিক্ষকদের জন্য পৃথক বেতন কাঠামোর ব্যবস্থা করবে। সরকারের পক্ষ থেকে এমন কোনো আশা এখনো পাওয়া যায়নি, বরং গত ১৩ মার্চ অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগের জারি করা এক প্রজ্ঞাপনে স্বায়ত্তশাসিত বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের জীবনকে আরও দুর্বিষহ করে দেওয়া হয়েছে। প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, চলতি বছরের ১ জুলাইয়ের পর থেকে স্বশাসিত, স্বায়ত্তশাসিত এবং রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থার চাকরিতে যারা নতুন যোগ দেবেন, তারা বিদ্যমান ব্যবস্থার মতো আর অবসরোত্তর পেনশন-সুবিধা পাবেন না। তার পরিবর্তে নতুনদের বাধ্যতামূলক সর্বজনীন পেনশনের আওতাভুক্ত করা হবে।

এখানে অনেক প্রশ্ন আছে, যার উত্তর শিক্ষকদের অজানা এবং এর ফলে শঙ্কা আরও বাড়ছে। প্রথমেই বলা যায়, সর্বজনীন কথার অর্থ হচ্ছে সবার জন্য কল্যাণকর। যদি তাই হয়, তাহলে যারা এ স্কিমের উদ্যোক্তা ও এর এত প্রশংসা করছেন, তারা কেন কেবল নির্দিষ্ট কিছু প্রতিষ্ঠানের জন্য এ নিয়ম চালু করলেন? নামের অর্থে প্রজাতন্ত্রের সব কর্মচারী এর আওতাভুক্ত হওয়ার কথা। নিশ্চয় এটা এমন কিছু, যা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের ওপর পরীক্ষা করা হচ্ছে।

বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়োগ ও পদোন্নতির বিষয়টি অন্যান্য প্রশাসন থেকে ভিন্ন। বিশ্ববিদ্যালয় মনে করলে সরাসরি বিভিন্ন পদে শিক্ষিক নিয়োগ দিতে পারেন। নতুন বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বার্থে অন্য কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক বা অধ্যাপককে নিয়োগ দিতে পারে। আবার শিক্ষকরা পদোন্নতি পেলে নতুন পদে নতুন করে যোগদান করেন। তাহলে নতুন নিয়মে যারা ১ জুলাইয়ের পর নতুন নিয়োগ পাবেন, তাদের নতুন পেনশন আইনের আওতায় থাকতে হবে। তাহলে বলতে হচ্ছে, দেশের স্বার্থে অন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে যাওয়া বা পদোন্নতি পাওয়া হবে শিক্ষকদের জন্য অপরাধ।

নতুন আইনে কেবল বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকরাই বলির পাঁঠা হচ্ছেন। প্রাথমিক থেকে শুরু করে কলেজের শিক্ষকরা ঠিকই আগের নিয়মে পেনশন পাবেন। এর ফলে যে বৈষম্য তৈরি হবে, তা কি ভেবেছি? এ নিয়ম বহাল থাকলে তো বিশ্ববিদ্যালয়ে আর মেধাবীরা আসবে না। বরং তাদের ঝোঁক থাকবে সরকারি চাকরি বা বিদেশ যাওয়াতে। বিগত দুই বছরে কত হাজার মেধাবী শিক্ষার্থী বিদেশ চলে গেছে, তা কি আমরা বিবেচনায় নিচ্ছি? এভাবে চলতে থাকলে তো দেশ মেধাশূন্য হয়ে যাবে।

আমাদের নীতিনির্ধারকরা কি ভেবে দেখেছেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা বেতন-ভাতা ছাড়া আর কী কী সুযোগ পান? এমনকি উচ্চশিক্ষা আমরা নিজেদের চেষ্টায় নেই এবং আমাদের জন্য বিশেষ কোনো বৃত্তি বা সহায়তা নেই। অথচ একই সময়ে অন্যান্য পেশার জন্য উচ্চশিক্ষার জন্য আর্থিক সুবিধা রয়েছে। বিনয়ের সঙ্গে জানতে চাই, উচ্চশিক্ষা অর্জন কাদের জন্য বেশি প্রয়োজন? জীবনের সবচেয়ে মূল্যবান সময়টুকু অধ্যাপনায় ব্যয় করে তাদের প্রাপ্তি কী? অনেক বছর ধরে লক্ষ করছি শিক্ষকসমাজ নিয়ে অনেকের অনেক নেতিবাচক মন্তব্য। এমনকি শিক্ষকদের নিয়ে নেতিবাচক কোনো সংবাদ পেলে অনেক গণমাধ্যমও বেশ গুরুত্বের সঙ্গে তা তুলে ধরে। ভর্তি পরীক্ষার বিল বা ভিসিদের অনিয়ম নিয়ে সংবাদগুলো যেন ‘হট কেক’ হয়ে যায়। আমি বলছি না, এটি করা ঠিক নয়। কিন্তু বিনয়ের সঙ্গে জানতে চাই, ক’জন শিক্ষক অর্থ পাচারে অভিযুক্ত বা ক’জনের বেগমপাড়ায় বাড়ি আছে? আর সম্মানিত ভিসিরা কি সব ক্ষেত্রে স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারেন? তাদের ব্যর্থতার সঙ্গে আমাদের লেজুড়বৃত্তির রাজনীতির প্রভাব অস্বীকার করার সুযোগ নেই।

আমাদের প্রতিবেশী দেশসহ পৃথিবীর অনেক দেশে শিক্ষকদের জন্য পৃথক বেতন কাঠামো ও অন্যান্য সুযোগ রয়েছে। উন্নত বিশ্বে শিক্ষাখাত থাকে অগ্রাধিকারে, কেননা তারা জানে, জ্ঞানের বিকাশ না হলে সভ্যতার বিকাশ ও উন্নয়ন থেমে যায়। যেজন্য সেসব দেশে উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের গবেষণার জন্য বিশাল বরাদ্দ থাকে। প্রতি বছর আমাদের দেশ থেকে অনেকেই উচ্চশিক্ষার জন্য উন্নত বিশ্বের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে বৃত্তিসহ পড়ালেখার সুযোগ পেয়ে থাকেন। এর কারণ আর কিছু নয়, জ্ঞানের বিকাশ। তাদের লক্ষ্য থাকে ভালো মানের কোনো গবেষণার মাধ্যমে নতুন কোনো ধারণা বা প্রযুক্তি উদ্ভাবন করা, তাহলে সেটাই সাফল্য। বলা বাহুল্য, সেসব দেশে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের গবেষণা করা বা আন্তর্জাতিক সেমিনারে অংশ নেওয়ার জন্য যথেষ্ট স্বাধীনতা ও আর্থিক সহযোগিতা পেয়ে থাকেন।

বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের প্রতি এমন চিন্তাভাবনা জাতির জন্য ক্ষতিকর। অনেকেই বলেন, শিক্ষকরা জাতির বিবেক, তাই তাদের কাছ থেকে জাতি সর্বোত্তম আচরণ প্রত্যাশা করে। আমিও এর সঙ্গে একমত। কিন্তু যাদের জাতির বিবেক বলা হয়, তাদের বিবেক, মেধা ও শ্রমের সর্বোচ্চ বিকাশে সমাজ ও সরকারের ভূমিকাও আলোচনায় থাকা জরুরি। ২৫ বছর অধ্যাপনা করার পরও যখন কেউ দেখেন নিজের একটি বাড়ি নেই, তখন কিন্তু কেউ এগিয়ে আসে না। ডলার সংকটের মধ্যেও লাখ লাখ ডলার দিয়ে অন্যদের জন্য বিলাসবহুল গাড়ি কেনা হলেও অধ্যাপকরা চড়েন বিশ্ববিদ্যালয়ের সাধারণ বাসে-এ দৃশ্য কি দৃষ্টি এড়িয়ে যায়? আমরা আমাদের বঞ্চনাগুলো বুকে আগলে রাখি; কিন্তু এর মানে এই নয়, আমাদের নিয়ে সবসময় পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হবে।

এখন আমাদের দেওয়ালে পিঠ ঠেকে গেছে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে এ নিয়ে চলছে প্রতিবাদ। সমস্যা আমাদেরও আছে। আমরা সবসময় সবকিছু মেনে নেই বলে কিছু মানুষ আমাদের প্রতি এমন উদাসীনতা দেখানোর সাহস দেখাচ্ছেন। আবার প্রতিবাদের জোর যতটা হওয়া দরকার, এখনো তা ততটা প্রবল বলে মনে হচ্ছে না। সবাই আশা করছে, দেশের প্রধান বিদ্যাপীঠগুলো অগ্রণী ভূমিকা নেবে, যদিও মনে জোর পাই না। নিকট অতীতে পদোন্নতির নীতিমালা নিয়ে অনেক জল ঘোলা হলেও আমাদের সম্মিলিত উদ্যোগ কি যথেষ্ট ছিল? আমরা যদি ভাবি, এটাই শেষ, তাহলে বলব এটি শুরু। আশঙ্কা করছি, আমাদের নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা আরও হবে। তাই আজ যারা এ নিয়মের বাইরে আছি বলে ভাবছি, তাদের ভবিষ্যতের নিশ্চয়তা কিন্তু নেই।

যে কোনো দেশে শিক্ষকতায় থাকেন দেশের মেধাবীরা এবং এটাই যুক্তিসংগত। বিশেষ করে যারা একাডেমিক কাজে নিজেদের নিয়োজিত রাখতে চান, সেরকম মানুষই শিক্ষকতার জন্য উপযুক্ত। আমরা প্রতি বছর গভীর দুঃখের সঙ্গে ১৪ ডিসেম্বর পালন করি কেন, তা নতুন করে বলা অপ্রয়োজনীয়। যে কোনো দেশের মেধাবী ও চিন্তাশীলদের যদি অচল করে দেওয়া যায়, তাহলে সে দেশ যে সামগ্রিকভাবে পিছিয়ে যায়, তা সবাই জানে এবং ১৯৭১ সালে হানাদাররা পরাজয় আসন্ন জেনে তাই করেছে। তাই, সব দেশই তার মেধাবী জনগোষ্ঠীর বিশেষ যত্ন নিয়ে থাকে এবং এটা আবশ্যকীয়। আমাদের নীতিনির্ধারক, প্রশাসকদের মনে রাখা দরকার, তাদের আজকের অবস্থান তৈরি করে দিয়েছেন শিক্ষকরাই। আজ যেসব আধুনিক প্রযুক্তি বা কৌশল আমরা ব্যবহার করছি, সেগুলো কিন্তু তৈরি হয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণাগারে, কোনো প্রশাসনিক ভবনে নয়। সরকার যেখানে চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের প্রস্তুতি নিচ্ছে, সেখানে যদি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের এভাবে অবমূল্যায়িত করা হয়, তাহলে দক্ষ নাগরিক তৈরি হবে কীভাবে? কেউ যদি মনে করেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের অভুক্ত রেখে দেশকে জ্ঞান-বিজ্ঞানে সমৃদ্ধ করতে পারবেন, তাহলে আর কিছু বলার নেই।

তাই, অবিলম্বে নতুন সিদ্ধান্ত রহিত করা হোক অথবা সবার জন্য একই সিদ্ধান্ত হোক, যাতে কেউ আর বৈষম্যের শিকার না হন। প্রত্যাশা করি, বিষয়গুলো গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করে বিবেচনাপ্রসূত সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।

আবুল কাশেম উজ্জ্বল : শিক্ষক, সমাজকর্ম বিভাগ, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, সিলেট

Jamuna Electronics
wholesaleclub

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম