গত কয়েক সপ্তাহ ধরে প্রিন্ট ও ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ার একটি বড় অংশজুড়ে রয়েছে টাকার খবর। এক-দুই টাকা না, হাজার হাজার কোটি টাকার খবর। সেই টাকা আবার বৈধ নয়, বেপথে আয় করা টাকা। যারা করেছেন, তারা আবার মামুলি ইনসান নন, সরকারের অনেক বড় ও গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিবিশেষ। তাদের ক্ষমতা অকল্পনীয়। আমার মতো সাধারণ মানুষের ব্যাংক হিসাবে দশ লাখ টাকা জমা হলে তা ‘সন্দেহজনক লেনদেনের’ পর্যায়ে পড়ে; কিন্তু ওই ক্ষমতাবানদের অ্যাকাউন্টে হাজার হাজার কোটি টাকা লেনদেন হলেও তা ‘সন্দেহজনক’ হয় না। বুঝতে অসুবিধা হয় না, অবৈধভাবে উপার্জিত হাজার কোটি টাকাকে নিরাপদ রাখতে নিশ্চয়ই আরও কয়েক হাজার কোটি টাকা খরচা করা হয়েছে। তাদের যেসব টাকা ব্যাংকে গচ্ছিত থাকে, সাধারণ মানুষের তা দেখার সুযোগ নেই। কিন্তু শত শত একর জমি করায়ত্ত করার বিষয়টি কি মানুষের দৃষ্টির আড়ালে থাকতে পারে? সরকারি গোয়েন্দা সংস্থার চোখে কি পড়েনি? পড়েছে, তবে ক্ষমতার ধারের কাছে সে দৃষ্টি ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর হয়েছে। দেশের এই যে উন্নয়নের জোয়ারের কথা বলা হচ্ছে, তার ছিটেফোঁটাও তো সাধারণ মানুষের দৈনন্দিন জীবনে পড়ছে না। উন্নয়ন সুবিধার পুরোটাই ভোগ করছে গুটিকয় মানুষ। সপ্তাহজুড়ে হাজার কোটি টাকার যে গল্প সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে, তার সংখ্যা চার-পাঁচটার বেশি নয়। এমন হাজার হাজার সত্য গল্প আছে, যা এখনো অপ্রকাশিত। শুধু শাসকগোষ্ঠীর ইচ্ছার ওপরই নির্ভর করে হাজার কোটি টাকার গল্প প্রকাশিত হবে কী হবে না। তবে এর দ্বারা প্রমাণিত হয়, রাষ্ট্রযন্ত্রের কোথাও কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। শাসনব্যবস্থার আশ্রয়ে-প্রশ্রয়ে একজন যা খুশি তা-ই করতে পারে। সে ক্ষেত্রে কোটি কোটি অক্ষম মানুষের চোখ দিয়ে দেখা ছাড়া করার কিছু নেই।
আমাদের মতো সাধারণ মানুষ এ মুহূর্তে রাজনৈতিকভাবে অভিভাবকহীন। এর একমাত্র কারণ হলো, কোনো দলের রাজনৈতিক ক্ষমতায়নে সাধারণ মানুষের কোনো ভূমিকা বা প্রয়োজন নেই। গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় এখন কী করে যেন জনগণের মতের তোয়াক্কা না করেই ক্ষমতায় থাকা যায়। শাসকগোষ্ঠী তাই এখন আর আমাদের ভালো-মন্দের কথা ভাবে না। যাদের সহযোগিতায় ক্ষমতা পাকাপোক্ত করা যায়, তাদের স্বার্থটাই বেশি করে বিবেচিত হয় এবং এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু শাসনক্ষমতার ভাগাভাগি নিয়ে আমাদের কোনো আক্ষেপ নেই, আক্ষেপটা হলো জনগণের টাকার হিসাব নিয়ে। যে টাকা করের মাধ্যমে এবং জনগণকে বন্ধক রেখে ঋণের মাধ্যমে আহরণ করা হয়, সেই টাকা ব্যয় করার একটা গ্রহণযোগ্য, স্বচ্ছ ও নির্ভেজাল হিসাব আমরা চাই। আপনি যেভাবেই ক্ষমতায় আসুন না কেন, থাকুন না কেন, জনগণের এ চাওয়াটা অধিকারের মধ্যে পড়ে।
সামন্তব্যবস্থায় জনগণের কাছ থেকে আহরিত অর্থ জমা হতো রাজকোষে। এ রাজকোষের সমুদয় অর্থ ব্যয় করার একক ক্ষমতা ছিল রাজার। কোন খাতে কত টাকা ব্যয় করবেন, কোন বিনোদনে কত অর্থ ব্যয় করবেন, তার সম্পূর্ণ এখতিয়ার ছিল রাজার। প্রজাগণের কাছে সেই অর্থের কোনো হিসাব দেওয়ার দায় রাজার ছিল না। কিন্তু আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থায়ও করের মাধ্যমে জনগণের কাছ থেকে অর্থ আদায় করা হয়, জমা করা হয় সরকারি কোষাগারে। তবে এ অর্থের কোনো একক মালিকানা রাষ্ট্র কিংবা সরকারপ্রধানের নেই। সরকারকে জবাবদিহি করতে হয়, জনগণের টাকা কোন খাতে কত ব্যয় করা হয়েছে। যে কারণে প্রতিবছরই জাতীয় বাজেটে সুস্পষ্ট উল্লেখ থাকে, আগামী এক বছরে সরকার কোন কোন উৎস থেকে কত আয় করতে চায় এবং কোন কোন খাতে তা ব্যয় করতে চায়। আয়-ব্যয়ের এ সাধারণ সমীকরণটি স্বাভাবিকভাবে ঘটে থাকলে কথা উঠত না, কিন্তু বাস্তবতা হলো এ প্রক্রিয়াটি স্বচ্ছতার সঙ্গে সবসময় সম্পন্ন করা হয় না। কোথায়, কীভাবে, জনগণের টাকা হাতিয়ে নেওয়া হয়, তার কিছুটা আলোচনা করছি।
ধরা যাক, সরকারি কোষাগারে জমা আছে ১০০ টাকা। এ টাকা সরকারপ্রধান চাইলেই যেনতেনভাবে খরচ করতে পারবেন না। ব্যয় করার যুক্তি ও ন্যায়সংগত খাত থাকতে হবে। ধরা যাক, জনকল্যাণে কোনো একটি এলাকায় রাস্তা নির্মাণ করা প্রয়োজন। সরকারের এ খাতে ব্যয় যুক্তিসংগত। সরকার রাস্তা নির্মাণে ১০০ টাকা বরাদ্দ দিল; এতে কোনো অন্যায্যতা নেই। কিন্তু সমস্যাটা হলো, রাজনৈতিক চাপ, অনিয়ম ও লুটপাটের ফলে মাত্র ৪০ টাকা ব্যয় করে রাস্তাটি কোনোরকমে সমাপ্ত করা হয় অথবা ৪০ টাকার রাস্তাটির নির্মাণব্যয় ১০০ টাকা দেখানো হয়। বাদবাকি ৬০ টাকা চলে যায় রাজনৈতিক মদদপুষ্ট ঠিকাদার, সংশ্লিষ্ট বিভাগের কর্মকর্তা ও রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকদের পকেটে। ১০০ টাকা ব্যয় করে জনগণ ৪০ টাকার রাস্তা পেলেন। এটাই আমাদের দুর্ভাগ্য। আমরা অনেকেই আজকাল উন্নয়ন-উন্নয়ন চিৎকার শুনি, কিন্তু একথা মনে রাখতে হবে, বড় বড় দুর্নীতি করতে হলে বড় বড় প্রকল্প অপরিহার্য। একটি সরকার যদি জনকল্যাণকামী হয়, তাহলে সে তো উন্নয়ন প্রকল্প নেবেই, যদি লুটেরা সরকারও হয়, তাহলেও তাকে উন্নয়ন প্রকল্প নিতে হবে। কেননা, প্রকল্প ব্যতীত লুটপাট অসম্ভব। সুতরাং, আমাদের দেখতে হবে উন্নয়নের পাশাপাশি জনগণের অর্থ কী পরিমাণ লুটপাট হয়েছে।
প্রকল্প বাস্তবায়নের মাধ্যমে অর্থ লোপাটের একটি অন্যতম পন্থা হলো প্রকৃত ব্যয়ের বিপরীতে অতিরিক্ত ব্যয়। আর এর পেছনে কারণ হিসাবে থাকে নির্দিষ্ট সময়ে প্রকল্পের কাজ শেষ না হওয়া। দেশে চলমান প্রায় প্রতিটি প্রকল্পের গড় অবস্থা একই রকম। এ মুহূর্তে আমি শুধু একটি মন্ত্রণালয়ের উদাহরণ দিতে চাই, যার নাম নৌ মন্ত্রণালয়। এ নিয়ে দৈনিক যুগান্তরে একটি প্রতিবেদন প্রকাশের পর মন্ত্রণালয় কর্তৃক গঠিত এক তদন্তে বিস্তারিত তথ্য উঠে এসেছে। এ মন্ত্রণালয়ের অধীন বাস্তবায়নাধীন ৩২ প্রকল্পের প্রকৃত অবস্থা নিয়ে উদ্বেগ সৃষ্টি হয়েছে। এ ৩২ প্রকল্পের মধ্যে ২৪ প্রকল্পই নির্ধারিত ব্যয়ের মধ্যে থেকে নির্ধারিত সময়ে শেষ করা যায়নি। নির্ধারিত সময়ে কাজ শেষ করতে না পারলে প্রকল্পের ব্যয় বেড়ে যায়। এরকম ২০ প্রকল্পে ব্যয় বেড়েছে এবং অতিরিক্ত ব্যয়ের কারণে রাষ্ট্রীয় কোষাগারকে বহন করতে হয়েছে ৯ হাজার ৩৭৫ কোটি টাকা। এ অতিরিক্ত ব্যয়ের দায় সরকারের হলেও এর দায়ভার বহন করতে হবে অসহায় জনগণকে। শেষতক লাভবান হবেন প্রকল্পসংশ্লিষ্টরা, যারা কুরবানির ঈদে ১২ লাখ টাকা দিয়ে ছাগল কেনার মতো উদাহরণ তৈরি করেন।
৩২ প্রকল্পের মধ্যে ২৪টিরই মেয়াদ বাড়াতে হয়েছে। প্রতিটি প্রকল্পের গড় মেয়াদ বৃদ্ধি পেয়েছে দুই বছর ১০ মাস। সেই হিসাবে প্রকল্পগুলোর মোট মেয়াদ বৃদ্ধির সময় প্রায় ৬৮ বছর। একটি প্রকল্পের প্রাক্কলিত সময় ধরা হয়েছিল ৩ বছর। অথচ সেই প্রকল্প ১১ বছরেও সমাপ্ত করা যায়নি। এ মেয়াদ ও ব্যয়বৃদ্ধির কতগুলো কারণ অবশ্য মন্ত্রণালয় গঠিত তদন্ত কমিটি দিয়েছে, যা যুগান্তরে প্রকাশিত হয়েছে। প্রকল্পের মেয়াদ ও ব্যয় বৃদ্ধির ১৪ কারণ চিহ্নিত করেছে তদন্ত কমিটি। এর মধ্যে ব্যয় বাড়ার জন্য ৮ কারণ ও মেয়াদ বাড়ার ৬ কারণ উল্লেখ করা হয়েছে। বাড়তি ব্যয়ের বিষয়ে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সঠিকভাবে প্রকল্পের সম্ভাব্যতা যাচাই না করায় প্রকল্পের ব্যয় বাড়ছে। পরামর্শক প্রতিষ্ঠান প্রকল্পের বিভিন্ন অঙ্গ পরিবর্তন ও সংশোধন করায় প্রকল্পের মেয়াদ বাড়ছে। এর ফলে ব্যয়ও বাড়ছে। আবার প্রকল্পে বিভিন্ন অঙ্গ যুক্ত করা বা বাদ দেওয়ার কারণেও ব্যয় বাড়ছে। দরপত্র প্রাক্কলনে মেয়াদ বাড়ানোর কারণে সময়ের ব্যাপ্তিতে রেট শিডিউল পরিবর্তিত হওয়ায় মূল্য বাড়ছে। ভূমি অধিগ্রহণে ক্ষতিপূরণের হার দ্বিগুণ থেকে তিনগুণ হওয়ার কারণেও খরচ বাড়ছে। ড্রেজিং প্রকল্পের মেয়াদ বাড়ার কারণে সংরক্ষণ ড্রেজিংয়ের পরিমাণ বাড়ছে। এরকম যুক্তির কোনো অভাব নেই; কিন্তু আখেরে তো জনগণের পকেটই ফাঁকা হলো।
এসব অনিয়ম কীভাবে দূর করা যায়, তার পক্ষে তদন্ত কমিটি ১৩ সুপারিশ করেছে। সেই সুপারিশগুলো একটি দিয়েই শেষ করব; উল্লেখেযোগ্য সুপারিশ হচ্ছে-প্রকল্প নেওয়ার আগে সম্ভাব্যতা যাচাই কার্যক্রম সঠিকভাবে অনুসরণ করতে হবে। সম্ভাব্যতা যাচাই ছাড়া কোনো প্রকল্প যেন গ্রহণ করা না হয়, তা সংস্থাপ্রধান নিশ্চিত করবেন।
এর অর্থ দাঁড়ায় প্রকল্পের সম্ভাব্যতা যাচাই করা ছাড়াই প্রকল্প অনুমোদিত হয়। এটি তো উৎকণ্ঠার ব্যাপার! ত্রুটি-বিচ্যুতির কথা তখন বলা হচ্ছে, যখন ৯ হাজার কোটি টাকারও বেশি টাকা সরকারি তহবিল থেকে বেরিয়ে গেল। এরকম অনিয়মে চলা রাষ্ট্রযন্ত্রের ওপর সাধারণ মানুষ আস্থা রাখতে পারে কি?
মুঈদ রহমান : অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়