কারণ না জানলে প্রতিকার হবে কীভাবে?
ড. মো. আনোয়ারুল ইসলাম
প্রকাশ: ২৫ জুন ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
সুরমা দেশের অন্যতম বৃহৎ নদী। বাংলাদেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চল তথা বৃহত্তর সিলেট অঞ্চলের প্রাণ-প্রকৃতির আবর্তন মূলত এ সুরমাকেন্দ্রিক। সুরমা নদীর উৎপত্তি মূলত ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় নাগা-মণিপুর পাহাড়ের মাও সংসাং এলাকায়, যা উৎসমুখ থেকে বরাক নাম ধারণ করে ভারতের আসাম রাজ্যের কাছাড় জেলার অমলশিদ ও সিলেট জেলার সীমান্তবর্তী গ্রাম বদরপুরে সুরমা এবং কুশিয়ারা নামে দুটি পৃথক শাখায় বিভক্ত হয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। এর উত্তর দিকের শাখাটি সুরমা নামে প্রথমে পশ্চিম দিকে প্রবাহিত হয়ে পরে দক্ষিণ-পশ্চিমে সিলেট শহর অভিমুখে প্রবাহিত হয়েছে। সিলেট অতিক্রম করে এটি উত্তর-পশ্চিমে প্রবাহিত হয়ে পশ্চিমে সুনামগঞ্জ শহরের দিকে ধাবিত হয়েছে। পরবর্তী সময়ে নেত্রকোনা জেলার মোহনগঞ্জ উপজেলার দক্ষিণে কংস নদী এবং আরও দক্ষিণে মগরা নদী সুরমা নদীর সঙ্গে মিলিত হয়েছে। নদীর উচ্চতর গতিপথে পশ্চিমাঞ্চলীয় নদীখাতটি ধনু, মধ্যবর্তী পর্যায়ে বাউলাই এবং নিুতর পর্যায়ে ঘোরাউত্রা নামে পরিচিত। নদীটি নিুতর পর্যায়ে কুলিয়ার চরের কাছ দিয়ে প্রবাহিত হয়ে আজমিরীগঞ্জের কাছে কুশিয়ারা নদীর সঙ্গে মিলিত হয়েছে। সুরমা ও কুশিয়ারার এ মিলিত ধারা কালনী নাম ধারণ করে দক্ষিণে প্রবাহিত হয়েছে, যা মূলত মেঘনা নদীর মূল প্রবাহ। এ নদীর ধারায় মেঘালয় মালভূমির দক্ষিণ থেকে নেমে আসা বিভিন্ন নদী ও স্রোতধারা মিলিত হয়েছে। পূর্ব থেকে পশ্চিমে এগুলো হলো লুভা, হরি (কুশিয়া), গোয়াইন গাঙ (চেঙ্গের খাল), পাইয়ান, বোগাপানি, জাদুকাটা, সোমেশ্বরী এবং কংস। সুরমা নদী প্রণালির অধিকাংশই হাওড় অববাহিকায় পতিত হয়েছে, যেখানে নিষ্কাশন রেখা স্পষ্ট এবং সুনির্ধারিত নয়। বর্ষা মৌসুমে সুরমা বন্যাপ্রবণ। এ অঞ্চলে সাধারণভাবে বন্যা মৌসুমের সময়সীমা মে মাসের শেষ সপ্তাহ থেকে অক্টোবরের মাঝামাঝি পর্যন্ত বিস্তৃত।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে সিলেটের বন্যা বেশ ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। বন্যার ভয়ালগ্রাসে সিলেট ও উত্তর পূর্বাঞ্চলের জেলাগুলোতে বন্যাকবলিত হয়ে মানুষের জানমাল ও সম্পদের ক্ষয়ক্ষতির মাত্রা বেড়েই চলেছে। বর্তমানে বন্যার কারণ হিসাবে অষ্টগ্রাম-মিঠামইন-ইটনার অলওয়েদার রোডের কথা এ অঞ্চলের মানুষের মুখে বারবার ফিরে আসছে। অষ্টগ্রাম, মিঠামইন, ইটনা মূলত কিশোরগঞ্জ জেলার তিনটি হাওড়বেষ্টিত উপজেলা। হাওড় হলো চারদিকে বিস্তীর্ণ জলরাশির এক অপূর্ব খেয়াল। বর্ষায় যার রূপ ক্ষণে ক্ষণে বদলায় আপন খেয়ালে। কিশোরগঞ্জের হাওড়গুলোর চিরায়ত রূপের বাহারে ইটনা-মিঠামইন-অষ্টগ্রাম অলওয়েদার রোড এক নতুন সংযুক্তি। হাওড়ের বিস্ময় খ্যাত এ অলওয়েদার রোডটি ৮ অক্টোবর ২০২০ তারিখে উদ্বোধন করেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ভাটি বাংলার কৃতি সন্তান রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদের ঐকান্তিক আগ্রহে নির্মিত হাওড় অধ্যুষিত ইটনা, মিঠামইন ও অষ্টগ্রাম উপজেলা সদরের মধ্যে সংযোগরক্ষাকারী ২৯ দশমিক ৭৩ কিলোমিটার দীর্ঘ সড়কটি যুগ যুগ ধরে অবহেলিত হাওড়বাসীর জন্য যোগাযোগের ক্ষেত্রে এক নবদিগন্তের সূচনা করেছে। ‘শুকনার দিনের পাও, বর্ষার দিনের নাও, একেই বলে ভাটি এলাকার গাঁও’ ভাটি এলাকার জনপ্রিয় এ প্রবাদটিকে বিগত কয়েক বছরে মিথ্যা প্রমাণ করে ওই এলাকার চিত্র অনেকটাই বদলে দিয়েছে বিশাল হাওড়ের বুকে নান্দনিক এ মহাসড়ক। উত্তর-দক্ষিণে বিস্তৃত ৮৭৪ কোটি ৮ লাখ টাকা ব্যয়ে নির্মিত এ সড়কটি ভবিষ্যতে ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের সঙ্গে যুক্ত হবে। উল্লেখ্য, হাওড় অঞ্চলে পানির প্রচুর চাপ বিবেচনায় নির্মিত এই অল ওয়েদার রোডে রয়েছে ৫৯০ দশমিক ৪৭ মিটার দীর্ঘ তিনটি পিসি গার্ডার ব্রিজ, ১৯০ মিটার দীর্ঘ ৬২টি আরসিসি বক্স কালভার্ট, ২৬৯ দশমিক ৬৮ মিটার দীর্ঘ ১১টি আরসিসি গার্ডার ব্রিজ। এগুলো দিয়ে সহজে দুই পাশে পানি চলাচল করতে সক্ষম এবং সিলেটের বন্যার সময় সরেজমিন পর্যবেক্ষণ করে দেখা গেছে, এই অলওয়েদার রোডের দুই পাশে পানির উচ্চতার তারতম্য হয় না। এই অলওয়েদার রোড থেকে আগে সুরমা নদীর দূরত্ব প্রায় ২৫ কিলোমিটার। সুরমা নদীতে পানিপ্রবাহের ক্ষেত্রে এ দীর্ঘ পানি নিষ্কাশন পথের বিস্তৃতিকেও মোটাদাগে কম বলা যাবে না। তাছাড়া সুরমা অববাহিকায় মেঘালয় পাহাড় থেকে চলে আসা প্রবল বৃষ্টির পানির একটা উল্লেখযোগ্য অংশ পাদদেশীয় সোমেশ্বরী, ধনু, মোগরা, নিতাই, কংস নদী দিয়ে ইটনার, যেখানে অলওয়েদার রোডের সমাপ্তি হয়েছে, তার ওপর দিয়ে অলওয়েদার রোডের পশ্চিম পাশ দিয়ে প্রবাহিত হয়ে কালনী তথা মেঘনায় পতিত হয়। সুতরাং উত্তর-দক্ষিণে বিস্তৃত এই অলওয়েদার রোড পানিপ্রবাহে যে বিরাট প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করছে, সেটা যুক্তিযুক্ত নয়। মেঘালয় পাহাড়ের পাদদেশীয় এলাকা ও সুরমা বেসিনের ওপর প্রবাহ থেকে নদীপথে এ অলওয়েদার রোডের দূরত্ব প্রায় ২০০ কিলোমিটার। এ দীর্ঘ দূরত্ব অতিক্রম করে উপরিভাগের প্রবাহ থেকে বিশাল জলরাশির নিুপ্রবাহে পৌঁছানোর একটা বিলম্বিত প্রভাব থাকে। ফলে অলওয়েদার রোড পর্যন্ত উপরিভাগের প্রবাহের পানি পৌঁছাতেই সেটা অনেকটা স্বাভাবিক অবস্থায় চলে আসে, যা বন্যার জন্য এই অলওয়েদার রোডের ভূমিকাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে না। আমরা যদি সামগ্রিক অঞ্চলটির ভূমি উচ্চতার তারতম্য বিবেচনা করি, তাহলে দেখা যাবে সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে কিশোরগঞ্জের হাওড়গুলোর উচ্চতা ৭-১০ মিটার, যেখানে সুরমার ওপর প্রবাহ তথা সিলেট অঞ্চলের উচ্চতা ২৫-৩০ মিটার। এখন বন্যার পানি অষ্টগ্রাম-মিঠামইন-ইটনার অলওয়েদার রোডে গিয়ে বাধাপ্রাপ্ত হয়ে ফুলে ওঠে যদি সিলেট অঞ্চলের ২৫-৩০ মিটার উঁচু এলাকাকে প্লাবিত করতে হয়, তাহলে পানির উচ্চতা হতে হবে ১৫-২০ মিটার। সুতরাং ঢালের গতিমাত্রা বিবেচনা করে বলা যায়, এ নিচু ভূমি উচ্চতায় অবস্থিত অলওয়েদার রোড সিলেটের বন্যা সংগঠনে বিরাট ভূমিকা পালন করছে, সেটা আসলে বাস্তবসম্মত নয়।
সুতরাং বলা যাবে না যে সিলেট অঞ্চলের বন্যার জন্য এই অলওয়েদার রোড একক ভূমিকা পালন করছে। সেক্ষেত্রে একটা প্রশ্ন উঠতেই পারে, এই অলওয়েদার রোড নির্মাণের আগে তো সিলেট অঞ্চলে এত ঘন ঘন বন্যা হতো না, এখন কেন বন্যা বাড়ছে? আমরা যদি এর উত্তর খুঁজতে যাই, তাহলে প্রথমেই আসবে সাম্প্রতিক সময়ে এ সিলেট তথা খাসিয়া-জৈন্তিয়া পাহাড়ি এলাকার চরম বৃষ্টিপাতের কথা। উল্লেখ্য, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে এ অঞ্চলের বৃষ্টিপাত পূর্বেকার সব রেকর্ড ছাড়িয়ে দিয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, গত ১৮ জুন প্রায় ২৫০ মিলিমিটার রেকর্ড বৃষ্টিপাত হয়েছে এ অঞ্চলে, যা এ দশকের গোড়ার দিকের পূর্বেকার যে কোনো সময় থেকে অনেক বেশি। সুরমার ওপর প্রবাহে অল্প সময়ে অতি বৃষ্টিপাত এ অঞ্চলের বন্যাকে বেশ প্রলম্বিত করছে। দ্বিতীয়ত, এ অঞ্চলে ভূমি ব্যবহারের ধরনে ব্যাপক পরিবর্তন বন্যার অন্যতম প্রভাবক হিসাবে কাজ করছে। আমাদের পর্যবেক্ষণ বলছে, গত এক দশকে অবকাঠামোগত উন্নয়নে সিলেটে ভূমির ব্যবহার বাড়ছে প্রায় ৬০ শতাংশ, যার অধিকাংশ আবার অধিগৃহীত হয়েছে জলাভূমি বা জলাশয় থেকে। সুতরাং বৃষ্টির পানির রিজার্ভারখ্যাত জলাধারগুলোর বিস্তৃতি ব্যাপকভাবে কমে গেছে। পাশাপাশি হাওড় এলাকায় নির্মিত ফসল রক্ষা বাঁধগুলো বৃষ্টির পানির স্বাভাবিক নিষ্কাশন প্রক্রিয়াকে বেশ বাধাগ্রস্ত করেছে, যা বন্যা হওয়ার ক্ষেত্রে বেশ সহায়ক ভূমিকা পালন করছে। উপরন্তু, আন্তঃসীমান্ত নদী থেকে প্রতিবেশী দেশের একতরফা পানি প্রত্যাহার, শুকনো মৌসুমে পানির কম প্রবাহ, অধিক পলায়নের কারণে নদীর তলদেশ ভরাট হয়ে যাওয়া, নদী দখলের কারণে নদীখাত সরু হয়ে যাওয়াসহ আনুষঙ্গিক অনেক কারণে এ অঞ্চলের নদীগুলো তার নাব্য হারিয়ে ফেলেছে। ফলে বর্ষা মৌসুমে অতিরিক্ত বৃষ্টিপাত হলেই নদীর পানি উপচে লোকালয়ে ঢুকে বিরাট বন্যার প্রাদুর্ভাব ঘটায়। সাম্প্রতিক সময়ে খাসিয়া-জৈন্তিয়া পাহাড়ি এলাকায় অতিরিক্ত বৃক্ষনিধনের কারণে পূর্বেকার যে কোনো সময়ের চেয়ে বৃষ্টির পানি নিষ্কাশন দ্রুততম হয়েছে। ফলে পাহাড়ি এলাকার অধিক বৃষ্টিপাত খুব দ্রুত সময়ে পাদদেশীয় এলাকায় চলে এসে বন্যার প্রক্রিয়াকে ত্বরান্বিত করছে। সর্বোপরি অপরিকল্পিত নগরায়ণ ও উন্নয়ন কর্মকাণ্ড এ অঞ্চলে বন্যার প্রবণতা বৃদ্ধির অন্যতম কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। সুতরাং সিলেট অঞ্চলের বন্যার পেছনে অষ্টগ্রাম-মিঠামইন-ইটনার অলওয়েদার রোডকে এককভাবে দায়ী না করে এ অঞ্চলের বন্যা ঝুঁকি কমানোর জন্য প্রকৃতিতে বেড়ে চলা মনুষ্যসৃষ্ট প্রতিবন্ধকতাগুলো দূরীকরণ, জনসচেতনতা বৃদ্ধি, টেকসই ও পরিকল্পিত উন্নয়ন, বৈজ্ঞানিক গবেষণা ও সমন্বিত বন্যা ব্যবস্থাপনা নীতি গ্রহণ এখন সময়ের দাবি।
ড. মো. আনোয়ারুল ইসলাম : দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা গবেষক; সহযোগী অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান, জিওগ্রাফি অ্যান্ড এনভায়রনমেন্ট বিভাগ, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়