বিএনপি কি ঘুরে দাঁড়াতে পারবে?
এ কে এম শাহনাওয়াজ
প্রকাশ: ২৫ জুন ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
আমাদের দুর্ভাগ্য এই যে, স্বাধীনতার ৫৩ বছর পরও এদেশে দ্বিধাবিভক্তি দেখতে হচ্ছে। এ বিভক্তি ১৯৭৫-এর পর থেকেই স্পষ্ট হচ্ছিল। মুক্তিযুদ্ধস্নাত একটি দেশের জন্য যা ছিল একেবারে অভাবিত। যেখানে বাংলাদেশের মতো মুক্তিযুদ্ধের পথ পেরিয়ে জন্ম নেওয়া দেশে মুক্তিযুদ্ধবিরোধীরা নিশ্চিহ্ন হয় বা নির্বাসিত হয়, সেখানে পরম আদরে রাজনীতিতে পুনর্বাসিত হলো জামায়াতে ইসলামী। এখন অনেকটা ডালপালা ছড়িয়েছে। অবশ্য এ দেশের সাধারণ মানুষের অন্তরে দৃঢ়মূল প্রথিত করতে পারেনি। স্বর্ণলতার মতো বন্ধুপ্রতিম গাছের ডাল জড়িয়ে বেড়ে উঠেছিল। আশ্রয়-প্রশ্রয়দাতা গাছের রস শুষে নিজ দেহ খোলতাই করেছে আর বন্ধুকে করে তুলেছে কৃশকায়।
জামায়াতে ইসলামী দলটি শুধু মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করেনি, জঘন্য অপরাধের সঙ্গেও জড়িয়ে পড়ে। মওদুদিবাদের বিতর্কিত আদর্শ ধারণ করে ধর্মের নাম ভাঙিয়ে হানাদার পাকিস্তানি বর্বর বাহিনীর স্থানীয় দালালের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়। মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি নিয়ে বেঁচে থাকা এ দেশের অসংখ্য মানুষ বলতে পারবেন, একাত্তরে জামায়াতে ইসলামী কতটা আতঙ্ক আর ঘৃণার নাম ছিল। এ দলের নেতাকর্মীরা ধর্মের নাম ভাঙিয়ে-পবিত্র ইসলাম ধর্মকে কলুষিত করে হেন অপকর্ম নেই যে, একাত্তরে করেনি। দুর্ভাগ্য এই, আজকে সুবিধাবাদী নেতাদের মিথ্যা ব্যাখ্যায় আচ্ছন্ন ইতিহাসবিচ্ছিন্ন তরুণ জামায়াত-শিবির কর্মীরা এই অতীত না জেনে অপরাধীদের রক্ষায় ধর্মের সঙ্গে, মানবতার সঙ্গে শত্রুতা করছে। গণহত্যা, নারী ধর্ষণ, লুণ্ঠন ও অগ্নিসংযোগকারী হানাদারদের সহযোগী এবং অংশগ্রহণকারীদের প্রতি ঘৃণা প্রকাশ না করে, তাদের রক্ষার জন্য এখনো দেশ ও জাতির বক্ষ বিদীর্ণ করছে। একইভাবে এদের রক্ষা করার পাপ কাঁধে তুলে নিয়ে মানবতাবিরোধী অপরাধীদের কাতারে নিজেদের যুক্ত করছে বিএনপির মতো একটি জনপ্রিয় দল। কিছু সংখ্যক নেতানেত্রীর রাজনৈতিক ও ব্যক্তিগত লোভের আগুনে পুড়ছে দলের প্রতি অসংখ্য নেতাকর্মীর ভালোবাসা।
অনেকে বলবেন, রাজনীতির মাঠে জামায়াত এখন অনেকটা নিষ্ক্রিয়। এটি তো সময়ের ফের। বর্তমান আওয়ামী লীগ শাসনের ধারাবাহিকতার শুরুতে মূল তরু বিএনপি কোণঠাসা হয়ে পড়ার সময় স্বর্ণলতা জামায়াত রসাস্বাদন করতে না পেরে নির্জীব তো হবেই। কিন্তু বসে নেই-রক্তবীজ তৈরি করছে নিজের ভেতর থেকে। এ দেশে সুবিধাবাদী রাজনীতি যতদিন সক্রিয় থাকবে, অন্ধকারের জীবদের প্রাণভোমরা ততদিন প্রত্যক্ষ না হলেও পরোক্ষভাবে ক্রিয়াশীল থাকবেই। নানা জাতের রাজনৈতিক দলের কাছ থেকে এরা প্রশ্রয় পাবেই।
বিএনপির যেহেতু বড় ময়দানে একা হাঁটার সামর্থ্য কম, তাই জামায়াতকে সে ছাড়তে পারবে না। তা সে জামায়াতের নিবন্ধন থাক বা না থাক। বিএনপির দলীয় আদর্শে পাকিস্তানপন্থা তো জিয়াউর রহমান দলটির জন্মলগ্ন থেকেই নিশ্চিত করেছেন। জামায়াতকে পাশে নিয়েই তো রাজনীতির মাঠে হাঁটছিলেন তারেক রহমান। অনেককাল থেকেই রাজনীতির মাঠে বিপন্ন-বিধ্বস্ত এদেশের বাম দলগুলো মৌলিক আদর্শ জলাঞ্জলি দিয়ে পায়ের নিচে মাটি ফিরে পেতে জামায়াত-বিএনপির সঙ্গে গাঁটছড়া বেঁধেছে। কোনো কোনো বাম ধারার আওয়ামী লীগে থাকা নেতা যথাযোগ্য সম্মান ও পদ-পদবি না পেয়ে ৩৬০ ডিগ্রি ঘুরে বিএনপি-জামায়াতের সঙ্গে আসন পেতে বসেছেন। জামায়াতের মতো স্বর্ণলতারা দ্রুতই এদের বন্ধু বানাতে পারবে।
১৯৭৫ সালের পর মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতাকারী জামায়াতে ইসলামী মুক্তিযোদ্ধা জিয়াউর রহমানের আশ্রয়ে এদেশের রাজনীতিতে পুনর্বাসিত হয়। সেদিন চমকে উঠেছিল বাংলাদেশের সুস্থ ধারার মানুষ। কিন্তু বঙ্গবন্ধু হত্যা-উত্তর সামরিক বাহিনীর ভেতর অভ্যুত্থান-পালটা অভ্যুত্থানের বাস্তবতায় যে গোলমেলে অবস্থার সৃষ্টি হয়েছিল, সে কারণে তেমনভাবে প্রতিবাদের শব্দ উচ্চারিত হয়নি। মুক্তিযোদ্ধা জিয়াউর রহমান তার রণাঙ্গনের পরিচয় পালটে ফেললেন। নিজের গড়া নতুন দলের শক্তি খুঁজতে চাইলেন মুক্তিযুদ্ধবিরোধীদের কাছ থেকে।
জিয়াউর রহমানের ব্যক্তিগত ক্যারিশমায় এবং আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক দুর্বলতার সুবিধায় বিএনপি নামের দলটি বেশ গুছিয়ে উঠিয়েছিল। কিন্তু সংকট তৈরি হয় জিয়াউর রহমান নিহত হওয়ার পর। খালেদা জিয়াকে নেতৃত্বে এনে আপাত সামাল দিলেও হীনম্মন্যতা থেকে বেরোতে পারেনি বিএনপি নেতৃত্ব।
আওয়ামী লীগ মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দেওয়া দল। অন্যান্য দলও মুক্তিযুদ্ধের গৌরবকে শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করে। ঠিক অমন একটি প্রেক্ষাপটে মুক্তিযুদ্ধের পরে জন্ম নেওয়া বিএনপি মুক্তিযুদ্ধবিরোধী জামায়াতে ইসলামীকে সমর্থন ও পৃষ্ঠপোষকতা দিয়ে সম্ভবত হীনম্মন্যতায় ভুগছিল। তাই অনেক বেশি সক্রিয় হতে চেয়েছিল মুক্তিযুদ্ধের গৌরব নিজেদের গায়ে মেখে, একদিকে নতুন প্রজন্মকে বিভ্রান্ত করতে; অন্যদিকে জামায়াতের ইচ্ছায় মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ভুলিয়ে দিতে চাইল নতুন প্রজন্মের মন থেকে। মানতে হবে এসব উদ্দেশ্য সফল করার জন্য মিথ্যার বেসাতির ডালা খোলা হয়েছিল জিয়াউর রহমান নিহত হওয়ার পর। বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা যে কাজ করেননি, তা অবলীলায় করলেন পরবর্তী বিএনপি নেতৃত্ব। অপ্রয়োজনে শুধু আওয়ামী লীগের মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দেওয়ার গৌরবময় ঐতিহ্যের সঙ্গে নিজ দলকে সংশ্লিষ্ট করার উদগ্র বাসনায় জিয়াউর রহমানকে স্বাধীনতার ঘোষক বানানো হলো। এ কাণ্ডে জিয়াউর রহমানের বিদেহী আত্মা নিশ্চয়ই বিস্মিত হয়েছিল। এমন আচরণ বিএনপি নেতৃত্বের হীনম্মন্যতারই বহিঃপ্রকাশ। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ভুলিয়ে দেওয়ার জন্য বিএনপি পাঠ্যপুস্তকে মুক্তিযুদ্ধের বাস্তব চিত্র ও বঙ্গবন্ধুর ভূমিকা ইত্যাদি বিকৃত করার ক্ষেত্রে নানা ভূমিকা রাখল।
আমরা জানি ঐতিহ্যহীন ভুঁইফোঁড় রাজনীতির কুশীলবরা প্রজ্ঞা ও দূরদর্শিতা দিয়ে সময়ের নানা বাঁকে বাস্তবতাকে গ্রহণ-বর্জনের ঔদার্যে দল পুনর্গঠন করে। আদর্শের রূপান্তর ঘটানোর স্থিতিস্থাপকতা থাকে। কিন্তু বারো রকমের নেতানেত্রীর দল বিএনপি কূটকৌশলী হতেও যেন ব্যর্থ হচ্ছে। রাষ্ট্রক্ষমতা মুখ্য হলেও সিংহাসনে অধিষ্ঠান নিষ্কণ্টক করার জন্য যে কখনো দম নিতে হয়, মোক্ষম সময়ের জন্য অপেক্ষা করতে হয়, বর্তমানের নেতৃত্ব সে অপেক্ষা করতে নারাজ। তাই স্থান-কাল-পাত্র বিবেচনা করতে না পেরে, নিজ দলকে জটিল সংকটে ফেলে দিচ্ছে।
কর্মী-সমর্থকের বিচারে বিএনপি এ দেশের অন্যতম বড় দল। এমন জনসমর্থনও বিএনপির স্বার্থবাদী দুর্বল নেতৃত্বকে আত্মবিশ্বাসী করে তুলতে পারেনি। জনগণকে নিয়ে ইতিবাচক রাজনীতি করার মতো সাহসী হতে পারেনি। তরুণ প্রজন্মের ভোটারকে আকৃষ্ট করতে চায়নি নিজ দলের দিকে। তাই মসনদে পৌঁছার জন্য বারবার জামায়াতে ইসলামীর ভোট গুনেছে। কিন্তু সে ভোটের অন্তর্জালাকে অনুভব করতে চায়নি।
আরও এক দশক আগের কথা বলছি। তখন থেকে আওয়ামী লীগ সরকারের বেসুরো হাঁটা, সুশাসন প্রতিষ্ঠায় নানা ব্যর্থতা, ছাত্রলীগ সন্ত্রাসের বাড়বাড়ন্ত ইত্যাদি আওয়ামী লীগকে অনেকটা ব্যাকফুটে ঠেলে দিয়েছিল। এ অবস্থাকে রাজনৈতিক প্রজ্ঞা দিয়ে ধারণ করতে পারেননি বিএনপি নেতৃত্ব। বুঝতে পারেননি জনদাবি। মানবতাবিরোধী অপরাধীদের বিচারের জন্য ট্রাইব্যুনাল গঠন করে এবং অপরাধীদের বিচারের মুখোমুখি করে ঘুরে দাঁড়ানোর পথ তৈরি করে ফেলেছিল আওয়ামী লীগ। এ বাস্তবতাকে মেনে নিয়ে জাতির সামনে নিজের স্বচ্ছ অবস্থান উপস্থাপনের একটি মহাসুযোগ এসেছিল বিএনপির সামনে। জামায়াতের সঙ্গে বন্ধুত্ব থেকে সরে আসার এ সুযোগ বিএনপির নিতে পারা ছিল একটি সাধারণ রাজনৈতিক প্রজ্ঞার পরিচয়। কিন্তু তেমন প্রজ্ঞার পরিচয় দিতে পারেননি বিএনপির নীতিনির্ধারকরা। সময়ের বাস্তবতায় আওয়ামী লীগের আর জামায়াতের দিকে মুখ ফেরানোর মতো ভুল করার সুযোগ ছিল না।
বিএনপি নেতৃত্বের বিশ্বাসের জায়গা দৃঢ় হয়েছিল যে, জামায়াতের সমর্থন ছাড়া আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে নির্বাচনের মাঠে হাঁটা কঠিন। তাই ছাড়তে পারেনি জামায়াতকে। এখন তো প্রেক্ষাপট পালটেছে। নিবন্ধন হারানো জামায়াত নির্বাচনের মাঠে কাজে লাগছে না। খুচরা বাম দলগুলোকে দলে ভিড়িয়েও স্বস্তি নেই। শুধু কণ্ঠশীলন ছাড়া ভোট পাওয়ার সামর্থ্য তেমন নেই এ দলগুলোর। আর তাই হতাশ বিএনপি নির্বাচন এলেই নানা ছুতোনাতায় নির্বাচন বর্জন করে যাচ্ছে।
এমন বাস্তবতায় নানা প্রেক্ষাপট তৈরিতে সক্রিয় থাকবেই বিএনপি। আওয়ামী লীগের বড় দুর্বলতাটি তো বিএনপির জানাই আছে। সুস্থ ও স্বচ্ছভাবে প্রকৃত গণতান্ত্রিক ধারায় নির্বাচন করছে না। সাধারণ ভোটারকে অনেকটা নির্বাচনবিমুখ করে তুলেছে। তাই গণতন্ত্রহীন দুর্বল রাজনৈতিক পরিবেশকে কাজে লাগিয়ে, দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্রের সঙ্গে যুক্ত হয়ে সরকার পতন ঘটানো ছাড়া বিএনপির হাতে তেমন বিকল্প নেই। না হলে পাঁচ বছর পর নির্বাচনি খেলায় আওয়ামী লীগ নিজেকে আরও শক্ত করে ফেলবে। তখন বিএনপি কী করবে! নির্বাচনে না গিয়ে নিবন্ধন হারাবে, নাকি নির্বাচনে গিয়ে ধরাশায়ী হবে!
ধরাশায়ী হওয়ার আশঙ্কা কেন করছি, আমরা অনেক আগে থেকেই লিখে আসছি, যৌক্তিক ও নিয়মতান্ত্রিক পথে হেঁটে দলকে পুনর্বিন্যাস করতে পারলে-তৃণমূল পর্যন্ত দলীয় তৎপরতা বাড়াতে পারলে এবং নেতৃত্বের জায়গাটি স্পষ্ট করতে পারলে, রাজনীতির অঙ্গনে বিএনপির শক্ত অবস্থানে দাঁড়ানো এখনো হয়তো সম্ভব। আওয়ামী লীগ যেভাবে দাম্ভিক হয়ে উঠেছে, কঠিন দলীয়করণে সাধারণ মানুষকে বিক্ষুব্ধ করে তুলছে, রাজনৈতিক স্বার্থ হাসিল করতে গিয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত করে তুলছে সমাজকে-এসব নেতিবাচক দিকগুলো কাজে লাগিয়ে, সুস্থ ধারার রাজনৈতিক দলের পক্ষে রাজনৈতিক মঞ্চের সামনের সারিতে এসে দাঁড়ানো কঠিন নয়। কিন্তু বিএনপির অতীত তেমন আত্মবিশ্বাস গড়ায় বড় বাধা হয়ে দাঁড়াবে। অতীত পাপের জন্য ক্ষমা কি চাইতে পারবে জনগণের কাছে?
এ কে এম শাহনাওয়াজ : অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
shahnawaz7b@gmail.com