বিরাজিত সংকট থেকে উত্তরণের পথ কী?
সাইফুল হক
প্রকাশ: ২৪ জুন ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
বাংলাদেশে গণতন্ত্র এখন এক শক্তিশালী প্রশ্নের সম্মুখীন। খাদের এ নিকষ কালো অন্ধকার কেবল আরও বাড়ছে। কেউই, কোনো পক্ষই এখানে হাঁটতে পারছে না। যারা হোঁচট খেয়ে খেয়ে চলার চেষ্টা করছেন, তাদের সামনেও কোনো গন্তব্য নেই, নেই কোনো আশা জাগানিয়া লক্ষ্য আর স্বপ্ন। এভাবে তারাও যে আর বেশিদূর যেতে পারবেন না, তা নিশ্চিতই বলা যায়।
সংকটের শুরু স্বাধীনতার উষালগ্ন থেকেই। ১৯৭০ সালে যে জনপ্রতিনিধিরা নির্বাচিত হয়েছিলেন পাকিস্তানি কাঠামোয়, সংবিধান প্রণয়নের জন্য তারাই আবার দায়িত্ব নিলেন স্বাধীন দেশের সংবিধান প্রণয়নের। মুক্তিযুদ্ধের পর দাবি উঠেছিল বিপ্লবী জাতীয় সরকার গঠনের। সেসব দাবি প্রত্যাখ্যাত হলো। যুদ্ধ করল সবাই, সরকার গঠন করল আওয়ামী লীগ একা। স্বপ্নভঙ্গের সেই শুরু। এরপর যত দিন গেছে, মুক্তিকামী মানুষের আশা হতাশায় আর স্বপ্ন দুঃস্বপ্নে পর্যবসিত হতে থাকে।
এ পরিস্থিতির মধ্যেই সমাজের অভ্যন্তরে এক দুর্বৃত্ত শ্রেণি গড়ে উঠতে থাকে। এরা রাষ্ট্রক্ষমতা ব্যবহার করে বেশুমার চুরি, দুর্নীতি আর যথেচ্ছ লুটপাটের মধ্য দিয়ে এদের প্রাথমিক পুঁজি গড়ে তোলে। সর্বগ্রাসী লুণ্ঠনের মধ্য দিয়ে গড়ে ওঠা এ দুর্বৃত্ত পুঁজি তার পুঞ্জীভবন ও কেন্দ্রীভবনের জন্য এমন এক রাজনৈতিক ও শাসনতান্ত্রিক কাঠামো চায়, যার জবাবদিহিতা, স্বচ্ছতা ও দায়বদ্ধতার কোনো বালাই নেই। এটি অস্বীকার করার উপায় নেই, কিছু ব্যতিক্রম বাদ দিলে গত ৫৩ বছরে ক্ষমতাসীন সরকার ও শাসকগোষ্ঠী এ নজিরবিহীন দুর্নীতি ও লুণ্ঠনের সহযোগী হয়েছে; হয়েছে তার মদদদাতা। বাস্তবে এরা দুয়ে এখন একাকার। লুটেরা-দুর্বৃত্ত এ শ্রেণি ও সরকারগুলোর মধ্যকার অশুভ মেলবন্ধনের কারণে মুক্তিযুদ্ধের ঘোষণা, এমনকি ’৭২-এর সংবিধানের সাম্যভিত্তিক গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক আদর্শের মূলনীতি ও অবস্থানের বিপরীতে রাষ্ট্রকে ঠেলে দেওয়া সহজ হয়েছে।
একটা রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে গড়ে ওঠা যে রাষ্ট্রব্যবস্থা গণতান্ত্রিক, মানবিক ও জবাবদিহিমূলক হওয়ার কথা ছিল, সেই রাষ্ট্রের ক্রমে চরম অগণতান্ত্রিক, কর্তৃত্বপরায়ণ ও নিপীড়নমূলক চরিত্র গ্রহণের রহস্য এখানেই। এভাবে রাষ্ট্র তার ঘোষিত লক্ষ্য থেকে যত বিচ্যুত হয়েছে, ততই তা জনবিচ্ছিন্ন দমনমূলক ফ্যাসিবাদী ব্যবস্থায় পর্যবসিত হয়েছে। একদলীয় বাকশালব্যবস্থা, সামরিক শাসন এ ব্যবস্থাকে আরও পাকাপোক্ত করেছে।
কিন্তু দেশের মানুষ গত সাড়ে পাঁচ দশকে নানা সময়ে এ ব্যবস্থার বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে, প্রতিরোধেও শামিল হয়েছে; মাঝে-মধ্যে সাময়িক বিজয়ও অর্জন করেছে; কিন্তু গোটা রাষ্ট্র ও শাসনব্যবস্থায় লুটেরা-দুর্বৃত্ত শ্রেণির একচ্ছত্র আধিপত্যের কারণে এর কোনোটাই টেকসই হয়নি। বরং এ সময়কালে দুর্বৃত্ত মাফিয়াগোষ্ঠী রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক কর্তৃত্বের পাশাপাশি রাজনৈতিক কর্তৃত্বও অনেকাংশে দখল করে নিয়েছে। ২০১৮ আর ২০২৪-এর নির্বাচনি তামাশার আগে ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানগুলো ও তাদের শীর্ষ নেতৃত্ব নজিরবিহীনভাবে প্রকাশ্যে ঘোষণা দিয়ে আওয়ামী লীগ সরকারের পক্ষে অবস্থান নেওয়ার আসল মাজেজা এখানেই। এদের এ অশুভ ও অনৈতিক গাঁটছড়া সমগ্র রাষ্ট্রব্যবস্থা ও সমাজকে বড় বিপদে নিক্ষেপ করেছে। ক্রমে এ বিপদ ঘনীভূত হয়ে রাষ্ট্র ফ্যাসিবাদের চেহারা নিয়েছে।
প্রকৃত প্রস্তাবে এ সংকট বিদ্যমান সমগ্র রাষ্ট্র ও সমাজব্যবস্থার অন্তর্নিহিত মারাত্মক সংকটেরই বহিঃপ্রকাশ। লুটেরা ও দুর্বৃত্তায়িত অর্থনীতি ও রাজনীতি এ সংকট কেবল আরও প্রকট করে তুলেছে। শাসনতান্ত্রিক ও নির্বাচনকেন্দ্রিক সংকট এর নির্দিষ্ট প্রকাশ মাত্র।
১৯৭১ সালে স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে নতুন রাষ্ট্রের দিশা হিসাবে সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার যে অঙ্গীকার ব্যক্ত করা হয়েছিল, তার ভিত্তি ছিল গণতন্ত্র ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ, জবাবদিহিমূলক গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক সংস্কৃতি। কিন্তু শাসকশ্রেণি তার বিপরীত দিকে, বলা চলে ১৮০ ডিগ্রি উলটো দিকে দেশকে নিয়ে গেছে।
দেশের বহুত্ববাদী গণতান্ত্রিক কাঠামো, প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ ভোটের ব্যবস্থা, বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচনের যেটুকু অবশিষ্ট ছিল, গত ১৫ বছর জোর করে সরকারে থাকতে গিয়ে আওয়ামী লীগ তা বিদায় করে দিয়েছে। যে আওয়ামী লীগ একসময় ভোটের অধিকারের জন্য রাজপথে নেমেছিল, ২০১৪ সালের পর থেকে সেই আওয়ামী লীগ কার্যত তার বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে। দেশ থেকে প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ নির্বাচনব্যবস্থা তারা তুলে দিয়েছে। নিবর্তনমূলক নানা কালাকানুনের মাধ্যমে জনগণের মতপ্রকাশের গণতান্ত্রিক অধিকার সংকুচিত করা হয়েছে।
আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে নির্বাহী বিভাগ, বিচার বিভাগ ও আইন প্রণয়ন বিভাগের মধ্যে যে যৌক্তিক ভারসাম্য থাকে, তাকে ধ্বংস করে দিয়ে প্রকারান্তরে সবকিছু নির্বাহী বিভাগের কর্তৃত্বে নিয়ে আসা হয়েছে। সাংবিধানিক ও গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে দুর্বল, ন্যুব্জ ও অকার্যকর করে তোলা হয়েছে। এভাবে প্রকারান্তরে গোটা রাষ্ট্রকেই তারা জনগণের বিরুদ্ধে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে রাজনৈতিকভাবে মোকাবিলা করতে না পেরে তাদের বিরুদ্ধে নির্মম দমন-নিপীড়ন ও রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস অব্যাহত রেখেছে।
আওয়ামী লীগ তার অবৈধ ও অনৈতিক শাসন প্রলম্বিত করতে গিয়ে আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীসহ রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ প্রায় সব প্রতিষ্ঠানের পেশাগত দক্ষতা, কার্যকারিতা ও নিরপেক্ষতা নষ্ট করে নানাভাবে তাদের দলীয় স্বার্থে ব্যবহার করছে। সরকারি দলকে ক্ষমতায় রাখার বিনিময়ে এদের যা খুশি তাই করার সুযোগ করে দেওয়া হয়েছে। রাষ্ট্রব্যবস্থায় একটা সংগঠিত দুর্বৃত্ত মাফিয়াগোষ্ঠীর একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণ ও আধিপত্য এখন চূড়ান্ত স্তরে উন্নীত হয়েছে। এ মাফিয়ারাই এখন দেশের অর্থনীতি ও রাজনীতির প্রধান নিয়ামক। এরা এখন দানবীয় শক্তি হিসাবে আবির্ভূত হয়েছে। এদেরই এক বড় অংশ এখন জাতীয় সংসদ থেকে শুরু করে স্থানীয় সরকারে কথিত জনপ্রতিনিধি হয়ে বসে আছে।
এভাবে সরকার ও সরকারি দল আওয়ামী লীগ জবরদস্তি করে ক্ষমতায় থাকতে গিয়ে অপার সম্ভাবনাময় দেশকে ক্রমে ব্যর্থ ও অকার্যকর করে তুলছে। দুঃখজনক হচ্ছে, যে দল একসময় ভোটের অধিকারসহ গণতন্ত্রের জন্য লড়াই করেছে, আজ তারাই ভোট, অবাধ নির্বাচন ও গণতন্ত্রের প্রধান প্রতিপক্ষ হয়ে দাঁড়িয়েছে; উদারনৈতিক গণতান্ত্রিক ধারার দল হিসাবে নিজেদের রাজনৈতিক মৃত্যু ঘটিয়েছে। নিয়মতান্ত্রিক গণতান্ত্রিক পথে সরকার পরিবর্তনের সুযোগও বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে এ অবরুদ্ধ কর্তৃত্ববাদী শাসনে দেশ ও দেশের জনগণের কোনো গণতান্ত্রিক ভবিষ্যৎ নেই।
এ একবিংশ শতাব্দীতে এভাবে কোনো দেশ চলতে পারে না। এ পরিস্থিতি থেকে দেশের গণতান্ত্রিক উত্তরণের প্রথম পদক্ষেপ হচ্ছে দেশের মানুষের ভোটের অধিকারসহ গণতান্ত্রিক অধিকার প্রতিষ্ঠা করা; অবাধ ও বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচনের ব্যবস্থা করা। ধ্বংস হয়ে যাওয়া নির্বাচনব্যবস্থা পুনর্গঠন করা। সমগ্র নির্বাচনিব্যবস্থার গণতান্ত্রিক সংস্কার সাধন করা। এ কারণেই বিরোধী দলগুলো সরকারের পদত্যাগের প্রশ্নকে সামনে নিয়ে এসেছে, যাতে দেশে একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের জন্য নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের রাস্তা প্রশস্ত করা যায়।
আর গণতান্ত্রিক উত্তরণের দ্বিতীয় পদক্ষেপ হচ্ছে সংগঠিত লুটেরা, মাফিয়া ও দুর্বৃত্তদের নিরঙ্কুশ নিয়ন্ত্রণে থাকা গোটা রাষ্ট্রব্যবস্থা ও সংবিধানের গণতান্ত্রিক সংস্কার নিশ্চিত করা। সংবিধানসহ যে রাষ্ট্রব্যবস্থা ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলকে জবাবদিহিহীন, স্বেচ্ছাচারী ও স্বৈরতন্ত্রী করে তোলে, রাষ্ট্রকে জনগণের বিরুদ্ধে নিয়ে যায়, সেই ব্যবস্থার পরিবর্তন করা এবং সর্বোপরি যে রাষ্ট্র জনগণের অধিকার ও নিরাপত্তার গ্যারান্টি না দিয়ে জনবিচ্ছিন্ন ঔপনিবেশিক ধারার দমনমূলক প্রতিষ্ঠানে পর্যবসিত হয়, তার আমূল পরিবর্তন সাধন করা।
আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে যে রাজনৈতিক দিশা ও সমঝোতার ভিত্তিতে স্বাধীন জাতিরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, গত পাঁচ দশকে তা পুরোপুরি ভেঙে দেওয়া হয়েছে। দেশ এখন এক অনিশ্চিত অন্ধকারে, ভয়াবহ বিপর্যয়ের মুখে। এ দেশ ও জনপদকে রক্ষায় এবং তার সম্ভাবনাময় গণতান্ত্রিক ভবিষ্যতের জন্য দরকার নতুন সমঝোতা, নতুন বোঝাপড়া।
বিদ্যমান গভীর সংকট থেকে বেরিয়ে আসতে সরকার ও সরকারি দলের কার্যকর ও বিশ্বাসযোগ্য রাজনৈতিক উদ্যোগ জরুরি। তারা যদি অচিরে এ উদ্যোগ নিতে পারেন, সেটা সবার জন্যই মঙ্গল। এ ব্যাপারে জাতীয় রাজনৈতিক নেতারা ও সংশ্লিষ্ট সবাই দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করবেন-এটাই কাম্য।
সাইফুল হক : সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশের বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি