অন্যমত
সরকারকে বৈদেশিক ঋণের ব্যাপারে সাবধান হতে হবে
আবু আহমেদ
প্রকাশ: ২১ জুন ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
গত ৬ জুন পৌনে ৫ লাখ কোটি টাকার বেশি কর আদায়ের লক্ষ্য নিয়ে ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেট জাতীয় সংসদে পেশ করেছেন অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী। এ বাজেটকে সাধুবাদ জানাতে পারছি না। কারণ, আমি এ বাজেটে আশাব্যঞ্জক কিছু দেখছি না। বর্তমান পরিস্থিতিতে এ বাজেটে আশাব্যঞ্জক কিছু দেখানো সম্ভবও নয়। কারণ, মিস ম্যানেজমেন্ট বা ব্যাড ম্যানেজমেন্ট যাই বলি না কেন, বাজেটের জন্য দুটি বিষয় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। এর একটি হচ্ছে ইনফ্লেশন বা মূল্যস্ফীতি আর অপরটি হচ্ছে সরকারি ঋণ। যেভাবে জ্যামিতিক আকারে সরকারি ঋণ বাড়ছে, সেটা আগামী দু’বছরে সরকার কীভাবে শোধ করবে, তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। সরকারের উচিত ছিল তার আকার ছোট রাখা এবং কম ব্যয় করা। কিন্তু সরকার সেটা করতে ব্যর্থ হয়েছে। ফলে যা হওয়ার তা-ই হয়েছে। অর্থাৎ সরকারের আকার বড় হওয়ায় খরচের পরিধি বৃদ্ধি পেয়েছে। এর ফলে অধিক হারে ঋণ করতে হয়েছে সরকারকে। সরকারের বিশাল অঙ্কের খরচ মেটানোর জন্য ট্যাক্সের ওপর অধিক হারে জোর দিতে হয়েছে। বেশি ট্যাক্স উঠাতে গিয়ে সরকার প্রত্যেক জায়গায় ৫ থেকে ১০ শতাংশ সুদ বাড়িয়ে দিয়েছে। কারণ, এ সুদ বাড়ানোর কথা আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) আগেই বলে দিয়েছে। আইএমএফের কথা তো আমাদের শুনতেই হবে; যেহেতু আইএমএফ আমাদের সম্ভবত কিস্তিতে ১ বিলিয়ন করে ডলার দিচ্ছে। আরেকটি কথা স্পষ্ট করে বলতে চাই, যেসব দেশের অর্থনীতিতে আইএমএফকে ডেকে আনা হয়েছে, তারা কেউই ঋণ থেকে আর উদ্ধার পায়নি। যেমন-পাকিস্তান, মিশর, নাইজেরিয়া, ল্যাটিন আমেরিকার বিভিন্ন দেশসহ অনেক রাষ্ট্র ওই ঋণের মধ্যে থেকেই হাবুডুবু খাচ্ছে। এদের কারোই ঋণের বোঝা কমেনি, বরং বেড়েছে। বাংলাদেশও সেই পথেই যাচ্ছে।
বাংলাদেশ কি বলতে পারবে, আগামী বছর আমাদের ঋণের বোঝা কমে যাবে, আমাদের ফরেন পেমেন্ট কম লাগবে, ফরেন এক্সচেঞ্জ বেড়ে যাবে? অর্থমন্ত্রী মহোদয় প্রকাশ্যে এ ধরনের বক্তব্য কি দিতে পারবেন? এ ধরনের বক্তব্য দেওয়ার মতো পরিবেশ বাংলাদেশ সরকারের আছে বলে মনে হয় না। বলতে গেলে অর্থনৈতিকভাবে আমরা একটা মহাদুর্যোগের দিকে যাচ্ছি। এটা দেশের জন্য অশনিসংকেত বলা যেতে পারে। সুতরাং, সরকারের আকার ছোট না করে এবং সরকারি ব্যয়ের লাগাম না টেনে এভাবে এগোতে থাকলে সামনে সমূহ বিপদের যথেষ্ট আশঙ্কা রয়েছে। তবে হ্যাঁ, দেশের এমন পরিস্থিতিতে কিছু লোকের কোনো অসুবিধা হবে না। তারা সম্পদের পালংকে বসে ভোগবিলাস, আনন্দ-আহ্লাদেই সময় পার করতে পারবেন। তারা কারা? যারা সরকারি পজিশনে আছেন, যারা সরকারের ফেভারড বিজনেস পারসন। তাদের কোনো অসুবিধা নেই। অসুবিধা হবে নিুমধ্যবিত্ত, গরিব ও নিুবিত্তদের। অর্থনৈতিক টানাপোড়েনের কশাঘাতে জর্জরিত হবে এসব নিুআয়ের মানুষ। সরকারের ছত্রছায়ায় থাকা কিছু লোকজনের কারণে বিদেশে অর্থ পাচারও বন্ধ হবে না। ব্যাংক লুট করাও বন্ধ হবে না। বন্ধ হবেই বা কী করে? কারণ ব্যাংক লুট তো পরিচালনা পর্ষদের মাধ্যমেই হচ্ছে।
হুন্ডির মাধ্যমে টাকা পাচার আগেও ছিল, সামনেও থাকবে। কারণ, দেশে কিছু অসচেতন, অসাধু, লোভী মানুষ যতদিন থাকবে, হুন্ডির প্রচলনও ততদিন থাকবে। কিন্তু যাদের হাত দিয়ে বিশাল অঙ্কের টাকা পাচার হচ্ছে, তাদের আটকাতে হবে। সরকারের আনুকূল্যে থেকে ব্যাংক ঋণের মাধ্যমে হাজার হাজার কোটি টাকা যারা বিদেশে পাচার করে যাচ্ছে, তাদের লাগাম টেনে ধরা সম্ভব। অনেক ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডে নিুমানের পণ্য সাপ্লাই দিয়ে কাজ সম্পন্ন করছে। অথচ তারা বিল-ভাউচার করছে উন্নত পণ্যের। এভাবে তারা সরকারের কাছ থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা বাগিয়ে নিয়ে বিদেশে পাচার করে দিচ্ছে। এ ধরনের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে চিহ্নিত করে আইনের আওতায় এনে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে। অনেক ধনী লোক সরকারি পজিশনে থেকে প্রজেক্ট করতে গিয়ে দুর্নীতি করে যাচ্ছে। এসব করে তারা ধনী হয়, তারপর সে অর্থও পাচার করে। সরকারের উচিত হবে বিভিন্ন প্রজেক্ট বা প্রকল্প করতে যে ধরনের সরকারি বিধিমালা আছে, সেগুলোকে আরও কঠোরতার আওতায় আনা এবং তদারকি বাড়ানো।
দেশের বিদ্যুৎ বিভাগ নিয়ে একটা শঙ্কা রয়েছে। কারণ, আমদানি করা বিদ্যুতের টাকা যদি ডলারে পরিশোধ করতে হয়, তাহলে সরকারকে অনেকটা বেকায়দায় পড়তে হবে। ভারতের আদানি গ্রুপের সঙ্গে চুক্তি অনুযায়ী সম্পূর্ণ টাকা মার্কিন ডলারে পরিশোধ করতে হবে। বিদ্যুৎ আর জ্বালানি আমদানিতে ৫ বিলিয়ন ডলার বাকি পড়েছে সরকারের। সুতরাং, সরকার সামনে বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর একটা চেষ্টা চালাবে। শেভরন বাংলাদেশে কাজ করছে। তাদের টাকাও ডলারে পরিশোধ করতে হবে। শেভরনের টাকা পরিশোধ করার জন্য আমেরিকানরা এসে চাপ দিয়ে যাচ্ছে। ছোট ছোট বিদেশি অনেক কোম্পানি আছে, যারা এখানে বিনিয়োগ করেছে, তারাও তাদের পাওনাটুকু ডলারের মাধ্যমেই নেবে। এভাবে দেশের রিজার্ভ থেকে অনেক টাকাই চলে যাবে। সবশেষে রিজার্ভ কোথায় গিয়ে দাঁড়ায়, সেটাই এখন দেখার বিষয়। এ অর্থনৈতিক সংকটের মধ্যেও নাকি এয়ার বাস (উড়োজাহাজ) কিনতে যাচ্ছে সরকার। কীভাবে কিনবে সেটা সরকারই ভালো জানে।
শেয়ারবাজারে মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা হিসাবে দেখা দিয়েছে এই বাজেট। কারণ, শেয়ারবাজারে যে সামান্য সুবিধাটুকু ছিল, এ বাজেটে সেটাও উঠিয়ে নেওয়া হয়েছে। আগে শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানি হলে ৭.৫ শতাংশ করপোরেট ইনকাম ট্যাক্স কম দিতে হতো, সেটাও কমিয়ে এখন ৫ শতাংশে নিয়ে আসা হয়েছে। এ ব্যাপারে নীতিনির্ধারকদের যখন জিজ্ঞাসা করা হয়েছে, তখন তারা তাদের মতো করে কুশলী উত্তর দিয়েছেন। করপোরেট ইনকাম ট্যাক্স কমানোর ফলে ভালো কোনো কোম্পানি শেয়ারবাজারে আসবে না। ট্যাক্স সুবিধা না পেলে তারা কেনই বা আসবে? শেয়ারবাজারে ২০০/৪০০ কোটি টাকার লেনদেন হয়তো হবে। তবে সেটার মধ্যে জুয়া চলে আসবে। কারণ, জুয়া খেলার লোকের তো আর অভাব নেই। সুযোগ বুঝে এসব জুয়াড়ি তাদের কার্যক্রম চালাবে। প্রকৃত অর্থে এ ধরনের জুয়ার লেনদেন শেয়ারবাজারের মধ্যে তেমন কোনো কাজ করবে না। ফলে এখান থেকে ভালো কোনো কোম্পানি অর্থ তুলতে পারবে না। ফলে ভালো কোম্পানিগুলো শেয়ারবাজারের বাইরেই থেকে যাবে। এর ওপর করপোরেট ইনকাম ট্যাক্সের বিষয়টি তো আছেই। উদাহরণস্বরূপ, দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম ওষুধ কোম্পানি কি শেয়ারবাজারে আছে? না, নেই। ইউনিলিভার, মূলত যারা সাবান-কসমেটিক্সের সরবরাহকারী, তারা কি শেয়ারবাজারে আছে? নেই। অথচ এই ইউনিলিভার হিন্দুস্তান লিভার হিসাবে ভারতে টপ টেন কোম্পানির মধ্যে আছে। শুধু তাই নয়, এ কোম্পানি পাকিস্তানে আছে, শ্রীলংকায় আছে। শুধু এখানে নেই। জাঙ্ক কোম্পানি দিয়ে কি শেয়ারবাজার দাঁড়াবে? না, দাঁড়াবে না। নেসলে থাইল্যান্ডে, ভারতে, পাকিস্তানে তালিকাভুক্ত কোম্পানি হিসাবে আছে। শুধু বাংলাদেশে নেই। কেন নেই? এটা আমাদের ব্যর্থতা। কতগুলো জাঙ্ক কোম্পানি দিয়ে ভর্তি করা হয়েছে শেয়ারবাজারের বোর্ডকে। বিমা খাতের ৭০ শতাংশের কোনো ব্যবসা নেই। তাদের প্রতারক কোম্পানি হিসাবে মানুষ মনে করে। কারণ তারা বিমার দাবি মেটাতে পারে না। এসব দুর্বল বিমা কোম্পানি দিয়ে শেয়ারবাজার কতদূর এগোতে পারবে তা বলাই বাহুল্য।
দেশের অর্থনীতির যে উজ্জ্বল চিত্রটা ছিল, সেটা দু-তিন বছর আগেই শেষ হয়ে গেছে। এখন সেটা নিভু নিভুর দিকে যাচ্ছে আর কী। আর এই নিভু নিভু অর্থনৈতিক অবস্থার মূল্য দেবে সাধারণ মানুষ। অর্থমন্ত্রীর কাছে কি কোনো ক্ষমতা বা ম্যাজিক আছে যে, ছয় মাস পর মূল্যস্ফীতি কমবে? মূল্যস্ফীতি বাড়বেই। আমি অর্থমন্ত্রীকে বলব, আপনি হিসাবটা করবেন ছয় মাস পরের মূল্যটা গত দু’বছর আগে কোথায় ছিল সে অনুযায়ী। তবেই বোঝা যাবে দেশের অর্থনৈতিক অবস্থাটা কোথায় গিয়ে দাঁড়িয়েছে।
৭ লাখ ৯৭ হাজার কোটি টাকার বাজেট হচ্ছে বিরাট আকারের বাজেট। এ বাজেট থেকেই সরকারের বিরাট অঙ্কের ঋণের সুদ দিতে হবে। সরকারের রেভিনিউ বাজেটের বিরাট অংশই সুদে চলে যাচ্ছে। ফলে আমাদের ফাইন্যান্সিয়াল ব্যালেন্স নেগেটিভ; যার কারণে ফরেন এক্সচেঞ্জ রিজার্ভের দ্রুত পতন ঘটছে। এর একমাত্র কারণ হচ্ছে, সরকারের ফরেন এক্সচেঞ্জে মাত্রাতিরিক্ত ঋণ গ্রহণ। সে ঋণের সুদ এখন কড়ায় গণ্ডায় দিয়ে যেতে হচ্ছে সরকারকে। সার্বিক চিত্র দেখে এখন আমাদের শঙ্কা তৈরি হয়েছে, সামনে আমরা আর কোনো বৈদেশিক ঋণ পাব কিনা। কারণ, আমাদের ফরেন এক্সচেঞ্জ রিজার্ভ যদি ১০ বিলিয়ন ডলারের নিচে নেমে আসে, তখন আমাদের কেউ আর ঋণ দেবে না। সুতরাং, সরকারকে সাবধান হতে হবে বৈদেশিক ঋণের ব্যাপারে।
আবু আহমেদ : অধ্যাপক ও অর্থনীতিবিদ