শতফুল ফুটতে দাও
বেনজীরকে নিয়ে আরও কিছু কথা
ড. মাহবুব উল্লাহ্
প্রকাশ: ২০ জুন ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
গত ১৩ জুন একটি দৈনিক পত্রিকা শিরোনাম করেছে, ‘সম্পদের খনি বেনজীর।’ এ পত্রিকার ভাষ্য অনুযায়ী, পুলিশের সাবেক আইজি বেনজীর আহমেদ যেন সম্পদের ‘খনি’। প্রতিদিনই কোনো না কোনো মাধ্যমে দুর্নীতি দমন কমিশনে আসছে বেনজীর ও তার পরিবারের অর্থ-সম্পদের তথ্য। সাবরেজিস্ট্রি অফিস ও ভূমি অফিস ছাড়াও ব্যক্তি পর্যায়ে অনেকেই স্বপ্রণোদিত হয়ে দুদকে এসে তথ্য দিচ্ছেন। আবার অনেকেই দুদকের হটলাইনে ফোন করেও তথ্য দিচ্ছেন। দুদক কর্মকর্তারা এসব তথ্যের দালিলিক প্রমাণ সংগ্রহ করে সেগুলো ক্রোক ও ফ্রিজের আদেশ পেতে আদালতে আবেদন করছেন। এমন অবস্থায় উপযুক্ত তথ্যের ভিত্তিতে গত ১২ জুন তৃতীয় দফায় বিপুল পরিমাণ অর্থ-সম্পদ ফ্রিজ ও ক্রোকের আদেশ দিয়েছেন আদালত। দুদকের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে, ঢাকা মহানগর দায়রা জজ মোহাম্মদ জগলুল হোসেন এ আদেশ দেন। এর আগে গত ২৩ ও ২৬ মে, ২০২টি দলিলে থাকা ৪টি ফ্ল্যাট ও ৬২১ বিঘা জমি ক্রোক এবং বিও অ্যাকাউন্টসহ ৩৭টি ব্যাংক অ্যাকাউন্ট ফ্রিজ করার নির্দেশ দেন আদালত। গত ১২ জুন ক্রোক ও ফ্রিজ আদেশ দেওয়া সম্পদগুলোর মধ্যে রয়েছে উত্তরায় ৩ কাঠার প্লট, মোহাম্মদপুরের আদাবরে পিসি কালচার সোসাইটিতে বেনজীরের ৬টি ফ্ল্যাট (স্ত্রী জিসান মির্জার নামে), বাড্ডায় ২টি ফ্ল্যাট, নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে ২৪ কাঠার প্লট, বান্দরবানে ২৫ একর জমি, সিটিজেন টিভির মালিকানা ও টাইগার অ্যাপারেল কোম্পানির (বায়িং হাউজ) শেয়ার মালিকানা।
এ নিয়ে ৩ দফায় বেনজীরের বিত্ত-সম্পদের ফিরিস্তি প্রকাশ হলো। সময় গড়ালে আরও কত ধরনের সম্পদের খবর প্রকাশ হবে, তা সৃষ্টিকর্তাই জানেন। বেনজীর দেশের সুনির্দিষ্ট স্থানে জমিজমা সংগ্রহ করে ক্ষান্ত হননি। বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে তার সম্পদের তথ্য উদ্ঘাটিত হচ্ছে। সাধারণ মানুষই এসব তথ্য উদ্ঘাটনে সহায়তা করছে। বেনজীর-কাণ্ড যতদিন ধরা পড়েনি, ততদিন লোকজন কিছু বলেনি। কারণ, এ রকম একজন শক্তিধর মানুষের বেশুমার সহায়-সম্পত্তি অর্জনের খবর প্রকাশ করে তারা ঝামেলায় পড়তে চাননি। যে মুহূর্তে মিডিয়া সাহস করে পুরো বিষয়টি তুলে ধরতে শুরু করল, তখন থেকেই সরকারের টনক নড়ল, দুদক সক্রিয় হলো। মানুষজনও আগ বাড়িয়ে তথ্য দিতে শুরু করল। যারা তথ্য দিচ্ছেন তারা সাহসী হয়েছেন দুদকের সক্রিয়তা দেখে। দুদক রাষ্ট্রের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান। রাষ্ট্রের তরফে, এ প্রতিষ্ঠানটি সক্রিয় হওয়ার পর সাধারণ মানুষ ভয়-ডরকে দূরে ঠেলে ফেলে বেনজীর সংক্রান্ত তথ্যাবলি যথাস্থানে তুলে ধরতে শুরু করল। দেখা গেল, রাষ্ট্র যদি অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়ায়, তাহলে সাধারণ মানুষও অন্যায়গুলো খুঁজে বের করতে এবং সেগুলো জনগণের গোচরে আনতে ভয় পায় না। দেশের প্রতিটি স্তরে সীমাহীন দুর্নীতি রয়েছে। অথচ এগুলো জনসমক্ষে কদাচিৎই প্রকাশ পায়। রাষ্ট্র একটু উদ্যোগী হলে দুর্নীতির তথ্য চাপা থাকে না, বেনজীর-কাণ্ডকে কেন্দ্র করে আমরা সেটাই লক্ষ্য করলাম। কথায় বলে বিপদ যখন আসে, তখন সবদিক থেকেই বিপদ হানা দেয়। বেনজীর তার ব্যতিক্রম নন।
বেনজীর সম্পর্কে একটি ভিন্ন মাত্রার খবর বেরিয়েছে ১৪ জুন শুক্রবারের একটি দৈনিকে। খবরটি দৈনিকের প্রথম পাতায় দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ সংবাদ হিসাবে ছাপা হয়েছে। এ সংবাদের শিরোনাম ছিল: ভর্তির যোগ্যতাই ছিল না, তবুও ডক্টরেট ডিগ্রি পান বেনজীর। এ সংবাদ থেকে জানা যায়, ২০১৯ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বেনজীর আহমেদ ডক্টরেট ডিগ্রি নেন। এরপর থেকে তিনি নামের আগে ডক্টর শব্দটি ব্যবহার করা শুরু করেন। উল্লেখ করার মত বিষয় হলো, গত কয়েক বছর ধরে দেখা যাচ্ছে, অনেক সামরিক ও বেসামরিক আমলা তাদের নামের সঙ্গে ডক্টর উপাধি ব্যবহার করেন। তারা রাষ্ট্রের যেসব দায়িত্ব পালন করেন, তার জন্য গবেষণাভিত্তিক ডক্টরেট ডিগ্রির প্রয়োজন নেই, তবুও তারা একটি ডক্টরেট ডিগ্রি জোগাড় করার জন্য উন্মুখ হয়ে পড়েন। এরা কী বিষয়ে ডক্টরেট ডিগ্রি করেছেন এবং এর জন্য প্রয়োজনীয় কোর্স রিকোয়ারমেন্ট ও রেসিডেন্সি রিকোয়ারমেন্টের শর্ত পূরণ করেছেন কিনা, জানা যায় না। সর্বোপরি ডক্টরেট ডিগ্রি করার সময় তারা শিক্ষা ছুটিতে ছিলেন কিনা এবং ন্যূনতম সময় বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন কিনা, সে সম্পর্কে সামান্যই জানা যায়। যে কোনো ব্যক্তি উচ্চতর শিক্ষা গ্রহণ করলে তা দেশের মানবসম্পদকে সমৃদ্ধ করে। সেদিক থেকে সামরিক ও বেসামরিক আমলাদের ডক্টরেট ডিগ্রি করার হিড়িক দেখে অখুশি হওয়ার কিছু নেই। তারা যদি সত্যিকারের শ্রম ও সাধনা দিয়ে ডিগ্রি অর্জন করে থাকেন, তা নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয়। পাকিস্তান আমলে মেধাবী ছাত্ররা সিএসএস পরীক্ষা দিয়ে সিএসপি অফিসার হতো। এদের মধ্যে অনেকেই ছিলেন ডাকসাইটে আমলা। তবে তাদের জ্ঞানগণ্ডি কম ছিল না। পাকিস্তান আমলে এসব অফিসারদের দু’একজন বাদে কেউ ডক্টরেট ডিগ্রি করার প্রয়োজন বোধ করেননি। তবে বাংলাদেশোত্তরকালে যেসব তরুণ সিএসপি অফিসার সরকারি দায়িত্বে নিয়োজিত ছিলেন, তাদের মধ্যে বেশ কিছু সংখ্যক অফিসার ডক্টরেট ডিগ্রি করেছেন। তারা এ ডিগ্রি অর্জন করেছেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা ও ব্রিটেনের বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। তাদের ডিগ্রির ওজন ও মূল্য নিয়ে কখনোই প্রশ্ন ওঠেনি। তাদের উচ্চতর ডিগ্রি থাকায় দেশ লাভবান হয়েছে।
বেনজীর আহমেদ ডক্টরেট ডিগ্রি নিয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবসায় শিক্ষা অনুষদের ডক্টর অফ বিজনেস অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (ডিবিএ) প্রোগ্রাম থেকে। সেখানে ভর্তির জন্য স্নাতক ডিগ্রি থাকতে হয়। শিক্ষাজীবনের সব পাবলিক পরীক্ষায় কমপক্ষে পঞ্চাশ শতাংশ নম্বর পেতে হয়। বেনজীরের তা ছিল না। বেনজীরের ভর্তির ক্ষেত্রে, মৌলিক শর্তগুলো শিথিল করা হয়েছিল ব্যবসায় শিক্ষা অনুষদের তৎকালীন ডিনের সুপারিশে। তিনি ছিলেন বেনজীরের ‘ডক্টরেট’ প্রোগ্রামের তত্ত্বাবধায়ক। ভর্তি ও ডিগ্রি পাওয়ার সময় বেনজীর ছিলেন র্যাবের মহাপরিচালক। ভর্তির শর্ত শিথিলের ক্ষেত্রে বেনজীরের পদ বিবেচনায় নেওয়া হয়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবসায় প্রশাসন ইন্সটিটিউটে (আইবিএ) আগে থেকে ডক্টর অব বিজনেস অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (ডিবিএ) প্রোগ্রাম চালু ছিল। ব্যবসায় শিক্ষা অনুষদ একই প্রোগ্রাম চালুর অনুমোদন পায় ২০১৩ সালের সেপ্টেম্বরে। বেনজীর ছিলেন ওই প্রোগ্রামের প্রথম ব্যাচের শিক্ষার্থী। তার ডক্টরেট ডিগ্রি পাওয়া নিয়ে ওই সময় র্যাবের বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছিল, বেনজীর প্রথম ব্যাচের প্রথম শিক্ষার্থী হিসাবে ডিগ্রিটি অর্জন করেন। বেনজীরের গবেষণার বিষয় ছিল ‘আমাদের জাতীয় অর্থনীতিতে বাংলাদেশের জাতিসংঘ শান্তি রক্ষা বাহিনীর অবদান।’
বেনজীর ১৯৭৮ সালে দ্বিতীয় বিভাগে এসএসসি সমমানের পরীক্ষায় পাশ করেন। ১৯৮০ সালে সরকারি জগন্নাথ কলেজ থেকে দ্বিতীয় শ্রেণি পেয়ে এইচএসসি সমমানের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। বেনজীরের ঢাকা বিশ্ববিদ্যায় থেকে দেওয়া বিএ পাশ ডিগ্রি আছে (১৯৮২)। এ ডিগ্রি অর্জনের জন্য তাকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত একটি কলেজে ভর্তি হতে হয়েছিল। বিএ পাশ সনদ অনুযায়ী বেনজীর মোট ১ হাজার ১০০ নম্বরের মধ্যে ৫১৭ পেয়েছেন। অর্থাৎ তিনি ৫০ শতাংশ নম্বর পাননি। কিন্তু ডিবিএ প্রোগ্রামের ভর্তির আবেদনে তিনি উল্লেখ করেছেন, তিনি ডিগ্রি বা সমমানের পরীক্ষায় মোট ৫০০ নম্বরের মধ্যে ৩০১ নম্বর (৬০ শতাংশ) পেয়েছেন। তার বিএ পাশ সনদে সাল উল্লেখ করা হয় ১৯৮২। বিবিএর আবেদনে সাল বলা হয়েছে ১৯৮৩। এ সালের সঙ্গে মিলিয়ে কোনো সনদ জমা দেননি তিনি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের সনদ অনুযায়ী বেনজীর ১৯৮৪ সালে ৫০০ নম্বরের মধ্যে ২২৯ পেয়ে (প্রায় ৪৬ শতাংশ) দ্বিতীয় শ্রেণি পেয়ে স্নাতকোত্তর উত্তীর্ণ হন। অর্থাৎ তিনি ৫০ শতাংশ নম্বর পাননি। ভর্তির আবেদনে তিনি স্নাতকোত্তরে মোট নম্বর দেখিয়েছেন ৫০০-এর পরিবর্তে ৪০০। মানে হলো, পরীক্ষার মোট নম্বর কম দেখিয়ে তিনি ডক্টরেট প্রোগ্রামে ভর্তির শর্ত পূরণের চেষ্টা করেছিলেন। এসব তথ্য বেরিয়ে এসেছে একটি বহুল প্রচারিত দৈনিকের অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার সুবাদে। দেখা গেছে, এর আগে তথ্য গোপন রেখে তিনি পাসপোর্ট নিয়েছিলেন। সরকারের খুবই উঁচু পদে থেকে কোনো কর্মকর্তা যদি তার নিজের সম্পর্কে তথ্য গোপন করেন অথবা ভুল তথ্য দেন, তা রাষ্ট্রের জন্য যে কত বড় ঝুঁকির ইঙ্গিত দেয়-তা সহজেই অনুমেয়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ শর্ত শিথিল করে বেনজীর আহমেদকে ডিবিএ প্রোগ্রামে ভর্তির সুযোগ দিয়ে যেভাবে ডিগ্রি অর্জনের সুযোগ করে দিয়েছে, তা অত্যন্ত দুঃজনক। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাসঙ্গিক পর্ষদে বিষয়টি অনুমোদিত হলেও, একে কোনো মতেই নৈতিকভাবে অনুমোদন করা যায় না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আমার প্রাণপ্রিয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। এ বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করার সুযোগ আমারও হয়েছে। এ বিশ্ববিদ্যালয় সম্পর্কে কোনো নেতিবাচক সংবাদ প্রকাশিত হলে খুবই দুঃখবোধ হয়। শুধু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় নয়, বাংলাদেশের অন্যান্য অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে এ রকম অনিয়মের ঘটনা থাকতে পারে। আমাদের উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর গুণে ও মানে যে ধস নেমেছে, তার জন্য কারও মুখের দিকে তাকিয়ে অথবা কারও পদমর্যাদার দিকে তাকিয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ মেনে নেওয়া যায় না। আশা করি, সবার সম্বিৎ ফিরবে; উচ্চতর শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো নিয়ম-নীতি বজায় রেখে শিক্ষার গুণমান উন্নত করতে প্রয়াসী হবে।
ড. মাহবুব উল্লাহ : শিক্ষাবিদ ও অর্থনীতিবিদ