ঋণখেলাপিরা সমাজে এত সমাদৃত কেন?
ড. ইফতেখার উদ্দিন চৌধুরী
প্রকাশ: ১৩ জুন ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
সভ্য সমাজের ইতিহাস পর্যালোচনায় দেখা যায়, যে কোনো ধরনের অপরাধই শাস্তিযোগ্য। বাংলাদেশের সংস্কৃতি একটি প্রশংসনীয় জায়গায় ছিল। অপরাধী যেই হোক না কেন, আইনের শাসন সুরক্ষায় তার বিচার অবধারিত ছিল। স্বাধীনতার অব্যবহিত পর থেকেই চোরাকারবার-মজুতদারি-দুর্বৃত্তায়ন দেশে অসহনীয় পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছিল। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর দূরদর্শী চিন্তা-চেতনা বরাবরই জনগণের সুখ-সমৃদ্ধির লক্ষ্যেই স্থির ছিল। এর মূলে ছিল অসাম্প্রদায়িক, সমাজতান্ত্রিক ও মানবিক রাষ্ট্রব্যবস্থা। জনকল্যাণমুখী রাষ্ট্র-সমাজব্যবস্থার টেকসই সমৃদ্ধি নিশ্চিতে বঙ্গবন্ধু গণবিরোধী কার্যক্রমকে উন্নয়নের প্রতিবন্ধকতা হিসাবে বিবেচনা করেছেন। রাষ্ট্রযন্ত্রের সব ক্ষেত্রে দুর্নীতিমুক্ত শাসন পরিচালনায় তার অঙ্গীকার ছিল নিখাদ। দুর্নীতি নির্মূলে বঙ্গবন্ধুর নির্দেশনা ছিল অত্যন্ত যৌক্তিক, যুগোপযোগী এবং খোলামেলা। অকপটেই তিনি এসব বিষয়কে জনগণের সম্মুখে প্রকাশ করতেন এবং এর প্রতিকারে সহযোগিতার আহ্বান করেছেন।
ঘুস-সুদ, মজুতদারি, চোরাকারবারি, চোরাচালানি, অন্যের জমি-বাড়ি দখল ইত্যাদির বিরুদ্ধে বঙ্গবন্ধু কঠোর ভাষায় বহুবার সাবধান করেছেন। তাদের আইনের আওতায় আনার হুঁশিয়ারি উচ্চারণও ছিল অতি জোরালো। ১৯৭২ সালে ঐতিহাসিক ৭ জুন সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে প্রদত্ত ভাষণে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘তাদের হুঁশিয়ার করে দিয়ে বলতে চাই, যারা শহরে সরকারি বাড়ি, গাড়ি দখল করে আছো, যারা দোকান বা অন্যের জমি দখল করে আছো, যারা মজুত করছো, জিনিসপত্র বিক্রয় করছো না, জিনিসের দাম বাড়ানোর চেষ্টা করছো, তাদের রেহাই নেই। আমি ভিক্ষা করে দুনিয়ার নানা দেশ থেকে জিনিসপত্র আনছি আমার গরিব-দুঃখীদের জন্য। সেই জিনিস যারা লুটপাট করে খাচ্ছো, তাদেরও রক্ষা নাই।’ ২৫ জানুয়ারি ১৯৭৫ সালে জাতীয় সংসদে প্রদত্ত ভাষণে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘আজ দুর্নীতিবাজ, ঘুসখোর, কালোবাজারি, নতুন পয়সাওয়ালা-এদের কাছে আমার আত্মা বিক্রি করতে হবে, অধিকারের নামে আমাদের এদের ফ্রিস্টাইলে ছেড়ে দিতে হবে-কখনো না। কোনো দেশ কোনো যুগে তা দেয়নি। দিতে পারে না। যারা আজকে আমার মাল বিদেশে চালান দেয়, চোরাকারবারি করে, যারা দুর্নীতি করে, এদের বাংলার মাটি থেকে উৎখাত করতে হবে।’
বর্তমান প্রেক্ষাপট বিশ্লেষণে চোরাকারবারি-মজুতদারিদের বেপরোয়া অভিপ্রায় সহজেই অনুমেয়। সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন সংস্থার কতিপয় কর্মকর্তা বা অসাধু রাজনীতিকদের পৃষ্ঠপোষকতা তাদের শক্তির মূল উৎস রূপে প্রতিষ্ঠিত। সিন্ডিকেট কারসাজিতে অত্যন্ত সিদ্ধহস্ত এসব মাফিয়াচক্র পুরো দেশকেই জিম্মি করে ফেলেছে। নিত্যপণ্যের দাম বাড়ানো, অবৈধ আমদানি-রপ্তানি, অর্থ পাচার, ঋণখেলাপি, অসৎ ঠিকাদারি এমন কোনো হীন কাজ নেই, যাতে তারা সংশ্লিষ্ট নয়। অর্থলোভী হিংস্র দানবরূপী এসব মানুষ কেন জানি সবার কাছে প্রিয়। মসজিদ-মন্দির-স্কুল-কলেজ-দাতব্যচিকিৎসালয় নির্মাণ, আর্তমানবতার সেবা ইত্যাদি কর্মযজ্ঞে তাদের আসল চরিত্র আড়ালে চলে যাচ্ছে। অনৈতিক-অবৈধ রাজনীতির ক্ষমতা দখলের কদর্য সংঘাত প্রতিনিয়তই জনগণ উপলব্ধি করতে পারছে। শহর-বন্দর-গ্রামীণ জনপদ ও দেশের প্রতিটি অঞ্চলে তাদের স্বরূপ উন্মোচন নৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। নানা গর্হিত পন্থায় উপার্জিত অর্থ দিয়ে সবকিছু তারা দখলে নিচ্ছে। যখন যেখানে যাকে দরকার, তাকে ম্যানেজ করে চলছে।
সম্প্রতি প্রস্তাবিত বাজেটে ১৫ শতাংশ কর প্রদান করে কালোটাকা সাদা করার সুযোগে ঘুস-দুর্নীতিকে কোন যুক্তিতে বৈধ করা হচ্ছে, তা মোটেও বোধগম্য নয়। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, আইন-আদালত-আইনজীবী প্রায় সবকিছুই তাদের অর্থের কাছে পরাভূত। বাহিনীভিত্তিক বড় ভাইয়ের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে কিশোর গ্যাং গঠন, মাদক-অস্ত্র ব্যবসা এর অন্তর্ভুক্ত। বহুতল ভবন নির্মাণ, বড় মাপের সরকারি-বেসরকারি অবকাঠামো নির্মাণ, জলাশয় ভরাট করে ইটভাটা-শিল্প স্থাপনে এদের ভূমিকা চোখে পড়ার মতো। ইত্যবসরে সাধারণ মানুষ হারাতে বসেছে সৎ উপায়ে কষ্টার্জিত জমি-ধনসম্পদ-পুকুর-জলাশয়-দোকান-ক্ষুদ্রব্যবসা ইত্যাদি প্রায় সবকিছু। নিরীহ জনগণ চরম হতাশাগ্রস্ত হয়ে শুধু নির্বাক তাকিয়ে থাকছে। অর্থ-ক্ষমতার প্রভাবের কাছে তারা সম্পূর্ণ নতিস্বীকারে বাধ্য হচ্ছে। প্রায় প্রতিদিনই প্রচার-সংবাদমাধ্যমসমূহের চিত্রে মানুষের হাহাকার-আর্তনাদ-কাতরতা প্রকাশিত হচ্ছে। সামান্য প্রতিবাদ করার বাকশক্তিও হারাতে বসেছে মানুষ। ফলাও করে তাদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন সংস্থার কার্যক্রম প্রায়ই পরিচালিত হচ্ছে। এতসব উদ্যোগ কোনোভাবেই দুর্বৃত্তায়নকে রোধ করতে পারছে বলে মনে হয় না। কার্যকর কোনো আইনি ব্যবস্থা এদের বিরুদ্ধে পরিলক্ষিত নয়। পক্ষান্তরে অনেক ক্ষেত্রে নির্দোষ-অসহায়-নিরীহকে নানা কারসাজিতে ফাঁসিয়ে দেওয়া হচ্ছে।
জনশ্রুতি মতে, এদের অধিকাংশই ঋণখেলাপি। অনিয়ম-কেলেংকারি-দুর্বল করপোরেট গভর্ন্যান্স ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের যথাযথ পর্যবেক্ষণের অভাবে ঋণখেলাপি বেড়েছে। ৬ জুন গণমাধ্যমে প্রকাশিত বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের মার্চ পর্যন্ত তিন মাসে ৩৬ হাজার ৩৬৭ কোটি বেড়ে দেশের ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ৮২ হাজার ২৯৫ কোটি টাকায়; যা পূর্বের তিন মাসের তুলনায় ২৫ শতাংশ বেশি। ২০২৩ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ১ লাখ ৪৫ হাজার ৬৩৩ কোটি টাকা। ২০২৪ সালের মার্চ পর্যন্ত মোট বিতরণকৃত ঋণ ছিল ১৬ লাখ ৪০ হাজার কোটি টাকা। বর্তমানে বিতরণকৃত ঋণের ১১ দশমিক ১১ শতাংশই খেলাপি ঋণে পরিণত হয়েছে। প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, রাষ্ট্রপরিচালিত বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর বিতরণকৃত ৩ লাখ ১২ হাজার ২৬৬ কোটি টাকা ঋণের বিপরীতে মার্চ ২০২৪ পর্যন্ত খেলাপি হয়েছে ৮৪ হাজার ২২১ কোটি টাকা। সর্বাপেক্ষা বেশি মন্দ ঋণ কেলেংকারিতে ক্ষতিগ্রস্ত জনতা ব্যাংক। যার পরিমাণ ৩০ হাজার ৪৯৫ কোটি টাকা। এটি মোট বিতরণ করা ঋণের ৩১ শতাংশ। অগ্রণী ব্যাংকের মন্দ ঋণ ২০ হাজার ৮৬৪ কোটি টাকা বা বিতরণকৃত ঋণের ২৮ শতাংশ। বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর মন্দ ঋণ ৮৮ হাজার ৯০০ কোটি টাকা, যা তাদের বিতরণ করা ঋণ ১২ লাখ ২১ হাজার ১৬৬ কোটি টাকার ৭ দশমিক ২৮ শতাংশ। এছাড়া বিদেশি বাণিজ্যিক ব্যাংক ও বিশেষায়িত ব্যাংকগুলোতে তাদের বিতরণকৃত ঋণের বিপরীতে খেলাপি ঋণ যথাক্রমে ৫ দশমিক ২০ ও ১৩ দশমিক ৮৮ শতাংশ।
অর্থনীতিবিদদের মতে, যদি অবলোপনকৃত-পুনঃনির্ধারিত ঋণ এবং আদালতে নিষেধাজ্ঞা আছে এমন ঋণ বিবেচনা করা হয়, তবে মন্দ ঋণের প্রকৃত পরিমাণ হবে ৫ লাখ কোটি টাকার বেশি। বাংলাদেশ পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক গণমাধ্যমে বলেন, ‘খেলাপি ঋণের এ পরিসংখ্যান নতুন নয়। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) শর্তের কারণে এটি এখন সামনে এসেছে। প্রায় ২৫ শতাংশ ঋণ খেলাপি হয়েছে। এতে মন্দ ঋণের পরিমাণ দাঁড়াবে প্রায় ৪ লাখ কোটি টাকা। অনেক মন্দ ঋণ আছে, যেগুলো এখনো প্রকাশ হয়নি। ভবিষ্যতে সেগুলো প্রকাশ করা হবে। উচ্চ মন্দ ঋণের কারণে ব্যাংকিং খাত দুর্বল হয়ে পড়েছে এবং ভালো ঋণগ্রহীতাদের ওপর এর প্রভাব পড়ছে।’ ব্যাংকসংশ্লিষ্টদের দাবি, একদিকে বর্তমান অর্থনৈতিক অবস্থার অজুহাত দেখিয়ে ঋণগ্রহীতাদের মধ্যে ঋণ পরিশোধ থেকে বিরত থাকার প্রবণতা বৃদ্ধি পেয়েছে, অপরপক্ষে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর বেশিরভাগ ঋণই অনিয়ম ও জালিয়াতির মাধ্যমে নেওয়া হয়েছে। তাই সেসব ঋণ আদায় করা কঠিন। তাছাড়া ২০২৩ সালের ডিসেম্বরে খেলাপি ঋণ কম দেখাতে বাছবিচার ছাড়াই ঋণ পুনঃতফসিল করা হয়। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রার্থী হতেও অনেক ঋণখেলাপি পুনঃতফসিলের আশ্রয় নেয়।
ঋণ পুনঃতফসিলের ক্ষেত্রে প্রচলিত নিয়ম ছিল ব্যাংকগুলো নিজ পর্ষদে এ সংক্রান্ত প্রস্তাব পাশ করে সেটি অনুমোদনের জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংকে পাঠাবে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক যাচাই-বাছাইয়ের পর ঋণ পুনঃতফসিলের সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত করবে। কিন্তু ২০২৩ সালের জুলাই মাসে প্রজ্ঞাপন জারি করে সে ক্ষমতা সংশ্লিষ্ট ব্যাংকগুলোর হাতে ছেড়ে দেওয়া হয়। ফলে ব্যাংকগুলো নিজেদের ইচ্ছামতো ঋণ পুনঃতফসিলের সুযোগ পায়। খাতসংশ্লিষ্ট অনেকেই কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এ উদারনীতিকে খেলাপি ঋণ পুনঃতফসিলে উল্লম্ফনের প্রধান কারণ হিসাবে বিবেচনা করছেন। প্রসঙ্গত, বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন বলেছেন, ‘দেশের ব্যাংক খাতের সুশাসন অনেক আগেই ভেঙে পড়েছে। ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ ও ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষের যোগসাজশে ঋণের নামে জনগণের অর্থ লুণ্ঠন করা হচ্ছে। এ কারণে পুনঃতফসিল নীতিমালা সহজ করা সত্ত্বেও ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব হচ্ছে না। দেশের ব্যাংকগুলোয় দৃশ্যমান খেলাপি ঋণের চেয়ে ধামাচাপা দেওয়া খেলাপি ঋণ অনেক বেশি। ব্যাংক খাত ভঙ্গুর হয়ে পড়ার প্রভাব অর্থনীতির সবক্ষেত্রে এখন দৃশ্যমান।’ যদিও সরকারের নির্দেশনা অনুযায়ী, বাংলাদেশ ব্যাংক ২০২৬ সালের মধ্যে মন্দ ঋণ রাষ্ট্রপরিচালিত ব্যাংকগুলোতে ১০ এবং বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলাতে ৫ শতাংশে নামিয়ে আনার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে। এ নীতির কার্যকারিতার ওপর নির্ভর করছে খেলাপি ঋণ অপসংস্কৃতির মডেল রচনা। মোদ্দাকথা, চিহ্নিত ঋণখেলাপিদের অনৈতিক পন্থায় পদ-পদক-পদায়ন অর্জন জনসম্মুখে প্রচার অতি জরুরি হয়ে পড়েছে। তাতে দুর্ভাগা জনগণ এদের কুৎসিত চরিত্র সম্পর্কে যৎসামান্য অবহিত হবে। সমাদরের বিপরীতে সমাজ এদের ঘৃণার চোখে দেখলে কিছুটা হলেও এর প্রতিকার হতে পারে।
ড. ইফতেখার উদ্দিন চৌধুরী : শিক্ষাবিদ; সাবেক উপাচার্য, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়