মূল্যস্ফীতি কমানো যদি এত সহজ হতো!
হাসান মামুন
প্রকাশ: ১২ জুন ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
আগামী ছয় মাসে মূল্যস্ফীতি কোথায় গিয়ে দাঁড়ায়, তা দেখার জন্য দেশের সিংহভাগ মানুষ বোধহয় অপেক্ষা করে নেই। দীর্ঘ সময় ধরে যে অভিজ্ঞতা, তাতে কারও আশ্বাসে আস্থা রাখার সুযোগ তাদের আছে বলেও মনে হয় না। মূল্যস্ফীতি আরও বাড়ে কি না, সে আশঙ্কা নিয়েই তারা আছে বোধহয়। প্রস্তাবিত বাজেটে মূল্যস্ফীতি কমিয়ে আনার যে লক্ষ্যমাত্রা ঘোষিত হয়েছে, সেটার পক্ষে বক্তব্য নেই বললেই চলে। মানুষ তো দেখেছে, চলতি অর্থবছরে লক্ষ্যমাত্রা এক শতাংশ (সাড়ে ছয় থেকে সাড়ে সাত) বাড়িয়েও মূল্যস্ফীতিকে এর ধারেকাছেও নামানো যায়নি। টানা ১৫ মাস একটা দেশে মূল্যস্ফীতি ৯ শতাংশের বেশি! প্রকৃত হিসাবে এটা আরও উপরে। খাদ্য মূল্যস্ফীতি আরও বেশি। গরিবের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য মূল্যস্ফীতি হবে আরও বেশি-যে হিসাব করা হচ্ছে না!
মূল্যস্ফীতি কমাতে না পেরে আবার কিছু ‘ভুল তথ্য’ পরিবেশন করা হচ্ছে। সারা দুনিয়াতেই নাকি মূল্যস্ফীতি বেশি! এটা ঠিক, অনেক দেশেই মূল্যস্ফীতি বেড়ে গিয়েছিল কোভিড থেকে বিশ্ব অর্থনীতি বের হওয়ার মুহূর্তে রাশিয়ার ইউক্রেন আক্রমণের পর। জরুরি পণ্যের সরবরাহ কোনো এক গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টে ব্যাহত হলে এর প্রভাব কত তীব্র হতে পারে, সেটা আমরা তখন দেখেছিলাম। এর সঙ্গে পালটা সামরিক, বাণিজ্যিক পদক্ষেপও সরবরাহ ব্যবস্থার অবনতি ঘটিয়ে বিশ্ববাজারকে অস্থিতিশীল করে তোলে। এর বিরাট প্রভাব পড়ে মূলত আমদানিনির্ভর দেশগুলোয়। বাংলাদেশ স্বভাবতই এটা এড়াতে পারেনি। সন্দেহ নেই, এই একক কারণেই এখানে দীর্ঘদিন স্থিতিশীল থাকা মূল্যস্ফীতি বেড়ে যেতে থাকে। কিন্তু বিশ্ববাজারের সেই পরিস্থিতি কি এখনো বিরাজমান? আর ‘ইউক্রেন যুদ্ধের’ প্রভাবে বেড়ে যাওয়া মূল্যস্ফীতি কমাতে কি আমাদের মতোই ব্যর্থ অবস্থায় রয়েছে সবাই? ইন্টারনেটে প্রাপ্ত তথ্য-উপাত্ত কী বলে? সেটা এই বলে যে, এরই মধ্যে বিশ্ববাজার অনেকখানি স্থিতিশীল হয়ে এসেছে এবং উন্নত, উন্নয়নশীল ও স্বল্পোন্নত নির্বিশেষে যারাই মূল্যস্ফীতি কমিয়ে আনার দৃঢ় পদক্ষেপ নিয়েছিল, তারা কমবেশি সুফল পেয়েছে। ঘরের কাছে বহুল আলোচিত শ্রীলংকা এক্ষেত্রে সবচেয়ে ভালো উদাহরণ বলে বিবেচিত হবে নিশ্চয়।
ইউক্রেন যুদ্ধসহ বাইরের ঘটনাবলির প্রভাবেই কেবল এখানে মূল্যস্ফীতি বাড়ছে-এমন একটা বয়ান বহাল রাখার চেষ্টাও লক্ষণীয়। দেশের ভেতরকার ব্যবস্থাপনা যেন পুরোপুরি ঠিক ছিল এবং আছে। কৃষিসহ পণ্য উৎপাদন পরিস্থিতি, সেবার সরবরাহ ও এর বাজার ব্যবস্থাপনা নিয়ে প্রশ্ন কিন্তু অনেক পুরোনো। আজও মূল্যস্ফীতি কমিয়ে আনতে কোনো একটা পদক্ষেপ নেওয়া হলে প্রশ্ন ওঠে, বাজার ব্যবস্থাপনায় নতুন কী করবেন? প্রচলিত ব্যবস্থাপনায় কর-শুল্কে ছাড় দিলেও দেখা যায় সরকার রাজস্ব হারাচ্ছে এবং ভোক্তা এর সুফল পাচ্ছে না। প্রস্তাবিত বাজেটে সরকার যে উল্লেখযোগ্যসংখ্যক নিত্যপণ্যের উৎসে কর অর্ধেক ছাড় দিয়েছে, তার সুফল ভোক্তার বদলে ব্যবসায়ীরাই পাবে বলে কথা উঠেছে এরই মধ্যে। এ নিবন্ধ ছাপা হতে হতে কুরবানির পশুর হাট বসতে শুরু করবে। প্রতিবারের মতো বিপুল অর্থের লেনদেন হবে এ খাতে। কিন্তু এর ব্যবস্থাপনাগত গলদগুলো দূর করার কোনো দৃশ্যমান পদক্ষেপ কি রয়েছে? গরু-ছাগলের দেশময় সরবরাহটাও কি নির্বিঘ্ন রাখা যাবে? চাঁদাবাজিসহ দুর্বৃত্তদের তৎপরতা রোধ হবে? কুরবানির পশুর পরিবহণ খরচ কমিয়ে রেখে এর বাজার স্বাভাবিক রাখার কোনো উদ্যোগও কি রয়েছে?
এদেশে মূল্যস্ফীতি ঠিক কী কী কারণে বাড়ছে, সেটাও বুঝে ওঠা প্রয়োজন। নইলে এটা কমিয়ে আনার লক্ষ্যে নেওয়া পদক্ষেপগুলো যথাযথ হবে না। ভিন্ন বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন অর্থনীতির দেশে যা সুফল দেয়, সেই পদক্ষেপ একই সুফল নাও দিতে পারে এদেশে। উদাহরণস্বরূপ, সুদের হার বাড়িয়ে বাজারে অর্থ সরবরাহ কমিয়ে মূল্যস্ফীতি কমানোর কৌশলের কথা বলা যায়। এটা যুক্তরাষ্ট্রসহ উন্নত দেশগুলোয় কার্যকর হলেও বাংলাদেশেও সুফল দেবে, এমন নয়। কারণ এখানে ভোক্তাঋণ খুবই কম। মূল্যস্ফীতি কমিয়ে আনার চেষ্টায় সে পদক্ষেপও তো নেওয়া হয়নি এখানে। দীর্ঘদিন ব্যাংকঋণের সুদের হার বরং বেঁধে রাখা হয়েছিল। তাতে ওই সময়ে বেসরকারি বিনিয়োগ অনেক বেড়ে গিয়েছিল বলেও খবর মেলেনি। বরং বছরের পর বছর বিনিয়োগ একটা জায়গায় আটকে থাকাটাই দেখতে হয়েছে, যা নিয়ে প্রত্যেক বাজেটের আগে-পরে আলোচনা হয়। এবারও হচ্ছে। অনেক দেরিতে সুদের হার বাজারভিত্তিক করার পর এটা যখন বাড়ছে, তখন আবার বিনিয়োগ বাড়বে কীভাবে-এরও কোনো সদুত্তর নেই। অথচ এক্ষেত্রেও একটা বর্ধিত লক্ষ্যমাত্রা ঘোষণা করে দেওয়া হয়েছে!
যে কোনো অবস্থায় বিনিয়োগ বাড়লে তাতে কিছু কর্মসংস্থান অন্তত সৃষ্টি হতো। বাজারে কাজের সুযোগ সৃষ্টি হলে কর্মে নিয়োজিতরাও লাভবান হয়। তাদের চাহিদা বাড়ে, বেতন-ভাতা বাড়ে। এভাবে শ্রমবাজারে দক্ষতারও উন্নয়ন হয়। বিনিয়োগকারীরাও এর সুফল পেয়ে থাকে। এ অবস্থায় মূল্যস্ফীতি কিছুটা বাড়লেও সেটা পুষিয়ে যায়। দীর্ঘদিন ধরে এটাও কি দেখছি না যে, মূল্যস্ফীতি মজুরি বৃদ্ধির হারের চেয়ে বেশি? সরকারি, বেসরকারি, বিদেশি মিলিয়ে বিনিয়োগ বাড়তে থাকলে কিন্তু অভ্যন্তরীণভাবে উৎপাদন বেড়ে গিয়েও মূল্যস্ফীতি কিছুটা রোধ হতো। সাম্প্রতিক বছরগুলোয় এডিপির বাস্তবায়নেও নজিরবিহীন দুর্দশা চলছে। অর্থবছরের সিংহভাগ সময়ে এর অর্ধেক বাস্তবায়নও হচ্ছে না। খরচের মান পাশে সরিয়ে রাখলেও বলতে হয়, এডিপির বাস্তবায়ন জোরদার হলে এতে পণ্যসামগ্রী সরবরাহকারী খাতগুলো অন্তত চাঙা হতো। প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ কাজের সুযোগ বাড়ত। মানুষ কাজ পেলে এবং সেটা টেকসই হলে একেকটা পরিবারের চেহারা বদলে যায়। তাতে চাহিদা বাড়ে এবং এর প্রকৃতিও বদলায়। সাম্প্রতিককালে মফস্সলেও ফ্রিজ ও এসির চাহিদা বেড়ে উঠেছে, যা বিশেষত গ্রীষ্মে ও ঈদের বাজারে হয়ে ওঠে স্পষ্ট। এ মুহূর্তে ফ্রিজের বাজার চাঙা কুরবানি সামনে রেখে। প্রশ্ন হলো, টানা উচ্চ মূল্যস্ফীতির চাপে যাদের সঞ্চয় ভেঙে এবং ধারকর্জ করে চলতে হচ্ছে, তারা কি পারবে প্রয়োজনীয় হয়ে ওঠা ঘরের এ পণ্যটি কিনতে? এরই মধ্যে আবার বাজেটের কর প্রস্তাব অনুযায়ী এসব পণ্যের দাম বাড়বে।
সিংহভাগ মানুষের হাতে অনেক টাকাপয়সা চলে যাওয়ায় মূল্যস্ফীতি বেড়েছে, এ ধারণা তো ঠিক নয়। ব্যক্তির হাতে তো বটেই, ব্যাংকেও পর্যাপ্ত নগদ টাকা নেই। যথেষ্ট টাকা নেই সরকারের হাতেও। এটা হলো পরিস্থিতি, যে কারণে সরকার মাঝে বাংলাদেশ ব্যাংককে টাকা ছাপিয়ে দিতে বলেছিল। স্বায়ত্তশাসনের অভাবেই নিশ্চয় সে প্রস্তাব তারা ফিরিয়ে দিতে পারেনি। কিন্তু মূল্যস্ফীতি উচ্চপর্যায়ে থাকাকালে সরকার কোন বিবেচনায় টাকা ছাপিয়ে দিতে বলেছিল? বাজারে এর ‘গুণিতক প্রভাবের’ কথা কি অজানা? তাও ভালো, কিছু সিনিয়র অর্থনীতিবিদের জোর অনুরোধে সরকার সেই পথ থেকে সরে এসেছে। সরে এসে অবশ্য ভর করেছে ব্যাংকব্যবস্থার ওপর। উচ্চ সুদে বিল-বন্ড গছিয়ে নেওয়া হচ্ছে ঋণ। প্রস্তাবিত বাজেটেও ব্যাংক থেকে আরও বেশি ঋণ নেওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে। তাতে প্রশ্ন উঠেছে দুটি। এক. এ অর্থের কতটা সদ্ব্যবহার হবে আর তা মূল্যস্ফীতি বাড়াবে না কমাবে? দুই. সরকার বেশি বেশি ঋণ নিলে বেসরকারি খাত ঋণ পাবে কোত্থেকে? একই বাজারে সরকার প্রতিযোগী হলে সুদের হার বেড়ে গিয়ে ব্যবসার খরচও তো যাবে বেড়ে। তাতে অভ্যন্তরীণভাবে মূল্যস্ফীতি ব্যবস্থাপনার কী হবে? আর রপ্তানি বাজারে প্রতিযোগিতা সক্ষমতাও কি কমবে না? এ অবস্থায় সরকারের উচিত হবে সহজ শর্তে বিদেশি ঋণ যতটা সম্ভব বেশি নিয়ে পরিস্থিতি সামলানো।
এবার অপেক্ষাকৃত ছোট বাজেট দিয়েছে সরকার। এ পরামর্শও যৌক্তিক যে, এটা আরও ছোট করে ফেলা প্রয়োজন। অনেক অবকাঠামো উন্নয়নের পর দু-এক বছর একটুখানি বিরতি দিলে দেশের এমন কোনো ক্ষতি হবে না। সঙ্গে অবশ্য কঠোরভাবে কমিয়ে আনতে হবে পরিচালন, বিশেষত প্রশাসনের পেছনে ব্যয়। এর ভাবমূর্তির কিছুটা উন্নয়ন বরং প্রয়োজন। এ ধরনের প্রশাসন পোষার জন্য নির্বিচারে আরও বেশি কর আদায় অর্থনৈতিকভাবেও ভুল পদক্ষেপ। কেননা উচ্চ মূল্যস্ফীতি চলাকালে শুধু এ কারণেই এটা আরও বাড়বে।
সাধারণ মানুষ তো আর অর্থশাস্ত্রের যুক্তিতর্ক দিয়ে পরিস্থিতি বোঝে না। তারা বোঝে যাপিত জীবন দিয়ে। এসব ঘিরেই আবার গড়ে ওঠে ‘মূল্যস্ফীতির প্রত্যাশা’। মূল্যস্ফীতি কমে আসার ‘প্রত্যাশা’ কি বাজেট পেশের আগেও ছিল? মাত্র কয়েকদিন আগে ঢাকা ওয়াসা পানির দাম বাড়াল ১০ শতাংশ। এর সঙ্গে সংগতি রেখেই বোধহয় পানি পরিশোধনকারী ফিল্টারের ওপর কর বাড়ানো হয়েছে বাজেটে। বিশুদ্ধ পানি পাওয়ার অধিকার যাদের নেই, তাদের তো সেটা পরিশোধনের জন্যও বেশি দাম দিতে হবে! তিন মাস অন্তর বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধির পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করে চলেছে সরকার। জ্বালানি তেলের বিশ্ববাজার ইউক্রেন যুদ্ধ-পূর্ববর্তী অবস্থায় চলে গেলেও দেশে কিন্তু এর প্রতিফলন নেই। অথচ মূল্যস্ফীতিতে রয়েছে এর অসাধারণ প্রভাব। সরকার এত কথা না বলে শুধু জ্বালানির দামে স্বচ্ছতা আনলেও কিন্তু অর্থনীতির প্রায় সব খাত কিছু না কিছু সুফল পায়।
‘আমদানি সূত্রে আসা মূল্যস্ফীতি’র চাপে অসহায় অবস্থার কথা সরকারি লোকজন বেশি বলে থাকেন। চিনিসহ অনেক নিত্যপণ্যে কী পরিমাণ কর-শুল্ক আরোপিত রয়েছে, তার কথাও কিন্তু বাজেটের এ সময়টায় জানা হয়ে যাচ্ছে মানুষের। যারা আয়করের আওতায় আসেনি, আপাতত আসার সম্ভাবনাও নেই; তারাও কিন্তু এসব পরোক্ষ করের চাপ এড়াতে পারছে না। গ্রাম পর্যন্ত তারা এসব নিত্যপণ্য কিনতে গিয়ে পকেট খালি করছে আর ঘরে ফিরছে দুর্ভাবনা নিয়ে। একবেলা খেয়ে পরের বেলায় কী খাবে-এমন লোকের সংখ্যা সরকারি তথ্য-উপাত্তেও বাড়ছে। এত বলাবলির পরও সামাজিক সুরক্ষা খাতে এদের জন্য বরাদ্দ বাড়ানো হয়েছে কত? এ খাতে স্বচ্ছতার অভাবও তো তীব্র। খাতটি পরিচ্ছন্ন করার পরামর্শ এমনকি দাতাগোষ্ঠীর তরফ থেকেও ছিল। সংস্কারের সে উদ্যোগ নেওয়া হলেও বলা যেত, উচ্চ মূল্যস্ফীতি চলাকালে দুর্দশায় নিপতিতদের রক্ষার সদিচ্ছাটুকু অন্তত আছে। মূল্যস্ফীতি কমিয়ে আনা তো পরের ব্যাপার। জটিল ব্যাপারও! এ নিয়ে রীতিমতো গবেষণা করে পদক্ষেপ নিতে হবে। সেটা আর আমলানির্ভর রাখাও চলবে না। এক্ষেত্রে বরং থাকতে হবে দেশপ্রেমিক ও সুদক্ষ অর্থনীতিবিদদের জোরালো অংশগ্রহণ।
হাসান মামুন : সাংবাদিক, বিশ্লেষক