আগামী অর্থবছরের জন্য প্রস্তাবিত বাজেট নানা কারণেই বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। বিশেষ করে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে এ বাজেট প্রণয়ন ছিল খুবই কঠিন একটি চ্যালেঞ্জ। বিষয়টি বিবেচনায় রেখেই অর্থমন্ত্রী নতুন বছরের জন্য বাজেট প্রণয়ন এবং তা উপস্থাপন করেছেন। বাংলাদেশের মতো একটি উন্নয়নশীল এবং দ্রুত বিকাশমান অর্থনীতির জন্য বাজেট প্রণয়ন করা সবসময়ই অত্যন্ত জটিল কাজ। কারণ বাজেটের মাধ্যমে সব শ্রেণি-পেশার মানুষের প্রত্যাশা পূরণ করা যায় না। এখানে চাওয়া ও পাওয়ার মধ্যে সমন্বয় সাধন করা বেশ কঠিন। তারপরও বাজেট প্রণয়ন করতে হয়।
প্রস্তাবিত বাজেটের সার্বিক আকার ৭ লাখ ৯৭ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে আয়ের পরিমাণ দেখানো হয়েছে ৫ লাখ ৪১ হাজার কোটি টাকা। এবং ব্যয়ের পরিমাণ হচ্ছে ২ লাখ ৫৬ হাজার কোটি টাকা। অর্থাৎ বাজেটে আয়-ব্যয়ের মধ্যে ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়াবে ২ লাখ ৫৬ হাজার কোটি টাকা। বাজেট ঘাটতি পূরণের জন্য স্থানীয় ও বিদেশি বিভিন্ন সূত্র থেকে ঋণ গ্রহণ করা হবে ২ লাখ ৫১ হাজার ৬০০ কোটি টাকা। এর মধ্যে বিদেশি ঋণের পরিমাণ হচ্ছে ৯০ হাজার ৭০০ কোটি টাকা। বাজেট ঘাটতি পূরণের জন্য ৪ হাজার ৪০০ কোটি টাকা অনুদান পাওয়া যাবে বলে আশা করা হচ্ছে। অভ্যন্তরীণ সূত্র থেকে কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় রাজস্ব আহরণে ব্যর্থতার কারণে বাংলাদেশ ক্রমেই বৈদেশিক ঋণনির্ভর একটি দেশে পরিণত হচ্ছে।
এদেশের অর্থনীতির একটি দুর্বল দিক হচ্ছে কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় রাজস্ব আহরণে ব্যর্থতা। কোনো বছরেই লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী রাজস্ব আদায় করা সম্ভব হচ্ছে না। দেশের ট্যাক্স-জিডিপি রেশিও ৮ শতাংশেরও নিচে। অথচ প্রতিবেশী প্রতিটি দেশ এক্ষেত্রে আমাদের তুলনায় এগিয়ে আছে। এমনকি নেপালের মতো দেশের ট্যাক্স-জিডিপি রেশিও ২০ শতাংশের কাছাকাছি। প্রস্তাবিত বাজেটে কর আদায় বাড়ানোর জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে; কিন্তু এসব পদক্ষেপ কতটা কার্যকর হবে, তা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে। অর্থনীতিবিদ এবং কর খাতসংশ্লিষ্টরা বলছেন, উচ্চ হারে কর নির্ধারণের পরিবর্তে কর নেটওয়ার্ক বাড়ানোর উদ্যোগ নিতে হবে। প্রগ্রেসিভ করহার নির্ধারণ করার জন্যও তারা পরামর্শ দিয়েছেন। একইসঙ্গে প্রত্যক্ষ করের নেটওয়ার্ক বিস্তার করা প্রয়োজন। কর নির্ধারণ পদ্ধতিতেই গলদ রয়েছে। তাই আগামীতেও কর আদায়ের পরিমাণ খুব একটা বাড়বে বলে মনে হয় না।
বাজেটে বিদেশে পাচারকৃত অর্থ ফিরিয়ে আনার ক্ষেত্রে যে উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে, তা বড় বিতর্কের সৃষ্টি করেছে। প্রস্তাব মোতাবেক, যে কেউ বিদেশে পাচারকৃত অর্থের ওপর ১৫ শতাংশ সাধারণ ট্যাক্স দিয়ে টাকা দেশে নিয়ে আসতে পারবেন। এজন্য টাকার মালিকদের টাকার উৎস সম্পর্কে কোনো প্রশ্ন করা হবে না। অর্থনীতিবিদদের অনেকেই মনে করেছেন, এতে প্রকৃত করদাতাদের প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণ করা হয়েছে। কারণ বৈধভাবে উপার্জনকারীদের তাদের অর্থের ওপর ৩০ শতাংশ পর্যন্ত ট্যাক্স দিতে হয়। আর যারা অবৈধভাবে বিদেশে অর্থ পাচার করেছিলেন, তারা মাত্র ১৫ শতাংশ ট্যাক্স প্রদান করলেই তাদের টাকা প্রশ্নাতীতভাবে দেশে ফিরিয়ে আনতে পারবেন। রাষ্ট্রের কাছ থেকে এ ধরনের আচরণ কোনোভাবেই কাম্য হতে পারে না। যারা নিয়মিত কর প্রদানকারী বৈধ অর্থের মালিক, তারা যদি ১৫ শতাংশ কর পরিশোধের সুযোগ গ্রহণের লক্ষ্যে উপার্জিত অর্থের ওপর যথাসময়ে ট্যাক্স না দিয়ে ধরে রাখেন এবং এক সময় ১৫ শতাংশ কর প্রদানের মাধ্যমে তাদের অপ্রদর্শিত অর্থ বৈধ করেন, তাহলে কি তাদের কোনো দোষ দেওয়া যাবে? কারণ রাষ্ট্রীয় নীতিমালাই তাকে এমন সুযোগ করে দিয়েছে। নিকট অতীতে অনেকবারই অপ্রদর্শিত অর্থ এবং বিদেশে পাচারকৃত অর্থ দেশে আনার জন্য সহজ শর্তে সুযোগ দেওয়া হয়েছে; কিন্তু ফলাফল আশাব্যঞ্জক নয়। অপ্রদর্শিত ও কালোটাকার মালিকদের কোনো ধরনের সুযোগ দেওয়া হলে বৈধ অর্থের মালিকরা হতাশ হন। কাজেই এ ধরনের অনৈতিক সুযোগদান বন্ধ করা প্রয়োজন।
চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের দিক থেকে প্রস্তাবিত বাজেট কিছুটা হলেও সংকোচনমূলক। এতে উচ্চ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের ইস্যুটিকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। উচ্চ মূল্যস্ফীতি হ্রাস করার জন্য সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি গ্রহণ ছাড়াও অপ্রয়োজনীয়, বিলাসজাত পণ্য এবং স্থানীয়ভাবে উৎপাদনযোগ্য পণ্য আমদানি নিরুৎসাহিত করা হয়েছে। বাজেটে ব্যক্তি খাতে বিনিয়োগ বৃদ্ধির পদক্ষেপ গ্রহণের কথা বলা হয়েছে। তবে এটি কতটা বাস্তবায়িত হবে, তা নিয়ে সংশয় রয়েছে। কারণ সাম্প্রতিক সময়ে গ্রস ডমেস্টিক প্রোডাক্ট (জিডিপি) যেভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে, ব্যক্তি খাতে বিনিয়োগ ঠিক সেভাবে বাড়ছে না। বরং জিডিপি বৃদ্ধির অনুপাতে ব্যক্তি খাতে বিনিয়োগের হার তুলনামূলকভাবে হ্রাস পাচ্ছে। ২০২১-২২ অর্থবছরে ব্যক্তি খাতে বিনিয়োগের হার ছিল ২৪ দশমিক ৫২ শতাংশ। পরের বছর তা ২৪ দশমিক ১৮ শতাংশে নেমে আসে। চলতি অর্থবছর অর্থাৎ ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ব্যক্তি খাতে বিনিয়োগ প্রাক্কলন করা হয়েছে ২৩ দশমিক ৫১ শতাংশ। সর্বশেষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বেশ ক’বছর আগে এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, দেশে রাজনৈতিক অস্থিরতা-সহিংসতা নেই ঠিকই, কিন্তু এক ধরনের অনিশ্চয়তা বিরাজ করছে। এ অবস্থায় বিনিয়োগকারীরা নতুন বিনিয়োগের সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে দ্বিধান্বিত থাকবেন, এটাই স্বাভাবিক। মাত্র ক’দিন আগে একটি বেসরকারি গবেষণার প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, দেশে ব্যবসায়-বাণিজ্যের অনুকূল পরিবেশের অবনতি ঘটেছে।
নতুন অর্থবছরের জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হিসাবে দেখা দেবে অর্থনীতিতে বিরাজমান অস্বাভাবিক উচ্চ মাত্রার মূল্যস্ফীতি। গত দুই বছরের বেশি সময় ধরে অভ্যন্তরীণ বাজারে উচ্চ মূল্যস্ফীতি বিরাজ করছে। সাধারণ মানুষ এখন উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে বিপর্যয়কর অবস্থার মধ্যে রয়েছে। গত ২৪ মার্চ দেশের সার্বিক মূল্যস্ফীতির হার ছিল ৯ দশমিক ৮১ শতাংশ। এক মাস পর অর্থাৎ ২৪ এপ্রিল মূল্যস্ফীতির হার ছিল ৯ দশমিক ৭৪ শতাংশ। ২৪ মে তা আবারও বৃদ্ধি পেয়ে ৯ দশমিক ৮৯ শতাংশে উন্নীত হয়। গত কয়েক মাস ধরে খাদ্য মূল্যস্ফীতি ডাবল ডিজিটের ওপরে রয়েছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো মূল্যস্ফীতির যে পরিসংখ্যান প্রকাশ করে, বাস্তবে মূল্যস্ফীতির হার আরও বেশি বলে অনেকেই মনে করেন। বাজারে গেল মূল্যস্ফীতির উত্তাপ অনুধাবন করা যায়। মূল্যস্ফীতির প্রসঙ্গ উত্থাপিত হলেই ইউক্রেন যুদ্ধের প্রসঙ্গ অবতারণা করা হয়। ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর বিশ্বব্যাপী সাপ্লাই সাইড বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছিল। সেই সময় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ প্রতিটি দেশের অভ্যন্তরীণ বাজারে মূল্যস্ফীতি রেকর্ড মাত্রা স্পর্শ করেছিল; কিন্তু অধিকাংশ দেশ নানা ব্যবস্থা গ্রহণের মাধ্যমে উচ্চ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসতে সমর্থ হয়। কিন্তু বাংলাদেশ এ ক্ষেত্রে ব্যর্থ হয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ বিশ্বের অন্তত ৭৭টি দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক অন্যান্য ব্যবস্থার পাশাপাশি মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের জন্য পলিসি রেট ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি করে। পলিসি রেট বৃদ্ধির উদ্দেশ্য হচ্ছে এর মাধ্যমে বাজারে অর্থের জোগান কমিয়ে আনা। পলিসি রেট বৃদ্ধির ফলে শিডিউল ব্যাংকগুলো গ্রাহক পর্যায়ে ব্যাংক ঋণের সুদের হার বাড়িয়ে দেয়। ফলে ব্যাংক থেকে ঋণ গ্রহণ আগের তুলনায় ব্যয়বহুল হয়ে পড়ে। গ্রাহক ব্যাংক ঋণ গ্রহণে নিরুৎসাহিত হয়। ফলে বাজারে অর্থ সরবরাহ কমে যাবে। কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংক পলিসি রেট একাধিকবার বৃদ্ধি করলেও তারা শিডিউল ব্যাংকগুলোকে তাদের দেওয়া ব্যাংক ঋণের সুদের হার বাড়ানোর কোনো সুযোগ দেয়নি। কারণ ব্যাংক ঋণের সর্বোচ্চ সুদ হার ৯ শতাংশে নির্ধারণ করে রেখেছিল। এতে ব্যাংক থেকে ঋণ গ্রহণ সহজ হয়ে পড়ে। বাজারে অর্থের জোগান বেড়ে যায়। এখন ব্যাংক ঋণের সুদের হার বাজারভিত্তিক করা হয়েছে; কিন্তু সর্বনাশ যা হওয়ার তা আগেই হয়ে গেছে। বাজেটে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের যে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে, তা অর্জিত হওয়ার তেমন কোনো সম্ভাবনা আছে বলে মনে হয় না। এছাড়া জিডিপি প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে সাড়ে ৬ শতাংশ। এটিও অর্জিত হবে না। যদিও অর্থনীতিবিদরা মনে করছেন, এ মুহূর্তে উচ্চ মাত্রায় জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জনের চেয়ে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণটাই বেশি জরুরি।
আগামী অর্থবছরের জন্য প্রস্তাবিত বাজেট অনেকটাই গতানুগতিক এবং এতে প্রত্যাশা পূরণের তেমন কোনো সম্ভাবনা নেই বললেই চলে।
এম এ খালেক : অবসরপ্রাপ্ত জেনারেল ম্যানেজার, বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক; অর্থনীতিবিষয়ক লেখক