আনার, শাহীন, শিমুল যখন সমাজে নায়ক হয়ে ওঠে
শরীফুজ্জামান আগা খান
প্রকাশ: ০৪ জুন ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
বাল্যবন্ধু আক্তারুজ্জামান শাহীনের পরিকল্পনায় ঝিনাইদহ-৪ আসনের এমপি আনোয়ারুল আজিম আনার খুন হয়েছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। কলকাতায় শাহীন ও আনারের সোনা চোরাচালান, হুন্ডি এমনতরো যৌথ ব্যবসার কারবার রয়েছে। কোটচাঁদপুরের এলাঙ্গী গ্রামে জার্মান শেফার্ড কুকুরের প্রহরার শাহীনের আলিশান বাংলোবাড়ির অন্যতম ভিআইপি অতিথি ছিলেন আনার। সেখানে অবৈধ কারবারের পরিকল্পনা ও লেনদেন জমিয়ে তুলতে মদের আসর আর জলসার আয়োজন হতো। নায়িকা-গায়িকার উদ্দাম নৃত্যে টাকার বান্ডিল উড়ত। শাহীনের বাংলোবাড়ির জব্দ করা সিসিটিভি ফুটেজে পুলিশ প্রশাসনের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদেরও নিয়মিত যাতায়াতের প্রমাণ মিলেছে। কলকাতায় শাহীনের রক্ষিতা সিলেস্তি রহমানের আহ্বানে সাড়া দিতে এমপি আনার নিউটাউন এলাকার সঞ্জীবা গার্ডেনের একটি ফ্ল্যাটে যান। ফ্ল্যাটটি শাহীনের ভাড়া করা। সেখানে আবার কালোবাজারির সোনা লেনদেনের আলাপ হওয়ার কথা ছিল। পথে এক লাল গাড়িতে খুন বাস্তবায়নের দায়ে অভিযুক্ত শিমুল ভূইয়া তাকে রিসিভ করেন। তিনি নিঃসংশয়ে শিমুলের গাড়িতে গিয়ে ওঠেন। এসব ঘটনায় আগে থেকে এদের পরস্পরের সম্পর্কের রসায়ন বোঝা যায়।
আনারকে বীভৎস, নারকীয় কায়দায় খুন করা হয়েছে বলে খবর পরিবেশিত হচ্ছে। এতে পাঠকের মনে হবে তাকে বুঝিবা খুব যন্ত্রণা দিয়ে মারা হয়েছে। ঘটনা কিন্তু তা নয়। তাকে মারা হয়েছে চেতনানাশক স্প্রে করে অজ্ঞান করার পর মুখে বালিশ চাপা দিয়ে। কাজেই মরার সময় তার কোনো সেন্স ছিল না। এরপর কসাই মৃত প্রাণী প্রসেস করার ক্ষেত্রে যা করে, লাশ গায়েব করতে জিহাদ সেই কাজটাই করেছে।
হুন্ডি ব্যবসা, খুন-খারাবি, সোনা চোরাচালানসহ আরও নানাবিধ অপকর্মের দায়ে আনারের বিরুদ্ধে ২১টি মামলা ছিল। আর ৩টি হত্যা মামলাসহ শিমুলের নামে ডজনখানেক মামলা রয়েছে। তবে এ দুজনার নামে বিস্তর মামলা থাকলেও শাহীনের নামে কোনো মামলার কথা জানা যায় না। মার্কিন পাসপোর্টধারী আন্ডারওয়ার্ল্ডের কারবারি শাহীন দেশ-বিদেশ করে বেড়িয়েছে। ‘ধরি মাছ না ছুঁই পানি’ কায়দায় চলেছে।
আন্ডারওয়ার্ল্ডের এ তিনজন ব্যক্তির উত্থানের কাহিনি আলাদা রকম। আনার বরাবর সরকারি দল করতে চেয়েছে। কারণ সে জানত, সে যে ধরনের কায়কারবারে লিপ্ত, তাতে সরকারি দলের আশ্রয়-প্রশয় এবং পুলিশ-প্রশাসনের সহযোগিতা ছাড়া টিকে থাকা সম্ভব নয়। কলেজ জীবনেই সরকারি দল জাতীয় পার্টিতে যোগ দিয়েছে। সে সময় সাইকেলে কালোবাজারির মাল টানাও শুরু করেছে। তখন এপার থেকে প্রকাশ্যেই জাপানি ভিসিপি ওপারে যেত। আর ওপার থেকে ফেনসিডিল আসত। সাইকেল থেকে মোটরসাইকেলে প্রমোশন পেতে এবং দলবলের বহর বাড়াতে আনারের বেশি সময় লাগেনি। বিএনপি ক্ষমতায় এলে আনার বিএনপিতে যোগ দিয়েছে। ১৯৯৬-তে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে আওয়ামী লীগে যোগ দিয়েছে। ইতোমধ্যে অপরাধের বিস্তৃতি ঘটিয়েছে। বিভিন্ন সময়পর্বের অস্ত্র ও বিস্ফোরক, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, দখলবাজি, চরমপন্থিদের আশ্রয়-প্রশয় দেওয়ার মামলা সেই তথ্যই হাজির করে। ২০০১ সালে ক্ষমতার পালাবদল ঘটে, বিএনপি ক্ষমতায় এলে তার পক্ষে সরকারি দল করা সম্ভব হয়নি। কারণ ওই দল থেকে মাত্র কয়েক বছর আগে বেরিয়ে আসায় চিহ্নিত হয়েছিল সে। এ সময় তার মামলাগুলো গতি পেয়েছে। অগত্যা গ্রেফতার এড়াতে ভারতে পালিয়েছে। বিপদ কেটেছে তত্ত্বাবধায়ক সরকার চলে যাওয়ার পর। এতদিনে নির্যাতিত আওয়ামী নেতার তকমা মিলেছে। খোঁজ নিলে দেখা যাবে ভারতে থাকাকালে কোনো কালোবাজারি কিংবা বন্ধু শাহীনের কোনো ফ্ল্যাটেই হয়তো সে অবস্থান করেছে। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে তার মামালাগুলো একে একে খারিজ হয়ে গেছে। এমনকি ইন্টারপোলের ওয়ারেন্টভুক্ত আসামির তালিকায়ও নাম থাকেনি। এলাকাবাসী তার খুঁটির জোরের বার্তা পেয়েছে। বুঝে গেছে তাকে সমঝে চলতে হবে।
শিমুল ভূইয়া পূর্ব বাংলা কমিউনিস্ট পার্টির আঞ্চলিক নেতা। ডিবিপ্রধানের ভাষায়-গলাকাটা পার্টির নেতা। প্রতিপক্ষ সরদার পরিবারের উপজেলা ও ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানকে গুলি করে হত্যার দায়ে অভিযুক্ত হয়েছে। দীর্ঘ সময় জেল খেটেছে। একাধিক খুন করার পরও জেল থেকে ফিরে আসায় এলাকায় ভয়-সমীহমিশ্রিত ভাবমূর্তি তৈরি হয় তার। তখন তার নামে চাঁদাবজি চলতে অসুবিধা হয়নি।
শাহীন সরাসরি রাজনীতিতে জড়ায়নি। মেরিন ইঞ্জিনিয়ার ছিল। জাহাজে চাকরি করা অবস্থায় মাদক ও সোনা চোরাচালানে হাত পাকিয়েছে। পরে চাকরি ছেড়ে দিয়ে মাদক, সোনা, হুন্ডির আন্তর্জাতিক কারবারি বনে গেছে।
অবৈধ কারবারের সঙ্গে কীভাবে রাজনৈতিক ক্ষমতার সম্মিলন ঘটাতে হয়, সে বিষয়ে এরা ছিল অভিজ্ঞ। ভোট নিয়ন্ত্রণ, পুলিশ-প্রশাসন দিয়ে নির্বাচনে কলকাঠি নাড়ানোর কৌশল এদের জানা। আনার পর পর তিনবার এমপি হয়েছে। এমপি হওয়ার পেছনে শাহীনের টাকা ও যোগাযোগের ভূমিকা থাকার সম্ভাবনাই সমধিক। আনার এমপি হওয়ার পাশাপাশি উপজেলা চেয়ারম্যান এবং মেয়র পদে নিজের লোক বসিয়েছে। তার পক্ষভুক্ত ব্যক্তিদের ইউনিয়নের চেয়ারম্যান পদে পাশ করিয়ে এনেছে।। এমনকি কালীগঞ্জ উপজেলার বাইরেও সে প্রভাব বিস্তারে প্রয়াস পেয়েছে।
খুলনা মহানগর লাগোয়া এক ইউনিয়নে শিমুল ভূইয়ার ভাবমূর্তি কাজে লাগিয়ে তার ভাই চেয়ারম্যান হয়েছে। তার স্ত্রী জেলা পরিষদের সদস্য পদে প্রার্থী হলে অন্য কেউ প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার সাহস দেখায়নি। এটা স্পষ্ট, ক্ষমতাসীন দলের আশীর্বাদ ছাড়া এ রকম প্রভাব বিস্তার সম্ভব নয়।
শাহীন অবস্থাপন্ন ঘরের ছেলে। পরিবার নিয়ে মার্কিন মুলুকে থাকে। সেখানকার নাগরিক। অন্ধকার জগতে না এলেও তার অর্থকড়ির অভাব ছিল না। শাহীনের বিপথগামী হওয়া থেকে পরিবার তাকে নিবৃত করতে পারেনি। হয়তো করতে চায়ওনি। যে দুষ্টচক্রে তার বিচরণ, এদেশে ক্ষমতাচর্চার জন্য সেটা প্রয়োজন। ক্ষমতার আকর্ষণ, অন্যদিকে অর্থের সীমাহীন লোভ তাকে বিপথে ঠেলে দিয়েছে। সে তার অবৈধ কারবারের প্রয়োজনে রাজনৈতিক নেতাদের পাশাপাশি পুলিশ-প্রশাসনের ঊর্ধ্বতন ব্যক্তিদের সঙ্গে সখ্য গড়ে তুলেছে। সরাসরি রাজনীতিতে না জড়ালেও নেপথ্যে কলকাঠি নেড়েছে। মেয়র নির্বাচনের আগে কয়েকদিন এলাকায় ঘুরে গেছে। এতেই ভাইয়ের জন্য যথেষ্ট কাজ হয়েছে।
যশোর শিল্পকলা একাডেমিতে এক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে দর্শকের সারিতে ছিলাম। আমার পাশে বসা মহিলার পরিচয় নিয়ে জানলাম তিনি কালীগঞ্জের এক কলেজের শিক্ষিকা। মনে পড়ল, ওই কলেজের এক শিক্ষককে দুবছর আগে এমপি আনার কলেজে গিয়ে থাপ্পড় মারার খবর আলোচিত হয়েছিল। মার খাওয়ার পরও ওই শিক্ষক বলেছিলেন, এমপি সাহেব ভালো লোক। তাকে ভুল বোঝানো হয়েছে। আমার বাড়ি কোটচাঁদপুর বলতেই তিনি মন্তব্য করলেন, আপনারা তো ফেমাস হয়ে গেলেন। দুর্বৃত্তায়িত রাজনৈতিক-অর্থনীতিক বাতাবরণে আনার, শাহীন, শিমুলদের মতো নেতি চরিত্রগুলো আমাদের পরিচয়ের ওপর ছাপ ফেলে।
শরীফুজ্জামান আগা খান : শিক্ষক ও গবেষক