পানির সংকটে কেবল দাম নিয়ে আলোচনা!
হাসান মামুন
প্রকাশ: ০৪ জুন ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
গত ১ জুলাই থেকে ঢাকা ওয়াসার পানির জন্য ১০ শতাংশ বেশি দাম দিতে হবে এর গ্রাহকদের। নতুন অর্থবছরের সঙ্গে অবশ্য এর সম্পর্ক তেমন নেই। জুন থেকেও এ বর্ধিত দাম কার্যকর হতে পারত। বিদ্যুতের ক্ষেত্রে কিন্তু এমনও হয়েছে, পূর্ববর্তী মাস থেকে কার্যকর হয়েছে বর্ধিত দাম। সরকার দাম বাড়ানোর ভঙ্গিতে থাকলে এসব ঘটতেই পারে। বিদ্যুৎ বা পানির মতো ‘সরকারি পণ্যের’ দাম বাড়াতে গিয়ে সংশ্লিষ্টরা অনেক সময় বিধিরও পরোয়া করেন না। যেমন, এর আগে ঢাকা ওয়াসা পানির দাম বাড়াতে চেয়েছিল ‘বিধি প্রণয়ন’ না করে। প্রশ্নটি হাইকোর্টে তোলা হলে রুল জারি হয় এবং তাতে দাম বাড়ানোর উদ্যোগ আটকে যায়। এরপর কীভাবে কী হলো-নতুন করে পানির দাম বাড়ানো হচ্ছে ১০ শতাংশ।
এভাবে দাম বাড়ানোর ‘বৈধতা’ নিয়ে তো বটেই, প্রশ্ন উঠেছে এর যৌক্তিকতা নিয়েও। আমি বৈধতা নয়; যৌক্তিকতার মধ্যে থাকব। ওয়াসা বলছে, মূল্যস্ফীতি সমন্বয়ের স্বার্থে এ দাম বৃদ্ধি। এদিক থেকে বক্তব্যটা ঠিকই আছে। মূল্যস্ফীতি তো দীর্ঘদিন ধরেই ৯-এর উপরে; ১০ ছুঁইছুঁই। তাছাড়া ওয়াসা অনেকদিন ধরে বলছে, পানির দামে তার উৎপাদন ব্যয়টুকুও উঠছে না। সংস্থাটির এমডি মনে করিয়ে দিচ্ছেন, সরকারের কাছ থেকে টাকা-পয়সা এনে পানি জোগাতে আর পারবেন না। তাকে অন্তত ‘না লাভ না লোকসানে’ থাকতে হবে। আলাদা করে তাকে দোষ দেওয়া যাবে না। বিদ্যুৎ ও জ্বালানি প্রতিমন্ত্রীও বলে দিয়েছেন, ধাপে ধাপে সরকার এসব ক্ষেত্রের ভর্তুকি থেকে বেরিয়ে আসতে চায়। এরই মধ্যে মাসে মাসে জ্বালানির ‘মূল্য সমন্বয়ের’ ব্যবস্থা হয়েছে। সে অনুযায়ী চলতি মাসে এর দাম বেড়েছে নতুন করে। বিশ্ববাজারে জ্বালানির দাম কিছুটা কমলেও টাকার অবমূল্যায়নে দেশে এর দাম বাড়ল। জ্বালানির দামে উচ্চ কর-শুল্কও আরোপিত রয়েছে। সেটা কমানো হলে এক্ষেত্রে কিছুটা ‘নিম্নমুখী সমন্বয়’ হয়তো করা যেত। কিন্তু সরকার এটা করছে না। এ খাতে বরং কিছু বাড়তি আয়ের সুযোগ রাখছে।
সরকার বিদেশি মুদ্রার বিনিময় হারটাও ছেড়ে দিতে চাইছে বাজারের ওপর। সে লক্ষ্যে চালু করেছে ‘ক্রলিং পেগ’। এতে করে ডলারের আনুষ্ঠানিক দামও গেছে অনেকখানি বেড়ে। কার্ব মার্কেটে দাম স্বভাবতই আরও বেশি। আমদানিসহ অর্থনীতিতে এর প্রভাব পড়তেও শুরু করেছে। এখন ওয়াসাও জোর দিয়ে বলতে পারবে, পানি পরিশোধনের উপকরণসহ দরকারি জিনিসপত্র আমদানিতে তাদের ব্যয় বেশি পড়ে যাচ্ছে ডলারের দামের কারণে। সুতরাং পানির দাম আরও বাড়াতে হবে! বছরে ৫ শতাংশ করে দাম বাড়ানোর অধিকার নাকি তাকে দেওয়াই আছে। এর বেশি হারে বাড়াতে হলে নিতে হয় সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের সম্মতি। পানির দামটা স্পর্শকাতর বলেই বুঝি নিতে হয় প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের ‘এনওসি’ও। ওয়াসা মাঝে অবশ্য চেয়েছিল বিভিন্ন শ্রেণির গ্রাহকের সামাজিক অবস্থান অনুয়ায়ী পানির দাম বাড়াতে। সেটা করা গেলে অবশ্য কোনো কোনো ক্ষেত্রে আরও অনেক বেশি হারে দাম বাড়ানো যেত। এ বিষয়ে ওয়াসা কিছু ‘টেকনিক্যাল স্টাডি’ও করেছিল।
যা হোক, শেষতক যে সিদ্ধান্ত হয়েছে, সেটা নিয়েই দুটো কথা এখানে বলি। প্রথমত, এটা আচমকা সিদ্ধান্ত নয়। ওয়াসা তো পানির দাম বাড়িয়েই চলেছে। ঢাকায় ১৬ বছরে ১৬ বার পানির দাম বাড়ল-রয়েছে এমন সংবাদ শিরোনাম। কোনো কোনো বছরে দু’বারও দাম বাড়ানো হয়েছে। সেটা অবশ্য ঘটিয়েছে চট্টগ্রাম ওয়াসা। সে নগরীতে পানি সরবরাহ পরিস্থিতি ঢাকার চেয়ে খারাপ। ওখানে পানির দামও ঢাকার চেয়ে বেশি। এর ওপর তারা সম্প্রতি দাম বাড়াতে চাইছেন ৩০ শতাংশ! মন্ত্রণালয় দামের এতটা বৃদ্ধি অনুমোদন করবে বলে মনে হয় না। ঢাকা ওয়াসা জানাচ্ছে, তারা আরও বেশি হারে দাম বাড়াতে চাইলেও সম্মতি মেলেনি। এর পরের ধাপে পানির বিভিন্ন দাম নির্ধারণে তারা মন্ত্রণালয়কে রাজি করাতে পারবেন বলে অবশ্য আশাবাদী। সত্যি বলতে, স্থানীয় সরকার মন্ত্রীই এক অনুষ্ঠানে বলেছিলেন-ধনী আর গরিব ভোক্তা কেন একই হারে বিল পরিশোধ করবেন? সরকারি পণ্য বা সেবার দাম একেক আয়গোষ্ঠীর কাছ থেকে একেক হারে নেওয়ার রীতি তো আছে। এতে রাজস্ব বাড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে কিছুটা হলেও ন্যায় প্রতিষ্ঠা সম্ভব বলে অনেকের ধারণা।
পানির দাম বাড়াতে গিয়ে ঢাকা ওয়াসা যেভাবে তার ব্যয় ও আয়ের হিসাব দিচ্ছে, তা নিয়ে অবশ্য প্রশ্ন আছে। চট্টগ্রাম ওয়াসাও দেখাচ্ছে, বছরের পর বছর পানি বিক্রি করে ‘লাভে’ আছে তারা। তখন এ প্রশ্নটা স্বভাবতই ওঠে, তাহলে কেন এ উচ্চ মূল্যস্ফীতির মধ্যে আবার পানির মতো জরুরি পণ্যের দাম বাড়ানো? এর জবাবে তখন বলা হয়, বিদেশি ঋণে বিভিন্ন প্রকল্পের বাস্তবায়ন চলাকালে সেটা পরিশোধের সময় এসে যাচ্ছে! আরও দুটি চালু ওয়াসা কর্তৃপক্ষ রয়েছে দেশে-রাজশাহী ও খুলনা ওয়াসা। সিলেটেও ওয়াসা গঠিত হয়েছে, যদিও পানি সরবরাহের কাজটা সেখানে এখনো করছে সিটি করপোরেশন। এ পাঁচ নগরীতেই পানি নিয়ে মানুষের অভিজ্ঞতা মোটামুটি অভিন্ন। খবরগুলোও বলতে গেলে এক প্রকৃতির। কোনো ওয়াসাই পানিসহ বিধিবদ্ধ সেবা জুগিয়ে গ্রাহকদের সন্তুষ্ট করতে পারছে না। বিশেষত পানির মান কোনোখানেই গ্রহণযোগ্য নয়। এ অবস্থায় যেসব উন্নয়ন প্রকল্প গৃহীত হচ্ছে, তাতে বিপুল ব্যয় হলেও প্রত্যাশিত সুফল মিলছে না। এর মাশুল আবার গুনতে হচ্ছে ওয়াসার সেবা গ্রহীতাদের। সে কারণেই প্রায় প্রতিবছর পানির দাম বাড়িয়ে এমনকি প্রকল্প ব্যয় নির্বাহের একটা প্রবণতা দেখা যাচ্ছে সবখানে। ঢাকা ওয়াসা নাকি ১৯ হাজার কোটি টাকার প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে-যেগুলোর গতি ধীর আর সুফল দৃশ্যমান নয়। চট্টগ্রামেও ঘটনা প্রায় অভিন্ন। কোনো কোনো ক্ষেত্রে বিপুল ব্যয়ে ‘ক্যাপাসিটি’ বাড়ানো হলেও পয়ঃনিষ্কাশন থেকে নিয়ে পরিশোধিত পানি সরবরাহে এর সদ্ব্যবহার পরিলক্ষিত হচ্ছে না। অবস্থা অনেকটা বিদ্যুৎ খাতের মতো। সেখানেও কিন্তু গ্রাহককে বেশি দাম দিতে হচ্ছে, এমনকি অব্যবহৃত ‘ক্যাপাসিটি চার্জের’ কারণে উৎপাদন ব্যয় বেড়ে যাওয়ায়।
ঢাকাসহ সব ওয়াসায় ‘সিস্টেম লস’ও অস্বাভাবিক বেশি। তবে ঢাকায় বোধহয় কিছুটা কমিয়ে আনা গেছে। সিস্টেম লস মানে পানি জুগিয়েও খাতাপত্রে দাম না পাওয়া। পানিটা হয় অপচয় হচ্ছে; নয়তো কোনো না কোনোভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে, কিন্তু এর রাজস্ব মিলছে না। ওয়াসার একশ্রেণির কর্মচারী যে এ প্রক্রিয়ায় বিপুলভাবে লাভবান হচ্ছে, সেটা অনেকদিন ধরে আলোচিত। চট্টগ্রাম ওয়াসায় সিস্টেম লস এখনো ৩০ শতাংশ। এক দশক ধরে এটা নাকি কমানোও যাচ্ছে না। তবে ঢাকা ওয়াসার অনুসরণে সেখানেও কর্মচারীদের ‘বিশেষ প্রণোদনা’ জোগানোর চেষ্টা রয়েছে। কোনো পণ্য বা সেবা বিক্রয়কারী প্রতিষ্ঠান ভালো পারফর্ম করলে সেটা ঘটতেই পারে। কিন্তু ২০-৩০ শতাংশ সিস্টেম লসের প্রতিষ্ঠান কীভাবে অতিরিক্ত বোনাস দেয়, এর সদুত্তর পাওয়া কঠিন। এর মধ্যে কোনো কোনো ওয়াসার এমডিকে আবার করে তোলা হয়েছে বিকল্পহীন! তার বেতন-ভাতা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে ঘটে চলেছে চাকরির নবায়ন।
এ পরিস্থিতিতে সবচেয়ে বড় অভিযোগটা হলো, ঢাকাসহ কোনো ওয়াসাই মানসম্মত পানি জোগাতে পারছে না। পানিটা অন্যান্য কাজে ব্যবহার করা গেলেও সরাসরি পান করা যাচ্ছে না। ওয়াসার পানিতে মিলছে কলেরার জীবাণুসহ মাত্রাতিরিক্ত ক্ষতিকর উপাদান। তাই আবার বলে দেওয়া হচ্ছে, এটা ফুটিয়ে পান করতে হবে! পানি ফোটাতে হলে তো গ্যাস ব্যবহার করতে হয়। আর আমরা গ্যাসের ওপর ভাসছি না। গ্যাসের দামও এমনকি আবাসিকে বাড়ানো হচ্ছে। আর নতুন করে দেওয়া হচ্ছে না গ্যাস সংযোগ। মানুষকে নির্ভর করতে হচ্ছে এলপি গ্যাসের ওপর। এর দামও স্থির হচ্ছে বাজারের নিয়মে। অনেকে অবশ্য এখন ফিল্টার ব্যবহার করেন ওয়াসার পানিটা সুপেয় করতে। এগুলোর নির্ভরযোগ্যতা নিয়েও প্রশ্ন আছে। আছে বাড়তি খরচের বিষয়। পানির দামের সঙ্গে এগুলোর দামও বাড়ছে। এগুলোও হয়ে আসছে আমদানি। আর সব মিলিয়ে আমদানি ব্যয় কমার প্রবণতা তো অনুপস্থিত।
‘পানির দেশে’ এর উৎস হাতের কাছে থাকলেও সুপেয় পানি কিন্তু মিলছে না। উৎপাদন ব্যয় বৃদ্ধি বা ভর্তুকি প্রত্যাহারের যুক্তিতে দাম অব্যাহতভাবে বাড়ালেও কোনো ওয়াসাই পারছে না সুপেয় পানি সরবরাহ করতে। অথচ এটা অন্যতম প্রধান মানবাধিকার বলেও স্বীকৃত। বাস্তবে নগরীর গ্রাহকদের পর্যাপ্ত পানিটুকুও জোগাতে পারছে না কোনো ওয়াসা। বিশেষত গ্রীষ্মে বিদ্যুতের সঙ্গে পানিরও ঘাটতি দেখা দিচ্ছে প্রতিবার। পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি অবশ্য হয়েছে ভূগর্ভস্থ পানির সঙ্গে ভূউপরিস্থ পানি পরিশোধনপূর্বক সরবরাহের ব্যবস্থা হওয়ায়। এতে সামগ্রিকভাবে ব্যয় আবার বেড়ে চলেছে। নদী-নালার পানি বোধগম্য নানা কারণে বেশি দূষিত বলে এর পরিশোধন ব্যয়ও বেশি। দূরের উৎস থেকে আনতে হলে ব্যয় আরও বেশি। এ অবস্থায় পরিকল্পনামতো ভূগর্ভস্থ পানির উত্তোলন কমিয়ে প্রতিবেশগত ভারসাম্য রক্ষার চেষ্টাও করা যাচ্ছে না। পানির স্তর বিপজ্জনকভাবে নেমে যাচ্ছে শুধু মাত্রাতিরিক্ত সেচের কারণে নয়; নগরবাসীকে ভূগর্ভস্থ পানি সরবরাহের কারণেও। সেটাও যদি মানসম্মত হতো, এমনকি মিলত পর্যাপ্ত পরিমাণে!
সুপেয় হোক না হোক, প্রয়োজনমতো পানি পেতে লোকে নানারকম দুর্নীতিরও আশ্রয় নিচ্ছে, এমনকি খোদ রাজধানীতে। নিজেরাই ডিপ টিউবওয়েল বসিয়ে নিচ্ছে ওয়াসার অনুমোদন না নিয়ে। প্রবণতাটি চট্টগ্রাম আর রাজশাহী নগরীতেও রয়েছে। বেড়ে চলা শিল্পকারখানা, বিশেষত বস্ত্র ও তৈরি পোশাক খাতে লাগছে প্রচুর পানি। তারাও যেভাবে হোক, পানির ব্যবস্থা করে নিচ্ছেন। এতে ওয়াসা আবার বঞ্চিত হচ্ছে বিধিবদ্ধ ফি তথা রাজস্ব থেকে। এতে করে ভূগর্ভস্থ পানির ওপরও বাড়ছে বছরব্যাপী চাপ। আশপাশের পানিবঞ্চিতরা অগত্যা ওইসব উৎস থেকে সংগ্রহ করছে পানি। বাড়ছে পানির ব্যবসাও! বেশি সংকটগ্রস্ত এলাকায় ওয়াসার কিছু বুথ অবশ্য হয়েছে-এটিএম কার্ডে সুপেয় পানি সংগ্রহের। তাতেও দাম বাড়ানোর প্রবণতা লক্ষণীয়। আসলে আমরা এসব ক্ষেত্রে ভর্তুকি প্রত্যাহার ও দাম বাড়ানোর একটা প্রক্রিয়ায় ঢুকে পড়েছি। এখানে স্বচ্ছতা ও ন্যায্যতার প্রশ্ন তোলার অবকাশ বোধহয় আর থাকছে না।
হাসান মামুন : সাংবাদিক, বিশ্লেষক