Logo
Logo
×

উপসম্পাদকীয়

প্রস্তাবিত বাজেট আশার আলো দেখাবে কি?

Icon

মুঈদ রহমান

প্রকাশ: ০২ জুন ২০২৪, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

বাজেট বলতে আমরা কী বুঝি? অনেকের ধারণা, বাজেট মানে সংশ্লিষ্ট বছরের আয়ব্যয়ের হিসাবনিকাশ। আসলে বাজেট হলো একটি অর্থনৈতিক দর্শন, যে দর্শন দ্বারা পরবর্তী বছর রাষ্ট্রের উন্নয়ন ঘটার কথা। বলা বাহুল্য, অর্থনীতি সমাজের অন্যান্য কর্মকাণ্ডকে প্রভাবিত করে। ফলে বাজেট অর্থাৎ অর্থনীতির দর্শনটা যদি দূরদর্শী হয়, তাহলে দেশের উন্নতি হতে বাধ্য।

৬ জুন সংসদে প্রস্তাবাকারে উপস্থাপিত হতে যাচ্ছে ২০২৪-২৫ অর্থবছরের জাতীয় বাজেট। রীতি-রেওয়াজ অনুযায়ী, মাননীয় অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী সংসদে নতুন অর্থবছরের বাজেট উপস্থাপন করবেন। বাজেটটি সংসদে উপস্থাপনের পর জনপ্রতিনিধিরা প্রায় তিন সপ্তাহ এর ওপর আলোচনা করবেন; কোনো কিছু সংশোধন-সংযোজনের ওপর গুরুত্ব দিয়ে মতামত রাখবেন। সার্বিক আলোচনা শেষে ওই মাসের শেষ সপ্তাহে তা চূড়ান্ত আকারে অনুমোদন দেবে সংসদ। পরবর্তী সময়ে এ বাজেটের কার্যকাল শুরু হবে ২০২৪ সালের ১ জুলাই থেকে। তবে দীর্ঘ পাঁচ দশকের পর্যবেক্ষণ বলে, সংসদের আলোচনায় বাজেট প্রস্তাবনার খুব লক্ষণীয় পরিবর্তন দেখা যায় না। তাই প্রস্তাবিত বাজেটটিই চূড়ান্ত বাজেটের রূপ লাভ করে। তথ্য সরবরাহের যুগে মানুষকে বাজেট উপস্থাপনের দিন পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয় না। এর আগেই গণমাধ্যমে বাজেট সম্পর্কিত বিস্তারিত তথ্য প্রকাশিত হতে দেখা যায়। এবারও এর ব্যতিক্রম হয়নি। আগামী অর্থবছরের বাজেটের আকার কেমন হবে, কোন কোন খাতে কী ধরনের প্রভাব পড়বে প্রভৃতি বিষয় এরই মধ্যে গণমাধ্যমে উঠে এসেছে।

যে সময়ে নতুন অর্থবছরের বাজেট উপস্থাপিত হতে যাচ্ছে, সেসময়ে সামগ্রিক অর্থনীতির অবস্থা খুব একটা সুখকর নয়। অর্থনীতির দু-একটি সূচক ভালোর ইঙ্গিত দিলেও বেশির ভাগ সূচকের অবস্থাই নাজুক। আমাদের বার্ষিক গড় প্রবাসী আয় কমবেশি ২২ বিলিয়ন ডলার হলেও ২০২৩ সালে তা কমতির দিকে ছিল। ২০২৪ সালে সেদিকটায় কিছুটা উন্নতি হয়েছে। কর আহরণের দিকটাও কিছুটা ভালো। কিন্তু নেতিবাচক চিত্র হলো অর্থনীতির প্রধান চার খাতে। মূল্যস্ফীতি ক্রমাগত বাড়ছেই। ২০২২ সালে সার্বিক গড় মূল্যস্ফীতি ছিল ৬ দশমিক ২৯ শতাংশ, যা ২০২৩ সালে বেড়ে দাঁড়ায় ৯ দশমিক ২৪ শতাংশে এবং ২০২৪ সালের এপ্রিলে মূল্যস্ফীতি বেড়ে হয় ৯ দশমিক ৭৪ শতাংশ। অন্যদিকে টাকার মান পড়তির দিকে। টাকার বিপরীতে ডলারের দাম বাড়ছেই। ২০২২ সালে ১ ডলার পাওয়া যেত ৮৭ টাকায়, ২০২৩ সালে ডলারের দাম বেড়ে হয় ১০৭ টাকা, আর বর্তমানে ডলারের বাজারমূল্য ১১৭ টাকা। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের পরিমাণ তো আশঙ্কাজনকভাবে কমছে। ২০২২ সালের ৪২ বিলিয়ন ডলারের রিজার্ভ ২০২৩ সালে কমে দাঁড়ায় প্রায় ৩০ বিলিয়ন ডলারে এবং বলা হচ্ছে ২০২৪ সালের মে মাসে প্রকৃত রিজার্ভের পরিমাণ ১৩ বিলিয়ন ডলারের বেশি নয়। ব্যাংক খাতের অবস্থাও নাজুক। ব্যাংকের তারল্য কমে গেছে, ব্যাংকের ওপর মানুষের আস্থা গেছে হারিয়ে। কমপক্ষে তিনটি ব্যাংক আছে, যারা গ্রাহককে আমানতের টাকা ফেরত দিতে পারছে না, এমনকি কোনো কোনো ব্যাংকের কোনো কোনো শাখাও বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। ব্যাংক একীভূতকরণের আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে পুরো ব্যাংক খাতে। খেলাপি ঋণের পরিমাণও বছরওয়ারি বাড়ছেই। প্রতিবছরই গড়ে প্রায় ২০ হাজার কোটি টাকার ঋণ খেলাপি হয়ে যাচ্ছে। এর বিরুদ্ধে কার্যকর কোনো ব্যবস্থার আভাস নেই। বাংলাদেশের অর্থনীতি ক্রমাগত যে আঘাতের শিকার, তা হলো অর্থ পাচার। প্রতিবছর বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার পাচার হয়ে যাচ্ছে, তা প্রতিকার ও প্রতিরোধের কোনো কার্যকর পদক্ষেপ দেখা যাচ্ছে না।

উল্লিখিত প্রতিকূলতাকে সামনে রেখেই ৬ জুন আসছে স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণের বাজেট। প্রত্যেক বাজেটেরই একটি আকর্ষণীয় প্রতিপাদ্য স্লোগান থাকে, সেই স্লোগানের বাস্তব চিত্র যাই হোক। এবারের প্রতিপাদ্য হচ্ছে, ‘সুখী, সমৃদ্ধ, উন্নত ও স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে অঙ্গীকার’। ২০২৪-২৫ অর্থবছরে বাজেটের আকার ধরা হয়েছে ৭ লাখ ৯৬ হাজার কোটি টাকা। অর্থনীতির নাজুক অবস্থার মধ্যে অনেকের ধারণা ছিল আগামী অর্থবছরের বাজেটের আকার চলতি বাজেটের চেয়ে ৫-৬ শতাংশ কম হবে; কিন্তু বাস্তবে দেখা যাচ্ছে, চলতি বাজেটের তুলনায় নতুন বছরের প্রস্তাবিত বাজেটের আকার প্রায় ৪ দশমিক ৬ শতাংশ বেশি; যা অঙ্কের পরিমাপে ৩৫ হাজার ১১৫ কোটি টাকা। এ বড় বাজেটে সবচেয়ে বড় চাপটি পড়বে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) ওপর। সংস্থাটিকে আগামী অর্থবছরে রাজস্ব আহরণ করতে হবে ৫ লাখ ৪১ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে কেবল করবাবদ আদায় করতে হবে ৪ লাখ ৮০ হাজার কোটি টাকা, যা চলতি বাজেটের তুলনায় ৫০ হাজার কোটি টাকা বেশি। অর্থনীতিকে গতিশীল রাখতে দুর্বল অর্থনীতির দেশগুলোয় সাধারণত ঘাটতি বাজেটের প্রস্তাব করা হয়ে থাকে। আমাদের দেশেও তা-ই। এবারের বাজেটে অনুদানসহ ঘাটতি থেকে যাবে ২ লাখ ৫৫ হাজার ৯০০ কোটি টাকা। বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) আকারও বেড়েছে। এবারে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির জন্য বরাদ্দ রাখা হয়েছে ২ লাখ ৬৫ হাজার কোটি টাকা। বাজেটের ঘাটতি মেটাতে সরকার ঋণের ওপর নির্ভরশীল হয়। ঋণের প্রধান দুটি উৎস হলো অভ্যন্তরীণ ব্যাংক ও বিদেশি ঋণ। সঞ্চয়পত্র বিক্রি করে এ বছর কোনো ঋণ না নেওয়ার কথা ভাবছে সরকার। তবে ধারকৃত অর্থের বেশির ভাগটাই পড়বে দেশীয় আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর। এবার সরকার আনুমানিক পৌনে ৩ লাখ কোটি টাকা ঋণ নেওয়ার কথা ভাবছে, যার মধ্যে দেড় লাখ কোটি টাকা নেবে অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে, আর বাদবাকি সোয়া লাখ কোটি টাকা নেবে বিদেশি উৎস থেকে।

গত ৫ দশকেরও বেশি সময় দেশে বার্ষিক বাজেট পাচ্ছি আমরা। সব অর্থমন্ত্রীই উপস্থাপনের আগে অত্যন্ত শৈল্পিক আশার বাণী শুনিয়েছেন। বর্তমান অর্থমন্ত্রীও ব্যতিক্রম নন। আগামী অর্থবছরের বাজেট সম্পর্কে অর্থমন্ত্রীর দৃঢ় বক্তব্য হলো, ‘অর্থনীতিকে আগের জায়গায় ফিরিয়ে আনাই হবে আগামী বাজেটে অগ্রাধিকারের বিষয়। পাশাপাশি নিত্যপণ্য মানুষের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে রাখা এবং মানুষের জীবনযাত্রার মান যেন সীমার মধ্যে থাকে, সেটিও নিশ্চিত করা হবে।’ অগ্রাধিকারের বিষয়টিতে পরে আসছি, প্রথমে দ্রব্যমূল্যের কথায় আসি। তিন বছর ধরে দ্রব্যমূল্য ক্রমাগত বেড়ে চলেছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) হিসাব মতে, দেশে মূল্যস্ফীতির হার ৯ দশমিক ৭৪ শতাংশ। আর বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) গবেষণা বলছে মূল্যস্ফীতির হার ১৫ শতাংশ ছাড়িয়ে গেছে। তাহলে কোন জাদুতে আসছে বাজেটে মূল্যস্ফীতি ৬ দশমিক ৫ শতাংশে নামিয়ে আনার কথা বলা হচ্ছে? নিয়ন্ত্রণ বা কমিয়ে আনার প্রক্রিয়া হিসাবে অর্থ বিভাগ কিছুটা পথ দেখানোর চেষ্টা করেছে। অর্থ বিভাগ বলছে, খাদ্যপণ্য ও জ্বালানি তেলের মূল্য কমে আসায় ২০২৪ ও ২০২৫ সালে উচ্চ মূল্যস্ফীতি ক্রমান্বয়ে হ্রাস পাবে। কারণ, সরকারি ব্যয়ে কৃচ্ছ্রসাধন করা হচ্ছে। এছাড়া আগামী দিনে বাড়বে খাদ্য উৎপাদন এবং পণ্য সরবরাহ স্বাভাবিক রাখতে বিভিন্ন পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি পণ্যের বাজার মনিটরিং, সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী বৃদ্ধি করা এবং জ্বালানি তেলের মূল্য বিশ্ববাজারের সঙ্গে স্বয়ংক্রিয়ভাবে সমন্বয়ব্যবস্থা বাস্তবায়ন হচ্ছে, যা মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে প্রভাব ফেলবে।

অর্থ বিভাগের বক্তব্যের সঙ্গে দ্বিমত করার কিছু নেই, কিন্তু বক্তব্যের সবটাই ‘যদি’র ওপর নির্ভরশীল। এদেশের শাসনব্যবস্থা তা বলে না। এ প্রসঙ্গে বিশ্বব্যাংকের বাংলাদেশ অফিসের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেনের বক্তব্য হলো, ‘মূল্যস্ফীতি লক্ষ্যমাত্রার মধ্যে রাখতে হলে প্রথমে দেখতে হবে সামষ্টিক অর্থনীতির ব্যবস্থাপনা রূপরেখার সঙ্গে সামঞ্জস্য কিনা। কারণ, মূল্যস্ফীতি নির্ভর করে আংশিক আন্তর্জাতিক মূল্য ও আংশিক অভ্যন্তরীণ অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনার ওপর। বিগত দুবছরে বিশ্ববাজারে পণ্যের মূল্য বেড়েছে, ওই সময় দেশেও বেড়েছে। কিন্তু আন্তর্জাতিক বাজারে কমলেও আমাদের মূল্যস্ফীতি বেড়েই চলছে। ফলে বিশ্ববাজারে দাম কমলেই দেশে স্বয়ংক্রিয়ভাবে মূল্যস্ফীতি কমবে, সেটি ধরে নেওয়া যায় না।’

মাননীয় অর্থমন্ত্রী অর্থনৈতিক দুরবস্থার কথা বিবেচনা করে বাজেটে অগ্রাধিকারের কথা বলেছেন। অগ্রাধিকারের কয়েকটি নমুনা তুলে ধরলে তার যথার্থতা পাওয়া যায় না। আসন্ন বাজেটের বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) বাস্তবায়ন করার লক্ষ্যে এতে মোট ৭৬৬টি নতুন প্রকল্প অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এর মধ্যে ১৪টি প্রকল্প ‘নিম্ন অগ্রাধিকার’, ৮২টিকে ‘মধ্যম অগ্রাধিকার’, আর ৬৮২টি প্রকল্পকে ‘উচ্চ অগ্রাধিকার’ হিসাবে বিবেচনা করা হয়েছে। কোন ধরনের প্রকল্পকে ‘উচ্চ অগ্রাধিকার’ দেওয়া হয়েছে, তার কয়েকটি উদাহরণ দেওয়া যায়। এগুলোর একটি হলো কক্সবাজার শহরের সৌন্দর্য বৃদ্ধির জন্য নানা রঙের সড়কবাতি, ফুটওভার ব্রিজ ও ভাস্কর্য প্রকল্প। প্রকল্পটিতে ব্যয় ধরা হয়েছে ২৪ কোটি টাকা। ঢাকার গুলশান-বনানীতে তিনটি পরিত্যক্ত বাড়ি ভেঙে সরকারি কর্মকর্তাদের জন্য নির্মাণ করা হবে বহুতল বিশিষ্ট বাসভবন। এ ভবন প্রকল্পে খরচ করা হবে ২১৭ কোটি টাকা। মিশরের রাজধানীতে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূতের ভবন নির্মাণও ‘উচ্চ অগ্রাধিকারের’ তালিকায় রাখা হয়েছে। এ প্রকল্পে ব্যয় ধরা হয়েছে ১৬৫ কেটি টাকা। এ সময়ে এ ধরনের প্রকল্প সম্পর্কে সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) নির্বাহী পরিচালক ড. সেলিম রায়হান সংবাদমাধ্যমকে বলেন, ‘অর্থনীতির এ সংকটের সময়ে এ ধরনের বিলাসী মানসিকতার প্রকল্প অনুমোদন কোনোভাবেই সমর্থনযোগ্য নয়। আমরা যখন সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে কৃচ্ছ সাধন করার কথা শুনি, তখন অবাক হতে হয় এই ভেবে যে, কীভাবে এ ধরনের প্রকল্প অনুমোদন পেতে পারে। অবশ্যই বাজেট প্রস্তাবনায় এ ধরনের প্রকল্প বাতিল করা প্রয়োজন।’

কে কার কথা শোনে! তাই ধরে নেওয়া যায়, আসন্ন বাজেট গতানুগতিক হবে এবং এর দ্বারা সাধারণ জনগোষ্ঠীর স্বার্থে কোনো অর্জন সম্ভব হবে না। বরাবরের মতোই একটি ক্ষুদ্র ধনিক শ্রেণির স্বার্থ রক্ষিত হবে এ বাজেটে।

মুঈদ রহমান : অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম