নীতি দুর্নীতি অর্থনীতি
আগ্রাসী বাজার অর্থনীতির পথ ছাড়তে হবে
ড. আর এম দেবনাথ
প্রকাশ: ০১ জুন ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
একশ্রেণির লোভী, অতিলোভী প্রভাবশালী ব্যবসায়ী কীভাবে বাজার অর্থনীতির (মার্কেট ইকোনমি) জন্য বদনাম কামাই করছেন, তার একটি উদাহরণ বিমানের ভাড়া। একটি কাগজে দেখলাম ঢাকা-কুয়ালালামপুর বিমান টিকিটের দাম এক লাখ টাকায় উঠেছে। সাধারণভাবে এ ভাড়া থাকে ২০-২৫ হাজার টাকা। এখন প্রবাসী শ্রমিকদের মালয়েশিয়ায় যাওয়ার দরকার। তাই চাহিদা বেড়েছে। অতএব, ভাড়া বৃদ্ধি-তাও মাত্রাতিরিক্তভাবে পাঁচগুণ। অসম্ভব একটা ব্যাপার। চাহিদা-সরবরাহের কথা বলে একশ্রেণির বিমান কোম্পানি টিকিটের দাম পাঁচগুণ করেছে। শুধু এই ঘটনা নয়, বিমানের বিভিন্ন গন্তব্যের ভাড়া আজ একরকম তো কাল আরেকরকম। যতই দিন এগোয়, ততই বাড়ে ভাড়া। সবাই বাজারের কথা বলে। চাহিদা-সরবরাহের কথা বলে।
এ মুহূর্তে ঢাকা-কুয়ালালামপুর রুটের ভাড়া পাঁচগুণ হওয়ার যুক্তি কী? তেল খরচ বেড়েছে? না, তা বাড়েনি। শ্রমিক-অফিসার-পাইলটের বেতন বেড়েছে? না, তাও নয়। প্রচালন ব্যয় বেড়েছে? না, তা নয়। তাহলে কেন এ ধরনের অস্বাভাবিক বৃদ্ধি? ঠিক যেন অন্যান্য জিনিসের মূল্যবৃদ্ধির মতোই ব্যাপারটা! ঝড়-বৃষ্টি, রোদ-খরা, সরবরাহ সংকট, ফিডের মূল্য, সারের মূল্য, উৎপাদনের খরচের কথা বলে একশ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ী যেমন যখন-তখন পণ্যের মূল্যবৃদ্ধি করে, ঠিক তেমনি সংগঠিত খাতের কিছু ব্যবসায়ীও এ কাজটি করছেন। মনে হয় এসব তদারকি করার মতো কেউ দেশে নেই। নেই বলেই দরিদ্র কৃষকের ছেলেদের পাঁচগুণ মূল্যে টিকিট কেটে যেতে হয়েছে মালয়েশিয়ায়। এতে কি কোনো আপত্তি আছে? দৃশ্যত কোনো আপত্তি নেই। কারণ এটি ‘মার্কেট ইকোনমি’। এখানে চাহিদা ও সরবরাহের ভিত্তিতে পণ্যের মূল্য নির্ধারিত হবে, যদি না সরকারি কোনো প্রতিষ্ঠান এতে বাধা সৃষ্টি না করে। অবশ্য সরকারি হস্তক্ষেপ এসব ক্ষেত্রে কোনোদিনই কাজে আসেনি। ফলে বাজার অর্থনীতির পুরো ফসল তুলে নিচ্ছে একশ্রেণির ব্যবসায়ী। তাও তারা তা করছে খরিদ্দার, ভোক্তা ও গ্রাহকদের স্বার্থের বিনিময়ে। মেনে নিলাম তাদের কীর্তি-কার্যকলাপ। তবে কয়েকটি প্রশ্ন আছে।
আমি নিশ্চিত, অনেক বিমান কোম্পানির ব্যাংক ঋণ আছে। তা বিভিন্ন ব্যাংকে। বর্তমানে বাজার অর্থনীতিরই কারণে খোলাবাজারে ঋণের ওপর সুদের হার বেড়েছে। সাবেক অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালের ৯-৬ সুদনীতির নিয়ম থেকে বাংলাদেশ ব্যাংক সরে এলে ঋণের ওপর সুদের হার বাড়তে বাড়তে এখন কোথাও কোথাও শতকরা ১২/১৩/১৪ শতাংশে উঠেছে বলে অভিযোগ। ব্যবসায়ীরা এ সম্পর্কে অভিযোগও করেছেন। তারা প্রধানমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। অর্থমন্ত্রীকে তাদের অভিযোগের কথা জানিয়েছেন। তেলের মূল্যবৃদ্ধি, ডলারের মূল্যবৃদ্ধি, জাহাজ ভাড়া বৃদ্ধি, কষ্ট অব বিজনেস বৃদ্ধি ইত্যাদিতে তারা নাকাল। ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে শিল্প উৎপাদন। শেষ পর্যন্ত আমদানি-রপ্তানি ব্যবসা হবে ক্ষতিগ্রস্ত। সরকারি রাজস্ব তো বটেই। হবে ঘাটতি বাজেট। উন্নয়নের জন্য টাকা পাওয়াই যাবে না। এসব জানা কথা, বহুল কথিত কথা। কে না জানে এসব। কিন্তু মূল প্রশ্ন তো এক জায়গায়-বাজার অর্থনীতি মানলে সর্বাংশে তা মানতে হবে। নিজের স্বার্থের বেলায় মানব, অন্যদের বেলায় মানব না-তা হয় কী করে? তাহলে তো সামঞ্জস্যপূর্ণ অর্থনীতি হয় না। বাজার অর্থনীতির নিয়ম পুরোপুরি মানা দরকার। বাজার অর্থনীতির নামে একে আগ্রাসী একটা ব্যবসায় আমরা নিয়ে যেতে পারি না। তাহলে অর্থনৈতিক, ব্যবসায়িক শৃঙ্খলা বলতে কিছুই থাকবে না।
এখানে আমার বক্তব্য হচ্ছে, বাজার অর্থনীতির মূল কাঠামো মানতে হবে। এর মূল কথা হচ্ছে প্রতিযোগিতা, দক্ষতা, মেধা ও শ্রম। বাজার অর্থনীতির অর্থ অবস্থার সুবিধা নেওয়া নয়। প্রতিযোগিতার ভিত্তিতে, মেধার ভিত্তিতে চললে কারও অসুবিধা হয় না। যেমন এ মুহূর্তে ব্যাংকগুলোও বাজার অর্থনীতির পুরো সুবিধা তুলতে ব্যস্ত। দেখা যাচ্ছে, তারা আমানতকারীদের আমানতের ওপর সুদ দিচ্ছে কম। অথচ ব্যবসায়ী ও শিল্পপতিদের কাছ থেকে জুলুম করে সুদ আদায় করছে। আদায় করছে ২০-৩০ রকমের চার্জ, যার মাথামুণ্ড বোঝা দায়। এ কারণে দেখা যাচ্ছে, ব্যাংকগুলোর ‘স্প্রেড’ (সুদ আয় এবং সুদের ওপর ব্যয়ের পার্থক্য) দিন দিন বাড়ছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য একথা জানান দিচ্ছে। তারা, বোঝাই যাচ্ছে, অবস্থার সুযোগ নিচ্ছে। এ মুহূর্তে বিমান কোম্পানিগুলো যে আচরণ করছে, অনেক ব্যাংকও একই কাজ করছে। নিয়ম উভয়েই ভাঙছে। কেউ বাজার অর্থনীতির মূল নিয়ম মানছে না। তাও বুঝতাম যদি ব্যাংকগুলো সুদ আয়ের একটা ভালো অংশ আমানতকারীদের দিত। না, তারা তা দেয় না। অর্থাৎ দেখা যাচ্ছে, সুযোগ কেউ ছাড়ছে না। ব্যাংকগুলো দেখছে, বাজারে ঋণের চাহিদা প্রচুর; অথচ আমানতের সরবরাহ কম। অনেক ব্যাংক ‘কলমানি মার্কেট’ থেকে ঋণ নিচ্ছে। ঋণ নিচ্ছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে। এসব দিয়েই তারা ব্যবসায়ীদের ওপর অত্যাচার চালাচ্ছে। অবশ্য সুদের হার বৃদ্ধির আরেক কারণ সরকারি ঋণ। সরকারও বাজার থেকে উচ্চ সুদে ঋণ নিচ্ছে। সরকার যদি উচ্চ সুদে ঋণ নিতে পারে, তাহলে ব্যাংকগুলো উচ্চ সুদে ঋণ দিতে পারবে না কেন? এসব হচ্ছে পালটাপালটি যুক্তি। কিন্তু এতে ক্ষতিগ্রস্ত হয় অর্থনীতি, ব্যবসা-বাণিজ্য।
অতি মুনাফার লোভের কারণে সৃষ্ট বর্তমান পরিস্থিতি মারাত্মক এক পর্যায়ে গিয়ে পৌঁছেছে। কেউ ভাবছেই না যে আমাদের এর বিকল্প পথ খুঁজতে হবে। প্রথমেই আগ্রাসী বাজার অর্থনীতির পথ আমাদের ছাড়তে হবে। বাজার অর্থনীতিকে করতে হবে কল্যাণকর। দ্বিতীয়ত, ঋণ সম্পর্কে আমাদের এখনই ভাবতে হবে। বিশ্বের পরিসংখ্যান বলছে, সারা দুনিয়ার দেশগুলোর সরকার, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তিরা যে ঋণ করেছে, তার মাত্র পাঁচ ভাগের এক ভাগ হচ্ছে বিশ্ব অর্থনীতির আকার। অর্থাৎ বিশ্ব অর্থনীতির (ওয়ার্ল্ড জিডিপি) আকার এক হলে আমরা সবাই মিলে ঋণ করে ফেলেছি তার পাঁচগুণ। আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো একে এখন বিপজ্জনক বলে চিহ্নিত করছে। গরিব দেশগুলোর বিপদ বেশি। তারা প্রয়োজনের অতিরিক্ত ঋণ করে ফেঁসে যাচ্ছে। প্রতিবেশী মালদ্বীপ, শ্রীলংকা, পাকিস্তান ও নেপাল এর উদাহরণ। আবার একক দেশ হিসাবে সবচেয়ে বেশি ঋণী আমেরিকা এবং তাদের নাগরিকরা। তারা ঋণের ওপর ভাসছে। খ্যাতনামা অর্থনীতিবিদরা এ অবস্থাকে টেকসই উন্নয়নের লক্ষণ মনে করেন না। আমরাও কিন্তু এ পথেই এগোচ্ছি। জিডিপির তুলনায় আমাদের ঋণ তত বেশি নয়। কিন্তু পরিশোধের সক্ষমতার তুলনায় অনেক বেশি। যেমন রপ্তানি আয় ও রেমিট্যান্স ধরে হিসাব করলে আমাদের অবস্থা ভালো দেখায় না। এটা সরকারি হিসাব, সরকারের ঋণের হিসাব। আমাদের ব্যবসায়ীদেরও একই অবস্থা। বড় বড় করপোরেটদের ঋণের পরিমাণ অনেক আগেই অনেক বেশি হয়ে গেছে। সস্তায় ও সুলভে ঋণ পাওয়ায় তারা শুধু ঋণই নিয়েছে। এরকম অনেক কোম্পানি এখন ‘ওভার বরোড কোম্পানি’। একটি বড় উদাহরণ হচ্ছে, অধুনা সমস্যায় পড়া ‘সিনহা গ্রুপের’ প্রতিষ্ঠান। তারা ব্যাংকের টাকা ফেরত দিতে পারছে না। একটি বিদেশি ব্যাংক তাদের সম্পদের বিপরীতে মামলা করেছে। আমি কোম্পানির আর নাম বলব না। অনেক কোম্পানির কাজকর্ম তলানিতে। অথচ ঋণের পরিমাণ শত শত, হাজার হাজার কোটি টাকা। কেউ কেউ ৫-৭-১০ হাজার কোটি টাকা পর্যন্ত ঋণ নিয়ে এখন প্রমাদ গুনছেন। অনেক বড় বড় কোম্পানির মালিক প্রয়াত হয়েছেন। তাদের সহায়-সম্পত্তি নিয়ে মামলা-মোকদ্দমা শুরু হয়েছে। কোম্পানিগুলো এতই অতিকায় হয়েছে যে কেউ তা এখন সামাল দিতে পারছে না। নতুন প্রজন্ম অনেক ক্ষেত্রেই প্রস্তুত নয়। এসব ‘ওভার বরোড কোম্পানি’ এখন চিনি, ইস্পাত, লোহা, চা, নির্মাণশিল্প থেকে শুরু করে সব ক্ষেত্রে বিরাজমান। ব্যাংকাররা এতে আতঙ্কিত। কী হবে শেষ পর্যন্ত?
অর্থাৎ দেখা যাচ্ছে, সারা বিশ্বের মতোই আমাদের সরকার অতিমাত্রায় ঋণগ্রস্ত। বেসরকারি খাতের ব্যবসায়ীরা অতিমাত্রায় ঋণগ্রস্ত। ব্যক্তি কি কম যাচ্ছে? মনে হয় না। ধীরে ধীরে ব্যক্তিরাও ঋণের খপ্পরে পড়ছে। দেশের এক-তৃতীয়াংশ লোক ঋণী। তারা ঋণ করে খায়। এক ঋণ নিয়ে আরেক ঋণ শোধ করে। চলছে আয়োজন ‘ক্যাশলেস সোসাইটির’। ‘নো ক্যাশ’। তাহলে কোথায় যাব আমরা? ডিজিটাল মুদ্রায়? জানি না কী হবে দশা। শেষ পর্যন্ত ডিজিটাল মুদ্রার নাম করে না জানি আমরা হয়ে পড়ি ঋণগ্রস্ত-ক্রেডিট কার্ডধারী। ডলারে ঋণ, টাকায় ঋণ। জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত ঋণ। ঠিক যেন উন্নত বিশ্বের মতো।
এসব দেখে মনে হয়, আমরা আমাদের এ অঞ্চলের প্রখ্যাত প্রাচীন দার্শনিক ‘চার্বাকের’ শিষ্য হতে চলেছি। তার কথা-‘ঋণ করো, ঘি ঘাও’, ভালো থাকো। বাঙালি আমরা ছিলাম লালনের শিষ্য, আউল-বাউল-মাইজভাণ্ডারি। মনে হয় ওই পথে এখন আমরা নেই। কিন্তু তাহলে কী হবে? ঋণ কি আমাদের ছাড়বে? সুদের ভার, অতিরিক্ত সুদের ভার থেকে কি আমরা মুক্ত হতে পারব? পারা উচিত। কীভাবে?
কোম্পানিগুলো, বিশেষ করে সংগঠিত খাতের কোম্পানিগুলো, ঋণের বাজার থেকে চলে আসতে পারে। বোঝাই যায় তারা সুদের ভারে আক্রান্ত। এটা হয়েছে ঋণের কারণে। সরকারেরও একই অবস্থা। রাজস্ব আদায় করতে না পেরে সরকার সমানে ঋণ করে যাচ্ছে। অতএব বাড়ছে সুদের খরচ-ভীষণ হারে। একইভাবে বেশি বেশি ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়ছে আমাদের বড় বড় কোম্পানি। তারা কি এ পথ ছেড়ে বিকল্প পথে যেতে পারে না? দেশে কি বিকল্প পথ নেই? দেশে কি শেয়ারবাজার নেই? বড় বড় কোম্পানি কি শেয়ারবাজারে যেতে পারে না? নিশ্চয়ই পারে। অনেক বড় বড় ব্যবসায়ী আছেন, যারা সফল ব্যবসায়ী। তারা অনেক সম্পদ করেছেন। অনেকের বাজারে বেশ সুনামও আছে। কিন্তু দেখা যাচ্ছে, তারা শেয়ারবাজার থেকে ঋণের বাজারকে বেশি পছন্দ করেন। এর প্রথম কারণ, তারা সম্পদের ভাগাভাগি চান না। শেয়ারহোল্ডাররা একটা ভাগ পাক, তারা চান না। তারা আইন-নিয়মের অধীনে পড়তে চান না। এটা হতো না যদি আমাদের সরকার একটু কঠিন হতো। আমরা ঋণকে করে ফেলেছি সস্তা ও সুলভ। ধমকেই ঋণ পাওয়া যায়। বাংলাদেশ ব্যাংক এখানে কোনো বিষয়ই না। তারপর নয়-ছয়ের মতো আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত করে ব্যবসায়ীদের আমরা প্রতিযোগিতা থেকে ফিরিয়ে আনি। প্রকৃতপক্ষে সুদ ব্যয় তো কোনো প্রতিষ্ঠানের একমাত্র ব্যয় নয়। একটা কোম্পানির অনেক খরচ আছে। প্রশাসনিক খরচ, বিদ্যুৎ ও অবকাঠামোগত খরচ আছে। কাঁচামালের দাম আছে। যন্ত্রপাতি ও যন্ত্রাংশের মূল্য আছে। দক্ষতা অর্জন দরকার সব ক্ষেত্রে। আমাদের একশ্রেণির ব্যবসায়ী শুধু সুদ ব্যয়কেই বড় করে দেখেন। বাকি খরচেরও যে দক্ষতা দরকার, তা তারা বুঝতে চান না। আমি মনে করি, এটাই মোক্ষম সময়। ব্যাংক খাতকে গাড্ডা থেকে মুক্ত করতে চাইলে বড় বড় ব্যবসায়ীকে ব্যাংকমুখী হওয়া থেকে বিরত করা দরকার।
ড. আর এম দেবনাথ : অর্থনীতি বিশ্লেষক; সাবেক শিক্ষক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়