দৃশ্যমান শক্তির পেছনের অদৃশ্য চিত্র
এ কে এম শাহনাওয়াজ
প্রকাশ: ২৮ মে ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো অনেক বছর ধরেই কোণঠাসা অবস্থায় আছে। গত জাতীয় নির্বাচনে বিএনপি দলীয় কর্মী-সমর্থকদের নিয়ে ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করেছিল। বেশ আশার সঞ্চারও করতে পেরেছিল দলটি। কিন্তু নেতৃত্বের দুর্বলতায় ও ভিন্ন পথে ক্ষমতায় আসার স্বপ্ন দেখতে গিয়ে আবার রেসের মাঠ থেকে ছিটকে পড়েছে। অদূর ভবিষ্যতে যে এসব দল মাথা তুলে দাঁড়াতে পারবে, এমন বোধ হয় না। এর মধ্যে সরকার নিজেকে অনেকটা গুছিয়ে নিয়েছে। শেখ হাসিনার দক্ষ নেতৃত্বে বাংলাদেশ উন্নয়নের সোপান পেরোচ্ছে একে একে। কিন্তু কোনো দেশে কিছু কিছু ক্ষেত্রে উন্নয়নের সূচক ঊর্ধ্বমুখী হলেও সে উন্নয়ন টেকসই হবে তা হলফ করে কেউ বলতে পারে না। সুশাসন প্রতিষ্ঠা ও শিক্ষার ভিত শক্ত না হলে সব আয়োজন চোরাবালিতে ডুবে যেতে পারে। প্রায় রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জ না থাকার মতো অবস্থায় থেকেও সরকার পরিচালকরা কেন যে নিজ দলের সুবিধাবাদীদের বিরুদ্ধে শক্ত হতে পারছেন না, তা এক বিস্ময়। এরাই সরকারের পেছনে আরেকটি সরকার গড়ে তুলেছে যেন। আর এ অদৃশ্য সরকার যেন ক্রমে দৃশ্যমান সরকারের চেয়েও শক্তিশালী হয়ে পড়ছে। এদের কারণে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সব সৎ উদ্যোগ না নড়বড়ে হয়ে পড়ে এ আশঙ্কা এখন সচেতন মানুষের।
এমন এক হযবরল অবস্থা যে, আজ দায়িত্বশীলরা জনকল্যাণমুখী একটি সিদ্ধান্ত জানান, তো কালই সুবিধাভোগীদের রক্তচক্ষু দেখে সিদ্ধান্ত কার্যকর না করে থমকে দাঁড়ান। এসবের কারণে ক্রমে মানুষের চোখে আরও অনেক প্রতিষ্ঠানের মতো আদালতও দুর্বল হয়ে পড়ছে। সরকারের ঘোষিত নীতির প্রতি আস্থা রাখা কঠিন হয়ে পড়ছে।
কতবার আদালত নদী দখলমুক্ত করার পক্ষে রায় দিয়েছেন, কিন্তু অনেক ক্ষেত্রে কার্যকর করা সম্ভব হয় না। ঢাকা থেকে নানা অঞ্চলে প্রকাশ্যে প্রাকৃতিক জলাধার ভরাট করে নানা স্থাপনা হচ্ছে। আদালত নিষেধাজ্ঞা দিলেও কোনো প্রতিকার হচ্ছে না। নিশ্চয়ই সরকারের চেয়ে বড় সরকার সেখানে ছড়ি ঘোরাচ্ছে।
পদ্মা সেতু উদ্বোধনের আগের কথা। সে সময়ের একটি সংবাদ অনেকের মনে থাকতে পারে। কাঁঠালবাড়ি ফেরিঘাটে সরকারের একজন যুগ্ম সচিবের জন্য বিলম্ব করতে গিয়ে অ্যাম্বুলেন্সে থাকা আহত কিশোর মারা যায়। এ নিয়ে দেশজুড়ে বিরূপ প্রতিক্রিয়া তৈরি হয়েছিল। এরপর আদালত বৈপ্লবিক সিদ্ধান্ত জানায়। পর্যবেক্ষণে বলা হয়, দেশে মহামান্য রাষ্ট্রপতি ও মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ছাড়া কেউ ভিআইপি নন। বাকি সবাই রাষ্ট্রের কর্মচারী মাত্র। গণমাধ্যমে আদালতের এ বক্তব্য প্রচারের পর আমি বিস্মিত হয়েছিলাম। ভিআইপি বিড়ম্বনা থেকে বাঁচা যাবে ভেবে স্বস্তি পাওয়ার বদলে শঙ্কিত হয়েছিলাম। শঙ্কা এজন্য যে, আদালত যদি আবারও জনগণের চোখে দুর্বল হয়ে যায়! ছোটবেলা থেকে জেনে এসেছিলাম ‘হাকিম নড়ে তো হুকুম নড়ে না’ কথাটি। এখন তো মনে হয়, এ ছিল সত্য যুগের কথা। আদালতের রায় নিয়ে কটাক্ষ করলে আদালত অবমাননার দায়ে এখনো সাধারণ মানুষকে কাঠগড়ায় ঠিকই দাঁড়াতে হয় আর রাজনৈতিক শক্তিধররা আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে গণমাধ্যমে ক্ষোভ প্রকাশ করলে, এমনকি আদালত প্রাঙ্গণে মিছিল করলেও আদালত অবমাননা হয় না। ধরে নিচ্ছি এসবের পেছনে হয়তো আইনের ফাঁক আছে। কিন্তু সেসব তো সাধারণ মানুষ জানবে না। এর ব্যাখ্যাও কখনো দেওয়া হয় না। তাই আদালতের সম্মান নিয়ে সাধারণ মানুষ বিভ্রান্ত হতেই পারে।
আদালতের দেওয়া ভিআইপির সংজ্ঞা নিয়ে আমার শঙ্কার কারণটি এখন বলি। এতকালের সুবিধাভোগী ভিআইপিরা শেষ পর্যন্ত আদালতের এমন ব্যাখ্যা মেনে নেবেন কিনা এ নিয়ে আমার সন্দেহ ছিল। না মানলে আবার তো আদালত সাধারণ মানুষের চোখে দুর্বল হয়ে যাবে। সে সময় আমার পরিচিত পুরোনো সংজ্ঞার একজন ভিআইপি আমলা একান্তে আমাকে জানিয়েছিলেন, আদালতের এ ব্যাখ্যা টেকানো সম্ভব নয়। কারণ তিনি জানেন সংশ্লিষ্ট প্রশাসন এখন কাদের ভিআইপি নিরাপত্তা আর ভিআইপি মর্যাদা দেবে তা নিয়ে দ্বন্দ্বে পড়েছে। একজন আদালতসংশ্লিষ্ট ভিআইপি ফেরিঘাট পেরোবেন। তিনি বা তারা ভিআইপি প্রটোকল পেয়ে আসছেন। এখন তা থেকে বঞ্চিত হতে চান না। আর আমলা ভিআইপিরা তো অনেক বেশি শক্তিমান। তারা সাধারণত নিজেদের জন্য সুবিধা বাড়াতে চান। খর্ব করার তো প্রশ্নই ওঠে না। দুর্বল গণতন্ত্রের দেশে ভোটের রাজনীতিতে আমলাদের গুপ্ত পথে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা থাকে। সরকারপক্ষীয় রাজনীতিকদের এ দুর্বলতা আমলারা জানেন। তাই প্রতি নির্বাচনের আগে নিজেদের নানা সুযোগ-সুবিধা বাড়িয়ে নেন। আমলারা ছাড়া প্রবীণ অধ্যাপক, এমনকি আন্তর্জাকিতভাবে খ্যাতিমান বিজ্ঞানী-গবেষক-ডাক্তার কারও কোনো মূল্য নেই। ভিআইপির সংজ্ঞায় তারা যুক্ত হন না। দলীয় সরকার টিকে থাকতে চায় আমলা আর নিজ দলীয় রাজনৈতিক নেতাদের নিয়ে। এরা সবাই গড়ে তোলেন সরকারের পেছনের সরকার। এভাবে অন্য পেশাজীবী ও সাধারণ অ-ভিআইপি নাগরিকরা অনেকটা যেন অস্পৃশ্য হয়ে পড়েন।
আমার আশঙ্কাই ঠিক হলো। এর কিছু দিন পর কাগজে দেখলাম আদালতের ভিআইপি সংজ্ঞা নীরবে বাতিল করে দিয়ে আগের নির্ধারিত সবাই ভিআইপি সম্মান ফিরে পেয়েছেন। এ সত্যটি আমাদের মানতেই হবে, যত যুক্তিই থাকুক সুবিধা ভোগকারী গোষ্ঠী সুবিধা হারাতে চাইবে না।
সরকারের ভেতরের সরকার এভাবেই শক্তিশালী হয়ে পড়ে দৃশ্যমান সরকারের চেয়েও। একই কারণে ঋণখেলাপিদের ঋণের মাত্রাই কেবল বাড়ে। আর শাস্তির বদলে এরা সহাস্য বদনে সরকারের ডানে-বামে অবস্থান নেয়। অ-ভিআইপিরা ঘর-সংসার ফেলে বিদেশে ঘাম ঝরিয়ে দেশের জন্য টাকা পাঠায় আর সম্মানিত ভিআইপিদের অনেকে দেশের টাকা বিদেশে পাচার করেন। এদের বিরুদ্ধে সরকারের কিচ্ছু করার নেই। সরকারের ভেতরের সরকার শক্তিশালী বলে ঘুস-দুর্নীতির রাহুগ্রাস থেকে আমাদের মুক্তি নেই।
গণতান্ত্রিক দেশের সরকার ও সরকারি দল বরাবরই একটি বেকায়দা অবস্থায় থাকে। যেহেতু মানুষের যাবতীয় নিরাপত্তা ও কল্যাণ নিশ্চিত করার দায়িত্ব থাকে সরকারের ওপর এবং জনগণের অধিকার রক্ষা ও নিয়ন্ত্রণকারী যাবতীয় প্রতিষ্ঠান পরিচালনার দায়িত্ব অর্পিত থাকে সরকারযন্ত্রের হাতে, তাই সামগ্রিক সাফল্যের গৌরব ও ব্যর্থতার দায় তাদেরই বহন করতে হয়। এ দেশের স্বার্থবাদী বিরোধী রাজনীতিকরা বরাবরই সরকারকে দুর্বল করার জন্য নৈরাজ্য উসকে দিতে ভূমিকা রাখে। ফলে রাজনৈতিক দুরভিসন্ধির ঘেরাটোপ থেকে বেরিয়ে আসার জন্য সরকারকেও গ্রহণ করতে হয় নানা রাজনৈতিক কৌশল। এ ব্যাপারে সরকারকে সহযোগিতা করার জন্য ভূমিকা রাখতে পারে সরকারি দল। সরকারি দলের ইতিবাচক ভূমিকার কল্যাণে গণবিচ্ছিন্ন হওয়ার হাত থেকে রক্ষা পেতে পারে সরকার, প্রাজ্ঞ রাজনীতিকদের পরামর্শে সরকারযন্ত্রের নিষ্ক্রিয়তা ও দুর্বলতাগুলো অপসৃত হতে পারে। সরকারি দলের রাজনীতিকদের সতর্ক দৃষ্টি ও মনিটরিংয়ের কারণে সতর্ক হয়ে যেতে পারে দুর্নীতিপরায়ণ আমলাতন্ত্র বা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। সরকারযন্ত্র যখন নিন্দিত হতে থাকে, তখন সরকারি দলের কর্মীদেরই ঝাঁপিয়ে পড়ার কথা এসব নৈরাজ্য প্রতিহত করে সরকারকে কালিমার হাত থেকে বাঁচাতে।
কিন্তু এসব গ্রহণযোগ্য যুক্তি হলেও আমাদের দেশের পরিপ্রেক্ষিতে সব যেন স্বপ্নবিলাস। বিএনপি, আওয়ামী লীগ, ছাত্রদল, ছাত্রলীগ, যে যখন ক্ষমতায় থেকেছে, নিজ সরকারকে জনপ্রিয় করায় কোনো ভূমিকা রাখেনি। বরং যাবতীয় অন্যায়ের চালিকাশক্তি, প্রেরণা প্রদানকারী হিসাবেই চিহ্নিত হয়েছে। তাই সরকারের পেছনের এ সরকার অর্থাৎ সরকারি দলের অনেকেই যখন সরকারি শক্তিকে পুঁজি করে অনাচারে লিপ্ত থাকে, তখন সরকারযন্ত্রের যাবতীয় বক্তব্য ফাঁকা বুলি হিসাবেই চিহ্নিত হয়।
সন্ত্রাস আর চাঁদাবাজিতে অতিষ্ঠ সমাজের মানুষ। প্রতিদিন সাধারণ নাগরিকের সম্পদ লুণ্ঠিত হচ্ছে। সামান্য উপলক্ষ্যে খুন হয়ে যাচ্ছে মানুষ। অসহায় মানুষ বুঝতে শিখেছে, এর মধ্য দিয়েই তাদের বেঁচেবর্তে থাকতে হবে। সরকারযন্ত্র এক্ষেত্রে নিরুপায়। অধিকাংশ ক্ষেত্রে সন্ত্রাসী ও চাঁদাবাজদের পরিচয় সরকারি দল ও এর অঙ্গ সংগঠনগুলোর সঙ্গে যুক্ত আছে। ব্যবসায়ীরা চাঁদাবাজদের দাবি পূরণে বাধ্য হন। কারণ তারা জানেন, ওদের টিকিও ছোঁবে না আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। এ বাহিনীর সেই ক্ষমতাই বা কোথায়! কারণ চাঁদাবাজদের ‘গডফাদার’ সরকারি দলের নেতার ধমক সইতে হয় তাদের। বিশ্ববিদ্যালয়সহ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে সরকারি দলের ছাত্র সংগঠনের নেতা থেকে কর্মী হতে পারাও এখন সংশ্লিষ্টরা সৌভাগ্যের প্রতীক বিবেচনা করে। কারণ অলিখিত নিয়ম হয়ে গেছে যে, সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের যে কোনো নির্মাণ কাজে একটি বখরা নেতাকর্মীদের হাতে আসতেই হবে। বিষয়টি এত প্রথাসিদ্ধ হয়ে গেছে, সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের কর্তারা চাঁদাবাজদের বখরা দিতে হবে বিবেচনায় একটি বর্ধিত হার ধরে দেন ঠিকাদারদের। এসব তস্করবৃত্তি সরকারি দলের ঊর্ধ্বতন স্তরের অগোচরে হয়-এ বিশ্বাস একমাত্র অর্বাচীনরাই করতে পারে। সরকারের হাইকমান্ড মনে করে, পেশিশক্তি ছাড়া তাদের অস্তিত্ব বিপন্ন হবে। আবার এ পেশিশক্তিকে টিকে থাকতে হলে কর্মীদের হাতে অস্ত্র ও অর্থের জোগান দিতে হবে। আর এভাবেই অর্থ সংগ্রহ করার অনুমোদন দিয়ে যাচ্ছেন তারা। এমনও শোনা যায়, চাঁদাবাজির অর্থের ভাগ কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব পর্যন্ত চলে যায়। এসব অভিযোগ বিশ্বাস করতে ইচ্ছা হয় তখনই, যখন দেখা যায় সরকারি সংগঠন বা অঙ্গ সংগঠনের নামে সন্ত্রাস-চাঁদাবাজি হচ্ছে এবং তা পত্রিকায় বিস্তারিত প্রকাশিত হলেও দল নীরবে হজম করে নিচ্ছে অভিযোগ। সরকারি দল বা অঙ্গ সংগঠনের সাইনবোর্ড থাকছে বলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তাদের টিকি ছোঁয়ারও চেষ্টা করছে না।
এরা সবাই সরকারের পেছনের সরকার। মাঝে মাঝে মনে হয়, এরাই নিয়ন্ত্রণ করছে সরকারকে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর যতই সদিচ্ছা থাকুক, সরকারের পেছনের সরকারকে শক্তিশালী রেখে দেশে সুশাসন প্রতিষ্ঠা সম্ভব নয়। সম্ভব নয় টেকসই উন্নয়ন।
এ কে এম শাহনাওয়াজ : অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
shahnawaz7b@gmail.com