কৃত্রিমভাবে পাকানো ফল কতটুকু নিরাপদ
ড. মুনীরউদ্দিন আহমদ
প্রকাশ: ২৬ মে ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
পাকা আম বাজারে আসা শুরু হয়েছে। আমার বিশ্বাস, এসব আম পরিপক্ব হওয়ার আগেই কৃত্রিমভাবে পাকিয়ে বাজারজাত করা হচ্ছে। পত্রিকায় প্রকাশ-অপরিপক্ব আম পরিপক্ব হওয়ার আগেই কৃত্রিমভাবে পাকিয়ে বাজারজাত করার কারণে ইতোমধ্যে অনেক আম জব্দ করে ধ্বংস করা হয়েছে।
আজকাল আর পাকা ফল গাছ থেকে পেড়ে বাজারজাত করা হয় না। কাঁচা ফল গাছ থেকে পেড়ে রাসায়নিক যৌগ দিয়ে কৃত্রিম উপায়ে পাকানো ফল বাজারজাত করা হয়। এ কারণে ভোক্তাদের মধ্যে আম ও অন্যান্য ফল খাওয়া নিয়ে সবসময় চরম আতঙ্ক বিরাজ করে। বাগান থেকে পাড়ার পর আমে পাঁচবারেরও বেশি রাসায়নিক মেশানো হয় বলে জানা যায়। সত্য কিনা জানি না, অভিযোগ রয়েছে-আম পাকার পর তা যেন পচে না যায়, এজন্য নিয়মিত স্প্রে করা হয় ফরমালিন। রাতে আমের দোকান বন্ধ করার আগে ফরমালিন স্প্রে করে রাখা হয়। ভোরে ওই আমের রাসায়নিক পরীক্ষা করা হলেও ফরমালিনের উপস্থিতি ধরা পড়ে না। তাছাড়া ক্যালসিয়াম কার্বাইড মেশানো আম উচ্চ তাপমাত্রায় রাখা হলে ক্যালসিয়াম সায়ানাইড তৈরি হতে পারে। ক্ষতিকর রাসায়নিক দিয়ে পাকানো আম খাওয়ার পর দীর্ঘমেয়াদি নানা জটিল রোগে আক্রান্ত হতে পারে মানুষ। আম বিক্রির এ মৌসুমে সংশয়ে ভুগতে হচ্ছে সবাইকে।
আম ব্যবসায়ীরা বলছেন, পঞ্চাশ কেজি আম পাকাতে আমের খাঁচায় ১০০ গ্রাম ক্যালসিয়াম কার্বাইড দেওয়া হয়। আম চকচকে করার জন্য এক ধরনের কেমিক্যাল দেওয়া হয়। ব্যবসায়ীরা আরও বলেছেন, জলীয়বাষ্পের সংস্পর্শে এসে ক্যালসিয়াম কার্বাইড অ্যাসিটাইলিন গ্যাস উৎপাদান করে। এ গ্যাসের প্রভাবে আম পাকে। আমে যতটুকু ক্যালসিয়াম কার্বাইডের জলীয় দ্রবণ ডুবানো হোক বা দেওয়া হোক না কেন, তা স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর হতে পারে। আম চাষি দাবি করেন, গাছপাকা আম পরিবহণ করলে খরচ পোষাবে না। গাছপাকা আম দেশের বিভিন্ন স্থানে নেওয়ার সময় তা নষ্ট হয়ে যাওয়ার আশঙ্কাই বেশি। প্রাকৃতিক উপায়ে ফল পাকার পর বিক্রি করতে আড়তে পাঁচ থেকে সাত দিন রাখার প্রয়োজন হয়। আর সব ফল একসঙ্গে পাকে না। এগুলো নিয়মিত বাছাই করতে খরচ বেশি পড়ে যায়। তাই তারা একসঙ্গে সব ফল পাকাতে রাসায়নিক পদার্থ প্রয়োগ করেন। নির্দিষ্ট সময়ের আগে আম পাকিয়ে বেশি মুনাফা পাওয়ার জন্য কিছু অসাধু ব্যবসায়ী এ অপরাধ করে থাকে। বাগানের বিভিন্ন গাছে আম ধাপে ধাপে পাকে। কিন্তু এভাবে ধাপে ধাপে পাকা আম পরিবহণ ও ব্যবসার জন্য সুবিধাজনক নয়। একসঙ্গে বিপুল পরিমাণ আম পাকাতে কেমিক্যাল প্রয়োগ করা হচ্ছে। এর ফলে ব্যবসায়ীদের পরিবহণ খরচ কম হয়। তাছাড়া ক্যালসিয়াম কার্বাইড ব্যবহারে ফলের রং সুন্দর হয়। ক্রেতাকে সহজেই আকৃষ্ট করা যায়। এছাড়া গাছে মুকুল আশার আগেই বিভিন্ন রাসায়নিক ব্যাপকভাবে ব্যবহার করা হয়। আম পূর্ণবয়স্ক হয়ে পাকা পর্যন্ত ৫ থেকে ৭ দফায় রাসায়নিক মেশানো হয়। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যে আম বেশি রঙিন, সে আমে যে রাসায়নিক মেশানো হয়েছে এটি নিশ্চিত। তাই হালকা সবুজাভ রয়েছে এমন আধপাকা আম কেনা সবচেয়ে নিরাপদ। বোঁটা কালো ও শুকনা দেখলে আম ও কাঁঠাল কিনবেন না। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, উন্নত প্রসেসিং অ্যান্ড প্যাকেজিং প্ল্যান্ট স্থাপন করা গেলে ২-৩ সপ্তাহ আম রাখা যাবে। সেক্ষেত্রে ফরমালিন ব্যবহারের প্রয়োজন হবে না। এ কাজে বেসরকারি উদ্যোক্তা বা সরকারকে এগিয়ে আসতে হবে। উন্নতমানের প্যাকেটে করে আম বাজারজাত করা গেলে নির্দিষ্ট সময়ের পর আম পাকবে। আল্ট্রাভায়োলেট রশ্মি দিয়ে আম জীবাণুমুক্ত করে প্যাকেটজাত করা যেতে পারে। আমি মনে করি, আমচাষির চাষ পদ্ধতিতে পরিবর্তন আনতে হবে। মুকুল আসার আগে ছত্রাক প্রতিরোধে একবার রাসায়নিক ব্যবহার, মুকুল পড়া বন্ধে এবং আম পরিপুষ্ট করতে ভিটামিনজাতীয় ওষুধ ব্যবহার এবং পোকা দমন করতে সীমিত কীটনাশক ব্যবহার করতে হবে। প্রতিটি বাগানে সমন্বিত বালাই ব্যবস্থাপনা পদ্ধতি তৈরি করতে হবে।
মুকুল আসার পরে এবং ফোটার আগে একবার স্প্রে এবং আরেকবার আম মটরদানার সমান হলে কীটনাশক দেওয়া যেতে পারে। দেশের মানুষ দাগবিহীন, পরিষ্কার ও সুন্দর আম কিনতে চায় না। কারণ তারা মনে করে পরিষ্কার ও সুন্দর আমে রাসায়নিক পদার্থ থাকে।
প্রবাদ আছে-‘প্রতিদিন একটি করে আপেল খাবেন, ডাক্তারের কাছে যাওয়া থেকে নিষ্কৃতি পাবেন।’ কথাটি আজকাল আর সত্য বলে মেনে নেওয়া যাচ্ছে না। শুধু আপেল নয়, আরও বহু রকম সুস্বাদু ফল খেয়ে কোনো কোনো সময় আমাদের ডাক্তারের কাছে দৌড়াতে হতে পারে। বিশেষ করে পাকা টমেটো, আম, কলা, পেঁপে, আনারসের মতো উপাদেয় ফল যদি ক্ষতিকর রাসায়নিক উপাদান দিয়ে কৃত্রিম উপায়ে পাকানো হয়। কৃত্রিম উপায়ে ফল পাকানোর কাজে ব্যবহার্য একটি ক্ষতিকর রাসায়নিক দ্রব্যের নাম ক্যালসিয়াম কার্বাইড। ইথ্রেল বা ইথেফোন ব্যবহার করেও কৃত্রিম উপায়ে ফল পাকানো যায়। তবে ইথ্রেল বা ইথেফোন ক্যালসিয়াম কার্বাইডের মতো ঝুঁকিপূর্ণ রাসায়নিক উপাদান নয়। কারণ, ক্যালসিয়াম কার্বাইডের সঙ্গে স্বাস্থ্য ও জীবনের জন্য বিপজ্জনক দুটি বিষাক্ত উপাদানের মিশ্রণ থাকে অল্প পরিমাণে। উপাদানগুলো হলো-বহুল পরিচিত আর্সেনিক ও ফসফরাস। অসাবধানতার কারণে এবং ভুল পদ্ধতিতে উচ্চমাত্রায় ক্যালসিয়াম কার্বাইড ব্যবহার করে কৃত্রিম উপায়ে ফল পাকানো হলে এ ফল আর্সেনিক ও ফসফরাস দ্বারা দূষিত হয়ে পড়তে পারে এবং বিষাক্ত উপাদান দুটি আমাদের শরীরে প্রবেশ করলে স্বাস্থ্যহানি ছাড়াও জীবন বিপন্ন হতে পারে। আর্সেনিক ও ফসফরাস দূষণের ফলে আমাদের শরীরে বিভিন্ন ধরনের উপসর্গ দেখা দেয়। এর মধ্যে রয়েছে বমি হওয়া, ডায়রিয়া, পেট ও বুকে জ্বালাপোড়া করা, তৃষ্ণা পাওয়া, সাধারণ দুর্বলতা, কথা বলতে বা কিছু গিলতে অসুবিধা হওয়া। এ ছাড়া হাত-পা অবশ হওয়া, শরীরের চামড়া ঠান্ডা ও ভিজে যাওয়া এবং রক্তচাপ কমে যাওয়ার মতো উপসর্গগুলোও দেখা দিতে পারে। ক্যালসিয়াম কার্বাইড অত্যন্ত ক্রিয়াশীল দ্রব্য বলে ভেজা হাতে ধরলে হাতে ফোসকা পড়ে যায়। অধিকাংশ ক্ষেত্রে আর্সেনিক ও ফসফরাস বিষাক্ততার উপসর্গগুলো আগেভাগে দৃশ্যমান হয় বলে সময়মতো চিকিৎসা নেওয়া সম্ভব হয়। সময়মতো চিকিৎসা না নিলে আর্সেনিক ও ফসফরাস বিষাক্ততার কারণে জীবন বিপন্ন হতে পারে।
দামে অতি সস্তা বলে ব্যবসায়ীরা ফল পাকানোর কাজে ক্যালসিয়াম কার্বাইডের যথেচ্ছ অপব্যবহার করে থাকে। এক কিলোগ্রাম ক্যালসিয়াম কার্বাইডের দাম ১০০ টাকার মতো। এক কিলোগ্রাম ক্যালসিয়াম কার্বাইড দিয়ে ১০ টন ফল পাকানো যায়। তবে ব্যবসায়ীরা সাধারণত ৫০ কিলোগ্রাম ফলের জন্য ১০০ গ্রাম ক্যালসিয়াম কার্বাইড ব্যবহার করে থাকে বলে জানা যায়।
কৃত্রিম উপায়ে ফল পাকানোর জন্য ব্যবহৃত রাসায়নিক উপাদানের কার্যপদ্ধতি এবং এর প্রভাব সম্পর্কে জানার আগে কাঁচা ফল প্রাকৃতিক উপায়ে কীভাবে পাকে, তা নিয়ে একটু আলোচনা করা যাক। প্রাকৃতিক উপায়ে ফল পাকার পেছনে যে রাসায়নিক উপাদানটি মূল ভূমিকা পালন করে থাকে, তার নাম ইথাইলিন। ইথাইলিন গাছ বা ফলে উৎপাদিত ছোট আকৃতির একটি প্রাকৃতিক রাসায়নিক যৌগ। ফল যখন পরিপক্ব হয়, তখন ফলে ইথাইলিনের উৎপাদনের পরিমাণ থাকে সর্বোচ্চ মাত্রায়। ইথাইলিন ফলের বিভিন্ন জিনকে উদ্দীপিত করার ফলে তৈরি হয় নানা ধরনের প্রয়োজনীয়সংখ্যক এনজাইম। এমাইলেজ ও পেকটিনেজ এ ধরনের দুই প্রকার গুরুত্বপূর্ণ এনজাইম। কাঁচা ফলের ভেতর থাকে স্বাদবিহীন দীর্ঘ আকৃতির শর্করা, যাকে আমরা বলি স্টার্চ। এমাইলেজ স্টার্চকে ভেঙে টুকরো টুকরো করে সুক্রোজ ফ্রুকটোজের মতো ছোট আকৃতির যৌগে রূপান্তরিত করে দেয়। এ বিক্রিয়া ফলের আটাতুল্য গুণাবলিকে কমিয়ে ফলকে মিষ্টি ও রসালো করে তোলে। অন্যদিকে পেকটিনেজ ফলের শক্ত খোসা বা আবরণ পেকটিনকে ভেঙে দিয়ে তাকে নরম করে ফেলে। অন্য আরেক ধরনের এনজাইম ফলের সবুজ ক্লোরোফিলকে রাসায়নিক রূপান্তরের মাধ্যমে কেরোটিনয়েডের মতো রঙিন উপাদান সৃষ্টি করে বলে পাকা ফল লাল বা হলুদ বর্ণ ধারণ করে। বিভিন্ন এনজাইমের রাসায়নিক কর্মকাণ্ডের ফলে বিভিন্ন রঞ্জক পদার্থের সৃষ্টি হয় বলে পাকা ফল বিভিন্ন রং ধারণ করে। অন্য একটি এনজাইম ফলে বিদ্যমান অ্যাসিডকে ভেঙে দিয়ে তার অম্লত্বকে নিরপেক্ষ করে দেয় বলে কাঁচা টক ফল পাকলে আর টক থাকে না। ফলের বৃহদাকৃতির যৌগগুলো ভেঙে ছোট ছোট উদ্বায়ী যৌগে রূপান্তরিত হয় বলে আমরা ফলের নানা সুগন্ধ পাই।
গাছে সব ফল একসঙ্গে পাকে না। ব্যবসায়ীরা বেশি মুনাফার জন্য অল্প সময়ের মধ্যে সব ফল বিক্রি করার উদ্দেশ্যে পরিপক্ব-অপরিপক্ব সব ধরনের ফল পেড়ে নিয়ে একসঙ্গে কৃত্রিম উপায়ে পাকানোর পন্থা গ্রহণ করে। অপরিপক্ব ফল কৃত্রিম উপাদানের মাধ্যমে পাকানো হলেও স্বাদ পাওয়া যায় না। এদিকে আবার অপরিপক্ব ফল পাকাতে অধিক পরিমাণে ক্যালসিয়াম কার্বাইড ব্যবহারের প্রয়োজন হয়। হলুদ পাকা ফল খেয়ে মিষ্টি বা স্বাদ না লাগলে বুঝতে হবে অপরিপক্ব ফল জোর করে কৃত্রিম উপায়ে পাকানো হয়েছে। বলার অপেক্ষা রাখে না, গাছে পাকা ফল নিঃসন্দেহে সর্বোৎকৃষ্ট, নিরাপদ ও সুস্বাদু। কিন্তু এ বিশ্বায়নের যুগে প্রযুক্তির উন্নয়ন, ব্যবসায়ীদের দুর্নীতি, জনসংখ্যা বৃদ্ধি, চাহিদা-সরবরাহের বৃদ্ধি, মানুষের লোভ-লালসা আমাদের দৈনন্দিন জীবনকে অতিমাত্রায় কৃত্রিম করে তুলেছে। তাই আমাদের আজ প্রায় ক্ষেত্রেই অনিরাপদ খাদ্যসামগ্রী খেয়ে ভুগতে হচ্ছে বা মরতে হচ্ছে। বিশাল জনসংখ্যার এ অনিয়ন্ত্রিত দেশে ভ্রাম্যমাণ আদালতের গুটিকয় অভিযান আমাদের কতটুকু নিরাপদ রাখতে পারবে?
ফল পাকানোর জন্য ক্যালসিয়াম কার্বাইড ব্যবহার করা হলেও মূলত ফলের ওপর কার্বাইডের কোনো প্রত্যক্ষ ভূমিকা থাকে না। ফল পাকানোর জন্য যে রাসায়নিক যৌগটি প্রত্যক্ষভাবে কাজ করে, তার নাম অ্যাসিটাইলিন গ্যাস, যা ইথাইলিনের মতো অনুরূপ একটি সমগোত্রীয় রাসায়নিক দ্রব্য। ক্যালসিয়াম কার্বাইড পানি বা জলীয়বাষ্পের সঙ্গে বিক্রিয়া করে ক্যালসিয়াম হাইড্রোক্সাইড ও অ্যাসিটাইলিন গ্যাস উৎপন্ন করে। ফল পাকানোর ক্ষেত্রে অ্যাসিটাইলিনের ভূমিকা ঠিক ইথাইলিনের মতো। আমাদের দেশে সাধারণত পানিতে ক্যালসিয়াম কার্বাইড গুলে তাতে ফল ডুবিয়ে তুলে নিয়ে রেখে দিলে দু-একদিনের মধ্যে ফল পেকে যায়। তবে এটি একটি বিপজ্জনক প্রক্রিয়া। এ ধরনের কাজে যে কোনো সময় আকস্মিক বিস্ফোরণ ঘটতে পারে। এ ছাড়া আর্সেনিক ও ফসফরাসযুক্ত কার্বাইড ফলের আবরণ বা ফলের ভেতর ঢুকে গেলে সমূহ বিপদের কারণ ঘটাতে পারে। অনেকে আবার কার্বাইড মিশ্রিত পানি স্তূপ করা ফলের ওপর ছিটিয়ে দিয়ে পাতা বা খড় দিয়ে ঢেকে রেখে অল্প সময়ে ফল পাকিয়ে ফেলে। এটিও বিপজ্জনক। তবে ক্যালসিয়াম কার্বাইডের নিরাপদ ব্যবহারও সম্ভব। সাধারণত একটি প্যাকেটে কার্বাইড পুরে একটি বদ্ধ ঘরে জমিয়ে রাখা ফলের স্তূপের পাশে রেখে দিলে ফল থেকে বেরিয়ে আসা জলীয়বাষ্প ক্যালসিয়াম কার্বাইডের সঙ্গে বিক্রিয়া করে পর্যাপ্ত পরিমাণে অ্যাসিটাইলিন উৎপন্ন করবে, যা ফল পাকাতে সাহায্য করবে। মনে রাখতে হবে, ক্যালসিয়াম কার্বাইড কোনোভাবেই মানুষ বা ফলের সংস্পর্শে আসতে পারবে না।
ইথেফোনের জলীয় দ্রবণ বা ইথাইলিন গ্যাসের মাধ্যমে ফল পাকানো নিরাপদ বলে অভিহিত করা হয়। ইথ্রেল বা ইথেফোনের জলীয় দ্রবণ সোডিয়াম হাইড্রোক্সাইডের সঙ্গে বিক্রিয়া করে ইথাইলিন গ্যাস উৎপন্ন করে, যা ফল পাকাতে সাহায্য করে। এ পদ্ধতিতে ফল পাকালে বিপদের ঝুঁকি থাকে না। একটি জাতীয় দৈনিকের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ইথেফোনের মাত্রাতিরিক্ত ব্যবহারে ক্যানসার ও কিডনি নষ্টসহ মৃত্যুর আশঙ্কা থাকে। প্রকৃত সত্য হলো, ফল বা টমেটো পাকানোর জন্য মাত্রাতিরিক্ত ইথেফোনের প্রয়োজন হয় না। ভারতে ফল ও টমেটো পাকানোর জন্য ইথেফোন বা ইথ্রেল ব্যবহারের অনুমতি প্রদান করা হয়েছে। কারণ, ইথেফোন ও ইথ্রেল ক্যালসিয়াম কার্বাইডের মতো অতটা ঝুঁকিপূর্ণ নয়। তবে ইথেফোন ফল বা টমেটোতে না ছিটিয়ে অন্যভাবেও ওগুলোকে পাকানো যায়। যেমন-তামিলনাড়ুতে বিজ্ঞানীরা ফল ও টমেটো পাকানোর জন্য একটি পদ্ধতি বের করেছেন। এ পদ্ধতি মোতাবেক একটি বড় পাত্রে পাঁচ লিটার পানিতে ১০ মিলি লিটার ইথেফোন এবং ২ গ্রাম সোডিয়াম হাইড্রোক্সাইড মিশিয়ে বদ্ধ ঘরে রাখা ফল বা টমেটোর পাশে রেখে দিলে ইথেফোন সলিউশন থেকে উৎপাদিত ইথাইলিন গ্যাস দ্বারা ফল বা টমেটো পেকে যাবে। এতে বিন্দুমাত্র ক্ষতির আশঙ্কা থাকে না। আমাদের কৃষককে ফল বা টমেটো পাকানোর সঠিক পদ্ধতি শেখানো হয় না বলে যত সমস্যার উৎপত্তি হয়। আমরা হয়তো জানি না, অনেক দেশেই কৃত্রিম উপায়ে ফল পাকানো হয়। যুক্তরাষ্ট্রের মতো উন্নত দেশেও কৃত্রিম উপায়ে ফল পাকানো হয়। যুক্তরাষ্ট্রে কাঁচা সবুজ রঙের কলা আমদানি করে গুদামজাত করা হয়। পরবর্তীকালে এসব কাঁচা কলায় ইথাইলিন গ্যাস স্প্রে করা হয়। দু-একদিনের মধ্যে কলা পেকে যাওয়ায় বাজারজাত করা সম্ভব হয়। বাংলাদেশেও কৃত্রিম উপায়ে বৈধভাবে টমেটো ও কলা পাকানো হয়। কলা ও টমেটো পাকানোর জন্য ফাইজার, কাসির, হারভেস্ট, প্রমোটজাতীয় রাসায়নিক পদার্থ ব্যবহার করা হচ্ছে বলে জানা যায়।
ক্ষতিকর রাসায়নিক উপাদান ব্যবহার না করেও প্রাকৃতিক উপায়ে পরিপক্ব কাঁচা ফল পাকানোর পদ্ধতি অতি পরিচিত ও আদিম। কয়েকটি ছোট ছিদ্রযুক্ত বাদামি রঙের কাগজের থলেতে ভরে মুখ বন্ধ করে খড় দিয়ে ঢেকে রেখে দিলে দু-একদিনের মধ্যে ফল পেকে যায়। ফলের মধ্যে দু-একটি আপেল পুরে দিলে ফল পাকার কাজ ত্বরান্বিত হয়। আপেল সাধারণত বিপুল পরিমাণে ইথাইলিন গ্যাস উৎপন্ন করে, যা ফল পাকতে প্রয়োজন হয়।
বাজারে ফল কেনা ও খাবারের ব্যাপারে নিরাপত্তা ও সাবধানতা অবলম্বনের জন্য কিছু করণীয় উল্লেখ করা হলো-এক. খাওয়ার আগে খুব ভালো করে ফল পানিতে ধুয়ে নিন। চলমান পানির টেপের নিচে কয়েক মিনিটের জন্য ফল রেখে দিলে ক্ষতিকর রাসায়নিক দ্রব্য ধৌত হয়ে পরিষ্কার হয়ে যাবে। দুই. ফলের মৌসুমের আগে ফল কিনবেন না। মৌসুম শুরুর আগে বাজারে প্রাপ্ত ফল কৃত্রিম উপায়ে পাকানো হয়ে থাকে। তিন. বাহ্যিকভাবে আকর্ষণীয় দেখালেও ফল ভালো না-ও হতে পারে। যেসব ফলের গায়ের রং সর্বত্রই একই রকম, তা কৃত্রিমভাবে পাকানো হয়েছে বলে ধরে নিতে পারেন। যেমন কলার কাঁদির কিছু কলা কাঁচা, কিছু হলুদ হলে বুঝতে হবে তা কৃত্রিম উপায়ে পাকানো হয়নি। কৃত্রিমভাবে পাকানো হলে সব কলার রং হলুদ এবং কলার বোঁটা বা কাণ্ড গাঢ় সবুজ থেকে যাবে। টমেটোর চামড়ার রং সর্বত্রই সমানভাবে লাল হলে, আম এবং পেঁপের রং কমলালেবুর মতো রং হলে বুঝতে হবে এসব ফল কার্বাইড দিয়ে পাকানো হয়েছে। চার. ফল পাকানোর জন্য ব্যবহৃত ইথাইলিন ও অ্যাসিটাইলিন গ্যাসজাতীয় রাসায়নিক। উদ্বায়ী বলে এসব রাসায়নিক পদার্থ শরীরের জন্য তেমন বিপজ্জনক নয়। তবে মনে রাখবেন, গাছে পাকা ফল সবচেয়ে ভালো। গাছে পাকা ফল বা প্রাকৃতিক উপায়ে পাকানো ফল সবসময় নিরাপদ।
ড. মুনীরউদ্দিন আহমদ : প্রফেসর ও বিভাগীয় প্রধান, ফার্মেসি বিভাগ, ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি, ঢাকা
drmuniruddin@gmail.com