শতফুল ফুটতে দাও
রাইসির মৃত্যুর পর মধ্যপ্রাচ্যের চিত্রটি কেমন হবে?

ড. মাহবুব উল্লাহ্
প্রকাশ: ২৩ মে ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

ইরানের প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম রাইসি হেলিকপ্টার দুর্ঘটনাকবলিত হয়েছিলেন। এ সংবাদ জানার পর ইরানসহ মুসলিম বিশ্বে প্রেসিডেন্ট রাইসির ভক্ত-অনুরক্তরা আশা করেছিলেন প্রেসিডেন্ট রাইসি হয়তো প্রাণে বেঁচে যাবেন। ইরান সরকার দেশবাসীকে তার জন্য দোয়া করার আহ্বান জানান। এ আহ্বানে সাড়া দিয়ে ইরানবাসী কায়মনোবাক্যে আল্লাহর কাছে দোয়া করেছে এবং একটি মিরাকলের অপেক্ষায় ছিল। বাংলাদেশের একটি দৈনিক প্রেসিডেন্ট রাইসির মৃত্যুর খবর নিশ্চিত হওয়ার পর লিখেছে, ‘কাঁদছে ইরান! প্রেসিডেন্ট রাইসির মৃত্যু মুসলিম বিশ্বসহ পৃথিবীর ন্যায়বিচারকামী মানুষদের দারুণভাবে মর্মাহত করেছে। এ যেন অতি আপনজনকে হারানো।’
গত রোববার ইরানের পূর্ব আজারবাইজান প্রদেশের জোলফা এলাকার কাছে দুর্ঘটনাটি ঘটে। দুর্ঘটনার কয়েক ঘণ্টা পরও রোববার রাত পৌনে ১২টা পর্যন্ত দুর্ঘটনাকবলিতদের কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি। বৈরী আবহাওয়ার কারণে উদ্ধার কাজ ব্যাহত হচ্ছিল। সেখানে ভারী বৃষ্টি ও ঘনকুয়াশার কারণে ৫ মিটারের বেশি দূরত্বে কিছু দেখা যাচ্ছিল না। হেলিকপ্টারে ইরানের প্রেসিডেন্ট ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী ছাড়াও পূর্ব আজারবাইজান প্রদেশের গভর্নর মালেক রহমতি এবং এ প্রদেশে ইরানের সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনীর মুখপাত্র আয়াতুল্লাহ মোহাম্মদ আলী আলে-হাশেম ছিলেন। নাম প্রকাশ না করার শর্তে ইরানের একজন কর্মকর্তা বার্তা সংস্থা রয়টার্সকে বলেছেন, দুর্ঘটনাস্থল থেকে যে খবর আসছে, তা খুব উদ্বেগজনক। ১৬ ঘণ্টার বেশি সময় উদ্ধার তৎপরতার পর সোমবার সকালে হেলিকপ্টারটির ধ্বংসাবশেষ খুঁজে পাওয়া যায়। এরপর তাদের মৃত্যুর খবর নিশ্চিত করে ইরান সরকার।
প্রতিবেশী দেশ আজারবাইজানের সীমান্ত এলাকায় একটি যৌথ জলবিদ্যুৎ প্রকল্প উদ্বোধন করে গত রোববার দুপুরে হেলিকপ্টারে করে ফিরছিলেন রাইসি। সেখান থেকে ১৭০ কিমি. দূরের ইরানের পূর্ব আজারবাইজান প্রদেশের রাজধানী তাবরিজের উদ্দেশে হেলিকপ্টারে যাত্রা করেন প্রেসিডেন্ট রাইসি ও তার সঙ্গীরা। ৫৮ কিলোমিটার যাওয়ার পর পর্বতঘেরা ভারজাগান এলাকায় বিধ্বস্ত হয় হেলিকপ্টারটি। ওই বহরে আরও দুটি হেলিকপ্টার ছিল। তবে সেগুলো নিরাপদে অবতরণ করে। প্রশ্ন জাগে, একই বহরের দুটি হেলিকপ্টার নিরাপদে ফিরলেও প্রেসিডেন্ট রাইসিকে বহন করা হেলিকপ্টারটি বিধ্বস্ত হলো কেন? দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ার কথা বলা হয়েছে। দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ায় অপর দুটি হেলিকপ্টার নিরাপদ থাকায় প্রশ্ন জাগা সংগত। প্রেসিডেন্ট রাইসি যে হেলিকপ্টারে ছিলেন সেটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে নির্মিত বেল হেলিকপ্টার। ১৯৭৯ সালে ইরান বিপ্লবের আগে এ হেলিকপ্টারটি পেয়েছিল তৎকালীন রেজা শাহ পাহলভির সরকার। রেজা শাহ পাহলভির বিরুদ্ধে তখন ইরানের ইসলামি বিপ্লবী অভ্যুত্থান হয়েছিল। সরল হিসাবে হেলিকপ্টারটির বয়স ৪৫-৪৬ বছর। এত বছর ধরে টিকে থাকা হেলিকপ্টারটির নিরাপদ সার্ভিস দেওয়ার কথা নয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ইরানের ওপর স্যাংশান বা অবরোধ আরোপ করার পর ইরানের পক্ষে হেলিকপ্টারের যন্ত্রাংশ আমদানি করা সম্ভব হচ্ছিল না। এতগুলো বছরে এ হেলিকপ্টারগুলো উড্ডয়ন-অযোগ্য হয়ে পড়ার কথা। কিন্তু তা হয়নি।
উদ্ধার অভিযানে তুরস্ক ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন প্রযুক্তিগত সহায়তা দিয়েছে। তুরস্কের ড্রোন ঘটনাস্থলের উষ্ণতা চিহ্নিত করে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন স্যাটেলাইট প্রযুক্তি দিয়ে দুর্ঘটনাস্থল চিহ্নিত করতে সাহায্য করে। তুরস্ক আগে ভাগেই জানিয়েছিল উদ্ধার কাজে সহায়তা করবে। তুরস্কের এ সহযোগিতা বোধগম্য। কিন্তু ইউরোপীয় ইউনিয়ন এগিয়ে আসতে পারে, এমনটি ভাবা যায়নি। ফিলিস্তিন নিয়ে প্রেসিডেন্ট রাইসির কট্টর অবস্থান সত্ত্বেও ইউরোপীয় ইউনিয়নের এ ঔদার্য্য প্রশংসনীয়। এ দৃষ্টান্ত দেখে পুরোনো প্রবাদ ‘Man does not quarrel with the dead’ আবারও সত্য বলে প্রমাণিত হলো। প্রমাণিত হলো ন্যায়-নিষ্ঠ অবস্থানের জন্য প্রেসিডেন্ট রাইসি শ্রদ্ধার আসনে প্রতিষ্ঠিত ছিলেন। তবে এ কলাম লেখার সময় পর্যন্ত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রিটেন শোক প্রকাশ করেনি। ইউরোপীয় ইউনিয়নের মতো এ রাষ্ট্র দুটি শোক প্রকাশ করলে তা হতো সভ্যতাসম্মত আচরণ।
প্রশ্ন উঠেছে, রাইসির মৃত্যু কি ইরানকে অস্থির করে তুলবে? জ্যাক ডেট্শ নামে ফরেন পলিসির পেন্টাগন এবং জাতীয় নিরাপত্তা বিষয়ক প্রতিবেদক এ প্রশ্নে তার কিছু মতামত ব্যক্ত করেছেন। তার মতে, ইরান যখন আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে ‘কঠোর পন্থা’ বেছে নিয়েছে এবং মধ্যপ্রাচ্যকে একটি আঞ্চলিক যুদ্ধের কিনারে নিয়ে যাওয়ার হুমকি দিয়ে যাচ্ছে, ঠিক এমন এক সময় এ দুর্ঘটনাকে ইরানের রাজনীতিতে একটি সংক্ষিপ্ত কিন্তু রূপান্তরমূলক যুগের উপসংহার বলা যেতে পারে। প্রায় তিন বছরের ক্ষমতাকালে রাইসি ইরানের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি এবং সামাজিক নীতিকে আগের চেয়ে অনেক বেশি রক্ষণশীল জায়গায় নিয়ে যান। পূর্বসূরি হাসান রুহানির পর তিনি এ অঞ্চলে ইরানকে স্পষ্টভাবে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিপক্ষের ভূমিকায় ঠেলে দেন। হাসান রুহানি উদারপন্থি হিসাবে পরিচিত ছিলেন। ২০১৮ সালে তৎকালীন ট্রাম্প সরকার ইরান চুক্তি থেকে বেরিয়ে যাওয়ার তিন বছর পর ক্ষমতায় এসে রাইসি ক্রমাগত ইরানের ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণের গতি বাড়িয়েছিলেন এবং ইরান চুক্তি নিয়ে পশ্চিমের সঙ্গে আলোচনার গতি কমিয়ে দিয়েছিলেন। রাইসির নেতৃত্বাধীন ইরান সরকার ইউক্রেন যুদ্ধে রাশিয়াকে অকুণ্ঠ সমর্থন দিয়েছে এবং রাশিয়াকে শাহেদ নামের মরণঘাতী ড্রোন ও প্রচুর গোলাবারুদ দিয়েছে। ইসরাইলের বিরুদ্ধে রাইসির নেতৃত্বাধীন ইরান স্পষ্ট অবস্থান নিয়েছে এবং ফিলিস্তিনিদের মুক্তির সংগ্রামে দ্ব্যর্থহীন সমর্থন ব্যক্ত করেছে। ইরান-সমর্থিত ইয়েমেনের রাইসি যোদ্ধারা এবং লেবাননের হিজবুল্লাহ যোদ্ধারা সম্মিলিতভাবে ইসরাইলের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ সংগ্রামে দৃঢ় অবস্থান গ্রহণ করেছে। এসব কারণে ইরান এখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ঘোরতর শত্রু হিসাবে গণ্য হচ্ছে। ইরান যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে সরাসরি কিছু না করলেও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পোষ্য ইসরাইলের বিরুদ্ধে নৈতিক অবস্থান গ্রহণ করায় যুক্তরাষ্ট্র যারপরনাই অসন্তুষ্ট ও ক্ষুব্ধ।
জ্যাক ডেটশ বিশেষজ্ঞদের বরাত দিয়ে আরও বলেছেন, পশ্চিমাদের সম্পর্কে ইরানের গ্রহণ করা নীতি এবং কৌশল সম্পর্কে রাইসি তার দেশের রাজনৈতিক ও ধর্মীয় নেতাদের মধ্যে যে শক্ত সংহতি স্থাপন করে গেছেন, তাতে মনে হচ্ছে, তার জায়গায় কে প্রেসিডেন্ট হবেন, সেটি কোনো বড় বিষয় হিসাবে থাকছে না। কারণ প্রেসিডেন্টের গদিতে এখন যিনিই বসুন না কেন, ইরানে রাইসির অনুসৃত নীতিতে কোনো পরিবর্তন হবে না। ফাউন্ডেশন ফর ডিফেন্স অফ ডেমোক্রেসিসের জ্যেষ্ঠ ফেলো বেহনাম-বেন তালেবলু মনে করেন, ৭ অক্টোবরের পর মধ্যপ্রাচ্য যেভাবে বিশ্বকে ঝাঁকুনি দিয়েছে, তা রাইসিসহ কিংবা রাইসিবিহীন-উভয়ই ইরানের জন্য সন্তোষজনক হবে।
এতক্ষণ যুক্তরাষ্ট্রীয় অবস্থান থেকে ইরান ও তার প্রয়াত প্রেসিডেন্ট রাইসির মূল্যায়ন করা হয়েছে। কিন্তু ইরানের সমর্থনে কিছু কথা না বললেই নয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প তার খামখেয়ালিপনার জন্য বিশেষ পরিচিতি অর্জন করেছিলেন। তিনিই ইরানের সঙ্গে সম্পাদিত চুক্তি থেকে বের হয়ে আসেন। অথচ এ চুক্তিতে পৌঁছানোর জন্য জেনেভায় ইরান ও অন্য পক্ষগুলোর মধ্যে দীর্ঘ আলোচনা হয়েছে এবং এ আলোচনার পরেই ইরানের আণবিক শক্তি ব্যবহারসংক্রান্ত চুক্তিটি হয়েছে। হঠাৎ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এ চুক্তি থেকে সরে আসার সিদ্ধান্ত ইউরোপের অনেক দেশ পছন্দ করেনি। দুনিয়ার পরাশক্তিগুলো যদি আণবিক অস্ত্রের অধিকারী হতে পারে, তাহলে তৃতীয় বিশ্বের কোনো দেশ কেন আণবিক অস্ত্রের অধিকারী হতে পারবে না? তারা যদি গ্যারান্টি দেয় এ আণবিক অস্ত্র জাতীয় নিরাপত্তা ছাড়া কোনো আগ্রাসী যুদ্ধে ব্যবহার করা হবে না, তাহলে আণবিক অস্ত্রের অধিকারী হওয়া দোষণীয় হবে কেন? ষাটের দশকে আণবিক অস্ত্রের একচেটিয়াত্বের বিরুদ্ধে আওয়াজ উঠেছিল। তৃতীয় বিশ্বের দেশ ভারত ও পাকিস্তান আণবিক অস্ত্রের অধিকারী হয়েছে। ইসরাইলও আণবিক অস্ত্রের অধিকারী, এমনটি ঘোষিতভাবে জানা না গেলেও এটা কারও অজানা নয়। ইরান ইসরাইলি গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদের আগ্রাসনের শিকার অনেকদিন থেকে। ইরানি বিজ্ঞানীদের খুন হওয়া নিয়ে ইসরাইলের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছে। ইসরাইল চায় না ইরান জ্ঞান-বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে এগিয়ে যাক। কারণ তাহলে তাদের জন্য সেটা হবে মহাবিপদ! ইসরাইলের বিরুদ্ধে আরও অভিযোগ, দামেস্কে ইরানি দূতাবাসে ইরানের কয়েকজন ঊর্ধ্বতন সামরিক অফিসারকে হত্যা করা হয়েছে। অভিযোগ রয়েছে, ইরানের বিপ্লবী গার্ড বাহিনীর প্রধান কাসেম সোলাইমানিকে ইসরাইল ড্রোন হামলা করে হত্যা করেছে। এতকিছুর পর ইরান যদি তার আত্মমর্যাদা প্রতিষ্ঠা করার জন্য কোনো পদক্ষেপ নেয়, তাহলে তা নিয়ে এত আপত্তি কেন?
‘সব দোষ ইরানের, ইসরাইল ধোয়া তুলসীপাতা’-যুক্তরাষ্ট্রের এমন একচোখা নীতি যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপ ও অস্ট্রেলিয়ার ছাত্রসমাজের কাছেও গ্রহণযোগ্য নয়। তারা আন্দোলনে ফুঁসে উঠেছে। যুক্তরাষ্ট্রের বাইডেন সরকার বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে পুলিশি শক্তি প্রয়োগ করছে। প্রেসিডেন্ট রাইসি নিহত হওয়ার পর ষড়যন্ত্রের প্রশ্ন উঠেছে। অভিযোগের তীর ইসরাইলের বিরুদ্ধে। ‘ঠাকুর ঘরে কে-আমি কলা খাই না’, এমন ভান করে ইসরাইল দাবি করেছে তারা এর সঙ্গে জড়িত নয়। মার্কিন ক্যাম্পাসগুলোতে ভিয়েতনাম যুদ্ধবিরোধী আন্দোলন যুক্তরাষ্ট্রকে ভিয়েতনাম যুদ্ধ থেকে সরে আসতে বাধ্য করেছে। এবার দেখার বিষয় যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা বিশ্বের ছাত্রসমাজের আন্দোলন ফিলিস্তিনের মুক্তিকে কতটা ত্বরান্বিত করে। ফিলিস্তিন মুক্ত হলে প্রেসিডেন্ট রাইসির অকালমৃত্যুও সার্থকতা বয়ে আনবে।
ড. মাহবুব উল্লাহ : শিক্ষাবিদ ও অর্থনীতিবিদ