হয়রানি নয়, জনকল্যাণে নজর দিন
ড. ইফতেখার উদ্দিন চৌধুরী
প্রকাশ: ১৬ মে ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের অধীনে রয়েছে ভিন্ন ভিন্ন সংস্থা। প্রতিটি মন্ত্রণালয়ের এখতিয়ারভুক্ত কর্মযজ্ঞের চৌহদ্দিও নির্ধারিত। ক্ষেত্রবিশেষে নানামুখী সমন্বয়সাধনের মাধ্যমে কর্মকৌশলের বাস্তবায়ন হয়ে থাকে। বাজেট, রিজার্ভ, ব্যাংক-বিমাসহ আর্থিক খাতগুলোর দেখভাল করে থাকে অর্থ মন্ত্রণালয়। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের রয়েছে দেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, পুলিশ-র্যাব-বিজিবির সমন্বয়ে সার্বিক নিরাপত্তার দায়িত্ব। একইভাবে প্রত্যেক মন্ত্রণালয় স্ব স্ব দায়িত্ব পালনে কতটুকু গণমুখী তা পর্যালোচনার দাবি রাখে। অভিযোগ আছে, এদের কার্যক্রম অধিকাংশ ক্ষেত্রে জনদুর্ভোগ তৈরি করে থাকে। সংবিধান ও প্রচলিত রীতিনীতি অনুসারে জনগণই সব ক্ষমতার উৎস। সরকারি সেবাপ্রাপ্তিতে সব নাগরিকের অধিকার সমান। সেবাদাতা সরকারি সংস্থাগুলো থেকে নাগরিকদের সেবা গ্রহণে হয়রানি কাম্য নয়। রাজনীতিকদের সভা-সমাবেশে তাদের আলোচনা-বক্তৃতায় জনগণের বিষয়গুলো জোরালোভাবে উপস্থাপিত হয়। কিন্তু বাস্তবে এর পর্যাপ্ত প্রতিফলন দৃশ্যমান নয়। কার্যত সংস্থাগুলোর কার্যক্রমের বাস্তবায়ন কতটুকু জনকল্যাণকর তা নিয়ে প্রশ্ন আছে। প্রায় সব ক্ষেত্রে ঘুস-দুর্নীতি-অনিয়মের অভিযোগ শোনা যায়।
ক্ষমতা ও অর্থের দুর্বৃত্তায়ন এবং সুশাসনের অভাব দেশের উন্নয়ন-সমৃদ্ধির প্রতি বড় চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছে। সততা-যোগ্যতার অবমূল্যায়ন, মিথ্যা-ভিত্তিহীন অভিযোগে শতভাগ নির্দোষ ব্যক্তির বিরুদ্ধে তদন্ত-বিচারের নামে হয়রানি, নিরীহ-দরিদ্র-অসহায় ব্যক্তিদের ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত করা ইত্যাদি পুরো দেশকে যেন অস্থিতিশীল করে তুলছে। অর্থলিপ্সুদের বিভিন্ন আর্থিক লেনদেনে প্রতিহিংসা-প্রতিশোধপরায়ণতা প্রকাশ পাচ্ছে। সভ্য মানুষ অযথা সম্মানহানির ভয়ে ক্ষমতা, অর্থ ও পেশিশক্তির কাছে আত্মসমর্পণ করে নগদ অর্থ-ভূসম্পত্তি খোয়াচ্ছে। প্রকৃত অপরাধীদের মনোরঞ্জন করতে ব্যর্থ হলে ভিটেবাড়িসহ সর্বস্ব হারানোর ভীতি সমাজে নিত্যনৈমিত্তিক বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। কথিত বিভিন্ন সংস্থা কর্তৃক প্রতারণামূলক বানোয়াট অভিযোগ তোলা হয়। সম্মানিত ব্যক্তিদের সমাজে হেয়প্রতিপন্ন করার মানসিকতাসম্পন্ন লোকের অভাব নেই। কদর্য চরিত্রের মানুষেরা ব্যক্তিস্বার্থ চরিতার্থে নানা উপায়ে অর্থের বিনিময়ে মিথ্যা অভিযোগ তুলছে। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের এসব সংকট উত্তরণে ন্যূনতম মনোযোগ আছে বলে মনে হয় না।
বিভিন্ন ক্ষেত্রে হয়রানি দরিদ্র-নিরীহ-সহজসরল মানুষকে প্রায় নিঃস্ব করে দিচ্ছে। অন্যদিকে বিত্তশালীদের জন্য অবৈধ উপার্জনের নানা সুবিধার পথ অবারিত। সেতু-কালভার্ট-এক্সপ্রেসওয়েসহ প্রায় সব অবকাঠামোই কিছুসংখ্যক ব্যক্তির উপকারে আসে। সামগ্রিক কল্যাণে এসবের ভূমিকা খুবই সীমিত। সম্প্রতি রাজস্ব আয়ের বিষয়টি ব্যাপক আলোচনার সূত্রপাত ঘটিয়েছে। ২১০ কোটি টাকা দিয়ে দুশ গাড়ি কেনার যে প্রস্তাব জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) থেকে দেওয়া হয়েছে, তার যৌক্তিকতা নিয়েও মানুষ বিভ্রান্ত। কর আদায়ে এনবিআর যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করবে, এটিই স্বাভাবিক। রাজস্ব আয়ের ওপর দেশের উন্নয়ন কর্মকাণ্ড অনেকটাই নির্ভরশীল। কিন্তু কর আদায়ের ক্ষেত্রে কিছু বড় শিল্পপতি-ব্যবসায়ীকে আড়ালে রাখার অপকৌশল দুঃখজনক। ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী এবং স্বল্প আয়ের মানুষ, নিম্নমধ্যবিত্ত বা দরিদ্র চাকরিজীবীদের কর কাঠামোর আওতায় আনা দেশের স্বার্থেই প্রয়োজন। কিন্তু বিশেষ উপার্জন না থাকলে আয়বৈষম্যের বিবেচনায় এদের হয়রানিমুক্ত রাখা একান্ত জরুরি। অডিটের নামে করদাতাদের বারবার ডাকা হচ্ছে। নোটিশ পেয়ে অফিসে গিয়ে ধনসম্পদের ব্যাখ্যা দিতে দিতে অনেক ক্ষেত্রে করদাতাদের হয়রানির শিকার হওয়ার অভিযোগ রয়েছে।
গত ২৮ এপ্রিল গণমাধ্যমে প্রকাশিত এনবিআরের তথ্যানুসারে, চলতি অর্থবছরে আয়কর আদায় হবে ১ লাখ ২০ হাজার কোটি টাকা। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) শর্তপূরণে আগামী অর্থবছরে প্রয়োজন ১ লাখ ৬৩ হাজার কোটি টাকা। অর্থাৎ আদায় বাড়াতে হবে ৪৩ হাজার কোটি টাকা। সংস্থাটির দাবি, লোকবল নিয়োগ-লজিস্টিক সাপোর্ট এবং এ খাতে নজরদারি বাড়ানো গেলে পূরণ হবে রাজস্বের বড় চাহিদা। বিশেষজ্ঞদের মতে, এসব উদ্যোগের পাশাপাশি কর ফাঁকি রোধ এবং করের নতুন নতুন ক্ষেত্র আবিষ্কারে মনোযোগ দিতে হবে। উৎসে কর আদায়ের জায়গাটি যদি আরও শক্তিশালী এবং বিশ্লেষণ করে ত্রুটি-বিচ্যুতিগুলো চিহ্নি করা যায়, তাহলে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া সম্ভব। একই সঙ্গে কর ফাঁকির দিকেও নজর দিতে হবে। দেশে কর আদায়ের প্রধান তিনটি খাত হলো-আয়কর, মূল্য সংযোজন কর (ভ্যাট) ও আমদানি-রপ্তানি শুল্ক। এনবিআরের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ফ্রেইট ফরওয়ার্ড এজেন্সি, শিপিং এজেন্সি, বিদেশি প্রতিষ্ঠান, ইটভাটা, ট্রাভেল এজেন্ট, কনসালটেন্সি সার্ভিস, ইন্টারন্যাশনাল গেটওয়ে হাউস, প্রপার্টি, জনশক্তি রপ্তানি, আবাসন ইত্যাদি খাতে ব্যাপক কর ফাঁকি দেওয়া হচ্ছে।
বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির ভাষ্য-ধনী ও উচ্চমধ্যবিত্তদের অধিকাংশই আয়কর প্রদান করে না। কর প্রশাসনের অদক্ষতা এবং কিছু কর্মকর্তার সঙ্গে অনৈতিক যোগসাজশে তারা এ কর ফাঁকি দেয়। ফলে কখনোই এনবিআরের রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হয় না। এছাড়া বছরে কোটি টাকা আয় করে এমন জনগোষ্ঠীর সিংহভাগই কর আওতার বাইরে। এরা সারা দেশেই ছড়িয়ে আছে। কিন্তু এদের করের আওতায় আনা যাচ্ছে না। তাই এ জনগোষ্ঠীকে করের আওতায় আনার প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে হবে। এনবিআরের তথ্য-উপাত্ত পর্যালোচনায় দেখা যায়, বর্তমানে দেশে ১ কোটির বেশি কর শনাক্তকরণ নম্বরধারী (টিআইএন) থাকলেও তাদের মধ্যে আয়কর রিটার্ন জমা দিয়েছেন ৪০ লাখ। ২০২২-২৩ অর্থবছরে এ সংখ্যা ছিল ৩০ লাখ ২৮ হাজার ৬৬১। বিজ্ঞজনদের মতে, কর আহরণ বাড়াতে হলে কর ব্যবস্থাপনায় বড় পরিবর্তন এনে কর প্রশাসনকে ঢেলে সাজাতে হবে। কর আহরণে ডিজিটাল পদ্ধতি চালু করে এ খাতের দুর্নীতি কমিয়ে আনার পদক্ষেপ নিতে হবে। বিদ্যমান ব্রিটিশ পদ্ধতিতে কর আদায় অব্যাহত থাকলে কর আহরণে সুফল মিলবে না।
কর-জিডিপি অনুপাতে বাংলাদেশ প্রতিবেশী দেশগুলোর তুলনায় পিছিয়ে আছে। গত এক দশকে কর-জিডিপি অনুপাত না বেড়ে উলটো কমেছে। ২০২৩ সালে জিডিপি অনুপাতে করের অংশ ৮ দশমিক ২ শতাংশ, ২০১২ সালে যা ছিল ৯ দশমিক ১ শতাংশ। ২০২২ সালে ভারতের কর-জিডিপির অনুপাত ১৬ দশমিক ৯৮ শতাংশের বিপরীতে বাংলাদেশে এ হার ছিল ৭ দশমিক ৭৭ শতাংশ। বিভিন্ন সময়ে অর্থনীতিবিদরা জিডিপির অনুপাতে করের অংশ বৃদ্ধির পরামর্শ দিয়ে আসছেন। এ পরিপ্রেক্ষিতে এনবিআর ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেটে রাজস্ব আহরণ বৃদ্ধিসহ করদাতাদের হয়রানি কমাতে নতুন উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। সুখের বিষয় হচ্ছে, আয়কর ব্যবস্থায় শৃঙ্খলা নিশ্চিত করতে ২০২৩ সালে জাতীয় সংসদে পাশ হয় ‘আয়কর বিল-২০২৩’। এ আইনের অধীনে ব্যক্তি কিংবা প্রতিষ্ঠানের কর নির্ধারণ হবে ‘গাণিতিক ফর্মুলা’ বা ‘স্বনির্ধারণী’ পদ্ধতিতে। এনবিআরের ধারণা, এ পদ্ধতিতে কর আদায় দ্রুত হবে। আপিল সংখ্যার পাশাপাশি কমবে ভোগান্তিও। নতুন আইনে অটোমেশনে জোর দেওয়ার পাশাপাশি রিটার্ন জমা, করপোরেট কর, কর কর্মকর্তাদের ক্ষমতা ইত্যাদি বিষয়ে পরিবর্তন আনা হয়েছে। রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে আইনটি সঠিকভাবে বাস্তবায়ন হবে বলে প্রত্যাশা। এর মাধ্যমে বাস্তবে যাতে করদাতাদের ভোগান্তি কমে, সে বিষয়েও নজর রাখতে হবে।
এমনিতেই সরকার ও দলের মধ্যে ঘাপটি মেরে থাকা বিভীষণের সংখ্যা ক্রমেই বাড়ছে। সরকারকে দেখতে হবে কর আদায়ের নামে দুর্ভোগ সৃষ্টি হলে তা যেন গণরোষে রূপান্তরিত না হয়। জনগণকে উসকে দিয়ে অস্থিরতা তৈরির নানা ধরনের ঘৃণ্য কৌশল অবলম্বন তরা হয়। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে জীবন নির্বাহে সাধারণ মানুষের নাভিশ্বাস উঠছে। তাপপ্রবাহের কারণে ওষ্ঠাগত জীবনের সঙ্গে প্রায় সব কৃষিজাত পণ্য উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। খাদ্যশস্যে আমদানিনির্ভরতা কমানো না হলে রিজার্ভ কমে যাওয়ার সমূহ আশঙ্কা আছে। সার্বিক বিবেচনায় সব ধরনের কর্মকৌশল নির্ধারণ ও বাস্তবায়নে জনগণের কষ্টের কথা সর্বাধিক গুরুত্ব পাওয়া উচিত।
সামনে বর্ষাকাল। সামান্য বৃষ্টির কারণে দেশের নানা অঞ্চলে সৃষ্টি হয় জলাবদ্ধতা। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবগুলো প্রতিমুহূর্তে অনুভূত হয়। যথাসময়ে ব্যবস্থা গ্রহণে ব্যর্থ হলে জলাবদ্ধতা অসহনীয় পর্যায়ে চলে যাবে। সর্বোপরি গ্রামীণ জনপদের দুঃখ লাঘবে পরিকল্পিত প্রকল্পগুলো বাস্তবায়নে দীর্ঘসূত্রতা মোটেও কাম্য নয়। বিরাজমান সমস্যাগুলোর সমাধান বর্ষার আগেই করে ফেলতে হবে। জনগণের কাছ থেকে আদায়কৃত কর বা রাজস্ব জনগণের কল্যাণেই ব্যয় হবে-এটিই প্রত্যাশা।
ড. ইফতেখার উদ্দিন চৌধুরী : শিক্ষাবিদ; সাবেক উপাচার্য, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়