Logo
Logo
×

উপসম্পাদকীয়

শতফুল ফুটতে দাও

দেখি এই দেশে মৃত্যুরই কারবার

Icon

ড. মাহবুব উল্লাহ্

প্রকাশ: ১৬ মে ২০২৪, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

দেখি এই দেশে মৃত্যুরই কারবার

গত ১৩ মে’র সংবাদপত্রগুলোয় ছিল এক মর্মান্তিক শিরোনাম। শিরোনামটি হলো ‘শহিদ তাজউদ্দীন আহমদ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের লিফটে ৪৫ মিনিট আটকে থেকে রোগীর মৃত্যু’। গাজীপুরের শহিদ তাজউদ্দীন আহমদ মেডেকেল কলেজ হাসপাতালের লিফটে দীর্ঘ সময় আটকে থাকার পর এক রোগীর মৃত্যু হয়েছে। রোববার সকাল সাড়ে ৯টার দিকে এ ঘটনা ঘটে। রোগী মমতাজ বেগম (৫৩) গাজীপুরের কাপাসিয়া উপজেলার রানীগঞ্জ বাড়িগাঁও গ্রামের সারফুদ্দিনের স্ত্রী।

মমতাজের মেয়ে শারমিন আক্তার বলেন, ‘আমার মা সকালে অসুস্থ হয়ে পড়েন। পরে সকাল ৬টায় হাসপাতালে নিয়ে আসি। প্রথমে মেডিসিন বিভাগে ভর্তি করে পরীক্ষা-নীরিক্ষা করা হয়। সেখানে পরীক্ষার পর জানা যায়, হার্টের কিছু সমস্যা দেখা দিয়েছে। পরে হাসপাতালের ১১ তালা থেকে ৪ তলার হৃদরোগ বিভাগে নেওয়ার কথা বলা হয়। লিফটে উঠলে ৯ তলার মাঝামাঝি এসে হঠাৎ লিফটি বন্ধ হয়ে যায়। এ সময় আমি, আমার মামা, ভাইসহ কয়েকজন মাকে নিয়ে ভেতরে ছিলাম। আমাদের দম বন্ধ হয়ে যাচ্ছিল। আমরা লিফটে থাকা তিনজন লিফটম্যানের নম্বরে কল দিই। তারা গাফিলতি করেন। ফোনে আমাদের সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করেন।’

শারমিন আক্তারের দাবি, ‘৪৫ মিনিট আমাদের লিফটে আটকে থাকতে হয়েছে। উপায় না পেয়ে ৯৯৯-এ কল দেই। ফোন পেয়ে ফায়ার সার্ভিসের সদস্যরা এসে আমাদের উদ্ধার করেন। লিফটম্যানদের গাফিলতির কারণে আমার মায়ের মৃত্যু হয়েছে। তাদের মধ্যে কোনো দায়িত্ববোধ নেই। মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়া মমতাজ বেগমের মেয়ে শারমিন আক্তার অনেক মোলায়েম ভাষায় তাদের ট্র্যাজেডির কথা জানিয়েছেন। আসলে লিফটম্যানরা নিছক দায়িত্ববোধহীনতার পরিচয় দেননি। তারা বস্তুত হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসা একজন রোগীকে হত্যা করেছেন। কর্তব্যে অবহেলা নয়, তাদের বিচার হওয়া উচিত খুন করার অপরাধে। বস্তুত তারা হৃদয়হীন খুনি ছাড়া আর কিছু নন। তাদের কাছে ফোনে সাহায্য চাওয়ায় তারা খারাপ ব্যবহার করেন। হাসপাতালের মতো প্রতিষ্ঠানে যারা দায়িত্ব পালন করেন অথবা কাজ করেন, তাদের থাকা উচিত সর্বোচ্চ মানবিক গুণাবলী। মানবিক গুণাবলি তো দূরের কথা, এ লিফটম্যানরা পশুসুলভ আচরণ করেছে। তারা ক্ষমার অযোগ্য। তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হওয়া উচিত। তাদের জন্য বিভাগীয় শাস্তি যথেষ্ট নয়। দায়িত্বে অবহেলা করে একজন মানুষের মৃত্যু ঘটিয়ে তারা খুনের অপরাধে অভিযুক্ত হতে পারেন।

শহিদ তাজউদ্দীন আহমদ মেডিকেল কলেজের উপপরিচালক মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম লিফটের ভেতরে রোগী মমতাজ বেগমের মৃত্যুর বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। তিনি জানিয়েছেন, এ ঘটনা তদন্তে ৫ সদস্যের কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটিকে ৩ কর্মদিবসের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে। এ ধরনের তদন্ত কমিটি সম্পর্কে আমরা সংবাদপত্রে অনেক সংবাদ ছাপা হতে দেখেছি। রেল, লঞ্চ, সড়ক দুর্ঘটনার পর এবং অগ্নিদুর্ঘটনা নিয়ে অতীতে অনেক তদন্ত কমিটি হয়েছে। এসব তদন্ত কমিটি তদন্ত করে কী পেল, কে বা কারা দুর্ঘটনার জন্য দায়ী এবং দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা নেওয়া হলো, তা কদাচিৎ জানা যায়। এসব ব্যাপারে প্রয়োজন সর্বোচ্চ স্বচ্ছতা। গোটা তদন্ত প্রক্রিয়া যদি স্বচ্ছ হয় এবং মানুষ জানতে পারে কী হয়েছিল, কারা দায়ী, তাহলে এসব মর্মান্তিক দুর্ঘটনা অনেকটাই হ্রাস করা সম্ভব হতো। দুর্ঘটনার জন্য দায়ী ব্যক্তিদের কোনো সরকারি বা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে নিয়োগ নিষিদ্ধ করা হলে কাঙ্ক্ষিত ফল লাভ করা সম্ভব হতে পারে। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ অবশ্য দাবি করেছে, লিফটে আটকে পড়া রোগীসহ লোকজন দরজা ধাক্কাধাক্কি করায় লিফটের দরজার নিরাপত্তাব্যবস্থা কাজ করেনি। এ ব্যাখ্যা আমলযোগ্য কিনা, আশা করি তা তদন্তে বেরিয়ে আসবে।

একটি দেশে সভ্যতা কোন স্তরে রয়েছে, তা নিরূপণ করা যায় খুন-খারাবি ও অপমৃত্যুর পরিসংখান থেকে। জাতীয় প্রতিষ্ঠানে কর্মরত ব্যক্তিরা কতটা দায়িত্ববোধের সঙ্গে তাদের দায়িত্ব পালন করেন, সেটাও সভ্যতার একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ মাপকাঠি। মনে রাখা দরকার, শুধু শাস্তি দিয়ে অপকর্ম, দায়িত্বহীনতা ও অমানবিকতা দমন করা সম্ভব নয়। যারা সমাজের নানা স্তরে কাজ করেন এবং দায়িত্ব পালন করেন, তাদের প্রেষণার বিষয়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কাজের নৈতিকতা একটি অত্যন্ত অপরিহার্য বিষয়। সব পেশায় সব ধরনের কাজে সাফল্যের ক্ষেত্রে নৈতিকতার বিষয়টি অলঙ্ঘনীয়। চিকিৎসকদের নৈতিকতার বিষয়টি হিপোক্রিটাসের শপথে বিদ্রিত হয়েছে। এ শপথের প্রতি আনুগত্য জানিয়ে চিকিৎসা পেশায় নিযুক্ত হতে হয়। জেলের নৈতিকতা হলো ডিম আসা মাছ এবং রেণু পোনা না ধরা। এ নৈতিকতার মান লঙ্ঘন করলে এমন একদিন আসবে, যখন শিকার করার জন্য মাছ আর পাওয়া যাবে না। এভাবে জেলেদের পেশার মৃত্যু ঘটবে। শিক্ষকদের নৈতিকতা হলো প্রশ্নপত্র ফাঁস না করা, শিক্ষার্থীদের মধ্যে কারও প্রতি অতিরিক্ত অনুরাগ পোষণ না করা এবং পাঠদানে সর্বোচ্চ নিষ্ঠার পরিচয় দেওয়া। এভাবে বিচার বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে, সব পেশারই নৈতিকতার বিধান রয়েছে।

অভিজ্ঞতা বলে, যতই দিন যাচ্ছে, বাংলাদেশে নীতি-নৈতিকতা হারিয়ে যাচ্ছে। যেসব মূল্যবোধ মানুষকে মানুষ করে তোলে, সেগুলোও ক্রমান্বয়ে হারিয়ে যেতে বসেছে। এ কারণেই হাসপাতালে লিফটম্যানরা দায়িত্বে অবহেলা করে ভুক্তভোগীদের নিয়ে কটূক্তি করতে বিবেকের দংশনবোধ করে না। দুর্ভাগ্যের বিষয় হলো, বাংলাদেশের সমাজ বিবেচনাবোধ ও নৈতিকতাবোধশূন্য হতে চলেছে। এর পরিণতি কী হতে পারে, তা ভাবতে গিয়ে গা শিউরে ওঠে। যদি অব্যাহতভাবে পরিস্থিতির অবনতি ঘটতে থাকে, তাহলে ভয়ংকর সামাজিক নৈরাজ্য ও বিশৃঙ্খলা অনিবার্য হয়ে উঠবে। বাংলাদেশের ইতিহাসে মাৎস্যন্যায়ের একটি পর্ব ছিল। এ পর্বে সমাজে ব্যাপক বিশৃঙ্খলা ও নৈরাজ্য দেখা দেয়। সমাজে কোনো শাসক বা শাসন আছে এমনটি প্রতিভাত হচ্ছিল না কয়েক বছর ধরে। অবশেষে প্রজারা মিলিত হয়ে গোপালকে তাদের রাজা মনোনীত করে। রাজা গোপাল শক্ত হাতে দুষ্টের দমন ও শিষ্টের পালন করে সামাজে ন্যায়বোধ ও শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠিত করেন। পরিস্থিতি দেখে মনে হচ্ছে বাংলাদেশ তেমন এক নৈরাজ্যের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে গেছে। এ অবস্থা থেকে পরিত্রাণের জন্য প্রয়োজন দুষ্টের দমন করে ও শিষ্টের পালন করে সামাজে সুশাসন প্রতিষ্ঠা করা। সমাজে দায়িত্ববোধ, নীতি-নৈতিকতা, শ্রেয়বোধ প্রতিষ্ঠার জন্য কার্যকর প্রেষণাও প্রয়োজন। এ প্রেষণা আসতে পারে শিক্ষাব্যবস্থায় নীতি-নৈতিকতাবোধ সৃষ্টির সহায়ক কারিকুলাম ও পাঠ্যসূচি প্রণয়ন করে। সরকার পাঠ্যসূচিতে ব্যাপক পরিবর্তন আনার পদক্ষেপ নিচ্ছে। অভিযোগ আছে, যেভাবে পাঠ্যপুস্তক রচনা করা হচ্ছে, তা থেকে নৈতিকতা ও মূল্যবোধকে নির্বাসনে পাঠানো হচ্ছে। এককালে পাঠ্যপুস্তকে ‘সদা সত্য কথা বলিবে’ ‘গুরুজনকে শ্রদ্ধা করিবে’, ‘পরস্ব অপহরণ করিবে না’ ইত্যাদি নীতিবাক্য আত্মস্থ করা হতো পড়ালেখার শুরুতেই। এগুলো বিদায় দিয়ে কী এমন অর্জন হয়েছে? অর্জন হয়েছে একটিই, আর তা হলো অধঃপতন।

যেদিন হাসপাতালে লিফটে আটকে পড়ে রোগীর মৃত্যুর খবর বের হয়েছে, সেদিনই পাশাপাশি আরেকটি শিরোনাম ছিল, ‘মায়ের সামনে ট্রাকচাপায় প্রাণ হারাল শিশু’। ফেনী সদর উপজেলার এ দুর্ঘটনা ছাড়া আরও ৩ জেলায় সড়কে প্রাণ হারিয়েছেন ৩ জন। এ রকম দুর্ঘটনার খবর প্রায় প্রতিদিনই সংবাদপত্রের পাতায় স্থান করে নেয়। এসব মৃত্যুর খবর পড়তে গিয়ে চোখ ঝাপসা হয়ে আসে। কোনো কোনো দিন সড়ক দুর্ঘটনার ১২-১৩ জনেরও একসঙ্গে মৃত্যুর খবর এসেছে। গুম, খুন, অপহরণ, ছিনতাই, রাহাজানি যেন আমাদের জবীনের নিত্যসঙ্গী হয়ে উঠেছে। একে সঙ্গী না বলে মুসিবত বলাই শ্রেয়। এসব ঘটনার ফলে সমাজ মনস্তত্বের ওপর বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হচ্ছে। প্রতিটি ঘটনা একটি বিশাল ট্রমার জন্ম দেয়। এসব ট্রমার পরিণতিতে মনোবৈকল্য, মানসিক অবসাদ, দুশ্চিন্তাগ্রস্ততা সৃষ্টি হয় বিলক্ষণ। এমন মানসিক বৈকল্যের মধ্যে যেসব মানবশিশু বেড়ে ওঠে, তাদের পক্ষে প্রায়ই সুস্থ আচরণ দেখানো সম্ভব হয়ে ওঠে না। এভাবে যে জাতির একটি উল্লেখযোগ্য অংশ বিকৃতির মধ্যে পড়ে যায়, সে জাতির ভবিষ্যৎ কেমন হতে পারে? কবি সুকান্ত তার এক কবিতায় লিখেছেন, ‘অবাক পৃথিবী অবাক যে বারবার/দেখি এই দেশে মৃত্যুরই কারবার।’ মৃত্যুরই কারবার দেখার জন্য কি বীরের রক্তস্রোত, মায়ের অশ্রুধারা প্রবাহিত হয়েছিল ’৭১-এর মুক্তিযুদ্ধে?

ড. মাহবুব উল্লাহ : শিক্ষাবিদ ও অর্থনীতিবিদ

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম