ডোনাল্ড লুর সফরের বিশেষ কোনো তাৎপর্য আছে কি?

ড. ইমতিয়াজ আহমেদ
প্রকাশ: ১৪ মে ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়াবিষয়ক সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডোনাল্ড লু বাংলাদেশ সফরে আসছেন আজ। আমি মনে করি, দক্ষিণ এশিয়ার সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের যে সম্পর্ক, সে ম্যান্ডেটের ধারাবাহিকতায় তার এ সফর। তিনি যে শুধু বাংলাদেশে আসছেন তা নয়, তার এ সফরসূচির মধ্যে ভারত ও শ্রীলংকাও আছে। একেক সময় একেক দেশ তিনি সফর করেন, কারণ এটাই হলো তার ম্যান্ডেট। তার বাংলাদেশ সফরকে আমি অস্বাভাবিক বা ব্যতিক্রম বলে মনে করি না। ডোনাল্ড লু কিংবা এ পদে যিনি থাকবেন, কাজের প্রয়োজনে তিনি নিয়মিতই আসবেন। দ্বিতীয় যে বিষয়টি খেয়াল করা প্রয়োজন তা হলো, ৭ জানুয়ারির নির্বাচনের পর ডোনাল্ড লুর এটাই প্রথম আগমন। তবে এটাও অস্বাভাবিক নয়। বরং নির্বাচনের এতদিন পর যে তিনি আসছেন, এটাই অবাক হওয়ার বিষয়। কারণ, নতুন সরকার এসেছে, স্বাভাবিকভাবেই তাদের তাগিদ থাকার কথা। এ কারণে আমি কিছুটা অবাক হয়েছি। এক্ষেত্রে একটা কারণ হতে পারে যে, সঙ্গে সঙ্গে এলে হয়তো যুক্তরাষ্ট্রের যে রাজনৈতিক অবস্থান ছিল নির্বাচন নিয়ে, সেটাকে হয়তো অন্যভাবে দেখা হতো। সেজন্য হয়তো তিনি সময় নিয়ে ঢাকা সফরে আসছেন। হতে পারে এটি একটি কারণ। সেটাকে আমি অস্বাভাবিক মনে করি না।
স্বাভাবিকভাবেই ডোনাল্ড লু সফরে আসার পর তিনি নতুন সরকারের সঙ্গে বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা করবেন। নতুন পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে আলোচনা হবে, বাংলাদেশের সঙ্গে কী কী বিষয়ে তারা সম্পর্ক উন্নয়নে কাজ করতে পারে। কারণ, আমাদের সম্পর্কের বিষয়ে বেশ কয়েকটি জিনিস মনে রাখা দরকার : আমেরিকার সঙ্গে আমাদের বহুমাত্রিক সম্পর্ক রয়েছে; একাধিক ধরনের সম্পর্ক রয়েছে। শুধু যে সরকারি পর্যায়েই আছে তা নয়, ব্যবসায়িক সম্পর্ক আছে, আমাদের প্রচুর ছাত্র সেখানে পড়াশোনা করে, সিভিল সোসাইটির সঙ্গে সম্পর্ক আছে, রোহিঙ্গা ইস্যু নিয়েও সম্পর্ক আছে। অর্থাৎ বিভিন্ন বিষয়ে বহুমাত্রিক সম্পর্ক দুদেশের মধ্যে রয়েছে।
যেহেতু আমাদের দেশে নতুন সরকার এসেছে তার পাঁচ বছরের ম্যান্ডেট নিয়ে, স্বাভাবিকভাবেই বড় ধরনের পরিকল্পনা তার (ডোনাল্ড লু) থাকবে বাংলাদেশের উন্নয়নকে আরও সামনের দিকে নিয়ে যেতে। যদিও বিশ্বে একটা অর্থনৈতিক সংকট রয়েছে অর্থাৎ ইউক্রেনের যুদ্ধ, ফিলিস্তিনে ইসরাইল কর্তৃক গণহত্যা চলছে। তারপরও স্বাভাবিকভাবেই মার্কিন সরকার তো বসে থাকবে না, তারা চাইবে বড় ধরনের কী কী প্রকল্পে বিনিয়োগ এখানে হতে পারে। সে জায়গায় তাই আমেরিকার আগ্রহ থাকবেই, যেমন জ্বালানি খাতে একটা বড় ধরনের আগ্রহ তো সব সময়ই তাদের ছিল। এমনিতেই এ সেক্টরে আমেরিকার বড় ধরনের বিনিয়োগ আছে, সেটা তারা আরও বৃদ্ধি করতে চাইবে। ইতোমধ্যে বঙ্গোপসাগরে নতুন বিডিংয়ের কথা উঠছে, কাজেই আমেরিকা চাইবে সেখানে যেন তার অংশগ্রহণ থাকে। এক্ষেত্রে যদিও মনে রাখতে হবে, আমেরিকাও ভালো করে জানে, যেটা নির্বাচনের সময়েও কিছুটা পরিষ্কার হয়েছে যে, পৃথিবী একটা বহুমাত্রিক কাঠামোর দিকে চলে যাচ্ছে এবং সেখানে একাধিক দেশ উঠে এসেছে। তার মধ্যে চীন তো আছেই, একইভাবে আমরা ভারতকে দেখছি, রাশিয়াকে দেখছি, জাপানকে দেখছি; অর্থাৎ এসব দেশের সঙ্গেই বাংলাদেশের ভালো সম্পর্ক এবং বড় ধরনের স্বার্থসংশ্লিষ্ট সম্পর্ক রয়েছে। এখন জ্বালানির বিষয় যদি হয় বা যে কোনো উন্নয়ন কাঠামোর বিষয় যদি থাকে, নতুন বিনিয়োগের বিষয় যদি থাকে, তাহলে স্বাভাবিকভাবেই বাংলাদেশের অপশনও বেড়ে গেছে। আগে হয়তো একটি-দুটি অপশন ছিল, এখন অনেক হয়েছে। সে জায়গায় দরকষাকষির ব্যাপার তো আছেই। স্বাভাবিকভাবেই বাংলাদেশ ওই অবস্থানে এখন গেছে। যেহেতু এখন তার একাধিক পার্টনার আছে, তারাও চাইবে এমন বিনিয়োগে রাজি হতে যেটায় তার লাভ। সেটা আমেরিকা ভালো করেই জানে। তাই স্বাভাবিকভাবেই ডোনাল্ড লুর সঙ্গে এসব বিষয়ে সামনাসামনি আলোচনা হতে পারে, যে দরকষাকষিটা তারাও হয়তো করতে চাইবে। কিন্তু ওই অবস্থায় আমেরিকা এখন নেই যে, তারা এসে যাই বলবে, সেটাই মেনে নিতে হবে।
ঠিক একইভাবে আমরা দেখছি, মিয়ানমার নিয়ে বেশকিছু ঘটনা চলমান রয়েছে। সেখানে বেশকিছু এথনিক আর্ম অর্গানাইজেশনের লড়াই চলছে জান্তা সরকারের সঙ্গে এবং সেই লড়াইয়ের কারণে বেশ কয়েকবার আমরা দেখেছি, মিয়ানমারের সশস্ত্র বাহিনীর বেশকিছু সদস্য আশ্রয় নিয়েছে বাংলাদেশে। এবং আমাদের দেশ স্বাভাবিকভাবেই যত দ্রুত রোহিঙ্গাসহ তাদের পাঠাতে পারে, সে ব্যাপারে কাজ করছে। এ বিষয়টি নিয়েও হয়তো আলোচনা বাংলাদেশ করতে চাইবে। কারণ রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর যারা বাংলাদেশে আশ্রয়ে আছে, তাদের প্রতি সমর্থনের অন্যতম অংশীদার হলো আমেরিকা। কাজেই রোহিঙ্গা সমস্যাটি কোনদিকে যাচ্ছে, এগুলোও তাদের চিন্তাভাবনার মধ্যে হয়তো রয়েছে। কারণ এ বিষয়ে মিয়ানমার বিশেষ আইন করেছে।
যেহেতু বাংলাদেশ সরকার ফিলিস্তিন বিষয়ে খুব স্পষ্ট অবস্থান প্রকাশ করেছে যে, ইসরাইল যা করছে তা গণহত্যা ছাড়া কিছুই নয়; একাধিকবার বলাও হয়েছে, এর সঙ্গে আমেরিকাও জড়িত। আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে (আইসিজে) যে মামলা দক্ষিণ আফ্রিকা দিয়েছে, আমরা নিজেরাও তার অংশীদার। আমরাও আইসিজেতে সাবমিশন দিয়েছি ইসরাইলের বিপক্ষে। তাই এটাও আমি মনে করি যে, এ ইস্যু নিয়েও আলোচনা তার সফর পরিকল্পনায় থাকতে পারে। আমেরিকায় ইসরাইলবিরোধী যে ছাত্র আন্দোলন হচ্ছে, এর পক্ষে আমাদের প্রধানমন্ত্রী স্পষ্টই দাঁড়িয়েছেন। কাজেই এ ধরনের একাধিক আলোচনা দুই পক্ষের মধ্যে হওয়াটাই স্বাভাবিক।
আরেকটি বিষয় উল্লেখ করতে হয়, আমাদের দেশে একধরনের মানসিকতার এখনো পরিবর্তন হয়নি যেমন: আমেরিকার কোনো উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা বাংলাদেশ সফরে এলেই তা বিশেষ খবর হয়। অন্য দেশে আমার মনে হয় না এটা নিয়ে কোনো খবর হতো। হলেও হয়তো কোনো পত্রিকার ভেতরের পাতায় ছোট করে ৩-৪ লাইনে ছাপা হতো। কিন্তু আমরা বড় আকারেই ছবি দিয়ে নিউজ করি। আমার মনে আছে, ডোনাল্ড লু একবার সাক্ষাতে বলেছিলেন, ‘আমি অবাক হয়ে গেছি আমার ছবি পত্রিকায় ছাপা হয়েছে।’ আমিও সেখানে ছিলাম। যখন দিল্লি থেকে তিনি বিমানে এখানে আসছিলেন, তখন বাংলাদেশের পত্রিকার পাতায় নিজের ছবি দেখে অবাক হয়েছিলেন। কাজেই আমার মনে হয়, আমাদেরও সচেতন ও পেশাদারির পরিচয় দেওয়া দরকার-কোনটা খবর করব, কোনটা করব না। কারণ, অনেক সময় এ ধরনের খবরের ফলে তাদের মধ্যেও একটা অন্য ধারণা তৈরি হয়। হয়তো তারা ভাবে, বাংলাদেশ নিশ্চয়ই কোনো কিছু বলতে চাইছে পত্রিকার মাধ্যমে। আবার অনেক সময় নিজেদের দুর্বলতাও প্রকাশ পায়। আমার মনে হয়, তারাও এতদিনে বুঝতে পেরেছে যে, খবরের রিয়ালিটি আর বাস্তব এক নয়। আমি মনে করি, নির্বাচনের সময় নিশ্চয়ই তারা বুঝতে পেরেছে, পৃথিবী যেহেতু একটা মাল্টি পোলার বা বহুকেন্দ্রিক ব্যবস্থার দিকে যাচ্ছে এবং বহুমাত্রিক কাঠামো তৈরি হয়েছে, সেখানে এ ধরনের খবর অনেকটা আগের যে মানসিকতা আছে আমাদের, তার ভিত্তিতেই ছাপা হচ্ছে বা প্রকাশিত হচ্ছে। কিন্তু বৈশ্বিক পরিস্থিতিতে বাস্তবে অনেক পরিবর্তন হয়েছে।
সব মিলে আমার মনে হয় না, ডোনাল্ড লুর সফরে বড় কোনো পরিবর্তন হবে। তবে দেখা দরকার তারা নতুন ধরনের বিনিয়োগ নিয়ে আসবে কি না। আবার এটাও মনে রাখতে হবে, যে কোনো বিনিয়োগের ক্ষেত্রে আমরা স্বাভাবিকভাবেই দেখব বাংলাদেশ এতে উপকৃত হচ্ছে কি না। এমন কোনো বিনিয়োগে আমরা যাব না, যেটায় তৃতীয় দেশকে বাদ দেওয়ার পরিকল্পনা থাকবে। অর্থাৎ আমার সঙ্গে থাকলে অন্য দেশের সঙ্গে ব্যবসা করা যাবে না, এ ধরনের শর্তে বাংলাদেশের কখনোই রাজি হওয়া উচিত নয়, তেমন সম্ভাবনাও নেই। কারণ, বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতির মধ্যে খুব স্পষ্টই উল্লেখ করা আছে : সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব, কারও সঙ্গে বৈরিতা নয়। (অনুলিখন)
ড. ইমতিয়াজ আহমেদ : অধ্যাপক ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশেষজ্ঞ