পেঁয়াজ উৎপাদনে ভারত এক নম্বরে। রপ্তানিতেও। চাল রপ্তানিতেও দেশটি এক নম্বরে। তবে উৎপাদনে নয়। এক্ষেত্রে চীন রয়েছে এগিয়ে। তা সত্ত্বেও রপ্তানিতে ভারতই ‘নাম্বার ওয়ান’। এটা হলো তার ‘সফট পাওয়ার’। চালে তার ওপর নির্ভরশীল বেশকিছু দেশ-যারা ভাত খেলেও যথেষ্ট চাল উৎপাদন করে না। ভারত কোনো কারণে রপ্তানি বন্ধ করে দিলে তারা পড়ে যায় বিপাকে। চালের অন্য রপ্তানিকারকরা বেশি দাম হাঁকে তখন। এমনই একটা পরিস্থিতি এখন বিরাজ করছে চালের বাজারে। এর রপ্তানিতে বিধিনিষেধ দিয়ে বসে আছে ভারত। দেশটিতে চলছে জাতীয় নির্বাচন। বিজেপি সরকার নাকি নিজস্ব বাজার শান্ত রাখতে চাইছে এখন। বিপুল দরিদ্র জনগোষ্ঠীর স্বার্থে চালের মজুদও বরাবর অনেক বেশি রাখতে চায় দেশটি। তবে অতিসম্প্রতি পেঁয়াজ রপ্তানির অনুমতি দিয়েছে ভারত। এর কারণ নিয়েও রয়েছে আলোচনা।
সেসব পাশে সরিয়ে বলি, এতে পেঁয়াজ আমদানিকারক দেশগুলোর সুবিধা হলো। বাংলাদেশেও মাঝে কিছু পেঁয়াজ আমদানি হয়েছিল ভারত থেকে। রপ্তানি বন্ধ থাকা অবস্থায় ‘কোটা’য় কয়েকটি দেশকে সীমিত পরিমাণ পেঁয়াজ দিয়েছিল ভারত। সে তালিকায় বাংলাদেশও ছিল। তখন পেঁয়াজ আমদানির প্রয়োজনীয়তা নিয়ে অবশ্য প্রশ্ন ওঠে। কারণ দেশে মূল মৌসুমের পেঁয়াজ উঠছিল তখন। আগের মৌসুমের (‘মুড়িকাটা’) কিছু পেঁয়াজও বাজারে ছিল। উৎপাদকের স্বার্থ দেখতে চাওয়া অনেকে বলছিল, আমদানির ফলে তারা এর ভালো দাম হারাবে। আমদানি হলেই স্থানীয় উৎপাদকের স্বার্থ বিনষ্ট হবে, তা অবশ্য নয়। দেখতে হবে কী পরিমাণ আমদানি হচ্ছে আর কত দামে। বাজারকে প্রভাবিত করার মতো পণ্য আমদানি হতে হবে। দামটাও হতে হবে উল্লেখযোগ্যভাবে কম। তখন আমদানি বোধহয় হয়েছিল ৫০ হাজার টন। দামও খুব বেশি কম পড়েনি। আর সেটা বিতরণ হয়েছিল মূলত টিসিবির মাধ্যমে। ফলে বাজারে তেমন প্রভাব পড়েনি। আমদানির খবরে তাৎক্ষণিকভাবে দাম পড়ে গেলেও ধীরে ধীরে আবার চড়া হয়েছে পেঁয়াজের বাজার।
দেশের পেঁয়াজ উৎপাদনকারী অঞ্চলগুলো থেকে তখন খবর আসছিল কৃষকদের লাভজনক দাম পাওয়ার। যারা কৃষকের আয়-উন্নতি দেখতে চায়, তারা এ খবরে খুশি হয়েছিল নিশ্চয়। তবে তারা তো পেঁয়াজের ভোক্তাও। তাদের মধ্যে যারা নিু ও নির্দিষ্ট আয়ের লোক, তারা আবার চাইছিল যেভাবে হোক পেঁয়াজের দামটা সহনীয় হয়ে আসুক। এটা তো প্রতিদিন লাগে রান্নাঘরে। পেঁয়াজের দাম বেশি বাড়লে রেস্তোরাঁয়ও খাবারের দাম বেড়ে যায়। রমজান মাস হলে দাম বেড়ে যায় ইফতার সামগ্রীর। আরেকটা কথা, পেঁয়াজের পরিভোগ বেশি। অন্য অনেক পণ্যের দাম অত্যধিক বাড়লেও তেমন সমস্যা হয় না। কারণ সেগুলোর ব্যবহার কম। আমরা কি খোঁজ নিই জাফরানের দাম কত? কারণ এর ব্যবহার অত্যন্ত সীমিত। এরই মধ্যে কিছু মসলাপণ্য, যেমন জিরা আর এলাচের দামও অনেক বেড়েছে। কিন্তু এ নিয়ে ভোক্তাদের মধ্যে আলোচনা কম। কারণ এগুলোও কম লাগে। পেঁয়াজকে মসলাপণ্য বলে বিবেচনা করলে বলতে হবে, এর সঙ্গে আদা-রসুনের ব্যবহারও বেশি। তাই আদা-রসুনের দাম জানার আগ্রহ থাকে। মিডিয়াও এসব পণ্যের দামের দিকে রাখে নজর।
এ মুহূর্তে পেঁয়াজ, আদা, রসুন সবগুলোর দামই কমবেশি চড়া। তার মধ্যে পেঁয়াজ নিয়ে স্বভাবতই আলোচনা বেশি। এর ভিন্ন কারণও রয়েছে। পেঁয়াজ উৎপাদনে আমরা কিন্তু পিছিয়ে নই। দেশের বেশকিছু অঞ্চলে, যেমন পাবনা, ফরিদপুরে বিপুল পরিমাণ পেঁয়াজ উৎপন্ন হয়। পেঁয়াজে আমরা স্বয়ংসম্পূর্ণ বলেও দাবি করা হচ্ছে। কিন্তু সমস্যা অন্য জায়গায়। পেঁয়াজের যথাযথ সংরক্ষণে আমরা ব্যর্থ। বিপুল পরিমাণ পেঁয়াজ প্রতিবছর নষ্ট হয় সঠিক ও পর্যাপ্ত সংরক্ষণ সুবিধার অভাবে। এটা নাকি কমপক্ষে ২৫ শতাংশ। অন্য অসুবিধাও আছে। সংরক্ষণ করলে পেঁয়াজ শুকিয়ে ওজন হারায়। অনেকে একসঙ্গে বেশি পেঁয়াজ কিনে খাটের তলায় বিছিয়ে রেখে দেয়। দাম বাড়ার প্রবণতা থাকলে ক্রেতাদের একাংশ এটা করে বেশি। তাদের হাতে সংরক্ষিত পেঁয়াজও ওজনের কমে যায়। এ কারণে মূল ক্ষতিটা হয় সেইসব কৃষকের, যারা চিরায়ত পদ্ধতিতে পেঁয়াজ সংরক্ষণ করে ধীরে ধীরে বিক্রি করবে বলে। এক্ষেত্রে উদ্দেশ্য ভালো দাম পাওয়া। পেঁয়াজ পচে নষ্ট হওয়ায় সেটা অর্জন হয় না অনেক ক্ষেত্রেই।
আমাদের কৃষকের মধ্যে মুনাফার প্রবণতা বাড়ছে। কিছু পণ্য সে উৎপাদন করে বিক্রি করে লাভ করতে। যেমন পাট। পাটের প্রায় পুরোটাই সে বিক্রি করে। তবে অনেক কৃষক এখনো চাল উৎপাদন করে প্রধানত পরিবারের ভোগের জন্য। কারণ এটা তার খাদ্য নিরাপত্তার সঙ্গে সরাসরি সম্পর্কিত। নিজ প্রয়োজনের অতিরিক্ত অংশটুকু সে বিক্রি করে অবশ্য। টাকা-পয়সার টানাটানি থাকলে দ্রুত করে; না থাকলে ধীরেসুস্থে। তবে পেঁয়াজ তারা উৎপাদন করে প্রধানত বিক্রি করতেই। ভালো দাম পেলে খেত থেকেই বেচে দেয়। পরে বাজার থেকে কিনে খায়। তবে কৃষক এখন খবর রাখে বাজারের; এমনকি বিশ্ববাজারের। বিশেষত ভারত থেকে পেঁয়াজ আসছে কিনা, সেই খবর রাখে। খবর আজকাল সহজলভ্যও। এ অবস্থায় নতুন করে যখন দেশটি থেকে পেঁয়াজ আমদানির পথ খুলে গেল, তখন কৃষক কি তার সংরক্ষণে থাকা পেঁয়াজ দ্রুত ছেড়ে দেবে? সেটা করলে বাজারে যে উচ্চ দাম রয়েছে, তা কমে আসতে পারে। ইতোমধ্যে মিডিয়ায় এসেছে-‘আমদানির খবরে’ বিভিন্ন স্থানে পেঁয়াজের দাম পড়তির দিকে। চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জ থেকে এমন খবর রয়েছে। ঢাকার কাওরান বাজার থেকেও আছে। পাইকারি বিক্রেতারা এজন্য নাকি লোকসানের শিকার হতে পারে! লোকসান না হলেও তাদের হয়তো লাভ হবে না। অনেক সময় এটা কিন্তু হয়ে থাকে।
আমদানিকারকরাও কখনো কখনো পড়ে লোকসানের মুখে। এর কারণ হতে পারে চাহিদার তুলনায় অতিরিক্ত আমদানি। চাহিদা আবার কমেও যেতে পারে। এমনও হতে পারে, আমদানির পাশাপাশি চোরাই পথে আসছে পণ্যটি। তাতে কর-শুল্ক না থাকায় সেটা বিক্রি হচ্ছে কম দামে। আর তাতে বাজার হারাচ্ছে আমদানিকৃত পণ্য। মাঝে চিনির বাজারে এমনটা হচ্ছে বলে অভিযোগ করছিল এর আমদানিকারকরা। মসলাপণ্য আমদানিকারকরাও ঈদের বাজারে এমন অভিযোগ করে। বলে যে, চোরাই পথে আসা মসলা বেশি বিক্রি হচ্ছে বলে তাদের বাজার মন্দা। তবে পেঁয়াজের ক্ষেত্রে এমনটা শোনা যায়নি। বরং আমদানি করা যাবে না বলে খবরে এর দাম বেড়ে গেছে লাফিয়ে। নিকট অতীতেই এমনটা ঘটেছিল। এর আগেও একবার পেঁয়াজের দাম বেড়ে কেজিতে হয়ে গিয়েছিল ২৭০ টাকা। এগুলো হলো অস্বাভাবিক পরিস্থিতি। প্রশ্ন হলো, দেশে এ মুহূর্তে পেঁয়াজের বাজার কি স্বাভাবিক? গেল বছরের একই সময়ের চেয়ে এখন এর দাম অনেক বেশি। এ অবস্থায় ভারত রপ্তানি নিষেধাজ্ঞা ‘হঠাৎ’ প্রত্যাহার করলেও পেঁয়াজ আমদানি কতটা হবে, সেটা কিন্তু বোঝা যাচ্ছে না। কারণ একইসঙ্গে তারা ‘ন্যূনতম রপ্তানি মূল্য’ বেঁধে দিয়েছে।
সেক্ষেত্রে ভারতীয় রপ্তানিকারকরা প্রতিযোগিতা করে কম দামে বেচতে পারবে না। আমরাও কম দামে আনতে পারব না। আর পেঁয়াজ তো কর-শুল্ক দিয়েই আনতে হবে। আছে পরিবহণ ও অন্যান্য খরচের প্রশ্ন। আমাদের পণ্যবাজারে হাতবদলের সংখ্যা আবার বেশি। সে কারণেও ভোক্তা পর্যন্ত আসতে আসতে পণ্যের দাম অনেক বেড়ে যায়। খবর রয়েছে, আমদানির সুবিধাজনক উৎস ভারত থেকে আনা হলেও দেশে উৎপাদিত পেঁয়াজের চেয়ে দাম কম পড়বে না। বরং বেশিই পড়বে। এমন খবর ৬ মে যুগান্তরেও রয়েছে। ভারত যে কারণেই হোক, কম দামে পেঁয়াজ দেবে না। মুশকিল হলো, ভারতের চেয়ে কম দামে অন্য উৎস থেকে এটা আনতেও বোধহয় পারা যাবে না। অন্যান্য উৎস থেকে বরাবরই আমাদের পেঁয়াজ আমদানি খুব কম। এ অবস্থায় দেশে উৎপাদিত পেঁয়াজের ওপরই নির্ভর করে থাকতে হবে। ক’বছর ধরেই ভালো দাম পাওয়ায় কৃষক এখন বেশি করে পেঁয়াজ ফলাচ্ছে। এবারও নাকি উৎপাদন হয়েছে চাহিদার চেয়ে বেশি। পেঁয়াজ উত্তোলনও শেষ হয়েছে এর মধ্যে। অবশ্য প্রশ্ন রয়েছে, কত শতাংশ কৃষকের হাতে পেঁয়াজ আছে এখন আর আছে কী পরিমাণ? নাকি সিংহভাগই চলে গেছে ব্যবসায়ীদের হাতে? তবে ব্যবসায়ীদের হাতে গেলেও কৃষক নাকি ভালো দাম পেয়েছে এবার। হাতে পেঁয়াজ থাকলে আর ঠিকমতো সংরক্ষণ করতে পারলে সামনে তারা হয়তো আরও ভালো দাম পাবে।
আমদানি হলেও পেঁয়াজের দাম আরও বাড়বে বলেই মনে হচ্ছে। লাভজনক না হলে আমদানিও হবে না বা কম হবে। সেক্ষেত্রে সরকার কি এতে কর-শুল্ক ছাড় দেওয়ার পদক্ষেপে যাবে? ভোক্তার স্বার্থ দেখতে হলে সেটাই করতে হবে তাকে। সামনেই কিন্তু কুরবানির ঈদ। এ সময়ে পেঁয়াজের চাহিদা উল্লেখযোগ্যভাবে বাড়বে। আদা-রসুনসহ মসলার চাহিদাও। এ পরিস্থিতি সামলানো কঠিন বৈকি। কর-শুল্কে ছাড় দিয়েও অনেক ক্ষেত্রে পণ্যবাজার শান্ত করা যায় না। ‘অন্যান্য ফ্যাক্টর’ এসে যুক্ত হয়ে সব বানচাল করে দেয়। স্বীকার করতে হবে, পেঁয়াজে আমরা একটা কঠিন পরিস্থিতির মুখে পড়েছি। এর সংরক্ষণে কিছু পরীক্ষামূলক পদক্ষেপও নেওয়া হচ্ছে দেশে। কৃষি বিপণন অধিদপ্তর রীতিমতো একটি প্রকল্প (‘মডেল ঘর’) বাস্তবায়ন করছে পেঁয়াজ সংরক্ষণে কৃষককে সহায়তা জোগাতে। এর চূড়ান্ত উদ্দেশ্য হলো পেঁয়াজের অপচয় কমানো। এটা অর্ধেক কমানো গেলেও নাকি পেঁয়াজ আর আমদানি করতে হবে না। আমদানিনির্ভরতায় কতটা অনিশ্চয়তা থাকে, সেটা তো আমরা হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছি। তবে দামের প্রশ্নও রয়েছে। পেঁয়াজের দামটা কীভাবে সহনীয় পর্যায়ে রাখা যাবে, সেটা অবশ্যই চিন্তা করে দেখতে হবে সরকারকে। সামনে কুরবানির ঈদ বলে এর প্রয়োজন আরও বেড়েছে।
হাসান মামুন : সাংবাদিক, বিশ্লেষক