তাপমাত্রা বৃদ্ধি রোধে যা করা দরকার
ড. এম. মেসবাহউদ্দিন সরকার
প্রকাশ: ২৮ এপ্রিল ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
দেশে কয়েক বছর ধরে তাপমাত্রা বৃদ্ধিতে নতুন রেকর্ড হয়েই চলেছে। ২০২১ সালের ২৫ এপ্রিল দেশে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ছিল ৪১.২ ডিগ্রি সেলসিয়াস, যা আগের ২৬ বছরের সর্বোচ্চ তাপমাত্রার রেকর্ড ভেঙেছিল। যদিও আবহাওয়া অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৪ সালে চুয়াডাঙ্গায় ৪২ ডিগ্রি তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছিল।
এ বছর পুরোনো সব রেকর্ড ভেঙে গত ২৬ এপ্রিল সর্বোচ্চ তাপমাত্রা উঠেছে ৪২.৭ ডিগ্রিতে, সেই চুয়াডাঙ্গায়। তবে এবার ১৭৩ বছরের ইতিহাসের সর্বোচ্চ উষ্ণতা ছাড়িয়ে যেতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন আবহাওয়া ও জলবায়ু সংশ্লিষ্টরা।
রেডক্রিসেন্ট সোসাইটি, জার্মান রেডক্রস এবং বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তরের এক গবেষণায় ৪৪ বছরের তাপমাত্রার একটি বিশ্লেষণে দেখা গেছে-এপ্রিল, মে ও জুন-এ তিন মাসে ঢাকায় সবচেয়ে বেশি গরম অনুভূত হলেও ধীরে ধীরে তা কমে যেত। কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে, এপ্রিল থেকে শুরু হয়ে অগাস্ট পর্যন্ত এ তাপপ্রবাহ বয়ে যায়, এমনকি শীতকাল বা শীতের দিনের সংখ্যাও কমতে দেখা যাচ্ছে গত ১০/১২ বছর ধরে।
জাতিসংঘের বৈশ্বিক উষ্ণতাবিষয়ক আন্তঃসরকার প্যানেলের (আইপিসিসি) গবেষণামতে, আমাদের গ্রহটি ১২ বছরের মধ্যে তাপমাত্রা বৃদ্ধির চূড়ান্ত সীমা ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস অতিক্রম করতে পারে। বিশ্ব আবহাওয়া সংস্থার হিসাব অনুযায়ী, একটি জায়গার দৈনিক যে গড় তাপমাত্রা, তা থেকে ৫ ডিগ্রি বেড়ে গেলে এবং সেটি পরপর পাঁচদিন চলমান থাকলে তাকে হিটওয়েভ বলে।
আবহাওয়া দপ্তরের হিসাবে বাংলাদেশে হিটওয়েভ বা দাবদাহ শুরু হয় ৩৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস থেকে। দেশে তাপমাত্রার এ ওয়েব এখন ৪৩ ছুঁইছুঁই। এভাবে সারা পৃথিবীতেই তাপমাত্রা বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং বিশেষজ্ঞদের মতে, গত ১০০ বছরে এ তাপমাত্রা গড়ে ১ ডিগ্রি বেড়েছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, পৃথিবীতে তাপমাত্রা বৃদ্ধির প্রধান কারণ মানুষের কিছু কার্যকলাপ। এগুলো হলো-১. জীবাশ্ম জ্বালানি দহনের ফলে বায়ুমণ্ডলে গ্রিনহাউজ গ্যাসের নিঃসরণ বৃদ্ধি পায়। গ্রিনহাউজ গ্যাসগুলো বায়ুমণ্ডলে তাপ আটকে রাখে, যার ফলে পৃথিবীর তাপমাত্রা বৃদ্ধি পায়; ২. বন উজাড়ের ফলে গাছপালা কমে যায়, যা বায়ুমণ্ডল থেকে কার্বন ডাইঅক্সাইড শোষণ করে। গাছপালা কমে গেলে বায়ুমণ্ডলে কার্বন ডাইঅক্সাইডের পরিমাণ বৃদ্ধি পায়, যা পৃথিবীর তাপমাত্রা বৃদ্ধি করে; ৩. কৃষি কার্যক্রমের ফলে বায়ুমণ্ডলে গ্রিনহাউজ গ্যাসের নিঃসরণ হয়। উদাহরণস্বরূপ, সার ব্যবহারের ফলে নাইট্রাস অক্সাইড নির্গত হয়, যা একটি শক্তিশালী গ্রিনহাউজ গ্যাস; ৪. শিল্প কার্যক্রমের ফলে বায়ুমণ্ডলে গ্রিনহাউজ গ্যাসের নিঃসরণ হয়। উদাহরণস্বরূপ, বিদ্যুৎ উৎপাদনের ফলে কার্বন ডাইঅক্সাইড নির্গত হয়; ৫. যানবাহন থেকে নির্গত ধোঁয়া বায়ুমণ্ডলে গ্রিনহাউজ গ্যাসের পরিমাণ বাড়িয়ে তোলে; ৬. পৃথিবীর তাপমাত্রা বৃদ্ধির কিছু প্রাকৃতিক কারণও রয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, সৌর ক্রিয়াকলাপ বৃদ্ধির ফলে পৃথিবীর তাপমাত্রা বৃদ্ধি পায়; ৭. জলবিদ্যুৎ প্রকল্প বাস্তবায়নের সময় প্রচুর গাছপালা কাটা হয়।
এছাড়াও জলবিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে নির্গত বাষ্প বায়ুমণ্ডলে মিশে তাপমাত্রা বৃদ্ধি করে; ৮. পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে নির্গত তাপ বায়ুমণ্ডলে মিশে তাপমাত্রা বৃদ্ধি করে; ৯. আগ্নেয়গিরির অগ্নুৎপাতের ফলে বায়ুমণ্ডলে গ্রিনহাউজ গ্যাস নির্গত হয়; ১০. বরফ গলে গেলে তাপ গ্রহণ করে, যার ফলে পৃথিবীর তাপমাত্রা বৃদ্ধি পায়; ১১. সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি পাওয়ার ফলে পৃথিবীর তাপমাত্রা বৃদ্ধি পায়। এগুলোর মধ্যে জীবাশ্ম জ্বালানি দহন এবং বন উজাড় হলো পৃথিবীর তাপমাত্রা বৃদ্ধির সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য কারণ।
অব্যাহত তাপমাত্রা বৃদ্ধির কারণে বিভিন্ন ধরনের পরিবেশগত ও সামাজিক সমস্যার সৃষ্টি হয়। এর মধ্যে রয়েছে-১. জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ঝড়, বন্যা, খরা, তাপপ্রবাহ এবং অন্যান্য প্রাকৃতিক দুর্যোগের ঘটনা বৃদ্ধি পাচ্ছে, ২. পৃথিবীর তাপমাত্রা বৃদ্ধির কারণে জীববৈচিত্র্য হ্রাস পাচ্ছে। অনেক প্রজাতির উদ্ভিদ ও প্রাণী তাদের আবাসস্থল হারিয়ে ফেলছে, ৩. মানুষের স্বাস্থ্যের সমস্যা-এর মধ্যে রয়েছে গরমের তাপপ্রবাহ, পানিবাহিত রোগ, খাদ্য ঘাটতি এবং অন্যান্য স্বাস্থ্য সমস্যা।
দেশি ও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন গবেষণায় পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, শুধু ঢাকায়ই অসহনীয় গরম গত ছয় দশকে অন্তত তিনগুণ বেড়েছে। সেই সঙ্গে সংযোজিত হয়েছে হিট স্ট্রোক নামক স্বাস্থ্যজনিত এক মারাÍক সমস্যা। চিকিৎসাশাস্ত্র অনুযায়ী, তাপমাত্রা ১০৫ ডিগ্রি ফারেনহাইট ছাড়িয়ে গেলে শরীরের তাপ নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা নষ্ট হয়ে ঘাম বন্ধ হয়ে যায় এবং আক্রান্ত ব্যক্তি অজ্ঞান হয়ে পড়ে, যাকে বলে হিট স্ট্রোক। এ বছর রাজধানী ঢাকা ও বিভিন্ন জেলায় বেশ কয়েক ব্যক্তির মৃত্যু হয়েছে হিট স্ট্রোকে। অসহনীয় গরমে যারা ঘণ্টার পর ঘণ্টা বাইরে খোলা আকাশের নিচে কাজ করে, তারাই হিট স্ট্রোকে বেশি আক্রান্ত হন।
তাপমাত্রা বৃদ্ধির প্রবণতা মোকাবিলার জন্য যেসব পদক্ষেপ জরুরি তা হলো : ১. জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার হ্রাস-নবায়নযোগ্য শক্তির উৎস ব্যবহার বৃদ্ধি, জ্বালানি দক্ষতা বৃদ্ধি এবং যানবাহনের ব্যবহার হ্রাস; ২. বনায়ন-গাছপালা বৃদ্ধি করে বায়ুমণ্ডল থেকে কার্বন ডাইঅক্সাইড দ্রুত শোষণ করা সম্ভব; ৩. প্রযুক্তিগত উন্নয়ন-জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলার জন্য বিভিন্ন প্রযুক্তিগত উন্নয়ন।
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্স দেশে গরম বৃদ্ধির অন্যতম কারণ হিসাবে বলছে, গত ২৮ বছরে ঢাকা থেকে ২৪ বর্গকিলোমিটারের সম-আয়তনের জলাধার এবং ১০ বর্গকিলোমিটারের সমপরিমাণ সবুজ কমে গেছে। এখন জেলা-উপজেলা পর্যায়েও পুকুর বা জলাধার ভরাট করে পরিকল্পনাহীন ভবন নির্মাণ চলছে। তাই নগরগুলোয় পরিকল্পিত ভবন এবং তৎসংলগ্ন এলাকাগুলোয় ব্যাপক হারে বৃক্ষরোপণ করে ২৫-৩০ শতাংশ সবুজায়ন নিশ্চিত করতে হবে।
ডিজেলচালিত গণপরিবহণ কমিয়ে মেট্রো রেলের মতো বিদ্যুৎচালিত গণপরিবহণ বাড়ানোর পাশাপাশি পরিবেশবান্ধব ভবন নির্মাণ করতে হবে। শহরের সুবিধাগুলোকে শহরের বাইরে ছড়িয়ে দিয়ে জনসংখ্যা কমিয়ে আনতে হবে। শীতাতপ যন্ত্রের ব্যবহার এবং কংক্রিটের পরিমাণ কমাতে হবে।
খাদ্যাভ্যাসে মাংসের পরিবর্তে সবজি এবং ফলের ওপর নির্ভরতা বাড়াতে হবে। ভাজাপোড়া, দুগ্ধজাত ও চর্বিজাতীয় খাবার কমাতে হবে। কারণ এসব খাদ্যের উৎপাদন ও পরিবহণে প্রচুর পরিমাণে গ্রিনহাউজ গ্যাস নির্গমন হয়। তাই হোটেল-রেস্টুরেন্টের ওপর নির্ভরতা কমিয়ে ঘরে তৈরি খাবার খেতে হবে। কিছুক্ষণ পরপর লবণ ও লেবুযুক্ত পানি খেতে হবে। অন্তত আধা ঘণ্টা পরপর ছায়ায় বা গাছের নিচে বসে বিশ্রাম নিতে হবে।
সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টায় তাপমাত্রা বৃদ্ধি এবং জলবায়ু পরিবর্তনের নেতিবাচক বিষয়গুলো সাধারণ মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে হবে। গড়ে তুলতে হবে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য একটি নিরাপদ, বাসযোগ্য ও সহনীয় তাপমাত্রার সবুজ পৃথিবী।
ড. এম. মেসবাহউদ্দিন সরকার : অধ্যাপক, তথ্যপ্রযুক্তিবিদ, আইআইটি, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়