Logo
Logo
×

উপসম্পাদকীয়

আবার নিরাপদ সড়ক আন্দোলন!

Icon

মাহমুদুর রহমান মান্না

প্রকাশ: ২৮ এপ্রিল ২০২৪, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

আবার নিরাপদ সড়ক আন্দোলন!

চট্টগ্রাম শহর থেকে ২৫ কিলোমিটার দূরে রাউজান উপজেলার পাহাড়তলী ইউনিয়ন। সেখানেই চট্টগ্রাম প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় চুয়েটের ক্যাম্পাস। ২২ এপ্রিল বিকালের দিকে মোটরসাইকেল নিয়ে বেড়াতে বের হয় তিন শিক্ষার্থী। এটা চুয়েটের ছাত্রদের একটা বৈকালিক ভ্রমণের মতো। রাউজানের ওদিকের নিসর্গ সত্যি সুন্দর। রাউজান উপজেলার জিয়ানগর এলাকায় পৌঁছালে তাদের মোটরসাইকেলকে ধাক্কা দেয় বেপরোয়া গতিতে দৌড়ানো শাহ আমানত পরিবহণের একটি যাত্রীবাহী বাস। ঘটনাস্থলেই মারা যায় শান্ত সাহা আর হাসপাতাল যাওয়ার পথে মৃত্যু হয় তৌফিক হোসাইনের।

খবর ছড়িয়ে পড়ে প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে। বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীরা সোমবার সন্ধ্যায়ই সড়ক অবরোধ করে। পুড়িয়ে দেয় শাহ আমানত পরিবহণের একটি বাস। ভেঙে চুরমার করে আরও দুটি। চুয়েট কর্তৃপক্ষ হস্তক্ষেপ করেন। তাদের আশ্বাসের পরিপ্রেক্ষিতে তারা রাত ৯টায় অবরোধ তুলে নিয়ে হলে ফিরে যায়। কিন্তু তাদের মনের মধ্যে জমে থাকা কষ্টের প্রশমন হয় না। রাতের বেলা নিজেদের মধ্যে কথাবার্তা বলে তারা পরবর্তী কর্মসূচি নির্ধারণ করে।

মঙ্গলবার সকাল ৯টা থেকে চুয়েট ক্যাম্পাসের সামনে কাপ্তাই সড়কে অবস্থান নেয় শিক্ষার্থীরা। তারা গাছ ফেলে এবং টায়ার পুড়িয়ে অবরোধ তৈরি করে। এ সময় শত শত শিক্ষার্থী সড়কে অবস্থান নিয়ে স্লোগান দিতে থাকে। দুপুরে শিক্ষার্থীরা মৃত দুই সতীর্থের রুহের মাগফিরাত কামনা করে জানাজা পড়ে। তারা অবরোধ অব্যাহত রাখে এবং বিক্ষোভ চালিয়ে যেতে থাকে। রাত ১০টার দিকে আবারও বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তাদের সঙ্গে আলোচনায় বসেন এবং শিক্ষার্থীরা অবরোধ তুলে নেয়।

আমি এ লেখা লিখছি ২৫ এপ্রিল সকালে। পত্রিকায় খবর বেরিয়েছে, আগের দিনও চুয়েটের সামনে কাপ্তাই সড়ক অবরোধ করে রাখে শিক্ষার্থীরা সকাল ১০টা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত। একসময় তারা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনের সঙ্গে কথা বলে। কী কথা হয়েছে তাদের মধ্যে, সেটা পত্রিকায় পাইনি। কিন্তু অতঃপর শিক্ষার্থীরা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের অফিসের দরজায় তালা দিয়ে দেয়। তারা নাকি আবার কর্তৃপক্ষের সঙ্গে বসবে। প্রশ্ন হলো, কর্তৃপক্ষ কী করবে? কী করার আছে তাদের? বা আরও স্পষ্ট করে বললে-এ ব্যাপারে তাদের ক্ষমতা কতটুকু?

পুলিশ অবশ্য ইতিমধ্যে সেই গাড়ির চালককে গ্রেফতার করেছে। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীরা এক সভায় নিরাপদ সড়কের দাবি করেছে। তারা ১০ দফা দাবি পেশ করেছে, যার মধ্যে আছে তাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে দিয়ে যাওয়া কাপ্তাই সড়ককে চার লেনে রূপান্তরিত করার কথা। এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত সরকার হয়তো তাৎক্ষণিকভাবেই দিতে পারে। কথা দিলেই যে কথা রাখতে হবে-এমন তো কথা নেই আর এখন কথা দিলে সেটা বাস্তবে রূপ পেতে কত বছর লাগবে, সেটাও দেখতে হবে। আমাদের দেশে এমনিতেই তো এক বছরের কাজ তিন বছরেও হয় না।

চুয়েটের এ মর্মান্তিক দুর্ঘটনার ব্যাপারে এখন পর্যন্ত সরকারের পক্ষ থেকে কোনো বক্তব্য আমি দেখিনি। সেও একদিক দিয়ে ভালো। আমাদের মন্ত্রীরা সব এমন আবোলতাবোল বলেন যে, তাতে সাধারণ মানুষের গা জ্বলে যায়। আর আন্দোলনের প্রসঙ্গে যদি বলেন, তাহলে আমি বলব তাতে ঘৃতাহুতি হয়।

আমি আপনাদের ২০১৮ সালে শহিদ রমিজ উদ্দিন ক্যান্টনমেন্ট কলেজের দুই শিক্ষার্থী যখন মারা গিয়েছিল, এ রকম করেই বাস চাপা পড়ে, তখন নৌপরিবহণমন্ত্রী কী বলেছিলেন তা স্মরণে আনার জন্য অনুরোধ করব। ঘটনাটি ঘটেছিল ২০১৮ সালের ২৯ জুলাই ঢাকায় দুই বাসের যাত্রী ধরার বেপরোয়া প্রতিযোগিতার কারণে।

দুই কলেজ শিক্ষার্থীর মৃত্যুর পর নৌপরিবহণমন্ত্রী এ দুর্ঘটনার সঙ্গে ভারতের মহারাষ্ট্রে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে বাস খাদে পড়ে গিয়ে ৩৩ জন মারা যাওয়ার ঘটনা তুলনা করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, ভারতে দুর্ঘটনার পর বাংলাদেশের মতো প্রতিক্রিয়া হয় না। দুর্ঘটনা তো মহারাষ্ট্রে ঘটেছে। সেখানে তো এত হুলুস্থুল হয়নি। এ বক্তব্যে তখন শিক্ষার্থীরা এত ক্ষুব্ধ হয়েছিল যে তারা তাদের উত্থাপিত নয় দফা দাবির সঙ্গে নৌপরিবহণমন্ত্রীর পদত্যাগের দাবিও যুক্ত করেছিল, যদিও সেটা শুরুতে ছিল না।

২০১৮ সালের নিরাপদ সড়ক আন্দোলন সম্পর্কে বিস্তারিত এখানে বলার অবকাশ নেই। সবার মনে আছে রাষ্ট্র মেরামতের কথা বলেছিল তারা। সে রাষ্ট্র মেরামত হয়নি। কিন্তু রাষ্ট্রের ভিত এক প্রকার নাড়িয়ে দিয়েছিল তারা। ছয় বছর পর একই নিরাপদ সড়কের দাবিতে শিক্ষার্থীরা রাস্তা অবরোধ করেছেন। কী অদ্ভুত মিল না! একেবারে চোখ বন্ধ করে বলা যায়, এ ছয় বছরে সড়কের কোনোরকম পরিবর্তন হয়নি। পাঠকরা নিশ্চয়ই এবার ঈদ যাত্রায় সরকারের প্রচার-প্রোপাগান্ডা লক্ষ করেছেন।

ঈদের দুদিন আগে থেকে তারা বিভিন্ন মিডিয়ায় বলতে শুরু করেছিলেন, এবারের ঈদ যাত্রা একেবারে নির্বিঘ্ন। কোথাও কোনো জ্যাম নেই। কিন্তু তারপরে আমরা যা দেখলাম, সেটা শুধু বিঘ্নসংকুল তো নয়ই, একেবারে জীবনঘাতী। সড়কে জ্যামও ছিল যথেষ্ট পরিমাণে।

সড়কে দুর্ঘটনা নিয়ে কাজ করা সংগঠন রোড সেফটি ফাউন্ডেশন বলেছে, জানুয়ারি থেকে মার্চে দেশে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছেন ১৬৯৯ জন। নিহতদের ১৩.২৪ শতাংশ শিক্ষার্থী। রোড সেফটি ফাউন্ডেশন আরও তথ্য দিয়েছে, ২০২৩ সালে সড়কে মৃত্যু হয় ৬৫২৪ জনের। এর মধ্যে ১০৫৩ জন শিক্ষার্থী।

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের সড়ক দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক মো. হাদিউজামান পত্রিকায় দেওয়া এক ইন্টারভিউয়ে বলেন, কর্মক্ষম ব্যক্তি ও শিক্ষার্থীদের চলাচল বেশি। তাই সড়ক অব্যবস্থাপনার শিকারও তারাই বেশি। অন্যদিকে সঠিক প্রশিক্ষণ ছাড়াই যার-তার হাতে ভারী যানবাহন লাইসেন্স চলে যাচ্ছে।

জানা যায়, শাহ আমানত পরিবহণের যে বাসটি দুর্ঘটনা ঘটিয়েছে, সেটি ৪৩ বছরের পুরোনো। বাসটির কোনো ফিটনেস ছিল না। ভাঙাচোরা গাড়িটি কিনে কিছু মেরামত করে শাহ আমানত পরিবহণ সেটিকে রাস্তায় নামিয়েছিল। গাড়িটির ট্যাক্স টোকেনও নিয়মিত নয়।

এরকম অবস্থাতেই অনেকদিন ধরে বাসটি এ রাস্তায় চলাচল করছিল। এ গাড়িটি চালাচ্ছিল যে ড্রাইভার, তারও কোনো লাইসেন্স ছিল না। বিআরটিএ-এর হিসাব অনুযায়ী চট্টগ্রাম শহর এবং জেলার মধ্যে চলাচলকারী যত নিবন্ধিত বাস আছে, তার মধ্যে ৭০ হাজারেরও বেশি গাড়ি ফিটনেসবিহীন।

সাবেক নৌপরিবহণমন্ত্রী শাজাহান খান মূলত ছিলেন একজন শ্রমিকনেতা। পরিবহণ শ্রমিকদের নেতৃত্ব দিতেন তিনি। এখনো দেন কি না, তা অবশ্য জানি না। চিত্রনায়ক ইলিয়াস কাঞ্চনের স্ত্রীর মর্মান্তিক মৃত্যুর কথা আমাদের নিশ্চয়ই মনে আছে। চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কের ওপর দিয়ে দুর্ঘটনায় আহত স্ত্রীকে কোলে নিয়ে ছুটছেন তিনি, এ ছবির কথা এখনো অনেকের মনে গাঁথা আছে। সড়ক দুর্ঘটনার অন্যতম কারণ ড্রাইভারদের অদক্ষতা।

এ সম্পর্কে প্রশ্ন উঠলে তৎকালীন মন্ত্রী বলেছিলেন, ড্রাইভারদের অত শিক্ষিত হওয়ার দরকার নেই, ড্রাইভিংয়ের সিগন্যাল আর ছবিগুলো চিনলেই হয়। অস্বীকার করার উপায় নেই আমাদের শাসকগোষ্ঠী নিজেদের সুবিধার্থে ভারী বিষয়কে লঘু করে দেখানোর চেষ্টা করেন। তাতে বিষয়টি হালকা হয় না। কিন্তু মানুষের জীবন হয় পাখির পালকের চেয়েও হালকা। এই যে বেধড়ক মৃত্যু, তা আমাদের সেই কথাই বলে।

সরকার খুব উন্নয়নের কথা বলে। কতগুলো রাস্তা বানিয়েছে, কতগুলো ফ্লাইওভার হয়েছে, কত রাস্তাকে ফোর লেন বানিয়েছে কিংবা বানাচ্ছে, এগুলোর গল্প শোনায় আমাদের। আর পদ্মা ব্রিজ বানানোর পর তো তারা এ রকম ড্রাম পেটাতে শুরু করেছে যে, মনে হয় যেন চন্দ্র বিজয় করেছে। এ নিয়ে কথা বলাটাকে তারা দেশদ্রোহের শামিল মনে করে। প

দ্মা ব্রিজের জন্য যে অ্যাপ্রোচ রোড বানানো হয়েছে, তার এক কিলোমিটার নির্মাণ করতে খরচ হয়েছে প্রায় আড়াইশ কোটি টাকা। সেখানেই তো আমাদের প্রশ্ন। ১০ টাকার কাজে ১০০ টাকা খরচ করা হচ্ছে (হাজারটা উদাহরণ এরকম আছে। গণমাধ্যমে এসেছে)।

হিসাব তো দিতে হচ্ছে না; কোনো জবাবদিহি লাগে না, সে নিয়ে কথা বলেও কোনো কাজ হয় না। কিন্তু এ প্রশ্ন তো করতেই পারি, মানুষের জীবন নিয়ে এরকম ছিনিমিনি খেলা হচ্ছে কেন? আমানত পরিবহণের ওই বাসটি এতদিন চলতে পারল কীভাবে? সারা দেশে সড়ক ব্যবস্থাপনার নামে এ নৈরাজ্য কি বহুদিন ধরে চলছে না? স্কুলের শিক্ষার্থীসহ তাদের পিতা-মাতা, গুরুজনরা দীর্ঘদিন ধরে এ নিয়ে কি আন্দোলন করেনি? তারপরও সড়কে এরকম নৈরাজ্য কেন? এটা কি উন্নয়ন?

আমাদের সড়ক পরিবহণ ও সেতুমন্ত্রী একজন করিতকর্মা লোক। বিরোধী দল বিএনপি একটা সমাবেশ দিলে সঙ্গে সঙ্গে তিনি পালটা সমাবেশ দিয়ে দেন। আর এখন তো মিডিয়ায় দিনরাত তারই সরব উপস্থিতি। আওয়ামী লীগের অন্য সিনিয়র নেতাদের দেখাই যায় না।

ওবায়দুল কাদের একাই বিরোধী দলকে নসিহত করে বেড়ান অথবা ধমক দেন। তিনিই আসল। তা তো হবেনই। তিনি যে ক্ষমতাসীন দলের সাধারণ সম্পাদক। কিন্তু একই সঙ্গে তিনি তো সড়ক পরিবহণ ও সেতুমন্ত্রীও বটে। আগে দেখতাম প্রচণ্ড গরমের মধ্যেও সুট-টাই পরে সড়কে সড়কে হেঁটে বেড়াচ্ছেন তিনি। আজকাল আর দেখি না। ওবায়দুল কাদেরকে আমি ব্যক্তিগতভাবে চিনি, জানি। মেধাবী ছাত্র ছিলেন। রাজনীতিতেও মন্দ কাজে জড়িত হতেন না। ভালোই লাগত তাকে আমার। কিন্তু এখন বেহাল সড়ক দেখে কষ্ট লাগে।

প্রথম আলো থেকে উদ্ধৃত করছি : তৌফিক তখন কথা বলছিল। নড়াচড়া করছিল। আমাদের বলছিল, ভাই আমি কি বাঁচব না? আমার নিশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে, শরীরের নিচের অংশ জ্বলে যাচ্ছে। আমাকে বাঁচান ভাই। এসব কথা বলতে বলতে কান্নায় ভেঙে পড়েন তড়িৎ ও ইলেকট্রনিক কৌশল বিভাগের চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী রিফাত হোসেন। কেন্দ্রীয় শহিদ মিনার প্রাঙ্গণে আয়োজিত শোকসভায় রিফাত সেই মুহূর্ত স্মরণ করে এসব কথা বলেন। এসব কথা বলতে গিয়ে তিনি নিজে যেমন কেঁদেছেন, তেমনি কাঁদিয়েছেন অন্যসব সহপাঠীকে।

মাহমুদুর রহমান মান্না : সভাপতি, নাগরিক ঐক্য

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম