চাঁদাবাজি, সন্ত্রাস, দুর্বৃত্তায়নমুক্ত ছাত্র রাজনীতি চাই
![Icon](https://cdn.jugantor.com/uploads/settings/icon_2.jpg)
মাহমুদুর রহমান মান্না
প্রকাশ: ২১ এপ্রিল ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
![চাঁদাবাজি, সন্ত্রাস, দুর্বৃত্তায়নমুক্ত ছাত্র রাজনীতি চাই](https://cdn.jugantor.com/assets/news_photos/2024/04/21/image-796785-1713646832.jpg)
ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধ করার দাবি উঠেছে। এবং সে দাবি উঠেছে বাংলাদেশের সবচেয়ে মেধাবী ছাত্রদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বুয়েট থেকে। সেখানে ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধই ছিল গত চার বছর।
হঠাৎ করে ২৭ মার্চ রাত ১টার দিকে ছাত্রলীগের এক বিশেষ শোডাউন হয়। অনেক হোন্ডা নিয়ে ছাত্রলীগের বেশ বড় এক বহর বুয়েট ক্যাম্পাসে ঢোকে। তারা বেশ কিছুক্ষণ সেখানে অবস্থান করে এবং সংগঠনিক তৎপরতা চালায়। প্রতিবাদে ২৯ তারিখ দুপুরের পর বুয়েটের সাধারণ শিক্ষার্থীরা শহিদ মিনারে সমাবেশ করেন। বুয়েটে ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধ থাকার পরও ছাত্রলীগের এ ধরনের সমাবেশ করার বিরুদ্ধে তারা বক্তব্য রাখেন। তারা জানতে চান, এ গভীর রাতে তাদেরকে বুয়েটের প্রধান সড়ক দিয়ে ভেতরে প্রবেশের ব্যবস্থা করে দিল কারা?
যারা বহাল থাকা ছাত্র রাজনীতির ওপর নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে এ কাজ করেছে তাদের শাস্তি দাবি করেন তারা। ধীরে ধীরে তাদের সমাবেশ বিশাল আকার ধারণ করে। বলা যায়, বুয়েটের নিরঙ্কুশ সংখ্যক শিক্ষার্থী এতে যোগ দেন। তারা নিষেধাজ্ঞা বহাল থাকার পক্ষে বক্তব্য রাখেন। অপরদিকে ছাত্রলীগ বিশ্ববিদ্যালয়ে আবারও ছাত্র রাজনীতি শুরু করার দাবি জানায়। মিডিয়াগুলো যে যেভাবেই খবর প্রকাশ করুক, বুয়েটের সাবেক ছাত্রলীগ নেতারা যত যুক্তিই দেখান না কেন, এটা দৃশ্যমান যে বুয়েটের নিরঙ্কুশ সংখ্যক শিক্ষার্থী ছাত্র রাজনীতি বন্ধ রাখার পক্ষে।
সমস্যাটা সেখানেই। যে দেশের রাজনীতির ইতিহাসের এক বিরাট অধ্যায়জুড়ে রয়েছে ছাত্র রাজনীতি, সেই দেশে মেধাবীদের প্রতিষ্ঠান বলে পরিচিত বুয়েটের শিক্ষার্থীরা ছাত্র রাজনীতি বন্ধ করে দিতে বলছেন! দেশের আপামর মানুষকে, বিশেষত বুদ্ধিজীবী মহলকে আমি বিষয়টি নিয়ে গভীরভাবে ভাবার জন্য অনুরোধ করব। কেন এমন হলো?
আমার ছাত্রজীবনে রাজনীতি করার সময় বহুবার আমি বুয়েটে গেছি। হলে হলে সভা করেছি। বুয়েট হাসানুল হক ইনু, শরিফ নূরুল আম্বিয়ার মতো ছাত্র ও জননেতা তৈরি করেছে। এদেশের স্বাধীনতার অন্যতম চিন্তক জননেতা সিরাজুল আলম খান বহুদিন আহসানুল্লাহ হলে থেকেছেন। আমার কাজের সময় আমি বুয়েটের শিক্ষার্থীদের রাজনীতির প্রতি, বা যাদের কথা বললাম তাদের প্রতি কোনো নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি বা আচরণ দেখিনি। আজ কেন তারা এরকম অবস্থান নিল? এ জন্য আমাদের অতীতের দিকে তাকাতে হবে। সেই অতীত বানিয়ে আমি কেবল ’৫২, ’৬০, ’৬২, ’৬৯ বা এরশাদ আমলের গৌরবোজ্জ্বল ছাত্র আন্দোলনের কথা বলছি না।
আমাদের নিকট অতীত যদি আমরা এরশাদ শাসনের অবসানের পর থেকে তথা ’৯০-এর পর থেকে বিশ্লেষণ করতে থাকি, তাহলে দেখব আজ পর্যন্ত এদেশে সেই অর্থে কোনো ছাত্র আন্দোলন গড়ে ওঠেনি। সেই অর্থে বলতে আমি রাজনীতি বোঝাতে চাইছি। এরশাদ সরকারের পতনের পর থেকে আজ পর্যন্ত বড় বড় গোটা চারেক আন্দোলনের কথা বলতে পারি আমরা। প্রথমত, গণজাগরণ মঞ্চ। এটা অবশ্য ঠিক ছাত্র আন্দোলন নয়। কিন্তু ছাত্রদের অংশগ্রহণই এ আন্দোলনকে ভিত্তি দিয়েছিল এবং ছাত্ররা এর শেষ পর্যন্ত ছিল।
অতঃপর আমরা ভ্যাটবিরোধী আন্দোলন, কোটাবিরোধী আন্দোলন এবং প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই নিরাপদ সড়ক আন্দোলনকে দেখতে পারি। সচেতন মানুষ মাত্রই খেয়াল করবেন এর কোনোটিকেই আমরা রাজনৈতিক আন্দোলন বলে চিহ্নিত করতে পারব না। গণজাগরণ মঞ্চের আন্দোলন অবশ্য শুরুতে রাজনৈতিক চরিত্রের বলেই মনে হয়েছিল; কিন্তু শেষ পর্যন্ত সেটা কেবল একটি ফাঁসি অর্জনের মধ্য দিয়ে শেষ হয়েছে। বলা যায়, এসব আন্দোলনে সরাসরি রাজনৈতিক দলীয় নেতৃত্ব ছিল না। যারা আন্দোলন করেছেন, তারা স্পষ্টতই রাজনৈতিক সংগঠন ও ব্যক্তিত্বকে দূরে রেখেছেন। সেটা কোনো লুকোছাপা করে নয়। রীতিমতো ঘোষণা দিয়ে।
এবার বুয়েটের শিক্ষার্থীরা কিন্তু আরও স্পষ্ট করে তাদের অভিব্যক্তি ব্যক্ত করেছেন। বিএনপির অঙ্গ সংগঠন জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল বুয়েটের শিক্ষার্থীদের এ আন্দোলন সমর্থন করেছিল। শিক্ষার্থীরা তাদের সমর্থন প্রত্যাখ্যান করেছেন। ৩ এপ্রিল সন্ধ্যায় উপাচার্যের কার্যালয়ের সামনে এক সংবাদ সম্মেলন করে সেখানে তারা ছাত্রদলের এ সংহতি প্রত্যাখ্যান করে বলেন, চলমান আন্দোলনের এ সংকটময় মুহূর্তে ছাত্রদলের এমন বক্তব্যকে আমরা সম্পূর্ণ রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বলে মনে করি। তাদের এ রাজনৈতিকভাবে মদতপুষ্ট সংহতিকে আমরা প্রত্যাখ্যান করছি।
২০২০ সালে জুলাই মাসে বুয়েটের নীতিমালা লঙ্ঘন করে ছাত্রদল বুয়েটে তাদের আহ্বায়ক কমিটি গঠন করেছিল এবং সেই কমিটি এখনো আছে, যদিও কার্যকর নয়। তখনও শিক্ষার্থীরা এ কর্মকাণ্ডের প্রতিবাদ করেছিল উল্লেখ করে লিখিত বক্তব্যে বলা হয়, আগামীতেও ক্যাম্পাসে সব ধরনের রাজনীতির বিরুদ্ধে শিক্ষার্থীরা সোচ্চার থাকবেন। পরবর্তী সময়ে অন্য কোনো সংগঠন যদি এমন বক্তব্য দিয়ে শিক্ষার্থীদের দাবি ও অবস্থানকে ঘোলাটে করার অপচেষ্টায় লিপ্ত হয়, তবে তাদের প্রত্যাখ্যান করবেন। তাদের দাবি একক কোনো সংগঠনের বিরুদ্ধে নয়, তারা ছাত্র রাজনীতি ক্যাম্পাসে প্রবেশের বিরুদ্ধে।
তারা সব ক্যাম্পাসের কথা বলছেন, নাকি কেবল তাদের ক্যাম্পাসের কথা বলছেন? আমি ধরে নিচ্ছি তারা তাদের ক্যাম্পাস অর্থাৎ কেবল বুয়েটের কথা বলছেন। কিন্তু তারা পরবর্তী সময়ের কথা বলছেন কীভাবে? এ বুয়েটেই তো আগে ছাত্র রাজনীতির চর্চা হয়েছে, ইকসু নির্বাচন হয়েছে। আর একটা কথাও বলা দরকার। তারা ছাত্রদল কিংবা অন্য যে কোনো কারও সমর্থন প্রত্যাখ্যান করেন কীভাবে! এরকম একটা ঘটনা ঘটেছিল, যখন তেল গ্যাস রক্ষা কমিটির আন্দোলনকে বিএনপি সমর্থন করেছিল। এবং তেল গ্যাস কমিটি সেই সমর্থনকে প্রত্যাখ্যান করেছিল। সমর্থন কি প্রত্যাখ্যান করা যায়? ফিরিয়ে দেওয়া যায়? তখন তেল গ্যাসের যে আন্দোলন হচ্ছিল তা ছিল যথার্থ। তাকে যে কেউ সমর্থন তো করতেই পারে! ভালো কাজকে সমর্থন করাকে নিন্দা বা সমালোচনা তো করা যায় না।
জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক অবশ্য বলেছেন, নিরাপত্তার ভয়ে শিক্ষার্থীরা এমন কথা বলেছেন। তারা এটাকে তাদের আন্দোলনের কৌশল হিসাবে দেখেন। তাই কি? এরকম একটা কৌশল অবশ্য ২০১৮ সালে কোটাবিরোধী আন্দোলন যারা করছিল, তারা নিয়েছিল। কোনো ইস্যুতে সরাসরি সরকারের বিরোধিতা না করলেও তারা সরকারের অত্যাচার, নির্যাতন থেকে ভয় পাচ্ছিল। তারা জানত তাদের আন্দোলনকে সরকার কোনো কারণেই পছন্দ করবে না। তাই বাঁচার জন্য তাদের মিছিলগুলোর সামনে শেখ মুজিব, শেখ হাসিনার ছবি রাখত; জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু স্লোগান দিত। এও বলত যে, বঙ্গবন্ধুর বাংলায় বৈষম্যের ঠাঁই নাই। কিন্তু সেটা করে তারা নির্যাতন, গ্রেফতার এড়াতে পারেনি। তবে তাদের আন্দোলনের কারণে শেষ পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রী পুরো কোটা ব্যবস্থাই তুলে দিয়েছিলেন।
লক্ষ করার বিষয়, যারা এসব কথাবার্তা বললেন, আন্দোলনের মূল নেতা নুরুল হক নূর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে দেখা করতে গিয়ে তার মধ্যে তার মায়ের ছবি দেখতে পেলেন; সেই তারাই আন্দোলন শেষে রাজনীতি করছেন কেবল তাই নয়, রীতিমতো একটি রাজনৈতিক দল গঠন করে এ সরকারের বিরুদ্ধে গণতন্ত্রের জন্য লড়াই করছেন।
বুয়েটের শিক্ষার্থীরাও কি সেরকমই ভাবছেন বা করছেন? ছাত্রদলের সাধারণ সম্পাদক নিশ্চয়ই তাদের সঙ্গে কথা বলে এটা বলেননি। তিনি তার ভাবনার কথা বলেছেন। কিন্তু এরকম ভাবার কোনো কারণ নেই যে হঠাৎ করেই একরাতে ছাত্রলীগের নেতাদের মনে হলো আর তারা বুয়েটের দখল নেওয়ার তৎপরতা শুরু করলেন। ব্যাপারটা সেরকম নয়।
এটা তো বোঝাই যায় যে, এতে সরকারের ইনভলভমেন্ট আছে। একদিন পর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের অ্যাকশন নেওয়ার সম্ভাবনার কথা থেকে সেটা বোঝা যায় না?
আওয়ামী লীগ একটি শক্তিশালী ঐতিহ্যবাহী দল। তারা ক্ষমতা বোঝে এবং সেটা রক্ষা করার জন্য, তাকে সংহত করার জন্য যা দরকার তা-ই করে। এখানে স্নেহ-ভালোবাসার খুব একটা জায়গা নেই। গোটা আন্দোলন সেটা নুর রাশেদদের স্পষ্ট করে বুঝিয়ে দিয়েছে। এখন যারা বুয়েটে আন্দোলন করছেন, তাদেরও আন্দোলনই সেটা বুঝিয়ে দেবে।
ব্যক্তিগতভাবে আমি মনে করি, ছাত্ররাই এখন পর্যন্ত এদেশের গণতান্ত্রিক আন্দোলনের সবচেয়ে বড় শক্তি। কিন্তু ’৯০-এর পর থেকে ক্ষমতার রাজনীতি সেই সম্ভাবনাকে প্রায় ধ্বংস করে দিয়েছে। বুয়েটের ছাত্রদের সঙ্গে আমি আছি এ কারণে যে, আমি মনে করি তাদের আন্দোলনের পেছনে আছে মূলত একটি সুস্থ, ইতিবাচক রাজনীতির আকাঙ্ক্ষা। সেটাকেই জাগিয়ে তুলতে হবে। ছড়িয়ে দিতে হবে সারা দেশের জনগণের মধ্যে, সারা দেশের ছাত্রসমাজের মধ্যে। এখনো তারা যদি জাগে, তাহলে দেশকে অগণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থার কবল থেকে মুক্ত করে একটি গণতান্ত্রিক, কল্যাণমুখী রাজনীতি প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব।
মাহমুদুর রহমান মান্না : সভাপতি, নাগরিক ঐক্য