Logo
Logo
×

উপসম্পাদকীয়

নীতি দুর্নীতি অর্থনীতি

ঈদের নিরানন্দের দিকগুলোও বোঝা দরকার

Icon

ড. আর এম দেবনাথ

প্রকাশ: ২০ এপ্রিল ২০২৪, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

ঈদের নিরানন্দের দিকগুলোও বোঝা দরকার

এবারের ঈদে ছুটি ছিল লম্বা। মাসের ৮ ও ৯ তারিখ এবং নববর্ষের ছুটি যোগ করলে মোট সরকারি ছুটি হয় ১০ দিনের। লম্বা বৈকি! এ সময়ে যারা দেশের বাড়িতে, গ্রামের বাড়িতে গিয়েছেন তাদের আনন্দের সীমা ছিল না। বাবা-মায়ের সাক্ষাৎ লাভ, আত্মীয়স্বজন, বন্ধু-বান্ধবদের সঙ্গ লাভ এক অপার আনন্দের সময়। অফুরন্ত আনন্দ। বাড়তি পাওয়া প্রকৃতির সঙ্গে সাক্ষাৎ যোগাযোগ। রয়েছে অফুরন্ত তাজা অক্সিজেন। শিশুদের আনন্দ আরও বেশি। শহরে, ঢাকায় খোলা জায়গা নেই, মাঠ নেই। গ্রামে তারা দুরন্ত শিশুর মতো খেলাধুলা করতে পেরেছে। ঘাসে পা লাগিয়েছে। পুকুরে, নদীতে স্নান/গোসল করেছে। রোদের আস্বাদন নিয়েছে। গাছে ফল যা কিছু ফলেছে, তারও আস্বাদন নিয়েছে। তাজা মাছ, তাজা শাকসবজি, মাংস, ফলমূল খেতে পেরেছে তারা। আর এ আনন্দে ইন্ধন জুগিয়েছে ‘ক্যাশ’। যারা ঢাকা ছেড়ে, শহর ছেড়ে গ্রামে গেছে, তারা ‘ক্যাশ’ নিয়ে গেছে। দিনমজুরও ‘ক্যাশ’ নিয়ে গেছে। প্রচুর ‘ক্যাশ’। এর সঙ্গে যোগ হয় ‘রেমিট্যান্সের’ টাকা। প্রবাসীদের টাকা। প্রচুর টাকা। প্রতি মাসে আসে প্রায় দুই বিলিয়ন ডলার। এক বিলিয়ন সমান শত কোটি। তার মানে ২০০ কোটি ডলার। ১২০ টাকা দরে টাকায় হয় ২৪ হাজার কোটি টাকা। ভাবা যায় কত ‘ক্যাশ’! বেতন-ভাতার টাকা, বোনাসের টাকা, সঞ্চয়ের টাকা, প্রবাসীদের পাঠানো টাকা-সব মিলে প্রচুর টাকা। তাও এক ঈদ উপলক্ষ্যে। এ উপলক্ষ্যে সর্বমোট কত টাকার লেনদেন হয়, তার কি কোনো হিসাব কারও কাছে আছে? অনেক দেশে খুচরা বিক্রির একটা হিসাব আছে। আমাদের সেভাবে নেই। সরকার তা করে বলে আমার জানা নেই। তবু কিছু অনুমান মাঝে মাঝে মেলে। যেমন ‘কার্ডের’ মাধ্যমে বিক্রি, ই-কমার্সের মাধ্যমে লেনদেন এবং খুচরা বিক্রি। এসবের ওপর নির্ভরযোগ্য তথ্য পাওয়া মুশকিল। এরই মধ্যে অবশ্য কাগজে দেখলাম একটা হিসাব। তাও গেল বছরের। সেই হিসাবে দেখা যায়, ২০২৩ সালের ঈদের সময়ে কার্ডের মাধ্যমে লেনদেন হয়েছে সর্বমোট ৫৪ লাখ। কত টাকার বাণিজ্য? মোট বিক্রির কথা রিপোর্টে বলা হয়েছে ৩৫০০ কোটি টাকা। এদিকে ই-কমার্সে লেনদেনের সংখ্যা ছিল ৩৬ লাখ। টাকার অঙ্ক কত? প্রায় ১০০০ কোটি টাকা। বলা বাহুল্য, এসব মাধ্যমে লেনদেন হয় সামান্যই। মোট লেনদেনের ১০ শতাংশও কার্ডে ও ই-কমার্সে হয় না। সেই হিসাবে বলা যায়, সারা দেশে ঈদে বেচাকেনা হয় কমপক্ষে ৫০ হাজার কোটি টাকার।

না, এর ওপরও একটা হিসাব এবার করেছে ‘বাংলাদেশ শপ ওনার্স এ অ্যাসোসিয়েশন’। তাদের পরিসংখ্যান অনুযায়ী সারা দেশে ঈদ উপলক্ষ্যে লেনদেন হয় প্রায় ১ লাখ ৭০ হাজার কোটি টাকার। তারা এ ব্যয়ের একটা খাতওয়ারি হিসাবও দিয়েছে। তাতে দেখা যায় ১ লাখ ৭০ হাজার কোটি টাকার মধ্যে বস্ত্রের পেছনেই মানুষ খরচ করে ৩৭ হাজার ৪০০ কোটি টাকা। তারপরই খরচ করে অতিরিক্ত খাবারে, যা মানুষ রোজার মাসে ভোগ করে। এর পরিমাণ ২৭ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। পরিবহণ, আপ্যায়ন ও অন্যান্য খাতে ব্যয়ের পরিমাণ যথাক্রমে ৪ হাজার ৬৭৫ কোটি, ৪ হাজার ৬৭ কোটি এবং ১৮ হাজার ৮১ কোটি টাকা। এর ওপর রয়েছে জাকাত ও ফিতরার মাধ্যমে বণ্টন। রয়েছে ইফতারের খরচ। সংশ্লিষ্ট রিপোর্ট অনুযায়ী, ইফতারে খরচ হয় ৬-৭ হাজার কোটি টাকা।

এসব তথ্যের নির্ভরযোগ্যতা সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া কঠিন। তবু এর থেকে খরচের একটা ইঙ্গিত মেলে। ঈদ উৎসব দেশের সবচেয়ে বড় উৎসব। দুই ঈদ-রোজার ঈদ এবং কুরবানির ঈদ। এরপরে রয়েছে ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের দুর্গাপূজা উপলক্ষ্যে খরচ। রয়েছে নববর্ষে মানুষের খরচ। এ চার উৎসবে দেশে প্রতিবছর যে ব্যবসা হয় তার পরিমাণ বিপুল। বলা যায়, এক মাসে ব্যবসা হয় ১১ মাসের। বাকি ১১ মাসের ব্যবসায় দোকান খরচ চলে। এটাই বলা হয়। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, সত্যি সত্যি বছরে এই খাতে, আরও সুনির্দিষ্টভাবে বললে, খুচরা ব্যবসা খাতে, ভোগের খাতে মানুষের কত খরচ হয়? বলাই বাহুল্য, এ খুচরা ব্যবসাই ব্যবসার ভিত্তি। এর ওপর ভিত্তি করে চলে পাইকারি ব্যবসা, আড়তদারি ব্যবসা, এজেন্টদের ব্যবসা। এর ওপর নির্ভর করে আমদানি ব্যবসা অর্থাৎ আমদানির পরিমাণ। নির্ভর করে উৎপাদনের পরিমাণ। এরপর হচ্ছে অন্যসব। ব্যাংক-বিমা, রপ্তানি ব্যবসা আসে পরে। খুচরা বাজার, ভোক্তা বাজার এর জন্যই খুব গুরুত্বপূর্ণ। এ বাজারের হালচাল দেখলে অর্থনীতি, ব্যবসা-বাণিজ্যের হালচাল বোঝা যায়।

এই খুচরা বাজার দেশে এখন দুই রকমের। অতি ধনী, ধনী, উচ্চবিত্ত ও মধ্যবিত্তের এক বাজার। আরেকটি হচ্ছে গরিবের বাজার, দিনমজুরের বাজার, শ্রমজীবীর বাজার। দোকান কর্মচারী, রিকশাওয়ালা, ওস্তাগার, সূত্রধর, বৈদ্যুতিক মিস্ত্রি, হরেকরকমের মিস্ত্রি, পিয়ন, বেয়ারার বাজার। রেস্তোরাঁ কর্মচারীর বাজার। এ বাজারে লাখ লাখ লোক। কিন্তু লেনদেনের পরিমাণ টাকার অঙ্কে আনুপাতিকভাবে কম। সংখ্যায় লেনদেন বেশি। অথচ এ বাজারকে প্রাণবন্ত না করতে পারলে অর্থনীতি বড় করা কঠিন। প্রশ্ন, এবারের ঈদ কেমন কেটেছে তাদের? তারা কি শান্তি ও স্বস্তির মধ্যে ঈদ করতে পেরেছে? পবিত্র ঈদের আনুষ্ঠানিকতা সবাই পালন করেছে যথাযোগ্য মর্যাদার সঙ্গে। তবে ব্যবসায়িক-অর্থনৈতিক দৃষ্টিতে তাদের ঈদের বাজার কেমন ছিল? মুশকিল হচ্ছে, এ প্রশ্নের উত্তর হবে অনেক। অঞ্চলভেদে, শহরভেদে, অর্থনৈতিক কাঠামোভেদে এ প্রশ্নের উত্তর হবে ভিন্ন ভিন্ন রকমের। পেশার ভিত্তিতেও হবে ভিন্ন ভিন্ন। তবে সারা দেশের চিত্র একটি কলামে তুলে ধরা খুবই কঠিন। তবু একটা চেষ্টা করা যেতে পারে। এই যেমন গত সোমবারের ঘটনা। রিকশায় উঠেছি তিনবার। তিন রিকশাওয়ালা তিন জায়গার-একজন নোয়াখালীর, একজন জামালপুরের এবং আরেকজন গাইবান্ধার। তিনজনই ঈদ উপলক্ষ্যে ‘বাড়ি’ যায়নি। কেন? উত্তর-অর্থাভাব। দেশের বাড়িতে যেতে-আসতে যে খরচ তা অনেক। রোজগার কম। বাজার মন্দা। কমপক্ষে ২০-৩০ শতাংশ আয় কম। এক-দুই বছর আগেও এ পরিস্থিতি ছিল না। তারা অবশ্য ‘বিকাশে’ কিছু টাকা পরিবারের কাছে পাঠিয়েছে। ৫ থেকে ৭ হাজার টাকা।

ঈদের আগে রোজার মাসে অনেক শ্রমজীবী ঢাকায় আসে কাজের জন্য। তারা রিকশা চালায়। ‘ক্যাশ’ সংগ্রহ করে। টাকা জমিয়ে দেশের বাড়ি যায়। এবার যারা এসেছে জামালপুর, গাইবান্ধা, ঠাকুরগাঁও ইত্যাদি অঞ্চল থেকে, তাদের রোজগার ভালো ছিল না বলেই প্রতীয়মান হয়। ঈদের ছুটিতে আমি কয়েকদিন অনেক রিকশায় চড়েছি। আমার অভিজ্ঞতা হচ্ছে, রিকশাওয়ালারা কেউ ঈদের বকশিশ চায়নি। এটা আমার কাছে অবাক করা বিষয়। কেন এ অভিজ্ঞতা হলো জানি না। কিন্তু বিষয়টি ঘটেছে। আরেকটি ঘটনার সাক্ষী হয়েছি, যা আগেই বলেছি-গাইবান্ধা, ঠাকুরগাঁও, জামালপুরের রিকশাওয়ালাদের অনেকেই এবার ঈদে বাড়ি যায়নি। ঋণ পরিশোধের জন্য যে ‘কিস্তি’ দিতে হয়, তা তারা জোগাড় করতে পারেনি বলে ঢাকায় থেকে গেছে কিস্তির টাকা রোজগারের জন্য। মাসিক কিস্তি। ভিন্ন ভিন্ন হিসাবে কিস্তি। বেশ বড় বড় বোঝা। একে তো ঈদের জন্য জামা-কাপড়ের তাগিদ, ছেলেমেয়ে-বউয়ের শাড়ি, কাপড়ের জন্য প্রয়োজনীয় টাকা, তার ওপর মহাজনের টাকা পরিশোধের তাগিদ। বোঝা যায়, ঋণের ফাঁদে সারা দেশের বিরাটসংখ্যক মানুষ। তাদের অনেকেই ঋণ করে ঋণ পরিশোধ করে। ভয়াবহ এ ফাঁদ। মুক্তি নেই এর থেকে। এমনকি কাগজে পড়ছি, আমরাও দেশ হিসাবে একই ফাঁদে পড়ছি। ১০০ বিলিয়ন ডলারের ঋণ আমাদের এখন। অনেক ঋণের কিস্তি ও মূল পরিশোধে নাকি আমাদেরও ঋণের টাকা ব্যবহার করতে হচ্ছে। আমাদের ঋণের পরিমাণ জিডিপির অনুপাতে কম অনেক দেশের তুলনায়। কিন্তু রপ্তানি এবং প্রবাসী আয়ের সঙ্গে তুলনা করলে এর পরিমাণ অনেক। ‘মারাত্মক’ পর্যায়ে না পৌঁছালে দিন দিন এর অবনতি ঘটছে, যা কোনোমতেই ভালো লক্ষণ নয়। তাহলে কী দাঁড়াচ্ছে? শ্রমজীবী মানুষ, গরিব মানুষ, নিুমধ্যবিত্ত মানুষ দিন দিন ঋণী হচ্ছে। আবার দেশের অবস্থাও তা-ই। ঋণী মানুষের প্রকৃত অবস্থা কী, তা ঘটনার বর্ণনা দিয়ে বোঝানোর চেষ্টা করছি।

কিশোরগঞ্জ জেলার ঘটনা, যেখান থেকে মহামান্য রাষ্ট্রপতি হয়েছেন তিনজন। দুজন ছিলেন ক্ষমতাসীন দলের সাধারণ সম্পাদক। তাছাড়া কত বড় বড় নেতার জন্মস্থান কিশোরগঞ্জে! ঢাকা শহরের একান্ত কাছের জেলা। সেখানে যেতে কোনো নদী পড়ে না, ব্রিজ নেই। অথচ এখন এমন একটা জেলার লোকজন দাদনের ফাঁদে পড়ে ‘বন্ডেড লেবার’ হচ্ছে। বিশ্বাস হচ্ছে না? গত ৭ এপ্রিল যুগান্তরেরই একটি খবরের শিরোনাম : ‘ইটভাটায় কাজ : কিশোরগঞ্জের দাদনের ফাঁদে তিন সহস্রাধিক পরিবার’। তাদের এবার ঈদ উৎসব পালন করা হয়নি। তারা ঋণ নিয়েছে দাদনদাতাদের কাছ থেকে। কিন্তু তারা দাদনের টাকা পরিশোধ করতে না পেরে বাড়িঘরে তালা ঝুলিয়ে চলে গেছে ব্রাহ্মণবাড়িয়া, কুমিল্লা, চট্টগ্রাম, ময়মনসিংহ ও সিলেটের বিভিন্ন ইটভাটায় কাজ করার জন্য। সেখানে কড়া নিরাপত্তার মধ্যে তারা আছে। জীবনযাপন করছে বন্দির মতো। ছুটিহীন, স্বপ্নহীন ও স্বাধীনতাহীন জীবন কাটে ইটভাটাসংলগ্ন শ্রমিকদের অস্বাস্থ্যকর কলোনিতে। ঈদ উৎসব ও সামাজিক আচার-অনুষ্ঠানেও তাদের কোনো ছুটি মেলে না। এমনকি দাদনের টাকা নিয়ে একজন ইটভাটা শ্রমিককে হত্যার অভিযোগ পাওয়া গেছে। ভুক্তভোগীদের বর্ষা মৌসুমের ৫ মাস কাজ থাকে না। তারা তখন দাদনওয়ালাদের কাছ থেকে ঋণ নেয়, যা কাজ করে পরিশোধ করতে হয়।

তাহলে কী দাঁড়াল? ঈদে নিরানন্দের দিকও আছে, যা বোঝা দরকার সবার।

ড. আর এম দেবনাথ : অর্থনীতি বিশ্লেষক; সাবেক শিক্ষক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম